শব্দজাল – ১৫

১৫

আবারও সেই শ্বাস ফেলার মতো শব্দ করে খুলে যাওয়া দরজা, আবারও সেই একই সাদাটে আলো, আবারও সেই আলোতে বসে থাকা নিবিষ্ট চিত্ত জান্তব মানুষটার মুখোমুখি হওয়া, আবারও একরাশ আদিম ভয়ের শিহরণ।

প্রফেসর হাতের বাক্সটা নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই মুখ তুলে তাকাল অ্যালবার্ট ফাত্তাহ। চোখ বন্ধ অবস্থাতেও লোকটার মুখে ঝুলে ছিল এক টুকরো বিচিত্র হাসি। চোখ তুলে প্রফেসরকে দেখে নিয়ে সেই হাসি যেন আরও বিস্তৃত হলো তার মুখে।

“হ্যালো, প্রফেসর,” মুখ একটু নিচু করে রেখেই সে শুধু ভালো চোখটাকে সামান্য ওপরের দিকে তুলে জানতে চাইল, “কেমন হলো তোমার বিরতি? ভলোভাবে শক্তি জোগাড় করে এসেছ তো?” যেন ভীষণ মজার কোনো কথা বলে ফেলেছে এমনভাবে বলে উঠল সে। প্রফেসরও সামান্য হেসে উঠল তার সাথে। কিন্তু হঠাৎ একটা ব্যাপার উপলব্ধি হতেই সে প্রায় থামিয়ে ফেলেছিল নিজের হাসি। কিন্তু মুখে হাসিটাকে ধরে রেখেই ভাবনার স্রোতধারাকে প্রবাহিত হতে দিল সে। অনেকক্ষণ ধরে যে ব্যাপারটা ধরার চেষ্টা করছিল কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছিল না, সেটার অনেকটাই ধরে ফেলেছে সে। অ্যালবার্ট ফাত্তাহর বাংলা যদিও পরিষ্কার কিন্তু তাতে একটা টান আছে। বিদেশিরা যারা বাংলা শিখে তাদের কথা যতই পরিষ্কার হোক তাতে খুব হালকা একটা বিদেশি বিদেশি টান থাকে। এটা ঘটে মাতৃভাষার প্রভাবের কারণে। অ্যালবার্টের বাংলা পরিষ্কার হওয়ার পরও তাতে খুবই সামান্য এরকম একটা টান আছে। কিন্তু সেই টান ছাড়িয়েও তার বাংলায় আরও একটা টান আছে সেটাই এতক্ষণ ধরে বোঝার চেষ্টা করেও প্রফেসর ধরতে পারছিল না। ফাত্তাহর বাংলায় বাংলাদেশের বিশেষ একটা এলাকার টান আছে। খুব সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে একটা নির্দিষ্ট এলাকার প্রভাব টের পাওয়া যায় তার কথায়। হঠাৎ ব্যাপারটা ধরা পড়তেই যেন এক পলকের মধ্যে অনেক কিছু ধরা পড়ে গেল প্রফেসরের কাছে।

“কী ব্যাপার প্রফেসর, হলোটা কী? খেয়ে-দেয়ে আবার ঢিলে হয়ে গেলে নাকি?”

প্রফেসর সামান্য হেসে উঠে বলল, “আপনি আছেন একটা সরকারি অফিসে। তাতে আপনার ব্রেক কেমন যাবে সেটা বোঝা কি খুব কঠিন ব্যাপার?” প্রফেসরের সাথে ফাত্তাহও হেসে উঠল। প্রফেসর আবারও জানতে চাইল, “আপনার কেমন কাটল ব্রেক?”

ফাত্তাহ মৃদু কাঁধ ঝাঁকাল, “হাসপাতালের রোগীর যেমন কাটে। হাগা মুতা- খাওয়া-দাওয়া সব বিছানাতেই। ইনপুট আর আউটপুট দুটোই যখন একই স্থানে হয় জীবন তখন কতটা মধুময় হতে পারে সেটা বলাই বাহুল্য নয় কি?”

প্রফেসর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ফাত্তাহ আবারও কথা বলে উঠল। এবার তার গলায় উত্তাপ আগের চেয়ে বেশ অনেকটা বেশি। “প্রফেসর সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার হলো এই কথোপকথন এবং ব্রেক আমার কাছে এগুলোর চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় লাগত যদি আমার টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনগুলো নিয়ে কথা বলতে পারলে। আমার প্রস্তাবগুলো নিয়ে অথরিটি কী ভাবছে সেটা জানাটা খুবই জরুরি।”

প্রফেসর ধীরে-সুস্থে যেন কোনো তাড়া নেই এমনভাবে হাতের কাঠের বাক্সটা টেবিলে রেখে ওটা থেকে পাইপ বের করে তাতে তামাক ভরতে লাগল। “মি. ফাত্তাহ, আপনাকে একটা ব্যাপার আমি পরিষ্কার বলতে চাই, ‘ সে তামাক ভরা শেষ করে হাতের আঙুলের সাহায্যে তামাকটা সেট করতে লাগল। “আপনি দেশের ঊর্ধ্বতম কর্তৃপক্ষের মতামত জানতে চাইছেন,” বলে সে তামাকে লাইটার দিয়ে আগুন দিতে লাগল। কানের ভেতর থেকে ভেসে এলো আফসারের গলা, ‘স্যার, খুব সাবধানে। ওর এতটা সরাসরি এই আলোচনায় চলে আসাটা মোটেই ভালো কোনো ব্যাপার নয়।’

প্রফেসর কিছুই না বলে পাইপের তামাকে আগুন ভরা শেষ করে আগের মতোই বলতে লাগল, “আপনার কি মনে হয় না আজ রাতে এখানে আমার উপস্থিতি তাদের মতামতেরই বহিঃপ্রকাশ,” পাইপে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সে বলতে লাগল।

“তোমার উপস্থিতি কী প্রমাণ করে?” ফাত্তাহর চোখে আগুন। “তারা আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের আর আমার প্রস্তাব নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই?”

প্রফেসর কিছু না বলে পাইপ টানতে লাগল। “সেটা আপনার ইন্টারপ্রিটেশন। আমি—”

“প্রফেসর,” কোনোরকম দ্বিধা না করে সে প্রফেসরের দিকে খানিকটা এগিয়ে এলো। একটু অস্বস্তি লাগলেও কোনোরকম চাঞ্চল্য প্রকাশ থেকে নিজেকে খুব সহজেই বিরত রাখতে পারল প্রফেসর। বরং আগের চেয়ে অনেক বেশি স্থির ভঙ্গিতে বসে রইল সে। ফাত্তাহ টেবিলের ওপর দিয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে এসেছে। তার ভালো আর মন্দ দুটো চোখই বেশি হলে ফুট খানেকেরও কম দূরত্ব থেকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে। ফাত্তাহর নষ্ট চোখের লাল শিরাগুলো আরও লাল হয়ে উঠেছে। আর ভালো চোখের জ্বলজ্বলে মণিতে প্রফেসরের অস্বস্তি উপভোগের উত্তাপ। ফাত্তাহ এগিয়ে এসে প্রফেসরের সামনে থেকে কাঠের বাক্সটা নিজের দিকে টেনে নিল। তারপর সেটাকে খুলে সিগার বের করে ঠিক প্রফেসরের মতোই ধীরস্থির ভঙ্গিতে লাইটার দিয়ে আগুন দিতে দিতে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল, “প্রফেসর তুমি একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছ যে তুমি আমাকে যাই বলো না কেন, এখানে তোমার উপস্থিতি এটাও প্রমাণ করে যে, তোমার অথরিটি বোমাগুলো এখনও খুঁজে পায়নি,” ফাত্তাহ মৃদু হেসে উঠল। “যদি তাই হতো তবে তুমি এখানে উপস্থিত থাকতে না প্রফেসর,” বলে সে মৃদু হেসে উঠল।

তার সাথে সাথে প্রফেসরও হেসে উঠল। হাতের পাইপটা তার দিকে তাক করে বলে উঠল, “আপনার কথা আপনাকেই ফিরিয়ে দিলাম। বুদ্ধিমান মানুষের সাথে তর্ক করতেও আনন্দ।”

“আমার জন্য আজ রাতে যেহেতু তুমিই পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম, কাজেই বলো কী প্রশ্ন আছে তোমার?”

“আচ্ছা, কার প্রশ্ন করার পালা ছিল, আমি ভুলে গেছি,” বলে প্রফেসর সামান্য চিন্তা করে জানতে চাইল, “যাই হোক, একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে যাব। যদি কিছু মনে না করেন,” বলে সে ফাত্তাহর অনুমতির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

ফাত্তাহ কিছু না বলে স্রেফ মাথা ঝাঁকাল বলার জন্য।

“আপনার এই,” বলে সামান্য অস্বস্তি বোধ করল প্রফেসর। একজন মানুষের শারীরিক ত্রুটি নিয়ে কথা বলাটা সবসময়ই অস্বস্তিকর। কিন্তু সে অস্বস্তি থেকে তাকে রক্ষা করল স্বয়ং ফাত্তাহ নিজেই। “তুমি কি আমার মুখের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বলতে চাইছ?”

প্রফেসর সামান্য মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল। “ এগুলোর সাথে নিশ্চই জড়িয়ে আছে অনেক অনেক গল্প,” কথাটা বলেই প্রফেসরের মনে হলো এভাবে বলাটা মোটেই ঠিক হয়নি।

ফাত্তাহ প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে আছে। “এই হয় প্রফেসর, একজন মানুষের অপরিসীম যাতনার আর কষ্টের পরাকাষ্ঠাগুলো তোমাদের মতো সভ্য আর সুশীল মানুষদের জন্য গল্প হয়ে ওঠে।”

“সরি, আমি আসলে,” প্রফেসর মনে মনে সত্যি দুঃখবোধ করছে। সে বলতে চেয়েছিল এক জিনিস কিন্তু বলতে গিয়ে বলে ফেলেছে একেবারেই ভিন্ন কথা। “ওভাবে বলতে চাইনি। আমি আমি-” সে কথা খুঁজে পাচ্ছে না।

“সমস্যা নেই প্রফেসর। পৃথিবীটা এমনই। এখানে একজনের যাতনা মানেই অন্যজনের আনন্দ। এই যে এত এত নাটক-সিনেমা-উপন্যাস আমরা পড়ি। এগুলোতে আসলে আমরা কী দেখি কিংবা কী পড়ি কখনো ভেবে দেখেছ। একজন মানুষ কিংবা একাধিক মানুষের কিছু ক্রাইসিসের মধ্য দিয়ে গমনের পরিক্রমা। তাই না?” ফাত্তাহ সিগারে জোরে টান দিয়ে নীলচে সুগন্ধি ধোঁয়া ছাড়ল। “তুমি বলো প্রফেসর, যদি একজন হিরো কিংবা ভিলেন কিংবা কোনো একটা চরিত্র ঝামেলার মধ্যে না পড়ত তবে কি কোনো গল্প রচিত হতো পৃথিবীতে। একজন মানুষ তার প্রাত্যহিক জীবনযাপন করছে, খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে— জীবনটা শুধু যদি এরমকই হতো তবে কি কোনো গল্পের সৃষ্টি হতো পৃথিবীতে? আমি যদি ঢাকা শহরে বোমা না সেট করতাম, এই শহরটা যদি এত ভয়ংকর কোনো ঝুঁকির মধ্যে না থাকত তবে তুমি আর আমি কি এখানে থাকতাম? তুমি তোমার বিছানায় আরামে ঘুমোতে, আর আমি থাকতাম আমার জায়গায়,” বলে ফাত্তাহ ওপরের দিকে তাকাল। “ক্রাইসিস-কষ্ট-যাতনা আর যন্ত্রণা এগুলোই মানব সমাজকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।”

“আর এ কারণেই এই ক্রাইসিসকে আপনি আরও বাড়িয়ে তুলতে চান বোমা মেরে,” কথাটা বলে প্রফেসর ভাবল আরেকটা ভুল কথা বলে ফেলল কি না কে জানে। একই সাথে পরপর দুইবার দুটো ভুল কথা বলার খেসারত দিতে হতে পারে তাকে। বিশেষ করে আজ রাতে একটা ভুল কথা অনেক বড় মূল্য বহন করতে পারে। প্রফেসর ভেতরে ভেতরে চূড়ান্ত শঙ্কিত হয়ে উঠলেও সেটার কোনো বহিঃপ্রকাশ সে ঘটাল না নিজের চেহারায়। বরং ওপরে খুব শান্ত-সৌম্য একটা ভাব ধরে রেখে তাকিয়ে রইল ফাত্তাহর দিকে।

সিগারের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ফাত্তাহ ধীরে ধীরে নিচের দিকে ফিরে তাকাল। তার মুখের ভঙ্গি দেখেই বোঝা গেল প্রফেসরের শেষ কথাটা তার মোটেই ভালো লাগেনি। সিগারটাকে বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে ধরে মধ্যমার সাহায্যে বিশেষ টোকা দিয়ে ছাই ফেলে দিল ফ্লোরের ওপরে। তারপর হাত দুটো নামিয়ে আনল টেবিলের ওপরে। চোখ-মুখ শক্ত করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফুসস করে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো শব্দ করে খুলে গেল রুমের দরজা। ভেতরে প্রবেশ করল অস্ত্র হাতে গার্ড, তার পেছনে কফির ট্রে হাতে একজন। আর তাদের ঠিক পেছনেই আফসার।

কফি হাতে লোকটা দ্রুত এগিয়ে এসে টেবিলের ওপরে কফির কাপ রাখল। আফসার কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। সে ক্রমাগত চোখ বুলাচ্ছে দুজনের ওপরে। কফি সার্ভ হয়ে যেতেই বেরিয়ে গেল দুজনে। সবার শেষে রুম থেকে বেরোল আফসার। যাওয়ার আগে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে গেল ওদের দুজনের ওপরে।

ফাত্তাহ নিজের আগুনে দৃষ্টি স্থির করল কফির মগের ওপরে। সিগারটা এক হাত থেকে অন্য হাতে চালান করে কফির মগটা তুলে নিয়ে তাতে চুমুক দিল টানা দুবার। প্রফেসরও কফির মগ হাতে লক্ষ করছে ফাত্তাহকে। শেষ মন্তব্যটা করার পর এখনও ফাত্তাহ কিছু বলেনি। ফাত্তাহ আরও দুবার কফির মগে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল।

কোন এক মহাপুরুষ নাকি বলেছিল পৃথিবীতে মানুষের যত ধরনের ভালোবাসা আছে তার ভেতরে সবচেয়ে বিশুদ্ধতম ভালোবাসা হলো খাবার আর পানীয়ের প্রতি। কথাটা আরেকবার সঠিক প্রমাণিত হলো,” বলে সে নিজের হাতের সিগারটা প্রফেসরের দিকে তাক করে বলে উঠল, “তোমার কফি তোমাকে আরেকবার বাঁচিয়ে দিল প্রফেসর,” শেষ কথাটা বলার সময়ে তার মুখটা সামান্য হাসি হাসি হয়ে উঠতেই প্রফেসর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। “বলো প্রফেসর, কী জানতে চাও এগুলোর ব্যাপারে?” নিজের চেহারার বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো দেখাল সে ইশারায়।

“এগুলোর পেছনের ইতিহাস,” প্রফেসর দ্রুত বলে উঠল। ফাত্তাহর মুড পরিবর্তন হওয়ার আগেই তাকে আবারও পুরানো প্রসঙ্গে ফিরে যেতে হবে। কোনো অবস্থাতেই ট্র্যাক থেকে বেরোনো যাবে না। সময় খুবই কম, তবে কার জন্য সেটা অধিক কম সেটাই নির্ধারণ করে দিবে খেলাটায় কার চাল কী হবে এবং এর সর্বশেষ পরিণতি কী হবে। আগের কথাটুকু বলেই প্রফেসর ইশারায় তার চেহারাটা দেখাল। “কীভাবে হলো এগুলো?”

“তুমি বহুত চালু মাল প্রফেসর। দেখতে যতই সুন্দর আর ভ্যাবলা ভাব ধরো না কেন। তোমার মধ্যে বহুত প্যাচ। কিন্তু তোমাকে আমার ভালোই লাগছে। আমি তোমাকে বলব প্রফেসর এগুলোর পেছনের গল্প। কিন্তু তোমার মনে আছে তো? এরপর আমি তোমাকে প্রশ্ন করব। তোমাকে কিন্তু তখন জবাব দিতে হবে।”

“অবশ্যই,” জবাব দিল প্রফেসর। তার গলায় কোনো দ্বিধা বা শঙ্কা নেই। ভেতরে ভেতরে সে এক ধরনের পুলক বোধ করতে শুরু করেছে। অবশেষে সে তার ট্র্যাকে ফিরে আসতে শুরু করেছে। খেলাটার বড় চিত্রটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে তার কাছে। এই প্রথমবারের মতো প্রফেসরের মনে হলো, আজ রাতে তার বিজয়ী হওয়ার সম্ভবনা একেবারে নেই যে তা নয়। কিন্তু মনের ভাবনা মনেই রয়ে গেল। চেহারাটাকে নির্বিকার রেখে সে তাকিয়ে রইল ফাত্তাহর দিকে।

“এগুলোর পেছনের গল্পটাকে জানতে হলে তোমাকে এগুলোর পেছনে থাকা একজন মানুষের গল্প জানতে হবে। বুঝতে হবে সেই মানুষটাকে, ফাত্তাহর কথার সাথে সাথে তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে নীলচে ধোঁয়া। ধোঁয়া মিশ্রিত কথার চাইতেও ধোঁয়াশা মেশানো তার ফ্যাসফ্যাসে গলার স্বর। বর্তমান থেকে নয় বরং যেন সময় পরিভ্রমণ করে তার গলাটা ভেসে আসছে বহু বহু বছরের ফেলে আসা সুদূর কোনো অতীত থেকে।

“তুমি পারবে কি না জানি না কিন্তু যে মানুষটার গল্প আমি বলতে যাচ্ছি বেশিরভাগ মানুষই সেই মানুষটাকে খুব সহজেই বুঝে ফেলতে পারে। কারণ কি জানো?” ফাত্তাহ ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করল প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে। “কারণ সেই মানুষটা তোমার কিংবা তোমাদের সমাজের বাইরের আলাদা কোনো মানুষ নয়। ওই মানুষটা তোমাদেরই সমাজের সবার মাঝে মিশে থাকা খুবই সাধারণ একজন মানুষ। প্রতিদিন বাজারে গিয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে যার সাথে তোমাদের ধাক্কা লাগে। কিংবা, বাসের ভিড়ে ঝুলতে ঝুলতে যে মানুষটার পা মাড়িয়ে দিয়ে সরি বলার মতো ভদ্রতাটুকুও দেখায় না তোমাদের সমাজ। সেই সমাজেরই একজন সাধারণ ছেলে, একজন সাধারণ ভাই, সাধারণ একজন বাবার চেহারার সাথে মিলিয়ে দেখলে খুব সহজেই পেয়ে যাবে সেই মানুষটাকে। আর সে কারণেই এই মানুষটাকে বোঝাটা খুব কঠিন হবে না তোমাদের জন্য। সেই মানুষটারই গল্প শোনাব তোমাদেরকে,” ফাত্তাহর জ্বলজ্বলে ভালো চোখের দৃষ্টিতে যোগ হয়েছে ভিন্ন এক স্তর। স্মৃতিকাতরতা, যন্ত্রণা আর যাতনার কষাঘাতে জর্জরিত এক স্তর। ‘একজন সাধারণ মানুষের মানুষ থেকে অমানুষ হয়ে ওঠার গল্প।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *