শব্দজাল – ৮

“বন্ধু, আমি কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছি?” আতিকুল আলম কফির কাপটা হাতে তুলে নিতে নিতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রফেসরের চশমার কাচের দিকে। নিজের কফির কাপটা হাতে তুলে নিয়ে খুব গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে প্রফেসর বলে উঠল, “ একদম না।”

প্রফেসরের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আতিকুল আলম হাসিতে ফেটে পড়ল। এরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও তার হাসি বাঁধ মানছে না। রুমের অনেকেই এক পলকের জন্য ফিরে তাকাল তাদের দিকে। মিটিঙে এই মুহূর্তে কফি বিরতি চলছে। পাঁচ মিনিটের সংক্ষিপ্ত কফি বিরতিতে সবাই যার- যার কফি নিতে ব্যস্ত।

“তুই একটা হারামি,” আতিকুল আলম হাসতে হাসতেই বলে উঠল। “কিন্তু আসলেই কি আমরা পরিস্থিতি সামলাতে পারব? এত এত মানুষের জীবনের প্রশ্ন যেখানে–“

প্রফেসর কিছু না বলে কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে নিজের পাইপে তামাক ভরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সরকারি আমলা আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনকে পৃথিবীতে কোথাও কোনো বুদ্ধিমান মানুষ বিশ্বাস তো করেই না, এমনকি পছন্দও করে না। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে আতিকুল আলমকে মন থেকে বেশ পছন্দ করে প্রফেসর জাকারিয়া। যদিও গত ছয় মাস ধরে তার আচরণে বেশ বিরক্ত এবং খানিকটা হতাশ হয়ে উঠেছিল সে। কিন্তু মনের গহিন কোণে আতিকুল আলমের জন্য লুকিয়ে থাকা ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ এই মুহূর্তে— এই জায়গাতে প্রফেসর জাকারিয়ার উপস্থিতি। যদি সেটা না হতো তবে সে এখানে আসত না তাও এরকম বিপজ্জনক একটা কাজের দায়িত্ব নিতে। তবে সবকিছুর ওপরে এত মানুষের মৃত্যুর সম্ভবনা এবং সেই ফাইলের ব্যাপারটা তো আছেই। পাইপে তামাক ভরে আগুন দিতেই মৃদু একটা সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে।

“শোন দোস্ত, আমি জানি না তুই এই কাজের জন্য আমার কথা ভেবেছিস কেন। কারণ আমি ঠিক এই লাইনের মানুষও না। তবে আমাকে এই কাজের জন্য নিয়ে এসে তুই ঠিক করিসনি,” বলে সে চশমার কাচের ওপাশ থেকে দৃষ্টি স্থাপন করল আতিকুল আলমের চোখে।

অভিজ্ঞ এবং শক্তিশালী পুরুষ মানুষ যখন ভেঙে পড়ে তখন সেই দৃশ্যটা খুব একটা সুখকর হয় না। কিন্তু সেই মানুষটা যখন ভেঙে পড়ার আগে খড়কুটো আঁকড়ে ধরতে চায় এমন মানুষের দৃষ্টিতে যে আকুতি কাজ করে সেই আকুতি সবচেয়ে শক্ত মানুষের ভেতরটাও নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আতিকুল আলম অনেকটা সেরকম দৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে প্রফেসরের দিকে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ধীরে ধীরে তার সেই অসহায় দৃষ্টি পরিবর্তন হতে শুরু করল। এমনকি এক পর্যায়ে সেখানে ফুটে উঠল মৃদু হাসির একটা ঝলক।

“আমি যখন তোকে কল করি এমনকি তোকে নিয়ে যখন এই রুমে প্রবেশ করি তোর ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত এই বিপদ থেকে আমাদেরকেসহ ঢাকা শহরবাসীকে কেউ যদি রক্ষা করতে পারে তবে সেটা একমাত্র তুই-ই পারবি। আমাদের এক্সপার্টরা নয়।’

“কেন? হঠাৎ কী হলো যে তুই এমন নিশ্চিত হয়ে গেলি?” প্রফেসরের ভুরু খানিকটা কুঁচকে উঠেছে।

“কিছু না, এই দেশের সাধারণ মানুষদের জন্য তোর মনে যে দরদ আছে, সেটাকে শুধু অনুভব করবি তুই, তাহলেই দেখবি বাকিটা এমনি এমনি পেরে যাবি,” বলে সে প্রফেসরের কাঁধে মৃদু একটা চাটি মেরে বলে উঠল, “মিটিং শুরু করতে হবে।”

প্রফেসর কেমন যেন একটু হতভম্ব বোধ নিয়ে মিটিঙে এসে বসল। তার মনের গহিন কোণে উঁকি দিচ্ছে অদ্ভুত কিছু প্রশ্ন, যেগুলোর সবার ওপরে ভেসে বেড়াচ্ছে একটাই প্রশ্ন, আতিক হঠাৎ এ কথা কেন বলল?

“তো যেখানে ছিলাম আমরা,” আফসার রিমোট চেপে স্লাইড ওপেন করল, সেখানে বড় বড় করে ইংরেজিতে যা লেখা সেটার বাংলা করলে দাঁড়ায় অ্যালবার্ট ফাত্তাহর কাছ থেকে কীভাবে তথ্য আদায় করা যাবে।

“আরে, এইটা নিয়া এত্তো ঝামেলার কী আছে?” সরকারি প্রতিনিধিদের ভেতরে সবচেয়ে মোটা— যাকে প্রফেসর মনে মনে নাম দিয়েছে ‘কুমড়ো” সে বলে উঠল। “শক্ত কইরা ডলা দিলেই ও ক্যান ওর বাপেও কথা কবে,” বলে সে অন্যদের দিকে তাকাল সাপোর্ট পাওয়ার আশায় তারপর নিজেই জোরে হেসে উঠল।

“ভেরি গুড স্যার,” আফসার, রিমোটটা কুমড়োর দিকে পিস্তলের মতো তাক করে বলে উঠল। “প্রাথমিকভাবে ব্যাপারটা শুনলে যে-কেউ শারীরিক নির্যাতনকেই সবচেয়ে সহজ উপায় বলে ধরে নেবে। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে এতটা সহজ নয়,” বলে সে মারিয়ার দিকে ফিরে ইশারা করল। সাথে সাথে মেয়েটা রিমোটে চাপ দিতেই আবারও ফাত্তাহর ছবি ফুটে উঠল স্ক্রিনে। আবারও সবাই শিউরে উঠল বীভৎস চেহারাটা দেখে।

ছবিতে মানুষটার গলার কাছে একটা সাদা দাগ দেখা যাচ্ছে, ওটাতে লেজার পয়েন্ট করে মারিয়া বলে উঠল, “আমরা আগেই বলেছি যে অ্যালবার্ট ফাত্তাহর অরিজিন এবং তার পূর্ব জীবন নিয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই আমাদের। তার চেহারার যে বীভৎস রূপ দেখা যাচ্ছে সেটা এরকম কীভাবে হয়েছে, আমরা কেউই জানি না। এয়ারপোর্টে সে ধরা পড়ার পর কাস্টমস পুলিশ যখন তাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেয় তখন তার বিস্তারিত মেডিকেল চেক- আপ করানো হয়। তার মেডিকেল চেক-আপ করে যে ডক্টর সে খুব অদ্ভুত কিছু তথ্য জানায় তার ব্যাপারে। এই যে গলায় গভীর দাগটা দেখতে পাচ্ছেন এটা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, তাকে গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল ফাঁসির জন্য। দাগের গভীরতা দেখে এটুকু অনুমান করা যায়, হয় সে মৃত্যুর দারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল, অথবা বলা চলে সে প্রায় মারাই গিয়েছিল। এরকম ক্ষত ফাঁসির দড়ির চাপে মৃতপ্রায় হলে তবেই হওয়া সম্ভব। এরকম ক্ষতের পর মানুষটার বেঁচে থাকা স্রেফ একটা মিরাকল। তবে লোকটা বেঁচে গেছে। কিন্তু এই আঘাতের ফলে তার শারীরিক গঠনে মারাত্মক কিছু পরিবর্তন হয়েছে।”

এইসব পরিবর্তনগুলোর ভেতরে সবচেয়ে ভাইটাল হলো, তার অনেক অনুভূতি মারা গেছে, সম্ভবত তার গলার হাড় ভেঙে ভেতরে বসে যাওয়ার কারণে তার বেশ কিছু নার্ভ কেটে যায়, যার ফলে মানুষটার নার্ভাস সিস্টেম এমনভাবে বদলে গেছে যে তার কোনো ব্যথার অনুভূতি নেই,” বলে মেয়েটা একটু থেমেই সবাইকে দেখে নিয়ে বলে উঠল, “কাজেই আমাদের ফিজিওলজিক্যাল এক্সপার্টদের মতে তাকে টর্চার বা শারীরিক নির্যাতন করে কোনো লাভ হবে না,” এইটুকু বলে মারিয়া আফসারের দিকে ইশারা করতেই সে বলতে লাগল।

“বরং এতে আরও কিছু সমস্যা হতে পারে। একদিকে ইন্টারপোলের চাপ তো আছেই তার ওপরে এসব ক্রিমিনালদের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন খুব কঠিনভাবে মানা হয়। তার বডিতে টর্চারের নিশানা থাকলে আমাদের অন্য ধরনের ঝামলায় পড়তে হতে পারে।”

“এই শালা কেমন মানুষ, মাইরেও কিছু অইবো না,” সেই কুমড়ো বলে উঠল। বলে সে আশেপাশে তাকাল সমর্থনের আশায়, কিন্তু এবারও তাকে কেউ সমর্থন দিল না। বরং পাশ থেকে আরেকজন কথা বলে উঠল।

“ইয়ে মানে, তাকে কি কোনো ধরনের লোভ বা ভয় দেখিয়ে…” মানুষটার কথাটা এতটাই বেকুবের মতো যে, সে নিজেই তার বাক্য পুরোটা শেষ না করে মাঝপথে খেই হারিয়ে ফেলল।

প্রফেসর আরেকটু হলে হেসেই উঠত কিন্তু সে আতিকুল আলমের দিকে তাকিয়ে দেখল মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় প্রতিনিধির বোকার মতো কথা শুনে আতিকের চোখ রাগে গরম হয়ে গেছে।

প্রফেসর মানুষটার দিকে তাকিয়ে দেখল এই লোকটা আগের মোটকুর চেয়ে দেখতে একেবারে বিপরীত। সে এতটাই চিকন যে তার জন্য মনে মনে একটা নাম ঠিক করে ফেলল প্রফেসর। টুথপিক।

টুথপিক তার মন্তব্যটা শেষ না করেই আফসারের দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু আফসার জবাব দেওয়ার আগেই মন্ত্রণালয় থেকে আসা তৃতীয় মানুষটা কথা বলে উঠল। সে টুথপিকের মন্তব্য একবার হাত নেড়ে যেন হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে জানতে চাইল, “যদিও আমি এই লাইনের এক্সপার্ট নই কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে এই লোকটার কাছ থেকে তথ্য আদায় করার জন্য আমরা সাইকোলজিক্যাল প্রসেসের ভেতর দিয়ে যেতে পারি। যেমন ধরেন বিভিন্ন মেডিসিনের ব্যবহার বা কিংবা ব্রেইন ওয়াশ বা এরকম কিছু করা যেতে পারে কি?”

মানুষটার মন্তব্য শুনে প্রফেসর এবং আতিকুল আলম দুজনেই একটু হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যে প্রস্তাবটা তারাই দিতে যাচ্ছিল সেটা যদি মন্ত্রণালয়ের লোকদের তরফ থেকে আসে তবে সেটা সবদিক থেকে তাদের জন্য নিরাপদ হয়। প্রফেসর এই প্রথম তৃতীয় লোকটাকে ভালোভাবে খেয়াল করল। এই লোকটাকেই তিনজনের ভেতরে মোটামুটি বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন মনে হলো তার কাছে।

তৃতীয় মানুষটার জবাবে আফসার বলে উঠল, “স্যার, আমরাও অনেকটা সেরকমই ভেবেছি। আমাদের ইভাল্যুয়েশন টিমের মতে ফিজিক্যাল টর্চার কিংবা অন্যান্য প্রসেসে এই লোকটার কাছ থেকে কোনো ধরনের তথ্য আদায় করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। সেই হিসেবে একমাত্র যে পথটা খোলা থাকে আমাদের সামনে সেটা হলো সাইকোলজিক্যাল প্রসেসের মাধ্যমে কিছু করার চেষ্টা করা,” এই পর্যন্ত বলে সে আতিকুল আলমের দিকে দেখল।

আতিকুল আলম একবার মাথা নেড়ে আবারও উঠে দাঁড়াল। “আপনি যেটা বললেন স্যার,” সে একবার মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “আমাদের এক্সপার্ট টিমও তাই ভেবেছে। আর সে কারণেই আমরা এই মুহূর্তে এখানে অবস্থান করছি। আপনাদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই,” বলে সে প্রফেসরের দিকে দেখিয়ে বলে উঠল, “আমার কলেজ জীবনের বন্ধু এবং বিশিষ্ট সাইকোলজিস্ট প্রফেসর ডক্টর জাকারিয়া আহমেদ, যাকে আমরা জ্যাক নামে ডাকি।”

আতিকুল আলমের সম্বোধনের জবাবে প্রফেসর কিছু না বলে বরং সে নিজের হাতের পাইপটা একটু উঁচু করে সবার উদ্দেশে একবার নাড়ল।

“তিনি কি আমাদের কেউ?” টুথপিকের করা প্রশ্নটা প্রফেসর ঠিক বুঝতে পারল না। কিন্তু আতিকুল আলম ঠিকই বুঝেছে। সে একটু দ্বিধার সাথে জবাব দিল। “না, কিন্তু এই কাজের জন্য এই মুহূর্তে তার চেয়ে বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন কাউকে আপনি পুরো দেশে পাবেন না,” বলে সে আফসার আর মারিয়ার দিকে তাকাল সমর্থনের আশায়।

“আমাদের নিজেদের এত এত মানুষ থাকতে বাইরের একজন লোককে এইভাবে,” অসন্তোষের সাথে মাথা নাড়তে লাগল কুমড়ো। “বিশেষ করে এই তথ্য বাইরের কারো সাথে শেয়ার করাটা আপনার ঠিক হয়নি।”

লোকটার কথার ধরনে এবার আতিকুল আলম রেগে গেল। “স্যার, আপনি মনে হয় একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন, এরকম বড় মাপের একটা নিউজ আমরা যে এখন পর্যন্ত মিডিয়া হাউজগুলোর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পেরেছি কিংবা ওদেরকে ছাপানো থেকে বিরত রাখতে পেরেছি এর পেছনে আমি আর আমার টিমের অবদান সবচেয়ে বেশি। সেক্ষেত্রে আপনার বোঝা উচিত কেন তাহলে আমি বাইরের একজন মানুষকে এই ব্যাপারটার সাথে যুক্ত করলাম। যেহেতু করেছি তার মানে এর পেছনে অবশ্যই কোনো না কোনো কারণ আছে।”

“আরে, আপনি থামুন তো,” সেই তৃতীয় প্রতিনিধি কুমড়োকে ধমকে উঠল। “আতিক সাহেব যেহেতু তার ওপরে ভরসা করছেন কাজেই এর পেছনে অবশ্যই কোনো না কোনো কারণ আছে। আমার মনে হয় প্রফেসর সাহেবের কথা আমাদের শোনা উচিত। তিনি কী বলেন আমি একটু শুনতে চাই,” রুমের সব কয়টা চোখ তাকিয়ে আছে প্রফেসরের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *