শব্দজাল – ১৬

১৬

কথা বলতে বলতে আঙুলের টোকায় ছাই ঝাড়ল ফাত্তাহ।

“তোমার কথাই ঠিক প্রফেসর, এই পৃথিবীতে কেউই দানব হয়ে জন্মায় না। তোমাদের সমাজ,” বলে সে সিগার ঘুরিয়ে চারপাশটা দেখাল। “যেটাকে তোমরা সভ্য-সুশীল সমাজ বলো সেই সভ্য-সুশীল সমাজই জন্ম দেয় দানবের,” বলে সে একটু থামল।

“মানুষ এমন এক প্রাণী যে সবকিছু পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। এনথ্রোপলজির একটা থিয়োরি আছে, যেখানে মানুষের জীবনটাকে বর্ণনা করা হয় ছোট-ছোট বৃত্তের সাথে। এই থিয়োরিকে বলা হয় লাইফ সার্কেল থিয়োরি। মানুষের সমস্ত জীবনটা নাকি ছোট ছোট সামাজিক বৃত্তের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। পরিবার-সমাজ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবার প্রতিটি জায়গাতে গড়ে ওঠে মানুষের ছোট ছোট সামাজিক সার্কেল মানে বৃত্ত। আর এরকম অসংখ্য ছোট-ছোট বৃত্তের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একজন মানুষের জীবন,” বলে সে মুখ তুলে বলে উঠল, “মানুষের সমস্ত জীবন ধরে এরকম অসংখ্য ছোট ছোট বৃত্তের

পরিক্রমা চলতেই থাকে। প্রতিটি মানুষের জীবনে প্রতিনিয়ত এই বৃত্ত ভাঙা-গড়ার খেলা চলে। মানুষ পার হতে পারে না একমাত্র ডেথ সার্কেল। মৃত্যুই হলো একমাত্র বৃত্ত যেটা মানুষ ভেদ করতে পারে না,” বলে সে জোরে হেসে উঠল। “যেটা আমি ভেদ করেছিলাম,” বলে সে জোরে জোরে হাসতে লাগল।

প্রফেসরও সামান্য হেসে উঠল তার সাথে। কিন্তু কিছু বলল না।

“তোমাকে আগে যতটুকু বলেছি জীবনের প্রথম ধাপে ঘটে যাওয়া দাঙ্গা- বাবা আর ছোটবোনের মৃত্যুর বীভৎস ঘটনা পেছনে ফেলে আমরা লাহোরে চলে যাই। সেদিন রাতে মা আমাকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার পর আমি আর মা সাঁতরাতে সাঁতরাতে যখন মরার দশা প্রায় এমন সময়ে একটা নৌকা আমাদের দুজনকে তুলে নিয়ে কাছের একটা ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। ওখান থেকে আমরা লাহোর চলে যাই। আমি আর আমার মা ওখানেই আমাদের জীবন গড়ে তুলি। তবে ওখানে আমাদের জীবনটা খুব বেশি আনন্দের ছিল না। আমি ছোট ছিলাম তাই বাবা-বোনের মৃত্যুর সেইসব বীভৎস স্মৃতিগুলো ভুলে যেতে পেরেছিলাম খুব সহজেই। আসলে ভুলতে পারিনি, কিন্তু ভুলে যাওয়ার চেষ্টা অন্তত করতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার মা সেসব ভয়ংকর স্মৃতি পেছনে ফেলে আসতে পারেনি। বিশেষ করে আমার ছোট বোনটার মৃত্যু সে মেনে নিতে পারছিল না কিছুতেই। রাতবিরাতে জেগে উঠত। আর তাই ওই বয়সেই মা খুব সহজেই বুড়িয়ে যেতে থাকে। তার জীবনও খুব বেশি দীর্ঘায়িত হয়নি। আমার আজ মনে পড়ে কোনো এক ঝড়ের রাতে মা’র পাগলামি চরমে ওঠে। সে রাতে না ছিল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার উপায়, না ছিল তার চিকিৎসা করানোর উপায়। সারারাত মাকে নিয়ে আমি একটা কিশোর ছেলে বসে ছিলাম ভোরের অপেক্ষায়। কী যে ভয়ংকর এক রাত ছিল সেটা। আমি চাইব আমার শত্রুর জীবনেও যেন এমন রাত না আসে।”

“নিজের মানুষকে চোখের সামনে যন্ত্রণা পেতে দেখার চেয়ে বাজে দুঃস্বপ্ন আর হতে পারে না,” প্রফেসর আনমনেই বলে উঠল। “বিশেষ করে যদি এমন হয় যেখানে কিছুই করার থাকে না।”

“ঠিক বলেছ প্রফেসর, সেই রাতে আমার কিছুই করার ছিল না। মাকে সারারাত ওভাবে তড়পাতে দেখা ছাড়া। ভোরের দিকে দিন যখন প্রায় পরিষ্কার হয়ে আসছিল সে-সময় মা মারা যায়। মাকে দাফন করার পর আমি অনুভব করতে পারি আমার পৃথিবী কতটা ছোট হয়ে এসেছে। প্রথমবারের মতো পরিবার হারানোর শোক আমাকে প্রায় পাগল বানিয়ে ফেলে। হয়তো আমি পুরোপুরি পাগলই হয়ে যেতাম কিন্তু আমাকে আক্ষরিক অর্থে উদ্ধার করে এক চাচা। এই মানুষটা না থাকলে আমি লাহোরের ওই চিপা গলিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতাম।”

প্রফেসরের মুখের ডগায় প্রায় চলে এসেছিল তাহলেই সবদিক থেকে ভালো হতো। আজ আমাদেরকে এখানে এই অবস্থায় পুরো শহর ধ্বংসের আতঙ্ক নিয়ে বসে থাকতে হতো না। কিন্তু সে-কথা তো বললই না বরং মনে মনে তার ভিন্ন এক ভাবনা খেলে গেল। তার দীর্ঘ কর্ম জীবনের অভিজ্ঞতায় সে একটা ব্যাপার জানে। পৃথিবীতে যা হয় তার কোনোটাই ফেলনা নয়। যা হয় এর পেছনে একটা না একটা কারণ অবশ্যই থাকে। আর সেই কারণের ভেতর থেকে ভালো কিংবা মন্দটা বের করে আনার দায়িত্ব মানুষেরই। আজ রাতে এখানে যা ঘটছে সেটার ভেতর থেকেও ভালোটা বের করে আনতে হবে তাকে।

“তো মায়ের ওই বীভৎস মৃত্যুর পর চাচা আমার দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। যদিও আমি থাকতাম আমাদের ছোট্ট বাড়িতেই কিন্তু আমার পড়ালেখা থেকে শুরু করে জীবনযাপন এমনকি খাওয়া-দাওয়ারও দায়িত্ব ছিল চাচার ওপরে,” বলে ফাত্তাহ হাসতে লাগল। “চাচা যখন আমার দায়িত্ব নিয়ে নিল আমি সবসময় ভাবতাম মর্ত্যের এই পৃথিবীতে আসলেই ফেরেশতা বলে যদি কেউ থেকে থাকে তবে সেটা এই মানুষটা। হায় খোদা,” বলে সে হাসতেই থাকল। “কত বোকা আর সরল ছিলাম আমি।”

“কেন? সে কি কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আপনার দেখভাল করছিল নাকি?” প্রফেসর জানতে চাইল।

“হা-হা-হা,” ফাত্তাহ হেসেই চলেছে। “একটা নয় এক হাজারটা উদ্দেশ্য নিয়ে সে আমার প্রতিপালন করছিল। লাহোরের উপকণ্ঠে আমার প্রয়াত পিতার বেশ কিছু জমি ছিল। বাবার মৃত্যুর পর যেগুলো মার নামে হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মা ওগুলো নিয়ে মোটেই চিন্তিত ছিল না। আর মার মৃত্যুর পর পরিবারের শেষ জীবিত ওয়ারিশ হিসেবে আমিই ছিলাম ওগুলোর একমাত্র উত্তরাধিকারী। আমি এগুলোর কিছুই জানতাম না। আমার সম্মানিত চাচা আমাকে ওসবের কথা কোনোদিন জানতেও দেয়নি। ওগুলোর পুরোটাই সে দখল করে নেয়। আর সেই দখলও করে খুব অভিনব উপায়ে। আমার কলেজ জীবন শেষ হওয়ার পর তার এক দুঃসম্পর্কের চাচাতো ভাই–যে থাকত নিউইয়র্কে— তার কাছে পাঠিয়ে দেয় আমাকে।”

“ভালোই তো, স্বপ্নের দেশ— স্বপ্নের শহরে পাঠিয়ে দেয় আপনাকে, বলে প্রফেসর হেসে উঠল। “বেশিরভাগ মানুষকে বাথরুম সাফ করার নামেও ওই দেশে পাঠালে তাদের জীবন ধন্য হয়ে যায়।”

প্রফেসরের কথা শুনে ফাত্তাহ হাসির চোটে প্রায় সোজা হয়ে গেল। হাতের নিভে আসা সিগারটা প্রফেসরের দিকে তাক করে সে বলে উঠল, “অনেকক্ষণ পর একটা ভালো কথা বলেছ প্রফেসর। এইসব দেশের মানুষদেরকে নিম্নতর কোনো কাজের জন্য ওসব দেশে পাঠিয়ে দিলেও এদের জীবন ধন্য হয়ে যায়। হা-হা-হা,” ফাত্তাহ এত জোরে হেসে উঠল যে প্রফেসরের মনে হলো হঠাৎ বাজি ফুটলে যেমন চমকে ওঠে মানুষ সেও ওরকম চমকে উঠল। “একদম ঠিক, একদম ঠিক।”

ফাত্তাহ হেসেই চলেছে। “তবে এই গাধাগুলো এটা জানে না, কতটা ফাঁপা হতে পারে বড় বড় বিল্ডিং-এর আদলে সাজানো ওসব সুন্দর শহরের ভেতরটা। কতটা কষ্টকর হতে পারে সুন্দর সাজানো-গোছানোর মাঝে মাথা নিচু করে বেঁচে থাকাটা। যাই হোক, সেগুলো তো আর আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমার ব্যাপারটা ভিন্ন,” বলে সে থেমে গেল।

একটু দম নিয়ে আবারও শুরু করল। “শুনতে যতই ভালো শোনাক না কেন আসলে আমার চাচা আমাকে সেখানে পাঠায় একাধিক উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে। সে আমার নামে থাকা সব সম্পত্তি হাতাতে চাইছিল, যে কারণে আমাকে বিদেশ পাঠালে তার জন্য সেটা করতে সুবিধে হবে। এর পাশাপাশি সে আমাকে যে তিন বছর ধরে দেখভাল করেছে তারপর বিদেশ পাঠিয়েছে এটার পেছনে আরেকটা বড় কারণ ছিল। সে নিউইয়র্কে তার যে চাচাতো ভাইয়ের কাছে আমাকে পাঠিয়েছিল সেই চাচাতো ভাইয়ের একটা প্রতিবন্ধী মেয়ে ছিল। আমার মায়ের মৃত্যুর পর-পরই আমার চাচা নিউইয়র্কের ওই চাচাতো ভাইয়ের সাথে একটা ডিল করে। সে ওই চাচাতো ভাইকে জানায় তার কাছে এরকম একটা ছেলে আছে যাকে সে চাইলে ভবিষ্যতে তার মেয়ের জামাই করতে পারবে।”

“সেই পুরানো গল্প,” প্রফেসর যোগ করল। “দেশ বদলায়, সমাজ বদলায়, পরিবার বদলায়। কিন্তু স্বার্থপরতা আর নিচুতার গল্পগুলো একই রয়ে যায় সবখানে।”

“মা মারা যাওয়ার পর আমার চাচা আমার যে ভরণপোষণ করেছিল সেটা সে পুরোটাই করত তার সেই ভাইয়ের পাঠানো টাকা দিয়ে। এমনকি আমাকে যখন সে বিদেশ পাঠায় তখনও সে অনেক টাকা নিয়েছিল সেই ভাইয়ের কাছ থেকে। এসবের কিছুই আমি জানতাম না। জেনেছি অনেক পরে। যাই হোক, তো আমার চাচা আমাকে নিয়ে বেশ ভালো ধান্দা করে আমাকে পাঠিয়ে দিল নিউইয়র্কে। লাহোরের পাট চুকিয়ে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে আমি রওনা দিলাম বিদেশে। নতুন জীবন, নতুন পরিবার, নতুন মানুষ সবই একেবারে আলাদা। দুঃসম্পর্কের হলেও যার বাড়িতে গিয়ে উঠলাম সেও আমার চাচা। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা খুব বেশি নয়। সুন্দর গোছানো পরিবার। নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা তার। আমার চাচা ভাবত চমৎকার পরিবারটার মধ্যে একটাই ভয়াবহ খুঁতের মতো ক্ষত হলো তার প্রতিবন্ধী মেয়েটা। যদিও সেটা আদতে সত্য নয়। যাই হোক, এই মেয়েটার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য এবং,” বলে ফাত্তাহ একটা হাত তুলল। “ঘরজামাই করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আমাকে। কী অদ্ভুত এক সমাজে বাস করি আমরা, প্রফেসর। ব্যাপারটার মধ্যে যে বীভৎস একটা কৌতুক আছে সেটা কি ধরতে পারছ তুমি? একটা ছেলে যে তার পরিবার হারিয়েছে অন্য এক রাষ্ট্রের ইস্যুতে— যেখানে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছে তার নিজের কোনো দোষ ছাড়াই। সেই ছেলেটাই তার মাকে হারিয়েছে চরমতম কষ্টের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে, সেই ছেলে যার কোটি টাকার সম্পদ আছে, কিন্তু সেই সম্পদ অন্য লোকেরা দখল করার জন্য তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত শহরে, অন্য এক পরিবারের একমাত্র খুঁতটাকে ঠিক করার জন্য,” প্রতিটি উচ্চারিত বাক্যের সাথে সাথে ফাত্তাহর গলার স্বর উঁচু থেকে উচ্চতর হচ্ছে। শেষ বাক্যটা উচ্চারণ করেই সে হেসে উঠল। “কে জানি বলেছিল, যার বাবা-মা নেই তার আসলে পৃথিবীতে কেউই নেই। কথাটা খুবই সত্য। কিন্তু এটাও আসলে মজার ব্যাপার নয়,” বলে ফাত্তাহ থেমে গেল।

প্রফেসর তার দিকে তাকিয়ে আছে। চেহারায় কোনো ভাব নেই। খুব স্বাভাবিক গলায় সে জানতে চাইল, “তাহলে মজার ব্যাপরটা কী?”

ফাত্তাহ টেবিলের ওপরে ঝুঁকে বলতে লাগল। “মজার ব্যাপার হলো, আমি নিউইয়র্কে গিয়ে সেই পরিবারটার সাথে বাস করতে করতে তাদেরকে ভালোবেসে ফেললাম। আগেই বলেছি আমার সেই চাচার পরিবার বেশ গোছানো এবং সুন্দর। চাচা মানুষ হিসেবেও খুব ভালো। এমনিতে বেশ সুনাম আছে তার। এমনকি ব্যবসায়ী হিসেবেও সে খুবই ভালো এবং সৎ। দুই ছেলেমেয়ে আর স্ত্রী নিয়ে তার পরিবার। সেই পরিবারের সাথে যুক্ত হয়ে আমার দিনগুলোও বেশ চমৎকার কাটতে লাগল। কুইন্সে থাকতাম আমরা। যেখানে থাকতাম তার কাছেই চাচার দেশি হালাল রেস্তোরাঁ ছিল। সেইসাথে তার বেকারি ব্যবসা। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজন মুসলিম শ্রমিক কাজ করত তার বেকারিতে। আর রেস্টুরেন্টে আরও আট-দশজন। পরিবারের সদস্য হিসেবে আমিও চাচার ব্যবসার সাথে কাজ করতে লাগলাম। আমার বয়স তখন আঠারো। আর কয়েক বছর পর প্রাপ্তবয়ষ্ক হলেই চাচার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হবে, এমনটাই জানতাম আমি। সবাই জানত। সব ঠিক থাকার পরও আশেপাশের সবাই খুব করুণার দৃষ্টিতে তাকাত আমার দিকে। প্রফেসর তুমি যদি এই মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে গিয়ে না থাকো তবে কোনোদিনই বুঝতে পরবে না, এ-যে কী নিদারুণ কষ্ট। আমরা মানুষেরা সবসময়ই বলি আমার আশেপাশের লোকজন কী বলছে সেটা আমরা কেয়ার করি না। কিন্তু সত্যি কথা হলো আমরা বেঁচেই থাকি আমাদের আশেপাশের লোকজনের চোখে বড় হয়ে থাকার জন্য। আর তাই লাহোরের সেই অনিশ্চিত জীবন থেকে নিউইয়র্কের নিশ্চিত জীবনে থেকেও আমি মোটেও সুখী ছিলাম না শুধুমাত্র এই একটা কারণে। তবে —” বলে ফাত্তাহ থেমে গেল। হতের সিগার শেষ হয়ে গেছে অনেক আগে। সে বাক্স খুলে আরকেটা নিয়ে নিল।

সিগার ধরিয়ে হাসতে লাগল, “আমি যখন নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, একবার আমাদের এক স্যার অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিল। টাইটেলটা ছিল অনেকটা এরকম; জীবন আসলে কী?” ফাত্তাহ সিগার ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলতে লাগল। “আমি অনেক ভেবে, অনেক চিন্তা করেও অ্যাসাইনমেন্টটা লিখতে পারিনি। কারণ জীবনের মানে আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না তখন। কিন্তু এখন যখনই ভাবি জীবনটা আসলে কী খুব সহজেই উত্তর পেয়ে যাই। আমার কাছে মনে হয় জীবনটা আসলে কী জানো প্রফেসর?” ফাত্তাহ মুখটাকে আরেকটু সামনের দিকে এগিয়ে আনল।

“জীবনটা আসলে একটা পুরানো কৌতুক। যেটার পাঞ্চলাইন আমরা সবাই জানি, তবুও বারবার শুনলে কখনো হাসি পায়, আবার কখনো হাসি পায় না।”

“আবার কখনো কখনো নেই পুরানো জানা পাঞ্চলাইন শুনেও বাধ্য হয়ে আমাদেরকে হাসতে হয়,” প্রফেসর আনমনেই বলে উঠল।

ফাত্তাহ টেবিলের ওপরে একটা চাটি মারল, “সাব্বাস আমার ফ্রয়েড, বলে সে জোরে হেসে উঠল।

“তারপর কী হলো?’ প্রফেসর প্রসঙ্গে ফিরতে চাইছে।

“মজার ব্যাপার হলো, আমার সমাজের চারপাশের প্রতিটা মানুষ আমাকে করুণার দৃষ্টিতে দেখত এই করুণার ব্যাপারটা নিয়ে আমি অসুখী ছিলাম। কিন্তু যে বিষয়টা নিয়ে আমাকে করুণা করা হতো সেটা নিয়ে আমি অসুখি ছিলাম না। আমার চাচার একমাত্র মেয়ে সাহেরা, আমার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট ছিল সে। তার কথা বলায় সমস্যা ছিল। আর চিন্তা-ভাবনা একটু অপরিণত ছিল। আমি তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম এবং সত্যি কথা হলো তাকে বিয়ে করার অনেক আগেই আমি তার প্রেমে পড়ে যাই। সবাই যখন ভাবত এই ছেলেটাকে অসুস্থ একটা মেয়ের সাথে বিয়ে দেওয়া হবে- করুণা করত। আর আমি যখনই ভাবতাম সাহেরার সাথে আমার একদিন বিয়ে হবে, ব্যাপারটা ভাবতেই পুলকিত হতাম আমি,” ফাত্তাহ একটু থেমে আবারও বলতে লাগল।

“যথা সময়ে সাহেরার সাথে আমার বিয়ে হলো। কিন্তু একটা ব্যাপার আমাকে মাঝে মাঝেই কষ্ট দিত। সেটা হলো এই রেস্টুরেন্ট আর বেকারির ব্যবসায় ব্যস্ত থাকলেও আমার মন অস্থির হয়ে উঠত পড়ালেখা করার জন্য। আমার শুধু মনে হতো আমি আরও বড় কিছু করতে চাই। সেই হিসেবেই বিয়ের এক বছরের মাথায় আমি আমার চাচা অর্থাৎ শ্বশুরকে বলি আমি পড়ালেখা করতে চাই। আমি ভেবেছিলাম তিনি রাজি হবেন না। কিন্তু তিনি খুশি মনেই রাজি হয়ে গেলেন। আমি ভর্তি হলাম নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে পড়ার সময় নতুন এক প্রেমিকার সন্ধান পেলাম আমি। কেমিস্ট্রি।”

“এটাই আপনার জীবনকে পালটে দিল, তাই না?” একটু ফোড়ন কাটার মতো করে বলে উঠল প্রফেসর।

“হা-হা,” করে হেসে উঠল ফাত্তাহ, “আসলে তা নয়। আমাকে বদলে দেয় তোমাদের এই তথাকথিত সমাজ, আইন ব্যবস্থা— যেটাকে আমরা সর্বোপরি সিস্টেম বলি। কেমিস্ট্রি বা সায়েন্স নয় আমাকে বদলে দেয় সিস্টেম। আমার মতো দানব তৈরি করে তোমাদের মতো সুশীলদের দ্বারা নির্মিত সিস্টেম। যাই হোক, আমি গ্র্যাজুয়েশন করে মাস্টার্স করি। ততদিনে আমার চাচা এবং চাচি দুজনেই পরলোকগত হয়েছেন। পারিবারিক ব্যবসা সামলায় আমার স্ত্রীর বড় ভাই। ততদিনে ওসব থেকে আমি আগ্রহ হারিয়েছি আমি পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কেমিস্ট্রি নিয়েই বাকি জীবনটা পার করে দেব। সেই হিসেবেই মাস্টার্স করে একটা কলেজে কেমিস্ট্রি টিচার হিসেবে ঢুকে যাই সেইসাথে ডক্টরেটে এনরোল করি সিটি ইউনিভার্সিটিতেই। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল এরই মাঝে আমাদের কোল জুড়ে আসে একমাত্র ছেলে, “ ফাত্তাহর গলা আবারও সরে গেছে বহুদূরে। গলার স্বরের ভাঁজে সযত্নে লুকিয়ে রাখা আবেগ দিশেহারা হয়ে মাঝে মাঝে উপচে পড়ছে তার কথা থেকে। সেই আবেগে ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করছে স্মৃতি কাতরতা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *