শব্দজাল – ২০

২০

দাঁড়িয়ে তালি দিতে থাকা সবাইকে বলতে গেলে একরকম উপেক্ষাই করল প্রফেসর।

রুম থেকে বেরিয়ে কারো দিকে না তাকিয়ে প্রফেসর সোজা চলে এলো ওয়াশরুমে। ভবনটা বানানো হয়েছে খুব অল্প কিছুদিন আগে। তাই ওয়াশরুম থেকে শুরু করে সবকিছু একেবারে ঝকঝকে তকতকে। কিউবিকলগুলোর একটা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল প্রফেসর। চোখ থেকে চশমাটা খুলে ওটাকে সাবধানে রেখে দিল কোটের পকেটে। তারপর কমোডের ঢাকনাটা নামিয়ে বসে পড়ল ওটার ওপরে। চোখ বন্ধ করে মাথাটাকে নিচু করে বসে রইল বেশ কিছুক্ষণ। মাথাটাকে স্রেফ ফাঁকা করে দীর্ঘক্ষণ বসে রইল সে। আসলে কিছু ভাবতে চাইছে না, নাকি পারছে না সেটা ঠিক পরিষ্কার বুঝতে পারল না। কতক্ষণ ওভাবে আধা তন্দ্রার মতো অবস্থায় বসে ছিল ঠিক খেয়ালই করতে পারেনি সে।

প্রফেসরের মনে হলো বেশ অনেকক্ষণ, প্রায় অনন্তকাল পর কেউ আলতো টোকা দিল তার কিউবিকলের প্লাইউডের দরজায়। “স্যার কি ভেতরে আছেন?” অনেকটা ঢিমি তালে প্রশ্ন করা একটা গলা শোনা গেল। গলাটা শুনে প্রফেসর অনুমান করল সেটা আফসার ছাড়া অন্য কারো হওয়ার কথা নয়।

“স্যার?” আবারও জানতে চাইল সেই গলাটা।

“হুমম, আফসার,” শুধু এইটুকুই বলতে পারল প্রফেসর।

“স্যার, আপনি ঠিক আছেন?” খুবই কোমল গলায় প্রশ্ন করছে সে। প্রফেসরের কেন জানি হঠাৎ হাসি পেল। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল আজ রাতের প্রথম ধাপে পরিচয়ের সময়ের সেই উদ্ধত অহংকারী ছেলেটাকে।

“আমি ঠিক আছি আফসার,” আফসার কি তাকে ছোট বাচ্চা মনে করেছে নাকি। “তুমি ওয়াশরুমের বাইরে অপেক্ষা করো, আমি আসছি।”

প্রফেসর কিউবিকল থেকে বেরিয়ে সময় নিয়ে ফ্রেশ হলো। চেখে-মুখ পানি ছিটিয়ে টাইটাকে আলগা করে গলা-ঘাড়ের ভেজা হাত বুলিয়ে নিল। মাথায় পানি ছিটিয়ে চুলগুলোকে আঙুল দিয়ে ব্যাকব্রাশ করল ভালো করে। তারপর মুখ মুছে চশমাটাকে আবারও চোখে পরে নিয়ে বেরিয়ে দেখল আফসার কথা বলছে টকিতে।

প্রফেসরকে দেখে এগিয়ে এলো তার দিকে। “স্যার, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি। আজ রাতে আপনি যা দেখালেন স্যার,” তার গলার স্বরে মুগ্ধতা। “স্যার, আমার একটা অ্যাপোলজি দেওয়ার আছে,” বলে সে তাকিয়ে রইল প্রফেসরের দিকে।

প্রফেসর তার জবাবের জন্য অপেক্ষা করছে।

“স্যার, আজ রাতের প্রথম ভাগে আতিকুল আলম স্যার যখন ফাত্তাহর কেসটা হ্যান্ডেল করার জন্য আপনাকে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন আমি খুব ইনসাল্ট ফিল করেছিলাম। কারণ এটা আমার ডিপার্টমেন্ট। যেখানে আমি সেকশন উইঙের প্রধান সেখানে আমাকে টপকে অন্য কাউকে কাজের এখতিয়ার দেওয়ার ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই আমি একটু উদ্ধত ছিলাম স্যার। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি শুধু জ্ঞান আসলে কিছুই না। আমার বাবা বলতেন, জ্ঞান আর প্রজ্ঞা সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। প্রথমটা পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে যে-কেউ অর্জন করতে পারে। কিন্তু দ্বিতীয়টার জন্য অনেক বেশি কিছু দরকার,” বলে সে একটু থেমে যোগ করল। “আমি আজ রাতে অনেক কিছু শিখলাম স্যার।”

প্রফেসর তার পিঠে একটা হাত রেখে মৃদু হেসে বলে উঠল, “তোমার শেখা এখনও শুরুই হয়নি, বালক। আমি নিজেই এখনও শেখা শুরু করতে পারিনি,” বলে সে হেসে উঠল। আফসারও যোগ দিল তার সাথে। দুজনেই এগোচ্ছিল কমিউনিকেশ রুমের দিকে হঠাৎ আফসারের টকিতে শব্দ করে উঠল। আফসার টকিতে কথা বলা শেষ করে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “স্যার, জলদি চলেন। গরম খবর আছে।” দুজনেই দ্রুত পা চালাল রুমের দিকে।

কমিউনিকেশন রুমে সবাই ভীষণ ব্যস্ত। ওখানে দারুণ উত্তেজনা চলছে। তবুও রুমটাতে ঢুকে প্রফেসর একবার সেই দ্বিমুখী কাঁচটার দিকে না তাকিয়ে পারল না। কিন্তু ওটাকে ঘোলা করে রাখা হয়েছে এখন।

ওরা ভেতরে ঢুকতেই আতিকুল আলম প্রায় দৌড়ে এলো ওদের দিকে। “বোমা পাওয়া গেছে, দুটোই,” বলে সে উত্তেজনার চোটে জড়িয়ে ধরল প্রফেসরকে। “বন্ধু তুই যা দেখালি, আমি আমি—“

“তুই কি আবেগে কেঁদে ফেলবি নাকি?” খুব শান্ত গলায় প্রশ্নটা করে প্রফেসর টেবিলের ওপরে রাখা একটা স্যান্ডউয়িচ তুলে নিয়ে কামড় বসাতে যাবে হঠাৎ তার মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল। একেবারে খাঁটি ভেজিটেরিয়ান সে। প্রায় অর্ধদশকের বেশি সময় ধরে নন-ভেজ খায়নি। আজ রাতের মধ্যভাগে উত্তেজনার চোটে চিকেন স্যান্ডউয়িচ খেয়ে ফেলেছিল। তখন মনে ছিল না কিন্তু এখন খেয়াল করতেই ওটাকে নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপরে। তার পরিবর্তে কফি দিতে বলল একজনকে। তারপর আতিকুল আলমের দিকে ফিরে জানতে চাইল, “বোমা কোথায় পাওয়া গেল?”

আতিকুল আলম টকিতে আর ফোনে ক্রমাগত কথা বলছিল, প্রফেসরের প্রশ্ন শুনে সে দুটোই নামিয়ে রেখে বলে উঠল, “তুই জানিস কি না আজ, মানে জানুয়ারির এক তারিখে ঢাকায় মোট চারটে প্রোগ্রাম ছিল। বিদেশি অতিথিদের নিয়ে প্রথমে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ। সেখান থেকে নতুন একটা থিয়েটার হল উদ্বোধন, তারপর একটা মন্যুমেন্টের উদ্বোধনের ফিতে কাটা। সবশেষে…“

“মতিঝিলে সিটি রেল আর মেট্রোসেন্টারের উদ্বোধন, রাইট?” কফির কাপ এসে যাওয়াতে প্রফেসর তাতে চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে তুলল। এদের কফি এত বাজে হয় কেন। “তো এই চার স্পটেই কি আমাদের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীকে সঙ্গ দিতেন তিন দেশের প্রধানরা?”

“হুমম, চারটেতেই।”

“বোমা পেলি–”

“দুটো স্পটেই যেখানে ফাত্তাহ বলেছিল, “ বলে আতিকুল আলম হাত দিয়ে সরকারি প্রতিনিধিদের দিকে দেখল একবার। কুমড়ো, টুথপিক আর সেই তৃতীয় ভদ্রলোক তিনজনেই কমিউনিকেশনে ব্যস্ত। “দোস্ত, ফাত্তাহ লোকটা শালা আসলেই একটা মাল। এমন জায়গাতে বোমা সেট করেছিল, কারো কল্পনাতেও আসবে না।”

“একে বলে প্রফেশনাল,” আনমনেই বলে উঠল প্রফেসর।

“একদম,” বলে মাথা নাড়ল আতিকুল আলম। “একটা বোমা ছিল দ্বিতীয় স্পটের একেবারে কাছেই নিরাপত্তাজনিত কারণে বন্ধ করে দেওয়া একটা পেট্রোল স্টেশনের পাম্পিং মেশিনের ভেতরে,” বলে আতিকুল আলম একবার আফসারকে মাথা চুলকাল। “যে দুটো বোমা পাওয়া গেছে দুটোই খুব একটা বড় বা বিরাট শক্তিশালী কোনো বোমা নয়। কিন্তু স্রেফ অবস্থান আর সেটিঙের কারণে বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ করার ক্ষমতা ছিল দুটোরই। “

“সময়ও গুরুত্বপূর্ণ,” প্রফেসর বলে উঠল। “দুটো বোমাই নিশ্চই এমন সময় সেট করা ছিল যাতে—” প্রফেসর কফিতে চুমুক দিয়ে মনে মনে কিছু একটা ভাবছে।

“হ্যাঁ। বোমা দুটো বিস্ফোরেতি হলে আর উপায় ছিল না। প্রধানমন্ত্রী- প্রেসিডেন্ট আর বিদেশি অতিথিরা তো বটেই অগুনিত মানুষ মারা যেত। একবার ভাব পেট্রোল পাম্পের ভেতরে বোমা বিস্ফোরিত হলে-–”

“বোমা দুটো ডি-অ্যাকটিভেট করা হলো কীভাবে?” প্রফেসর মুখ তুলে আতিকুল আলমের দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে জানতে চাইল। “সেই কোড দুটোর মাধ্যমে?”

“দুটো বোমাতেই টাইমার এবং স্পেশাল কোড সেট করা ছিল,” বলে সে এই মুহূর্তে ঘোলা করে রাখা একমুখী কাঁচটার দিকে দেখাল। “বোমার অবস্থান বলার সময় সে যে কোড দুটো বলেছিল সেগুলোর দিয়ে ইনপুট দিতেই… আরে বাদ দে,” বলে আতিকুল অলম প্রায় জোরে হেসে উঠে প্রফেসরের কাঁধে একটা হাত রাখল। “তুই আজ যা দেখালি বন্ধু—“

“সেটা আর বলতে,” তিনজনেই ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল মন্ত্রণালয় থেকে সেই প্রতিনিধি তিনজনের মধ্যে তৃতীয়জন দাঁড়িয়ে আছে ওদের কাছেই। পকেটে হাত রেখে মৃদু হেসে সে বলে উঠল, “যদিও আমার শুরু থেকেই মি. আতিকের ডিসিশনের ওপর কোনো সন্দেহ ছিল না। কিন্তু আমার পার্টনাররা তো—” বলে সে হাতের ইশারায় ফোনে ক্রমাগত কথা বলতে থাকা কুমড়ো আর টুথপিককে দেখাল। “বলেই বসেছিল সব ডুবতে বসেছে। যাই হোক, মি. জাকারিয়া, আতিক সাহেব একটা ফাইলের ব্যাপারে বলছিল। আপনি ওটা নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না। বিশেষ ফাইলটা আনানোর জন্য লোক পাঠানো হয়েছে। সে মন্ত্রণালয় থেকে ওটা তো আনবেই আজ রাতেই আপনি ফাইলটা পেয়ে যাবেন। আর কালকের ভেতরেই ওটা নিয়ে কাজ করার বিশেষ অনুমতিপত্রও পৌঁছে যাবে আপনার বাসায়। আপনি দেশের জন্য যা করেছেন, তার জন্য প্রয়োজনে প্রেস ডেকে আপনাকে” বলে সে একটু থেমে যোগ করল। “সেটা তো আর সম্ভব হবে না। কিন্তু অন্তত প্রেসিডেন্টের বিশেষ একটা পদক তো—”

মানুষটার কথার জবাবে প্রফেসর কিছুই বলেনি। সে মাটির দিকে তাকিয়ে একমনে কফি পান করছিল আর কিছু একটা ভাবছিল। হঠাৎ সে একটা হাত তুলে আতিকুল আলম কিংবা মন্ত্রণালয়ের মানুষটার দিকে না তাকিয়ে বরং আফসারের দিকে তাকিয়ে অনেকটা মন্তব্য করার ভঙ্গিতে বলে উঠল, “বুঝলে আফসার। কোথায় যেন একটা হিসাব মিলছে না,” আনমনেই মাথা নাড়ল সে। “সবকিছু কীভাবে যেন ঠিক ঠিক মিলে গেল। আমি ভেবেছিলাম…” বলে সে আতিকুল আলমের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। “তুই কি নিশ্চিত বোমা দুটো পাওয়া গেছে এবং সেগুলো ডি-অ্যাকটিভেট করা হয়ে গেছে?”

আতিকুল আলম অবাক চোখে প্রফেসরকে দেখে নিয়ে একবার আফসার আর তৃতীয় প্রতিনিধির দিকে দেখে নিয়ে জোর গলায় বলে উঠল, “অবশ্যই, দুটো বোমাই পাওয়া গেছে এবং ডি-অ্যাকটিভেট করা হয়ছে।

প্রফেসর সামান্য মাথা নেড়ে জানতে চাইল, “ওই জায়গাগুলোর পেরিফেরি মানে চারপাশ খুব ভালোভাবে চেক করা হয়েছে?”

“অবশ্যই,” এবার কথা বলে উঠল তৃতীয় প্রতিনিধি। “আমি এইমাত্র পুরো রিপোর্ট শুনে এলাম। আপনি আসলে–“

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে আফসার আতিকুল আলমের পাশ থেকে এক ধাপ এগিয়ে প্রফেসরের কাছাকাছি এসে জানতে চাইল, “স্যার, আপনার খটকা লাগছে কোন জায়গায়?” বলে সে একবার আতিকুল আলমের দিকে দেখল কৌতূহলী দৃষ্টিতে।

কফি শেষ করে কাপটাকে মুচড়ে প্রফেসর নিখুঁত লক্ষ্যে ছুড়ে ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলে দিল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শরীরটাকে টানটান করে দিয়ে বলে উঠল, “বুঝলে আফসার, আমাদের গল্পটাতে সবকিছু কেমন জানি জিগ-স্ পাজলের মতো মিলে গেল,” বলে সে মাথা নাড়ল। “বাস্তব জীবনে সবকিছু এত সুন্দরভাবে মিলে যায় না। এরকম হয় একমাত্র কাচা হাতে লেখা থ্রিলার উপন্যাসে—” শরীরটাকে আবারও টান করে দিয়ে সে যোগ করল, “বাস্তবে সবকিছু এভাবে—” প্রফেসর কথা শেষ করার আগেই মনিটরিং সেকশনে কাজ করতে থাকা মারিয়া মেয়েটা বেশ তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এলো ওদের দিকে।

“স্যার, একটা ব্যাপার,” বলে সে আতিকুল আলমের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রফেসর মনে মনে ভাবল এদের সরকারি শিক্ষা এতটাই মজবুত যে ইমার্জেন্সি পরিস্থিতিতেও এরা ওপরওয়ালা ব্যাপারটা ভুলে যেতে পারে না। আতিকুল আলম মাথা নাড়তেই সে ফরফর করে বলতে শুরু করল।

“স্যার, একটা ব্যাপার ঘটেছে,” বলে সে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। “জিনিসটা মনে হয় আপনাদের দেখা উচিত,” বলেই সে নিজেকে শুধরে নিয়ে বলে উঠল, “আপনার দেখা উচিত স্যার।”

প্রফেসর কিছু না বলে সে মেয়েটার সাথে রুমের কমিউনিকেশন সেকশনের দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে ফাত্তাহর বসে থাকা রুমটাকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে বেশ কয়েকটা মনিটরে দেখা যাচ্ছে। প্রফেসরকে নিয়ে মনিটরগুলোর সামনে এসে কমিউনিকেশন টেবিলে বসে থাকা ছেলেটাকে মারিয়া ইশারা করতেই ছেলেটা একটা মনিটরে দেখাতে লাগল।

“স্যার, এখানে থাকা প্রতিটি ক্যামেরা রুমের প্রতিটি ইঞ্চি পরিষ্কার কভার করে। বিশেষ করে এই ক্যামেরাটা, এটাতে রুমের ভেতরে থাকা টেবিলটা বেশ পরিষ্কার দেখা যায়। “স্যার, দেখেন এখনকার ছবি। “

প্রফেসর দেখল চেয়ারের পায়ের ওপরে পা তুলে বেশ আয়েশ করে বসে আছে ফাত্তাহ। একটু আগে তাকে যেরকম বিধ্বস্ত অবস্থায় রেখে এসেছিল লোকটার অবয়বে তার ছিটেফোঁটাও নেই এই মুহূর্তে।

“আরে, কী দেখাতে চাচ্ছ সেটা দেখাও,” আতিকুল আলম ধমকে উঠল। প্রফেসর দেখল আতিকুল আলম, আফসারসহ তৃতীয় সরকারি প্রতিনিধি সবাই এসে দাঁড়িয়েছে তার পেছনে। রুমের অন্য প্রান্ত থেকে এমনকি কুমড়ো আর টুথপিকও তাকিয়ে আছে। এখানে কিছু একটা ঘটছে সেটা বেশ টের পেয়ে গেছে সবাই।

আতিকুল আলমের ধমক খেয়ে ছেলেটা সেই মনিটরটার দিকে নির্দেশ করল যেখানে টেবিলটা পরিষ্কার দেখা যায়। “স্যার কয়েক মিনিট আগের ফুটেজ দেখাই। বলে সে ওটার ভিডিওটা রিওয়াইন্ড করতেই দেখল ফাত্তাহ টেবিলে মাথা নিচু করে বসে ছিল। হঠাৎ সে উঠে এসে একমুখী কাচটার সামনে এসে দাঁড়াল হাসিমুখে। তারপর দুবার টোকা দিয়ে টেবিলটার দিকে দেখাল। তারপর টেবিলে ফিরে গিয়ে আঙুলের ডগা দিয়ে লেখার মতো করে কিছু একটা করতে লাগল।

“লোকটা কিছু একটা লিখছে,” আনমনেই বলে উঠল আফসার। “এই জুম করো তো।”

“কেউ একজন একটা পেনসিল আর কাগজ দাও, “ একজন দৌড়ে প্রফেসরের হাতে একটা কাগজ আর পেনসিল ধরিয়ে দিল দ্রুত। সে-দুটো নিয়ে প্রফেসর ছেলেটার পাশে গিয়ে উবু হয়ে গেল মনিটরের সামনে।

ছেলেটা মনিটরের ফুটেজে টেবিলের ওপরটা জুম করে রিওয়াইন্ড করে দিতেই দেখা গেল ফাত্তাহ টেবিলের ওপরে আঙুল বুলাচ্ছে। কিছুটা আঙুল বুলাতেই প্রফেসর লিখতে শুরু করল।

“একটা বাক্য লিখছে লোকটা,” প্রফেসরের পেছন থেকে আনমনে বলে উঠল আফসার। বাক্যটা শেষ হতেই প্রফেসর মৃদু একটা শব্দ করে উঠল। কাগজটা টেবিলে রেখে নিজের মাথার চুলে অস্থির ভঙ্গিতে হাত বুলাল একবার। তারপর দ্রুত সে ফাত্তাহর রুমের দিকে এগোতে লাগল।

প্রফেসর সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই টেবিলের ওপরে রাখা কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে পড়ল। তাতে যা লেখা সেটার বাংলা করলে যা দাঁড়ায় সেটা আনমনেই বলে উঠল সে, ‘প্রফেসর তোমার উচিত মি. রিড আর তার সহযোগীদের ধন্যবাদ জানানো,’ বলেই সে একমুহূর্ত পরে ধরতে পারল গন্ডগোলটা কোথায়। “সর্বনাশ,” বলেই সেও রুমটার দিকে রওনা দিল।

আতিকুল আলম হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশ থেকে তৃতীয় প্রতিনিধি বেশ উচ্চৈঃস্বরে জানতে চাইল, “হচ্ছেটা কী? কে এই মি. রিড?”

তার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো কেউ নেই। প্রফেসর দ্রুতবেগে ঢুকে গেছে রুমের ভেতরে। প্রফেসরের রেখে যাওয়া কাগজটা পড়ে আফসার যখন পৌঁছাল রুমের সামনে ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে রুমের দরজা। সে কি ঢুকবে না ঢুকবে না সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *