শব্দজাল – ৪

বিরাট ডুপ্লেক্স বাড়ির কাচের সদর দরজা ঠেলে বাইরে বেরোতেই প্রফেসরের ভারি পোশাক ভেদ করে কামড় বসাল ঠান্ডা।

প্রফেসর মনে মনে বলে উঠল, ব্যাপার কী? এবার এত শীত পড়ল কেন ঢাকায়?

বাইরে হালকা কুয়াশার চাদর ভেদ করে একটা বড়সড়ো গাড়ির অস্তিত্ব চোখে পড়ল তার। সেদিকেই এগোল প্রফেসর। প্রায় তিন একর জায়গার ওপরে বানানো বাড়ির পুরোটাই উঁচু বাউন্ডারি দিয়ে ঘেরা। বাউন্ডারির ভেতরে বাড়ির পুরো সেটআপটাই গড়ে উঠেছে মাঝখানে অবস্থিত ডুপ্লেক্স বাড়িটাকে কেন্দ্র করে। ডুপ্লেক্সের সামনেই বিরাট লন আর লনটাকে কভার করে লম্বা ড্রাইভওয়ে।

প্রফেসর তীব্র শীতের ভেতরে ড্রাইভওয়ে ধরে একটু এগিয়েই পিবিএসআই ছাপ মারা বিরাট সাদা গাড়িটা পরিষ্কার দেখতে পেল। গাড়িটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কালো স্যুট পরা লম্বা এক যুবক।

এই শীতে গাড়ির ভেতরে বসে না থেকে কিংবা বাড়ির ভেতরে না ঢুকে বাইরে কেন দাঁড়িয়ে ছিল যুবক ঠিক বুঝতে পালো না প্রফেসর। তবে তার মুখ দিয় বেরোনো হালকা ধোঁয়া দেখে অনুমান করল সে সম্ভবত ধূমপান করছিল, কিংবা কে জানে চোখের ভুলও হতে পারে। হয়তো শীতের কারণে তার মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল।

প্রফেসর এগিয়ে গেলেও যুবক তাকে দেখে এগিয়ে এলো না। শুধুমাত্র হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে একটু সোজা হয়ে দাঁড়াল, এই যা। তবে কাছাকাছি যেতেই প্রফেসরের চশমার ঘোলাটে কাচের দিকে তাকিয়ে সে খানিকটা ভারি গলায় বলে উঠল, “আপনি নিশ্চই জাকারিয়া আহমেদ?”

যদিও তেমন দরকার ছিল না কিন্তু খুব ভালো করে ছেলেটাকে খেয়াল করল প্রফেসর। লম্বা পাতলা শক্তিশালী কাঠামো, লম্বা খাড়া নাক আর শক্ত চোয়াল, সুদর্শন চেহারায় একটা দুর্বিনীত ভাব এনে দিয়েছে। তবে তার চেহারায় সবার আগে চোখে পড়ে ডান ভুরুর কাছে একটা বিরাট কাটা দাগ, সম্ভবত ছোটবেলার কোনো দুষ্টামির ফল। সম্বোধন করার সময় প্রফেসর কিংবা স্যার বলেনি, তাকে দেখে সালাম দেয়নি, হাতও বাড়ায়নি, সবই খেয়াল করল প্রফেসর কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠল, “হুমম, তুমি ঠিকই ধরেছ আমিই জাকারিয়া,” বলে সে নিজেই ডান হাতে থাকা কাঠের বাক্সটা বাম হাতে চালান করে দিয়ে নিজেই হাত বাড়িয়ে দিল ছেলেটার দিকে। “তুমি?”

“ডক্টর,” বলে সে একটু থামল যেন তার পিএইচডির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বিরতি দিয়ে যোগ করল, “ডক্টর আফসার আহমেদ। পিবিএসআইয়ের সাইকোলজিক্যাল অ্যানালিসিস উইঙের হেড। আমাকে আতিকুল আলম স্যার পাঠিয়েছেন,” কথাটা সে এমনভাবে বলল যেন আতিকুল আলম তাকে এখানে পাঠিয়ে ভীষণ একটা অন্যায় করেছে। যুবক শক্ত মুঠোতে প্রফেসরের হাতটা এমনভাবে ধরে আছে সে যেন মনে মনে ভাবছে আর কতটা জোরে চাপ দিলে প্রফেসরের হাতের হাড়গুলো ভেঙে যাবে।

এই অল্প বয়সেই পিএইচডি করে ফেলেছে, তার মানে মেধাবী। সেইসাথে আবার একটা বিশেষ উইঙের প্রধান, এর মানে সে প্রভাবশালীও বটে। যুবকের দুর্বিনীত আচরণের কারণ খুঁজে পাওয়া গেল, নাকি কারণ আসলে অন্য কিছু। প্রফেসর তার চশমার ঘোলাটে কাচের ওপাশ থেকে যুবকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিল। “আমাদের মনে হয় রওনা হওয়া উচিত।”

“অহ, ইয়েস,” বলে সে প্রফেসরের হাতে শেষ একটা চাপ দিয়ে ছেড়ে দিল। “আপনি এখানে বসবেন,” বলে সে পেছনের সিটটা দেখিয়ে দিয়ে সামনে ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসল। দরজাটা খুলে দেওয়ার মতো ম্যানার দেখানোরও কোনো প্রয়োজনীয়তাবোধ তার ভেতরে দেখা গেল না। প্রফেসর নিজেই দরজা খুলে ভেতরে বসল। গাড়ির ভেতরে খুবই আরামদায়ক গরম। আজকাল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনকে এত দামি গাড়ি দেওয়া হয়, প্রফেসরের কোনো ধারণাই ছিল না। সিটে বসেই সে দেখল পাশেই একটা প্লাস্টিকের ফোল্ডার রাখা। ওটার ভেতরে কয়েক গোছা কাগজও দেখতে পেল সে।

যুবক গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলে উঠল, “আপনার কতটা কাজে লাগবে তা জানি না, কিন্তু আতিক স্যার প্রয়োজনীয় সব সাপোর্টিং ডকুমেন্ট ওখানে সাজিয়ে দিতে বলেছেন আমাকে।”

“জানালার কাচটা একটু নামাও,” প্রফেসর যুবকের কথার জবাব না দিয়ে বলে উঠল। হাতে তুলে নিয়েছে সাথে নিয়ে আসা কাঠের বাক্সটা।

“সরি?”

“বলেছি, জানালার কাচটা একুট নামাও আমি পাইপ ধরাব,” বলে প্রফেসর তার হাতের বাক্স থেকে বের করে পাইপটা বাম হাতে নিয়ে ডান হাতে লাইটার দিয়ে ধরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

“স্যার…?”

যুবক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই প্রফেসর পাইপে আগুন দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়ল। বাধ্য হয়ে যুবক পেছনের সিটের একপাশের জানালার কাচ একটু নামিয়ে দিল। গজগজ করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে তার আগেই প্রফেসর জানতে চাইল, “এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে তুমি পড়ালেখা করেছ, ওখানে কি মেমোরি অ্যানালিসিসের ওপরে জেড থিয়োরিটা এখনও পড়ানো হয়?”

যদিও প্রফেসর নামানো জনালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পাইপ টানতে ব্যস্ত কিন্তু সে ঠিকই অনুমান করতে পারল উদ্ধত যুবকের অবাক দৃষ্টি ভিউ মিরেরর ভেতর থেকে তার ওপর স্থির। “জি, পড়ানো হয়, আমার আন্ডার গ্র্যাডে মেজর ছিল মেমরি অ্যানালিসিসেস ওপরে। পরে পোস্ট গ্র্যাডের সময়ে আমি ক্রিমিনাল সাইকোলজি নিয়ে কাজ করতে শুরু করি…”

যুবক বলে চলেছে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সামান্য উদাস ভঙ্গিতে পাইপ টানছে প্রফেসর। নিজের বাড়ির জানালা দিয়ে দেখা ছেলে- মেয়েগুলোকে জটলা করতে দেখল সে। একটা মেয়ের হাতে বিয়ারের বোতল দেখে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। নারী স্বাধীনতা কিংবা নারীর অ্যালকোহল পান নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এই মেয়ে কিংবা ছেলেগুলো নিজের স্বাধীনতা উপভোগ করার জন্য আনন্দ করছে না কিংবা পান করছে না। এরা পান করছে নিজের কাছে নিজেকে স্বাধীন প্রমাণ করার জন্য — তথাকথিত আধুনিক বিশ্বের অনুকরণে নিজেকে স্মার্ট প্রমাণ করার জন্য। অনুকরণীয় স্বাধীনতা অথবা স্মার্টনেস দুটোই সমান ক্ষতিকর। অবশ্য সে-কে এসব ভাবার। ওই বয়সে সেও কি এসব ভাবত। কিংবা ওই বয়সে তাকে যদি কেউ এসব বলত তবে সে কি তাকে পাগল ছাড়া অন্যকিছু ভাবত।

“…স্যার আপনি কি ওখানে পড়াশুনা… মানে আপনি জানলেন কীভাবে?” উদ্ধত যুবকের বলা কথাগুলো ঠিক মনোযোগ দিয়ে শোনেনি সে। তাকে কথা শেষ করতেও দিল না প্রফেসর বরং মাঝখানে বলে উঠল, “আল ফাত্তাহ ধরা পড়ল কীভাবে? তার মতো এরকম একজন আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল আমাদের এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি ভেদ করতে পারল না, এ কেমন কথা! তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো, এরকম একটা ঘটনা মিডিয়ার কাছ থেকে আড়ালে রাখলে কীভাবে তোমরা? প্রথমটা সম্ভব হলেও দ্বিতীয়টা তো পুরোপুরি অসম্ভব মনে হচ্ছে আমার কাছে। এমনিতেই সাধারণ সময়ে এয়ারপোর্টে কিছু একটা ঘটলেই পত্রিকা-টিভি চ্যানেলগুলোয় চাউর হয়ে যায়। সেখানে এই মুহূর্তে সারাবিশ্বের সব বাঘা বাঘা মিডিয়া হাউজগুলোর প্রতিনিধিরা যখন এ দেশে অবস্থান করছে, এমন সময় এরকম চাঞ্চল্যকর একটা ব্যাপার তোমরা চাপা দিয়ে রাখতে পারলে কীভাবে? ধরা পড়েছে সে কখন?” বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ ডেমোলিশন এক্সপার্ট এবং টেকনো টেররিস্ট কি না ধরা পড়ল এই বাংলার মাটিতে। তাও আবার দেশের সবচেয়ে বড় উৎসব মুখর সময়ে। কেন এবং কীভাবে? ব্যাপারটা মেনেই নিতে পারছে না প্রফেসর।

“আজ সন্ধ্যায়। যদিও ওই ফাইলে সব লেখা আছে— “আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছি—”

“জি স্যার,” আফসার নামক অল্পবয়স্ক পিএইচডিধারী যুবকের গলায় অহংকার থাকলেও আগের উদ্ধত ভাব একটু কম মনে হচ্ছে। গাড়ি চালাতে চালাতে যেভাবে ভিউ মিররে তাকে দেখছে কখন আকসিডেন্ট করে বসে কে জানে। প্রফেসর ঠিকই বুঝতে পারছে যুবকের মনের ভেতরে কী ভাবনা বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না যেটা সেটা হলো পিবিএসআইয়ের অফিসে যাওয়ার পর আসলে ঘটবেটা কী? সেই ব্যাপারেই একটা ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করছে সে।

“স্যার, আল ফাত্তাহর ধরা পড়ার ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত এবং চমকপ্রদও বটে। তবে ঘটনাটা ঘটেছে একেবারেই কাকতালীয়ভাবে। প্রথমেই বলে নেই, এটা ঘটেছে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি টার্মিনালের একেবারে ভেতরে। আর এ কারণেই ওখানে মিডিয়া বা মিডিয়া হাউজের কারো উপস্থিতি ছিল না। মনে হয় এ কারণেই প্রাথমিকভাবে মিডিয়ার নজর এড়াতে সক্ষম হয়েছি আমরা। এরপরে সে ধরা পড়ার পর তো ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে–“

“আচ্ছা, তোমাদের কী মনে হয়, ফাত্তাহ কি বাংলাদেশে প্রবেশ করছিল নাকি সে এখান থেকে বিদেয় নিচ্ছিল?”

“স্যার, সে বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। প্রথমে আমরা ধারণা করেছিলাম পরে ফাত্তাহ নিজেই এটা কনফার্ম করেছে। সে একটা বিশেষ কাজে ঢাকায় এসেছিল সেটা সেরে ফিরে যাওয়ার সময়ে ধরা পড়ে।”

“ধরা পড়ল কীভাবে?” আগামীর ব্যাপারে করণীয় ঠিক করতে হলে তাকে অতীতের সব বুঝতে হবে। “তার সাথে লোকজন যারা ছিল তারা ধরা পড়েনি?”

“তার সাথে লোক খুব বেশি ছিল না। এদের মধ্যে একজন এয়ারেপার্টেই গোলাগুলিতে মারা যায়, অন্যজন নকল দাঁতে থাকা সায়নাইড খেয়ে মারা পড়ে, তৃতীয়জন আহত হয়েছিল। ফাত্তাহ ধরা পড়ার ঘণ্টা দুয়েক পরে আহত অবস্থায় লোকটা মারা যায় কুর্মিটোলা হাসপাতালে।

আফসোসের সাথে মাথা নাড়ল প্রফেসর। এদের একজনও যদি বেঁচে থাকত তবে পুরো ব্যাপারটা অনেক বেশি সহজ হতো।

আফসার বলে চলেছে, “আগে ফাত্তাহর পাসিং সিকিউরিটি সেট- আপটা নিয়ে বলে নেই। ব্যাপারটা খুবই ব্রিলিয়ান্ট স্যার। আমরা এখানে আজ যেটা আবিষ্কার করেছি এটা সারা বিশ্বের সব সিকিউরিটি সংস্থাগুলোর জন্য শিক্ষণীয় ব্যাপার হতে পারে। যেখানে বিশ্বের প্রায় সব টপ লিস্টেড ওয়ান্টেড ক্রিমিনালরা চুরি করে, বর্ডার দিয়ে লুকিয়ে কিংবা ভিন্ন ভিন্ন চোরাপথে অথবা ছদ্মবেশে আন্তর্জাতিক ট্র্যানজিট ক্লিয়ার করে, সেখানে এই লোক ভিআইপি পাশ নিয়ে প্রাইভেট প্লেন নিয়ে চলাচল করে।”

প্রফেসর ঘোলাটে কফি কাচের অন্যপাশ থেকে আফসারের দিকে তাকিয়ে আছে। অত্যন্ত রহস্যময় ভাড়াটে বোমারু, মাস্টার অব ডেমোলেশন বা মাস্টার ডি. নামে পরিচিত কুখ্যাত আন্তর্জাতিক অপরাধী ফাত্তাহ— যার ব্যাপারে শুধুমাত্র নামটা বাদে আর তেমন কিছুই জানা নেই, যাকে প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের বড় বড় প্রায় সব গোয়েন্দা সংস্থা থেকে শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন খুঁজছে তার ধরা পড়ার বয়ান পুরোটা শুনতে চাচ্ছে সে।

“স্যার এই লোক জিনিয়াস। অসাধারণ সেট আপ ছিল তার। কোমায় থাকা রোগী সেজে সে ভিআইপি টার্মিনাল দিয়ে ইমার্জেন্সি এক্সিট নিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় ধরা পড়ে যায়।”

প্রফেসর শুধু মাথা নাড়ল। মুমূর্ষু রোগী সেজে ট্র্যানজিট, ভেরি গুড।

“লোকটার সিস্টেমটা ছিল অনেকটা এরকম; সে একজন ভিআইপি পেসেন্ট। ডক্টর থেকে শুরু করে পুরো মেডিকেল সেট আপ নিয়ে আলগা করোনারি ইউনিট সাজানো অবস্থায় সম্পূর্ণ অথেনটিক ওয়েতে বিশেষ ব্যবস্থায় সে ট্র্যানজিট নেওয়ার কথা ছিল। ভেতরে এয়ারেপোর্টে তার জন্য প্রাইভেট মেডিকেল টিম অপেক্ষা করছিল। আপনি জানেন কি না স্যার এ ধরনের ইমার্জেন্সি এবং ভিআইপি পেশেন্টের জন্য কিন্তু বিশেষ ট্র্যানজিটের ব্যবস্থা থাকে। বিশ্বের যেকোনো এয়ারপোর্টে একজন মেডিকেল অফিসার কাগজপত্র চেক করে কোনো ঝামেলা না পেলে এ ধরনের পেশেন্টদেরকে ইমার্জেন্সি এবং ভিআইপি ট্র্যানজিট দিয়ে দেয়। এই লোকটা আর তার টিম ঠিক সেভাবেই পার হচ্ছিল। তার কাগজপত্র থেকে শুরু করে কোনো কিছুইতেই কোনো গলদ ছিল না, এমনকি সেট-আপ দেখেও কেউ সন্দেহ করার কোনো কারণই ছিল না।”

“এই লোকটা এভাবেই তাহলে এত বছর অপারেট করেছে বিশ্বব্যাপী। এ কারণেই কখনোই কোনো বিমানবন্দরে তো বটেই কোথাও সে এমনকি সিসিটিভিতেও ধরা পড়েনি। এবার ধরা খেল কীভাবে?” প্রফেসর পাইপে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জানতে চাইল।

ওদের গাড়ি হাউজিং পার হয়ে উত্তরাতে প্রবেশ করছে, পিবিএসআইয়ের অফিস বেশি দূরে নেই। “এরপর কী হলো? সে কি ভিআইপি টার্মিনালের সিকিউরিটির কারণে ধরা খেল?”

“না স্যার,” বলে আফসার একটু হেসে উঠল। “সে ধরা খেয়েছে একেবারেই হাস্যকার একটা কারণে। সে ধরা খেয়েছে লিফটের ভেতরে। সে প্রথম ট্র্যানজিট পার হয়ে এমনকি ভিআইপি টার্মিনাল পার হয়ে যখন শেষ চেকিং এরিয়ার দিকে যাচ্ছে এমন সময় ফাত্তাহ আর তার সাজানো মেডিকেল টিমের সাথে লিফটে উঠছিল মিশরের প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত মেডিকেল টিম একটু আগেই মিশরের প্রেসিডেন্ট এয়ারপোর্টে নেমে ঢাকার দিকে রওনা দিয়েছেন। উনি আসার একটু পরেই তার পারসোনাল শেফ ও মেডিকেল টিম এসে পৌঁছায়। প্রেসিডেন্টের মেডিকেল টিমের ডাক্তার দুজন প্রথম চেকিঙের এরিয়াতে হ্যান্ডব্যাগ ফেলে আসে। হ্যান্ডব্যাগ খুঁজে আনার জন্য ওরা যখন ফার্স্ট চেকিং এরিয়াতে ফেরত যাচ্ছিল এমন সময় তাদের সাথে লিফটে ওঠে ফাত্তাহর টিম। লিফটে উঠতে উঠতে হঠাৎ একজন ডক্টরের চোখ পড়ে রোগীর হার্ট মনিটরের দিকে,” বলে আফসার একটু থামল।

“তারা যেভাবে মেডিকেল সাপোর্ট সাজিয়েছিল সেটা এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি পাশ করার জন্য যথেষ্ট কারণ এয়ারপোর্টে সিকিউরিটির তো আর অত গভীর মেডিকেল জ্ঞান বা ইকুইপমেন্টে ব্যাপারে ধারণা থাকে না কিন্তু একজন বিশেষজ্ঞ ডক্টরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য হয়তো সেটা যথেষ্ট ছিল না। যাই হোক, আসলে লিফটে কী হয়েছিল তা আমিও সঠিক জানি না। সম্ভবত সেই ডাক্তার হার্ট মেশিন বিট করছে না দেখে রোগি মারা গেছে ভেবে চিৎকার- চেঁচামেচি লাগিয়ে দেয়। ওরা লিফটের ভেতরে সেই দুজনকে সামলে নিতে নিতে লিফট ফার্স্ট সিকিউরিটিটা এরিয়াতে পৌঁছে যায়। দরজা খুলতেই তারা পড়ে যায় অন্য এক দেশের প্রেসিডেন্সিয়াল সিকিউরিটির একেবারে সামনে। ব্যস শুরু হয়ে যায় ফাইট।”

“ফাত্তাহর সাথের লোকজন কি আর্মস ক্যারি করছিল?” প্রফেসর চিন্তিত মুখে জানতে চাইল।

“না স্যার, মেডিকেল টিমের অভিনয় অথেনটিক করার জন্য ওদের সাথে কোনো অস্ত্র ছিল না। কিন্তু তাতে ওরা দমেনি। আগেই বলেছি স্যার তিনজনের ভেতরে একজন ওখানেই মারা পড়ে, একজন আহত হয় আর অন্যজন সুইসাইড করে ধরা পড়ার আগে। আর আহত লোকটা…”

“ফাত্তাহ কি আহত হয়েছিল?” প্রফেসর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়াতে একবার ঘড়ি দেখল। সে ধ্যানে বসার পর মাত্র এক ঘণ্টা পার হয়েছে। এই অল্প সময়ে এতকিছু ঘটে গেছে যে মনে হচ্ছে যেন অনেক সময় চলে গেছে।

“না স্যার,” গাড়ি উত্তরা পার হয়ে রাজলক্ষ্মীর সামনে দিয়ে চলেছে। আর কিছুক্ষণের ভেতরে তারা জায়গামতো পৌঁছে যাবে। “কারণ যখন এই ঘটনা ঘটে সে বলতে গেলে প্রায় অজ্ঞান ছিল। তাকে ইনজেকশন দিয়ে অর্ধচেতন করে রাখা হয়েছিল, যাতে মেডিকেল চেক আপের সময়ে কোনো সমস্যা না হয়।”

“তার মানে ওরা এয়ারপোর্ট ট্র্যানজিটের ব্যাপারটা অসাধারণ সূচারুভাবে সম্পন্ন করত কিন্তু এবার স্রেফ কপাল দোষে ফেঁসে গেছে,” অনেকটা আনমনেই বলে উঠল প্রফেসর।

“জি স্যার, তা বলা যেতে পারে। এ কারণেই সে আহত হয়নি, শুধু ঘটনাটা ঘটার সময়ে ধাক্কাধাক্কিতে তাকে রাখা স্ট্রেচারটা উলটে গিয়ে সে মাটিতে পড়ে যায়, তাতে তার কপালের একপাশে চোট লাগে, কিন্তু সেটা গুরুতর কিছু না,” ওদের গাড়ি রাস্তার বাম থেকে ডানে ঘুরতে শুরু করেছে।

“জ্ঞান ফিরে আসার পর সে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেনি?”

“না স্যার, জ্ঞান ফিরে আসার পর প্রথমে তো সে বুঝতেই পারেনি কী হচ্ছে। আর যখন বুঝতে পেরেছে তখন আসলে আর কিছু করার ছিল না।”

“এরপর কী হলো?” প্রফেসর দেখল ওরা প্রায় চলে এসেছে। “মূল ঝামেলাটা সে তাহলে পাকাল কখন?” এখন প্রফেসর ঘটনার ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে। “যদিও আতিকুল আলম স্যার আমাকে বলেছেন আপনার সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কিন্তু যেহেতু আমরা প্রায় চলেই এসেছি সবচেয়ে ভালো হয় মূল সমস্যাটা আপনি আতিক স্যারের কাছ থেকে সরাসরি শুনলে, বলে সে জিপটাকে প্রবেশ করাল একটা বড় বাউন্ডারির ভেতরে, যেখানে সারি দেওয়া কয়েকটা বিল্ডিং চোখে পড়ছে। গাড়ি পার্ক করতে করতে সে একটু দ্বিধার সাথে বলে উঠল, “স্যার, একটা প্রশ্ন ছিল।”

“বলো,” প্রফেসর গাড়ির দরজার হাতলে হাত রেখে থেমে গেল।

“স্যার, জেড থিরোরির ব্যাপারে আপনি কীভাবে জানেন? আমি যতটুক জানি ওটা খুব একটা পপুলার কোনো থিরোরি না। যারা ওই ফিল্ডে সরাসরি কাজ করে একমাত্র তারাই এ ব্যাপারে জানে। আপনি কি স্যার কোনো সময় ওই বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন?” প্রশ্নটা নিয়ে তার মধ্যে অনেক দ্বিধা।

“নাহ,” গাড়ির দরজাটা এক ধাক্কায় খুলে পাইপটাকে উলটো করে পোড়া তামাকটুকু পেভমেন্টে ফেলে দিল প্রফেসর। “আমি কখনোই জেড থিয়োরি নিয়ে কাজ করিনি,” বলে সে একটু থেমে যোগ করল। “ওটা আমারই উদ্ভাবিত থিয়োরি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *