শব্দজাল – ৭

এরকম টানটান পরিস্থিতিতেও প্রফেসরের মুখের চারপাশে বিদ্যমান পাইপের তামাকের হালকা সুগন্ধি ধোঁয়ার সাথে ঝুলে রয়েছে এক টুকরো মৃদু হাসি। সে সবসময়ই মনে করে প্রাণী হিসেবে মানুষের যে কয়টা বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে তার মধ্যে ভাষা হলো সবচেয়ে শক্তিশালী। শুধু বোমা নয়, মুখের কথাও যে বোমার মতোই শক্তিশালী আঘাত হানতে পারে এই কামরায় উপস্থিত থাকলে যে-কেউ সেটা অনুধাবন করতে পারত।

শেষ কয়টা বাক্য আফসারের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হওয়ামাত্র প্রথমে কয়েক সেকেন্ড সবাই চুপ করে রইল, তারপর প্রায় সাথে সাথেই রুমের সবাই একযোগে কথা বলতে শুরু করল উত্তেজিত ভঙ্গিতে। প্রফেসরের যদিও একটু বিরক্ত লাগছিল কারণ এ পর্যন্ত সে ফোনেই শুনেছে, বাকিটুকু তার জানা দরকার। কিন্তু সে এটাও বোঝে, এরকম কথা প্রথম শুনলে যে-কারো মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে মন্ত্রণালয় থেকে তিন সরকারি প্রতিনিধির প্রায় সবাই বিভিন্ন প্রশ্ন করতে শুরু করেছে।

“সর্বনাশ, তারপরও আমরা বসে আছি কেন?’

“ঘটনা কী? এই লোকের কথা কি সত্য?’

“বিদেশি প্রেসিডেন্ট আর প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা…’

“লোকটা ব্লাফ মারছে না, সেটা বোঝার উপায়-’

“এক মিনিট, এক মিনিট,” বলে আতিকুল আলম বসা থেকে উঠে আফসারের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। “সব বলছি, আগে শান্ত হয়ে শোনার চেষ্টা করুন সবাই। আগেই উত্তেজিত হবেন না। পরিস্থিতি খুব খারাপ আমি মানছি কিন্তু ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। আর সেজন্যই আমরা এখানে,” এই পর্যন্ত বলে সে একবার প্রফেসরকে দেখে নিল

প্রফেসরের মুখে কোনো বিকার নেই। পাইপ টানা শেষ করে সেটা টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে সামনের দিকে। চশমার ঘোলাটে কফি কাচের অন্যপাশে তার চোখের ভাষা পড়ার কোনো উপায় নেই।

আতিকুল আলম আফসার আর মারিয়ার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে শুরু করল, “পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য, আফসার নয় আমিই আপনাদের সবাইকে সব ব্যাখ্যা করে বলছি।”

“আগে বলুন, এরপর কী হলো?” উত্তেজিত মানুষগুলোর ভেতরে একমাত্র প্রফেসরই একদম শান্ত সুরে জানতে চাইল।

“হ্যাঁ, অ্যালবার্ট ফাত্তাহকে যে মুহূর্তে জানানো হলো তাকে আগামীকাল সকালে ইন্টারপোলের কাছে হস্তান্তর করা হবে সেই মুহূর্তে সে উলটো এই প্রস্তাব দেয় আমাদেরকে। তার প্রস্তাবটা খুবই অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক এবং হাস্যকর।”

“… কিন্তু ভয়ংকর,” সরকারি প্রতিনিধিদের একজন প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল।

আতিকুল আলম এবার কিছু না বলে স্রেফ চোখ নাচাল। ঘটনাটা সে ঠিকমতো বলতে না পেরে রীতিমতো বিরক্ত হতে শুরু করছে এখন। “আপনারা আগে পুরো ব্যাপারটা শুনুন। তা না হলে বুঝতে পারবেন না,” সে প্রায় ধমকে উঠে চুপ থাকতে বলল সবাইকে।

“ফাত্তাহর প্রস্তাবটা অনেকটা এরকম— সে ঢাকায় এসেছিল একটা বিশেষ অর্গানাইজেশনের হয়ে বিশেষ একটা কাজ করতে। সেটা সেরে ফিরে যাওয়ার সময়ে ধরা পড়ে সে। কাদের হয়ে কাজ করতে এসেছিল সেটা জানাতে অস্বীকার করে সে। কিন্তু কাজটা কী সেটা জানায়। আপনারা সবাই জানেন, আগামীকাল ঢাকায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রতিনিধিসহ তিন দেশের প্রেসিেিডন্টের উপস্থিতিতে আমাদের অনেক দিনের ঢাকাবাসীর স্বপ্ন সিটিরেল ও দেশের সবচেয়ে উঁচু স্থাপনাটার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ফাত্তাহর দাবি আগামীকাল অনুষ্ঠিতব্য অনুষ্ঠানগুলোর কোনো একটাতে বা একাধিক অনুষ্ঠানের আশেপাশে সে দুটো বোমা সেট করেছে। তার দাবি হলো, তাকে যদি ইন্টারপোলের হাতে তুলে দেওয়া হয় তবে এই বোমা দুটো কাল বিস্ফোরিত হবে। আর যদি তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় তবে সে আমাদেরকে জানিয়ে দেবে বোমা দুটো কোথায় আছে। “

“ সেটা কীভাবে জানাবে সে?” একজন সরকারি প্রতিনিধি জানতে চাইল।

“তাকে কীভাবে ছেড়ে দেওয়া হবে?” অপর প্রতিনিধির প্রশ্ন।

“তাকে একজন পাইলট আর একটা স্যাটেলাইট ফোনসহ একটা চার্টার করা প্লেন দিতে হবে। সেই প্লেনে করে সে নির্দিষ্ট দূরত্ব পার হওয়ার পর আমাদেরকে ফোন করে জানাবে বোমা দুটো কোথায় আছে।”

আতিকুল আলমের কথা শুনে দুয়েকজন হেসে উঠল। একজন হতাশ ভঙ্গিতে দুটো হাত তুলল। “এটা কোনো কথা! যদি সে আমাদের কবজা থেকে বেরোনোর পর বোমা দুটো কোথায় আছে সেটা না বলে তবে আমাদের কী করার থাকবে?”

আতিকুল আলম অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকাল। “তাকে বলা হয়েছে এই কথাটা, উত্তরে সে জানিয়েছে এটাই তার প্রস্তাব। আর তার প্রস্তাব মানতে হলে তাকে বিশ্বাস করতে হবে।”

“আপনারা একটা ভাইটাল পয়েন্ট মিস করছেন,” নিভে যাওয়া পাইপটা নাড়া চাড়া করতে করতে প্রফেসর অনেকটা মন্তব্য করার মতো করে বলে উঠল, “সে যে আসলেই বোমা সেট করেছে সেটার আদৌ কোনো সত্যতা আছে কি না?”

“আছে,” আতিকুল আলম বলে উঠল। “এখানে আমি একটু যোগ করতে চাই। তার কথা সত্য হোক না হোক। সে এই কথা বলার পর প্রথমেই আমরা যেটা করি সেটা হলো তিন দেশের প্রেসিডেন্ট এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টকে আমরা ঢাকার বাইরে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলি এবং সাথে সাথে আমাদের বোম স্কোয়াড অ্যাকটিভ হয়ে কাজ করতে শুরু করে।”

“এগুলো অ্যালবার্ট ফাত্তাহও জানে,” প্রফেসর একটা আঙুল তুলল। “যদি সে সত্যি সত্যি বোমা সেট করে থেকে থাকে সে বোমা দুটোর কথা বলার পর কী ঘটতে পারে সেটা সে ঠিকই জানত। কাজেই তার সেট করা বোমা কিংবা বোমাগুলো থেকে থাকলে সেগুলো যে কেউ খুঁজে পাবে না এই ব্যাপারে সে নিশ্চিত না হলে এই প্রস্তাব সে দিতই না।”

“তা ঠিক। কিন্তু আমাদেরকেও তো ডেকোরাম ফলো করতেই হতো,“ আতিকুল আলম চিন্তিত ভঙ্গিতে তার চুলগুলো মুঠো করে টেনে ধরে ছেড়ে দিল। “তবে বোমা যে সেট করেছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ তা না হলে এই দেশে সে আসবে কেন? তার মতো একজন লোক বেড়াতে নিশ্চই আসেনি! তাও এরকম একটা সিকিউরিটি রিস্কের সময়ে।”

প্রফেসর সম্মতির সাথে মাথা নাড়ল।

“এক মিনিট, আপনি কে?” হঠাৎ সরকারি প্রতিনিধিদের একজন প্রফেসরকে নির্দেশ করে বলে উঠল। প্রফেসর তার দিকে ফিরে জবাব দিতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই আতিকুল আলম টেবিলের সামনে থেকে কথা বলে উঠল। “ওনার পরিচয় যথাসময়ে দেওয়া হবে। তার আগে আমাদের হাতে থাকা অপশনগুলো আমরা যাচাই করে দেখতে চাই। আফসার বলো,” বলে সে আবারও বসে পড়ল।

খুব স্মার্ট একটা ভঙ্গি করে স্লাইডের রিমোট হাতে দাঁড়িয়ে গেল আফসার “পুরো ব্যাপারটাতে বেশ কিছু কনফিউশন আছে। প্ল্যান অব অ্যাকশন বুঝতে হলে সেগুলো বোঝাটাও জরুরি। প্রথম প্রশ্ন, অ্যালবার্ট ফাত্তাহ কি আদৌ ঢাকা শহরে কোনো বোমা সেট করেছে কি না?” বলে সে সবাইকে দেখে নিয়ে বলে উঠল, “আমাদের এক্সপার্ট টিমের ক্যালকুলেশন অনুযায়ী, সে করেছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন, তাকে কি আমরা ইন্টারপোলের হাতে তুলে দেব, নাকি নিজেদের কাছে রেখে দেব, নাকি তার কথামতো ছেড়ে দেব?” আফসার কাঁধ ঝাঁকাল।

“যদি তাকে আমরা ইন্টারপোলের হাতে তুলে দিই তবে বোমা থেকে থাকলে সেটা বিস্ফোরিত হবে। এখানে বলে রাখি যদি বোমার ঝুঁকি থেকেই থাকে তবুও এত বড় আয়োজনের তিন-তিনটে অনুষ্ঠার বাতিল করাটা একটা বিরাট ঝক্কির ব্যাপার— আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ইমেজের ব্যাপার। আর তাছাড়া কোনো অবস্থাতেই এত অল্প সময়ে ঢাকা শহরে বসবাসরত এত এত মানুষ সরানো সম্ভব নয়। আর বোমাটা সে সম্ভাব্য কোথায় সেট করতে পারে সেটা নিয়ে কাজ চললেও সেগুলো খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত কিংবা ফাত্তাহ নিজ থেকে না বলা পর্যন্ত বোমা নিষ্ক্রিয় করার কোনো সম্ভবনাও থাকছে না। কাজেই মানুষের প্রাণের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।”

“দ্বিতীয় অপশন, ফাত্তাহকে দীর্ঘসময় আমাদের কাছে রাখার কোনো উপায় নেই। রাখলে কোনো লাভও নেই আমাদের। উলটো আমাদের ওপরে ইন্টারপোলের বিরাট চাপ আছে। তৃতীয় অপশন, এই অবস্থায় সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, ফাত্তাহকে আমরা ছেড়ে দেব কি না? এই প্রশ্নের প্রাথমিক জবাব হলো, এরকম একজন মানুষকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই, কোনো কারণও নেই। তাকে ছেড়ে দিলেই যে সে বোমার লোকেশন বলবে এমনটা ভাবারও কোনো সুযোগ নেই। কাজেই উপায় আমাদের হাতে একটাই,” বলে আফসার একটু নাটকীয়ভাবে সবার দিকে তাকিয়ে চোখ নাড়ল।

“তার ভাষ্য এবং আমাদের হিসেব মতে সে যদি ঢাকায় বোমা সেট করেও থাকে সেটা তবে বোমাগুলো আজ রাতের ভেতরে বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভবনা খুবই কম। বরং জোরদার সম্ভবনা সেগুলো বিস্ফোরিত হবে আগামীকাল, সম্ভবত আয়োজিত অনুষ্ঠানগুলোর সময়ে। কাজেই আজ রাতে আমাদের হাতে যে সময় আছে এই সময়ের ভেতরে যেকোনো উপায়ে তার কাছ থেকে বোমার অবস্থানগত তথ্য আমাদের আদায় করতে হবে। গুরুতর এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার এই একটাই রাস্তা খোলা আছে আমাদের হাতে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *