শব্দজাল – ২২

২২

ফাত্তাহর শেষ কথাগুলো শোনার সাথে সাথে প্রথমবারের মতো প্রফেসরের আফসোস হলো ডান কানের সাথে লাগানো এয়ারপিসটা ছুড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য। আফসারের প্রতিক্রিয়া জানার কোনো সুযোগ হবে না তার। তবে সে এটা জানে ফাত্তাহর মুখ থেকে যেইমাত্র তৃতীয় বোমার ব্যাপারটা উচ্চারিত হয়েছে সেই মুহূর্তে কমিউনিকেশ রুমে সেই তথ্য বোমার মতোই বিস্ফোরিত হয়েছে। এমনকি সেকেন্ডের জন্য সে কুমড়ো আর টুথপিকের হাঁ হয়ে থাকা চেহারাটাও কল্পনায় দেখতে পেল সে।

হঠাৎ আপনার দিকে কেউ কিছু একটা ছুড়ে দিলে স্রেফ প্রবৃত্তির বলে মানুষ যেমন মাথা নিচু করে ফেলে কিংবা মুখ ঢেকে ফেলে হাত দিয়ে। হঠাৎ সামনে ঝোঁপের মধ্যে সাপ কিংবা জোঁক দেখলে যেমন চিন্তা না করেই পিছিয়ে যায়, ফাত্তাহর কথা শোনার প্রায় সাথে সাথে অনেকটা সেরকম প্রবৃত্তির বশেই একটা হাত তুলল সে আয়নার দিকে। আফসারসহ বাকিদেরকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য এটা একটা ইশারা, যাতে তারা উত্তেজিত না হয়।

তারপর ফাত্তাহর দিকে শান্তভাবে ফিরে তাকিয়ে বলে উঠল, “তুমি মিথ্যে ধোঁকা দিচ্ছ না সেটার নিশ্চয়তা কে দেবে?” তার গলা এখন একেবারেই শান্ত। এতটু আগের উত্তেজনার ছিটেফোঁটাও নেই।

ফাত্তাহও খুব শান্ত গলায় জবাব দিল, “আজ সন্ধ্যায় আমি যা বলেছিলাম সেটারও তো কোনো নিশ্চয়তা ছিল না কিন্তু সেটা তো সত্যি প্রমাণিত হয়েছে তাই না?” বলে সে হাসির সুরে জানতে চাইল, “বোমা দুটো তো তোমরা পেয়েছ, তাই না?”

প্রফেসর কিছু না বলে স্রেফ মাথা নাড়ল। “কিন্তু একটা ব্যাপার এখনও আমার কাছে পরিষ্কার হলো না। তুমি যদি আমার কথোপকথনের ভেতরে থাকা মাইন্ড গেম পুরোটাই বুঝতে পেরেছিলে তবে তুমি কেন বোমা দুটোর অবস্থান জানালে? ওই দুটোর কথা না জানালেও তো কোনো সমস্যা ছিল না। যদি সময়ক্ষেপণই তোমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে শুধু সেটা করলেই তো চলত তাই না? বোমা দুটোর অবস্থান জানানোর কোনো কারণ তো আমি দেখতে পাচ্ছি না।”

“কারণ আছে প্রফেসর,” ফাত্তাহ খুবই সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে উঠল “কারণটা ঘটেছে আজ সন্ধ্যায় যখন আমি ধরা পড়ি। তবে সেই কারণটা ব্যাখ্যা করার আগে অন্য একটা ঘটনা ব্যাখ্যা করতে হবে,” বলে সে একবার নিঃশ্বাস ছাড়ল।

“তুমি সাইবার পাঙ্ক ব্যাপারটা বোঝ প্রফেসর?”

প্রফেসর মাথা নেড়ে জানাল সে বোঝে ব্যাপারটা কী।

“ভেরি গুড। তাহলে আমার জন্য ব্যাখ্যা করতে সুবিধে হবে। সাল ২০১১ তে জার্মানির কলেজ পড়ুয়া এক ছেলে তার বাড়ির সাধারণ কম্পিউটারে বসে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর একটির ফায়ারওয়াল ভেদ করে ঢুকে যায় স্ব-আবিষ্কৃত একটা ভাইরাস ব্যবহার করে। সেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকগুলা ব্যাপারটা টের পেয়ে কয়েক ঘণ্টার ভেতরে সেই ভাইরাসটা ডিটেক্ট করে সেটাকে রিমুভ করে সিস্টেম নিরাপদ করে ফেলে। এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এতে একটা টুইস্ট ছিল,” বলে প্রফেসর মৃদু হেসে উঠল।

“আসলে ছেলেটাকে তারা যতটা ব্রিলিয়ান্ট ভেবেছিল সে ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি মেধাবী। খুব স্বাভাবিকভাবে যেকোনো সিস্টেমে যখন কেউ একটা ভাইরাস ধরতে পারবে ওটাকে রিমুভ করে সিস্টেম নিরাপদ করাটাই হবে মূল উদ্দেশ্য। আর এই স্বাভাবিক ব্যাপারটাকেই অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায় জার্মানির সেই হ্যাকার ছেলেটা। সে জানত সিস্টেমে ভাইরাস ধরা পড়তেই সবাই সেটাকে রিমুভ করবে আগে। আর তাই সে একটা বিশেষ ব্যবস্থা করে রাখে। যেই মুহূর্তে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা সেই ভাইরাস ডিটেক্ট করে রিমুভ করে দেয় সিস্টেম থেকে, সেই রিমুভালটা একটা ট্রিগারের মতো কাজ করে। কীসের ট্রিগার? আসলে সেই সিস্টেমে ছেলেটা ভাইরাস ঢুকিয়েছিল দুটো। সিস্টেমটাকে সে এমনভাবে সাজিয়েছিল যে দুটো ভাইরাস একসাথে সিস্টেমে ঢোকাবে, একটা অ্যাকটিভ থাকবে অন্যটা চুপচাপ থাকবে। প্রথম ভাইরাসটা যে মুহূর্তে রিমুভ করা হবে সিস্টেম থেকে সাথে সাথে দ্বিতীয় ভাইরাসটা কাজ শুরু করবে। এবং… এই দ্বিতীয় ভাইরাসটিই প্রকৃত ভাইরাস যেটা দিয়ে সে সিস্টেমটা ক্রাশ করাতে চাইছিল এবং সেটা করতে সমর্থ হয় সে।”

“এই ঘটনার সাথে তোমার সম্পর্ক কী?” ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল প্রফেসর। “তুমি তো আর হ্যাকার নও।”

“একদম ঠিক প্রফেসর। আমি হ্যাকার নই। কিন্তু ওই ঘটনা থেকে আমি ডেমোলিশনের মানে বোমাবাজির নতুন একটা আইডিয়া দাঁড় করাই। সিরিজ বোমা।”

“সিরিজ বোমা তো নতুন কিছু না। এর আগে—“

“আমারটা নতুন,” ফাত্তাহ একটা হাত তুলে বলে উঠল। “আমি তিনটে বোমা সেট করি ঢাকাতে। এর মধ্যে যে দুটো বোমা তোমরা পেয়েছ সেগুলো আসলেই ছিল হোক্স, মানে আইওয়াশ, ঠিক ওই প্রথম ভাইরাসের মতো। তবে ওই বোমা দুটোর একটা পারপাস ছিল। এই ধরনের বোমাকে আমরা বলি সিরিয়াল বোমা। এই বোমাগুলো এমনভাবে সাজানো হয় যাতে একটা ফাটলে পরেরটা অ্যাকটিভেট হয়। কিন্তু আমি সেগুলোকে আরও ডেভলপ করেছি। আমি এই ক্ষেত্রে এমনভাবে সিরিজটা সাজিয়েছি যাতে প্রথম একটা বোমা ফাটক বা ডি অ্যাক্টিভেট হোক, সাথে সাথে পরেরটা অ্যাকটিভ হয়ে যাবে। আমার প্ল্যান ছিল, আমি বোমাগুলো সেট করে প্লেনে উড়াল দেওয়ার পর আমার একজন অপারেটিভ এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে যাবে প্ৰথম দুটো বোমার যেকোনো একটার অবস্থানের কাছে। যদি কোনো বোমা ধরা পড়ে যায় তাহলে তো কোনো কথাই নেই। সেটা ব্লাস্ট হোক কিংবা ডি-অ্যাক্টিভেট হোক অন্য বোমাগুলো চালু হয়ে যাবে। কিন্তু আমি ধরা পড়ার সময়ে সেই লোকটা গোলাগুলিতে মারা পড়ল। সেক্ষেত্রে আমার ওই বোমা দুটোর মাধ্যমে তৃতীয় ও প্রধান বোমাটাকে অ্যাকটিভ করার একটাই উপায় ছিল আমার সামনে, বলে সে হেসে উঠল। “কাজটা তোমাদের মাধ্যমে করানো।”

“তার মানে যে মুহূর্তে তোমার বলা কোড দুটো দিয়ে বোমা দুটো ডি- অ্যাকটিভ করা হলো সেই মুহূর্তে তৃতীয় বোমাটা চালু হয়ে গেল। ঠিক?” বলে প্রফেসর রাগের সাথে বলে উঠল। “তার মানে তুমি পুরোটা সময় সে ভাবেই আসলে আমাদেরকে ব্যবহার করেছিলে?” প্রফেসরের গলার উত্তাপ বাতাসে যেন ভাসছে।

ফাত্তাহ শব্দ করে হেসে উঠল। “বোমা সেট করার এই প্রক্রিয়াটা শুনতে জটিল মনে হতে পারে কিন্তু সত্যি কথা হলো, সিস্টেমটা খুব সহজ। যেকোনো জায়গায় যখনই আমি কাজ সেরে উড়াল দেই আমার এক্সপার্ট অপারেটিভ বাকি কাজ সারে। বহু বছরের অভ্যাসে ব্যাপারটা খুবই সোজা হয়ে গেছে। এতটাই যে আমি ধরা পড়ব এটাই মাথায় আসেনি। কাজেই ধরা পড়ার পর আমার একটাই উপায় ছিল,” বলে সে ছোট বাচ্চাদের মতো কাঁধ ঝাঁকাল। “তোমাদেরকে ব্যবহার করা।”

প্রফেসর আফসোসের সাথে মাথা নাড়ল। “সেক্ষেত্রেও একটা প্রশ্ন রয়ে যায়। তাহলে তুমি সারারাত কেন আমার সাথে খাজুরে আলাপ করলে। ধরা পড়ার পরই বলে দিলে আরও আগে হয়ে যেত কাজটা।”

“হতো না প্রফেসর। সময় এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। তুমি জানো না এই রুমে অবস্থানের সময়ে আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি যেটা নিয়ে আমি একেবারে সঠিক সময় আন্দাজ করতে পারছিলাম না। কিন্তু তুমি প্রফেসর সেই সুযোগটা আমাকে এনে দিলে,” বলে সে প্রফেসরের হাতের ঘড়িটা দেখাল। “ওই ঘড়ি। তুমি যে মুহূর্তে এই কামরায় প্রবেশ করলে ওই ঘড়িটা দেখেই আমি খুব সহজেই সময় দেখে হিসাব করে নির্ধারণ করতে পারছিলাম কখন কী করতে হবে,” বলে সে খুব কৃতজ্ঞ একটা ভাব করে বলে উঠল— “প্রফেসর, আজ রাতে তুমি না এলে আমার যে কী হতো! তোমাদের বোকা অথরিটি তোমাকে এখানে পাঠিয়েছিল বোমা খুঁজে বের করে প্রতিরোধ করতে। কিন্তু তুমি তার চেয়েও বড় বোকামি করে আমাকে আমার কার্য সমাধা করার সব সুযোগ এনে দিয়েছ। ধন্যবাদ প্রফেসর।”

ফাত্তাহর তাচ্ছিল্য আর টিটকিরি ভরা কথা শুনে প্রফেসরের রেগে ওঠা উচিত ছিল। কিন্তু প্রফেসর তেমন কিছুই করল না। বরং সে বসে রইল স্থাণুর মতো স্থির হয়ে।

“কী প্রফেসর কিছু তো বলো?” ফাত্তাহ আবারও সেই পুরানো তাচ্ছিল্য আর শ্লেষ ভরা কণ্ঠে বলে উঠল, “আজ রাতে তোমার সাথে কথোপকথনটা আমি অনেক উপভোগ করেছি। সেটার জন্য ধন্যবাদ। তবে কয়েকটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি। তুমি সেই সিগার আর কফির ব্যাপারটা জানলে এবং জিনিসগুলো সংগ্রহ করলে কীভাবে। সেইসাথে তুমি আমার অতীতের যেসব কথা বলেছ সেগুলো তুমি জানলে কীভাবে? সেটাও আমি একেবারেই পরিষ্কার না। তুমি আজ সন্ধে থেকেও যদি প্রস্তুতি নিয়ে থাক সেক্ষেত্রেও বড় বড় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যে তথ্যগুলো এত বছরে বের করতে পারেনি তুমি এখানে বসে কীভাবে জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে বের করলে এটা আমি এখনও বুঝতে পারছি না। এমনকি তুমি এই রুম থেকে স্রেফ একবার বেরিয়েছ ব্রেকের সময়ে মাত্র দশ মিনিটের জন্য,” ফাত্তাহর গলায় খানিকটা সন্দেহ আর খানিকটা কৌতূহলের সুর। এত অল্প সময়ে ব্যাপারগুলো কীভাবে বের করা সম্ভব এটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, এই পর্যন্ত বলে সে প্রফেসরকে অবলোকন করতে লাগল ভালোভাবে। প্রফেসর একেবারে স্থির হয়ে বসে আছে। “আরে প্রফেসর, কিছু তো বলো। আরে তুমি অসুস্থ হয়ে গেলে নাকি?”

প্রফেসর একেবারে স্থির হয়ে বসে আছে। কিছুই বলছে তো না-ই এমনকি নড়ছেও না।

“আরে প্রফেসর—” ফাত্তাহর ডাকের জবাবে প্রফেসর কিছুই বলল না, একেবারে চুপ হয়ে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *