শব্দজাল – ২৩

২৩

“আরে প্রফেসর,” ফাত্তাহ আবারও ডেকে উঠল।

প্রফেসর কোনো জবাব দিল না কিন্তু তৃতীয়বার ডাক দিতেই একটা হাত তুলে থামিয়ে দিল তাকে। তারপর হাতটাকে মুখের সামনে এনে চুপ থাকার জন্য ইশারা করল। প্রফেসরের ভঙ্গি দেখে ফাত্তাহ অবাক হয়ে কাঁধ ঝাঁকাল একবার। “এই ব্যাটার হলো কী?” একমুখী আয়নার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল সে।

“এক মিনিট,” বলে প্রফেসর আবারও একবার হাত তুলল। বাম কানের ওপরে একটা হাত রেখে কিছু একটা শোনার বা বোঝার চেষ্টা করছে সে। তবে এক মিনিটের জায়গায় পুরো চার মিনিট সময় ব্যয় করে সে মৃদু হাসিমুখে ফিরে তাকাল ফাত্তাহর দিকে।

“সরি, অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্য,” বলে সে মুখ দিয়ে ফুসসস করে একবার নিঃশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে মুখটাকে খানিকটা উঁচু করে ফিরে তাকাল ফাত্তাহর দিকে।

ফাত্তাহ একটু অবাক হয়ে খেয়াল করছে প্রফেসরের এক্সপ্রেশন। “তুমি ঠিক আছ প্রফেসর?”

“নেভার বেটার মি. ফাত্তাহ–”

“তোমার সাহস আছে প্রফেসর। নিজের এরকম ভয়াবহ পরাজয়ের পর মুখে হাসি নিয়ে বসে আছ। ব্যাপারটা খারাপ না,” বলে সে নিজের হাতের নখবিহীন আঙুলগুলো চোখের সামনে তুলে ধরে দেখতে দেখতে বলে উঠল, “তোমার কি মনে হয় না এই তৃতীয় বোমাটা নিয়ে তোমার কিংবা তোমাদের অথরিটির,” বলে সে কাচের ওপাশে দেখাল, “উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। আমার কোনো অফার আছে কি না শোনা উচিত।”

ফাত্তাহর কথা শুনে হেসে উঠল প্রফেসর, “মি. অ্যালবার্ট ফাত্তাহ, “ এক পায়ের ওপরে অন্য পা তুলে দিতে দিতে সে একবার টেবিলের ওপর রাখা পাইপটাকে দেখল। কিন্তু ওটাকে আর হাতে না নিয়ে সে বরং ফিরে তাকাল ফাত্তাহর দিকে। “বলো তো দেখি মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী?“

“দেখো প্রফেসর,” ফাত্তাহ প্রায় রাগের সাথে একটা হাত তুলল প্রফেসরের দিকে। “আজ রাতে তোমার সাথে এসব দার্শনিক মার্কা কথাবার্তা অনেক হয়েছে। আমি আর—”

“দর্শন কী মি. ফাত্তাহ?” প্রফেসরের গলায় আরও আতলামির সুর। “দর্শন বলুন আর বিজ্ঞান কোনোটাই মানুষের জীবনের থেকে আলাদা নয়। যদি বিজ্ঞান মানে প্রকৃতির নিয়মকে আরেকটু ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা হয় তবে দর্শন মানে জীবনকে আরেকটু গভীরভাবে প্রতিফিলত করা নয় কি?” বলে সে একবার হাত নাড়ল। “আচ্ছা বাদ দিন। অনেক হয়েছে দার্শনিক মার্কা কথাবার্তা। শেষ একটা কথা প্লিজ। প্রতিটি মানুষের কোনো না কোনো দুর্বলতা আছে এটা তো মানেন নাকি?” প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে কথাটা বললেও ফাত্তাহর কাছ থেকে কোনো জবাব না শুনেই প্রফেসর বলে যেতে লাগল। “এমনকি সুপারম্যানও ক্রিপ্টোনাইটের সামনে অসহায়। আর মানুষ তো কোন ছাড়। প্রতিটি মানুষের জীবনে কোনো না কোনো ক্রিপ্টোনাইট আছে,” বলে প্রফেসর হেসে ফেলল। “কথায় বলে এমনকি দিগবিজয়ী বীরেরাও বাড়িতে ফিরে নিজের স্ত্রীর সামনে অসহায়,” এইটুকু বলে মৃদু হেসে প্রফেসর ফিরে তাকাল ফাত্তাহর দিকে। “আর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় কার সামনে জানো, বিশেষ করে বাবা-মায়েরা?” প্রশ্নটা করে প্রফেসর চুপ হয়ে গেল ইচ্ছে করেই।

প্রশ্নটা ফাত্তাহর সামনে উচ্চারিত হতেই তার চেহারাটা হলো দেখার মতো। প্রফেসর দেখল সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশের মধ্যে ফাত্তাহর ভালো চোখটা একবার ঝিকিয়ে উঠল, তার মুখটা একটু খুলে গিয়েই বন্ধ হয়ে গেল এবং নষ্ট চোখটার শিরাগুলো যেন মুহূর্তের ভেতরেই আরেকটু লাল হয়ে গেল। বুদ্ধিমান লোক সে, সেকেন্ডের মধ্যে যা হলো তার চেয়েও কম সময়ে সে নিজেকে সামলে নিয়ে খবু স্বাভাবিক গলায় সে জানতে চাইল, “হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?”

“আমি আজ রাতে এই রুমে ঢোকার আগে ওই কাচটার ওপাশ থেকে বেশ কিছুক্ষণ তোমাকে অবজার্ভ করছিলাম,” প্রফেসর কাচটা দেখিয়ে বলে উঠল। “প্রায় দশ মিনিটের বেশি সময়। আমি তখন বিভিন্নভাবে বোঝার চেষ্টা করছিলাম তোমার মতো একজন মানুষের ‘একিলিস হিল’ মানে দুর্বলতম জায়গা কী হতে পারে। শুধু দেখে তোমার দুর্বলতম জায়গা আমি পাইনি। কিন্তু অন্য কিছু একটা ঠিকই বের করতে পেরেছিলাম। আর সেটা ধরেই আজ রাতে আমি এগিয়েছি ফাত্তাহ।”

প্রফেসর থেমে যেতেই একটা নীরবতা ঝুলে রইল রুমের ভেতরে।

“ব্যাপারটা সহজ ছিল না। মোটেই সহজ ছিল না, বিশেষ করে আমার মতো একজন মানুষের জন্য তোমার মতো একজন মানুষের ভেতর থেকে তার দুর্বলতম জায়গাটা খুঁজে বের করাটা,” প্রফেসর আনমনেই মাথা নাড়ল একবার। সে যেন নিজে নিজেই কথা বলছে এমন সুরে বলে চলেছে কথা। “এই যে রিড টেকনিক, ইন্টারগেশন, দার্শনিক কথাবার্তা এগুলোর কিছুই আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল না ফাত্তাহ,” বলে সে মৃদু হেসে উঠল। ফাত্তাহ থমথমে মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

“তোমার মতো বুদ্ধিমান মানুষের কি একবারও মনে হলো না যে আমি কেন তোমার মতো ঝানু লোকের ওপরে রিড টেকনিকের মতো এত হালকা একটা টেকনিক প্রয়োগ করব যেটা খুব সাধারণ অপরাধী কিংবা সন্দেহভাজনের ওপরে প্রয়োগ করা হয়,” এবার প্রফেসর ঠোঁট দিয়ে চুকচুক শব্দ করল। “তোমার প্রথম বোমা দুটো যেমন ছিল হোক্স, তেমনি এইসব টেকনিক-ফেকনিক ছিল আমার হোক্স। আমি আসলে তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিলাম, স্রেফ কথা। আর তুমি সেটাই করেছ ফাত্তাহ। ওপরে ওপরে চলতে থাকা আমাদের সাধারণ কথোপকথনের ভেতরে আমি টেকনিক কাজে লাগাচ্ছিলাম, এটা তুমি যেমন বুঝতে পারছিলে ঠিক তেমনি আমিও খুব ভালো করেই জানতাম যে তোমার মতো ঝানু লোক এই টেকনিক একটা বা দুটো স্টেজ পার হওয়ার অগেই ধরে ফেলবে,” এইটুকু বলে সে সময় দিল ফাত্তাহকে কথাগুলো অনুধাবন করার।

“তাতে লাভটা হলো কী? ফাত্তাহ হেসে উঠে বলল, “আমরা দুজনেই এখানে এবং তৃতীয় বোমাটা কোথায় আছে সেটা এখনও আমার মাথার ভেতরে,” বলে সে পুরানো ভঙ্গিতে বলে উঠল, “যদি পার আমার মুখ থেকে আদায় করো দেখি সেটা কোথায় আছে।”

“ভুল প্রশ্ন, ফাত্তাহ,” প্রফেসর পাইপটাকে উঠিয়ে নিয়ে সেটাকে ফাত্তাহর দিকে পিস্তলের মতো তাক করে বলে উঠল। “তোমার প্রশ্ন করা উচিত ছিল, এরকমটা আমি কেন করলাম?”

ফাত্তাহ মুখে কিছু না বললেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সে জানতে চাইছে প্রফেসর এরকমটা কেন করল।

“আমি এমনটা করেছি কারণ আমি কথার ছলে তোমাকে বুঝতে চাইছিলাম। তোমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতাটা খুঁজে বের করতে চাইছিলাম। নিজেকে নিয়ে তোমার বক্তব্যের মাঝে তুমি অনেক মিথ্যে বলেছ কিন্তু তোমার কথাগুলো থেকে সত্য আর মিথ্যাকে আলাদা করে আমার দরকারি অংশটুকু নিয়ে আমি ঠিক কাজে লাগিয়ে ফেলেছি। একটা পর্যায়ে আমি ভেবেছিলাম আমি জিতে গেছি, কিন্তু আসলে তা নয়। আমার সেই অনুমান ভুল ছিল, প্রফেসর থেমে হেসে উঠল। “আগেই বলেছি স্রষ্টার সামনে যেমন সৃষ্টি অসহায়, সন্তানের সামনে তেমনি বাবা-মা অসহায়। ঠিক কি না?”

ফাত্তাহকে দেখে মনে হচ্ছে সে রাগে ফুলে উঠছে।

“অ্যালবার্ট ফাত্তাহ, আন্তর্জাতিক অপরাধী যার নামে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষিত হয়েছে। যার নাম শুনলে অনেক বড় বড় রাষ্ট্র আর প্রতিষ্ঠানের ঘুম হারাম হয়ে যায়, তার কী এমন দুর্বলতা থাকতে পারে? আর তাছাড়া তার বাংলাদেশের মতো একটা দেশে এসে বোমা মারার মতো কারণ কী থাকতে পারে। কী এমন মোটিভ থাকতে পারে তার যে এদেশে আসতে হলো তাকে?” বলে মৃদু হেসে উঠল প্রফেসর।

“যেকোনো মানুষের স্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব যদি বিচার করা হয় তবে এটা পরিষ্কার যে মানুষের জন্য তিনটে জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ,” বলে প্রফেসর একটা হাত তুলে আঙুলের কর গুনতে শুরু করল। “প্রথমত, তার দুর্বলতা, সেই দুর্বলতার ওপরে ভিত্তি করে তার চাহিদা, আর সেই চাহিদা দ্বারা পরিচালিত তার উদ্দেশ্য বা মোটিভ। যেমন একজন মধ্যবিত্ত মানুষের দুর্বলতা যদি তার পরিবার এবং পরিবারের অর্থনৈতিক চাহিদা হয়, তবে তার চাহিদা হবে পরিবারের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠা করা। আর সেই ভিত্তিতে তার মোটিভ বা উদ্দেশ্য হবে পড়ালেখা করে একটা ভালো চাকরি পাওয়া। আমরা যারা সাইকোলজিস্ট সবসময়ে মানুষের কথা আর তার ডিজায়ার দ্বারা আমরা একেক রকম ম্যাপিং করার চেষ্টা করি। আজ সরারাত ধরে আমি যত কথা বলেছি, এই টেকনিক সেই টেকনিক অ্যাপ্লাই করেছি এই সবই ছিল তোমার মানে আবদুল্লাহ আল ফাত্তাহর মস্তিষ্কের একটা ম্যাপিং করার প্রচেষ্টা। বিশ্বাস করো,” বলে প্রফেসর নিজের বুকে একটা হাত রাখল। “তুমি যখন বোমা দুটোর কথা বললে আমি নিজেকে প্রায় কনভিন্স করে ফেলছিলাম যে তোমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা আমি খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু না—” প্রফেসর মুখ তুলে তাকিয়ে আছে ফাত্তাহর দিকে। “আমি ভুল ছিলাম।”

ফাত্তাহ কিছু না বলে তাকিয়ে আছে। একটু আগের রাগের হলকা তার ভেতরে যেন আরও বেড়েছে। “প্রফেসর, ফালতু কথা বাদ দাও। তোমার ফালতু কথা অনেক শুনেছি। আগে বলো তুমি বাবা-মা, সন্তান ওই কথা কেন বললে?”

কিন্তু প্রফেসর তার কথার জবাব দেওয়ার মতো মুডে নেই। সে নিজে নিজেই বলে চলেছে, “তোমার মতো একজন মানুষের চাহিদা-দুর্বলতা-উদ্দেশ্য কী হতে পারে? টাকা? টাকা নয় সেটা আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছি। একেবারে শুরুতে আমি ভেবেছিলাম ধৰ্মীয় মূল্যবোধ কিংবা উন্মাদনা–যেটা তোমার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। কিন্তু পরে বুঝলাম না, সেটাও নয়। একটা পর্যায় পর্যন্ত আমি কনভিন্সড ছিলাম তোমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা সম্ভবত তোমার জাতীয়তা বোধ। বিশেষ করে তোমার বাবার ব্যাপারটা আবিষ্কার করার পর। কিন্তু —” বলে প্রফেসর থেমে গেল। নিজের শরীরটাকে হেলান দেওয়া থেকে সরে এসে টেবিলের ওপরে হাত রাখল। “আমি ভুল ছিলাম, কারণ সবচেয়ে অবশ্যম্ভাবী ব্যাপারটা আমার চোখে পড়েনি—” সে মুখ তুলল ফাত্তাহর দিকে। “পরিবার— তোমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা তোমার পরিবার।”

প্রফেসর এই পর্যন্ত বলতেই ফাত্তাহ প্রায় জোরে জোরে হেসে উঠল, “হা- হা-হা,,” তার এতক্ষণের সেই ভারিক্কি ভাব সেটা খসে পড়ল মুহূর্তেই। “এত গবেষণা করে এত ভাব নিয়ে তুমি শেষ পর্যন্ত এই বের করলে প্রফেসর। আমার তো কোনো পরিবারই নেই।”

“একদম ঠিক,” প্রফেসর সাথে সাথে ফাত্তাহর কথার সমর্থন দিয়ে সোজা হয়ে বসল। তাকে দেখে ছোট বাচ্চাদের মতো উত্তেজিত মনে হচ্ছে। “আর এ কারণেই একেবারে অবভাস ব্যাপারটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। তুমি ফাত্তাহ তোমার কোনো পরিবার নেই, আর এ কারণেই তোমার পরিবারের শেষ যে অংশটা এখনও আছে সেটাই তোমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা,” এটুকু বলে চট করে প্রফেসর জানতে চাইল। “আবদুল্লাহ আল জুবায়ের কে ফাত্তাহ?”

পুরানো দিনের সিনেমাতে যখন কোনো দুর্গ আক্রমণ করা হতো, হঠাৎ দুর্গের হাজার বছর ধরে টিকে থাকা দেওয়াল কামানের গোলায় ফাটল ধরলে রাজাদের চেহারা থেকে যেরকম রঙ উড়ে যেত, প্রফেসরের মুখ থেকে নামটা উচ্চারিত হওয়া মাত্রই ফাত্তাহর মুখটা যেন সাথে সাথে সাদা হয়ে গেল। পুরো রাতের কথোপকথনের সময় একেকবার একেক উত্থান-পতনের সময় একবারও ফাত্তাহকে এতটা নার্ভাস ভঙ্গিতে ঢোক গিলতে দেখেনি প্রফেসর। এই প্রথমবারের মতো সে ঢোক গিলল এবং আমতা-আমতা করে বলে উঠল, “মানে, কে সে? আমি এই নামে কাউকে চিনি না,” তার গলায় কোনো জোরই নেই।

“জাপানের সবচেয়ে বড় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মগুলোর একটায় কর্মরত, সিনিয়র সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, আবদুল্লাহ আল জুবায়ের কে ফাত্তাহ? কী হয় সে তোমার?” প্রফেসর খুবই শান্ত গলায় আর সাবধানে উচ্চারণ করছে প্রতিটি শব্দ।

কোম্পানিটার নাম উচ্চারিত হতেই ফাত্তাহ অনুধাবন করল তার দুর্গের ফাটল দৃশ্যমান হয়ে গেছে। “প্রফেসর, আমি সাবধান করছি তুমি এসব ব্যাপারের সাথে ওকে জড়াবে না। আমি সাবধান করছি,” বলে সে টেবিলের ওপরে জোরে একটা থাবা মারল।

প্রফেসরের মধ্যে কোনো বিকার নেই। “আমি তাকে মোটেও জড়াচ্ছি না এসবের সাথে। তাকে জড়িয়েছ তুমি ফাত্তাহ। ব্যাপারটা কখনোই সহজ ছিল না। কারণ সম্পূর্ণ কথোপকথনে খুব সাবধানে তুমি যতটা সম্ভব এই মানুষটাকে এড়িয়ে গেছ। যাতে কোনোভাবেই তাকে ধরতে না পারি আমি। কিন্তু অবশ্যম্ভাবী ব্যাপারটাই ঘটে গেছে ফাত্তাহ। তুমি একাধিকবার তোমার স্ত্রীর কথা বলেছ কিন্তু, ছেলের কথা সম্পূর্ণ কথোপকথনে দুয়েকবার স্রেফ উচ্চারণ করেছিল। তাও মনে হয় সেটা আবেগের বশে। আর এখানেই তুমি ভুলটা করেছিলে। একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। তুমি জেলে থাকা অবস্থায় তোমার স্ত্রী মারা গেল। তুমি অনেক বছর পর বেরিয়ে এলে, তবে তোমার ছেলে গেল কোথায়। অনেক বেশি সাবধানে তাকে এড়িয়ে যেতে গিয়েই ব্যাপারটা আমার নজড়ে ফেলেছ তুমি ফাত্তাহ। কারণ ছেলের জন্মের ব্যাপারে যে আবেগ তুমি দেখিয়েছ, যে ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তুমি শত নির্যাতনেও মচকাওনি, সেই ছেলের ব্যাপারে আর কিছুই বললে না, সেই ছেলের কাছ থেকে এত সহজে দূরে সরে গেলে! এটাই খোঁচাচ্ছিল আমাকে,” প্রফেসর দম নিল।

“আমি অনুমান করতে পারি তুমি জেলে যাওয়ার পর তোমার স্ত্রী তোমাদের একমাত্র ছেলে জুবায়েরকে নিয়ে নিয়মিত তোমাকে জেলে দেখতে যেত। তারপর তোমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর সেটা বন্ধ হয়ে যায়। কারণ সম্ভবত তার মামা— নিউইয়র্কের সবচেয়ে বড় বেকারি ব্যবসায়ীদের একজন সেটা চাইত না। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে সরাসরি না পারলেও তুমি ঠিকই দেখা করতে ছেলের সাথে। লুকিয়ে দেখা করতে সম্ভবত। কারণ তুমি জানতে ব্যবসায়ী মামার সাথেই সে ভালো থাকবে এবং তোমার জেল খাটা দাগি জীবনের সাথে তাকে জড়ালে সে ধ্বংস হবে। তারপর একদিন তুমি জড়িয়ে গেলে অন্যদের সাথে, অন্য এক জীবনে। কিন্তু আমার বিশ্বাস তবুও খুব সাবধানে ছেলের সাথে দেখা করতে। তাই না?” প্রফেসরের দিকে ভালো চোখটা দিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফাত্তাহ। “কিন্তু তারপর কী হলো?” প্রফেসরের ভুরু কুঁচকে উঠেছে।

“প্রফেসর আমি কিন্তু তোমাকে বারবার সাবধান করছি জুবায়েরকে এর সাথে জড়াবে না,” বলে সে একটা হাত তুলল। “আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না তুমি এখানে বসে কীভাবে বের করলে ব্যাপারটা, যেটা বড় বড় সংস্থাগুলো এতদিনে বের করতে পারেনি। ঠিক আছে, জুবায়ের আমার ছেলে কিন্তু তার সাথে এসবের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি আমার অপরাধী জীবনের সাথেও তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।”

“একদম ঠিক, ফাত্তাহ,” প্রফেসর তুড়ি বাজিয়ে উঠল। “জুবায়েরের সাথে তোমার অপরাধী জীবনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই কিন্তু এই ঘটনার সাথে ঠিকই আছে। তাই না? কারণ যে জাপানিজ কোম্পানির হয়ে সে কাজ করে সেই কোম্পানিই বাংলাদেশে সিটি রেলের প্রজেক্ট সম্পন্ন করেছে এবং ওরা আরও বড় একটা চুক্তি করতে যাচ্ছে আজ। তোমার ঘৃণার বাংলাদেশের সাথে। আর সেই চুক্তির অন্যতম অগ্রদূত তোমার ছেলে আবদুল্লাহ আল জুবায়ের, তাই না?”

ফাত্তাহ কোনো কথা না বলে তাকিয়ে আছে প্রফেসরের দিকে। তার ভালো চোখটার দৃষ্টিতে রাগ-ক্রোধ, হতাশা-স্নেহ আর উদ্বিগ্নতা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। কিন্তু সে কিছুই বলল না।

“আমি কোনোদিনই এটা মেনে নিতে পারব না যে তুমি বিশ্বের সেরা বোমারু আজ বাংলাদেশে একটা বোমা মারতে যাচ্ছ যেদিন তোমারই ছেলে আবদুল্লাহ আল জুবায়ের বাংলাদেশের জন্য বিগত দশকের সবচেয়ে বড় চুক্তিগুলোর একটা করতে যাচ্ছে এই ঢাকাতেই। তুমি যদি বলো এই দুটো ঘটনার ভেতরে কোনো সম্পৃক্ততা নেই তবে আমি বলব তুমি পৃথিবীর সেরা বোকা লোক,” বলে প্রফেসর আঙুল তুলল। “ হয় এই ঘটনার সাথে তোমার ছেলে জড়িত। কারণ সে-ই তোমাকে এই বোমাবাজির জন্য সব তথ্য দিয়েছে, আর না হয় তুমি নিজের ছেলেকেই মেরে ফেলার জন্য এই বোমা সেট করেছ। এখন বলো এই দুটোর কোনটা সত্য?”

প্রফেসরের কথা শেষ হতেই ফাত্তাহ চেঁচিয়ে উঠল। “এই দুটোর কোনোটাই সত্য নয়। আমি নিজে মরে যাব কিন্তু কোনোদিনই জুবায়েরকে—”

“যদি তাই হয়, তবে আমরাসহ সবাই এমনকি তোমার ছেলের মৃত্যুও এখন স্রেফ সময়ের ব্যাপার মাত্র।”

“মানে?”

“মানে খুব সহজ ফাত্তাহ, তোমার ছেলের প্লেন প্রায় এক ঘণ্টা আগে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করেছে এবং এই মুহূর্তে সে তার অফিসের অ্যাসোসিয়েটদের সাথে মতিঝিলের দিকে যাচ্ছে যেখানে এতদিন ধরে তাদের গড়ে তোলা সিটি রেলের উদ্বোধন হতে চলেছে এবং যেখানে সকালে সিটি রেলের মূল স্ট্রেশনের বাইরে মেট্রো সেন্টারে ভবনটা উদ্বোধনের পর জাপান আর বাংলাদেশের ভেতরে সেই চুক্তি সম্পন্ন হবে,” বলে প্রফেসর একবার মাথা নাড়ল। “চয়েজ এখন তোমার।”

ফাত্তাহ খুব শান্তভাবে হেসে উঠল, “প্রফেসর তুমি কি আমাকে বোকা ভেবেছ। তোমার হাতের ঘড়ি যে সময় দিচ্ছে সেটা অনুযায়ী আমার ছেলের প্লেন ল্যান্ড করতে আরও দুই ঘণ্টা বাকি। আর এর মধ্যেই তোমাদের ঢাকা ম্যাসাকার হয়ে যাবে। তোমাদের সিটি রেল সহ সব শেষ হয়ে যাবে,” ফাত্তাহর গলায় পুরনো উল্লাস।

“ওহো, এটা?” বলে প্রফেসর মৃদু হেসে উঠল। “ফাত্তাহ। আমি তোমাকে বলেছিলাম না আজ রাতে আমাদের কথোপকথনের ব্যাপারটা ছিল স্রেফ বাইরের আবরণ। এর বাইরে এবং ভেতরে তুমি আমি দুজনের মধ্যে অনেকগুলো খেলা চলছিল। তবে মূল খেলাটা কী ছিল জানো? এই সময়ের ব্যাপারটা। আমার এই ঘড়ির ব্যাপারটা পুরোপুরিই ভূয়া।”

“এর মানে কী?” ফাত্তাহর দৃষ্টি সরু হয়ে উঠছে

“মানে হলো, আমি তোমাকে বলেছিলাম না এই রুমে ঢোকার আগে আমি বেশ কিছুক্ষণ তোমাকে অবজার্ভ করছিলাম। তখনই প্রথম অবাক হয়ে দেখলাম তুমি বারবার দেওয়ালের দিকে তাকাচ্ছ, যেখনে সাধারণত দেওয়ালঘড়ি থাকে। খুব সামান্য হলেও মৃদু একটা অস্থিরতা যেন তোমার ভেতরে। ব্যাপারটা নিয়ে ঠিক নিশ্চিত না হলেও কেন জানি মনে হচ্ছিল তুমি সময় জানতে চাইছ এবং যেকোনো কারণেই সময় নিয়েই তোমার ভেতরে একটা অস্থিরতা কাজ করছে। এরপর আমি রুমে ঢোকার আগে ইচ্ছে করেই ঘড়িতে সময় দুই ঘণ্টা পিছিয়ে রাখি। রুমে ঢুকে আমি চেয়ারে বসতেই দেখি তুমি প্রথমেই আমার ঘড়িতে সময়টা দেখে নিলে। এরপর অসংখ্য বার তুমি আমার ঘড়ি দেখেছ। কথা বলার সময় তুমি আসলে ভাবছিলে তুমি সময় ক্ষেপণ করছ সঠিক সময়ে বোমাটা ব্লাস্ট করার জন্য, আসলে সময় ক্ষেপণ করছিলাম আমি। এই ঘড়ির ব্যাপার পুরোই ছিল হোক্স,” বলে প্রফেসর হেসে উঠল।

“আর কত মিথ্যে বলবে প্রফেসর?” ফাত্তাহ তালি দিয়ে উঠল।

“প্রমাণ দিচ্ছি। তোমার ছেলে যে এয়ারপোর্টে এসেছে তারও প্রমাণ দিচ্ছি,’ বলেই প্রফেসর একমুখী কাচটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “আফসার, একটা ল্যাপটপ নিয়ে এসো সেন্ট্রাল সিকিউরিটি সার্ভারে ঢোকার ব্যবস্থা থাকে যেটাতে,” বলে প্রফেসর একবার ফাত্তাহকে দেখে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

একটু পরেই একজন গার্ডসহ রুমে প্রবেশ করল আফসার। তার হাতে একটা অ্যাপলের ল্যাপটপ। সেটাকে প্রফেসরের সামনে রাখতেই সে ফাত্তাহর সামনে দিতে বলল সেটা। সেইসাথে আফসারকেও রুমে থাকার জন্য নির্দেশ দিল।

ফাত্তাহর দিকে ল্যাপটপটা ঘুরিয়ে দিতেই প্রফেসর বলে উঠল, “প্রথমে ল্যাপটপের ঘড়িতে সময়টা দেখ। যদি সেটাও বিশ্বাস না হয় তবে গুগলে ঢুকে ঢাকার বর্তমান সময়টা দেখে নাও,” বলে সে নিজের ঘড়িটা দেখাল। “এটার সাথে মেলে কি না দেখো।”

ফাত্তাহ দ্রুত টাইপ করে অস্ফুট শব্দ করে উঠল

“নিশ্চই দেখছ। এবার আফসার, তুমি তোমার স্পেশাল আইডি ব্যবহার করে এয়ারপোর্ট সেন্ট্রাল কমিউনিকেশন জোনে ঢোক। পারবে না, এখান থেকে?”

“পারব স্যার,” বলে আফসার কাজে লেগে গেল। “স্যার হয়েছে।

“এবার ওকে দিয়ে এয়ারপোর্টের তিন নম্বর টার্মিনালের ছয় নম্বর গেটের ক্যামেরার ফুটেজ ফিড ওপেন করত বলো,” বলে সে সময়টা বলে দিল। ফাত্তাহ নিজেই টাইপ করে নির্দিষ্ট সময়ের ফুটেজটা বের করল। ফাত্তাহর পেছন থেকে আফসার দেখতে পেল সাদা ট্রাউজার আর কালো জ্যাকেট পরা দশ-পনেরোজন জাপানিজ গেট দিয়ে বেরিয়ে আসছে, না তাদের ভেতরে একজন ভিন্ন চেহারার মানুষও আছে। লম্বা গড়নের ফরসা একটা ছেলে, কালো চুল। তাকে স্ক্রিনে পরিষ্কার দেখা যেতেই ফাত্তাহ দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।

আফসার একবার তাকে দেখে নিয়ে প্রফেসরের দিকে তাকাল। “সময়টা দেখো ফাত্তাহ, আরও বেশ অনেকক্ষণ আগে।” প্রফেসরের মুখে কোনো ভাব নেই সে টেবিলের দিকে তাকিয়ে নিভে থাকা পাইপটা টেনেই চলেছে। “এখন বলো ফাত্তাহ, বোমাটা কোথায় রেখেছ। আমি জানি তোমার মতো মানুষ নিজের জীবনের পরোয়া করে না। কিন্তু তোমার ছেলের জীবনের পরোয়া যদি তুমি করো, তবে বলো বোমাটা কোথায়?”

হঠাৎ টেবিলের ওপরে জোরে একটা চাপড় দিয়ে ফাত্তাহ বলে উঠল, “যথেষ্ট হয়েছে প্রফেসর,” বলে সে নিজের একটা হাত তুলল। “আজ রাতে তুমি একের পর এক মিথ্যে বলেই চলেছো, বলেই চলেছ। একের পর এক ধোঁকা দিয়েই চলেছ। আর বিশ্বাস করি না আমি তোমার এসব ধোঁকাবাজি আর মিথ্যে কথা।”

“দারুণ বলেছ ফাত্তাহ। আমিও সেটাই চাই,” পাইপটাকে ঠোঁটের কোণে কামড়ে ধরে প্রফেসর আনমনেই বলে উঠল। “আমার কথা বিশ্বাস করার কোনো প্রয়োজন নেই তোমার। আসলেই তো আমি ধোঁকাবাজি করছি কি না সেটা প্রমাণ করার মতো আর কী করতে পারব আমি, বলো। তোমার ছেলে বাংলাদেশে ঢোকার সিসিটিভি ফুটেজ দেখানোর পরও তুমি যদি বিশ্বাস না করো সেক্ষেত্রে আমিও তোমাকে সেই চয়েজটাই দেব যেটা তুমি গত সন্ধেয় আমাদেরকে দিয়েছিলে।”

প্রফেসর থেমে গেছে, ফাত্তাহ এখনও তাকিয়ে আছে তার দিকে। “তুমি আমাদেরকে চয়েস দিয়েছিলে, বোমা আছে কি নেই সেটার ব্যাপারে বিশ্বাস করা না করা আমাদের ব্যাপার। আর তোমার ছেলে ইতোমধ্যেই এদেশে এসেছে কি আসেনি এটাও বিশ্বাস করা তোমার ব্যাপার। তুমি এখন সেটা বিশ্বাস করে বোমাটা কোথায় আছে বলে দিতে পার। আর না হয় সে আসেনি এটা বিশ্বাস করে বোমাটা ফাটিয়ে দিতে পার,” থেমে সে মৃদু শুষ্ক হাসি হেসে বলে উঠল। “সিদ্ধান্ত এখন তোমার।”

ফাত্তাহ নিজের মুখ ঢেকে ফেলল।

আফসার তাকিয়ে আছে প্রফেসরের দিকে। পৃথিবীর সমস্ত কৌতূহল তার দৃষ্টিতে। প্রফেসর তার দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল একবার। “কিন্তু আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, তোমার ছেলের সাথে তোমার হয়েছিল কী? তুমি– “

শুধু আমার সাথেই এরকম কেন হবে প্রফেসর?” ফাত্তাহ মুখ তুলে হঠাৎ খুব আবেগি গলায় বলে উঠল। এমনকি সে একবার আফসারের দিকেও তাকাল প্রায় একই ভঙ্গিতে। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল প্রফেসরের ওপর। প্রফেসর দেখল তার দৃষ্টিতে একজন বাবার আকুতি। এই দৃষ্টি প্রফেসর খুব ভালোভাবেই চেনে।

“প্রথমে আমার বাবা, সেই ছোটবেলায় যখন কিছুই বুঝতাম না প্ৰায় কিন্তু দেখতাম এই দেশের, এই মাটির প্রতি আমার বাবার ভালোবাসার কোনো সীমা নেই। আমার মা সহ্য করতে পারত না। আর সেটারই বীজ সে রোপণ করে দিয়েছিল আমার ভেতরে,” ফাত্তাহর চোখে পানি। “তারপর বাবাকে নিজ হাতে খুন করে… এরপর বহুকাল, বহু যুগ পর আমি সব হারিয়ে ফেলার পরও যে মানুষটার জন্য বাঁচতে ইচ্ছে হতো, যে মানুষটা বড় হয়ে সভ্য সাধারণ মেধাবী একজন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিল, ভেবে গর্বে আমার বুক ফুলে উঠত।”

ফাত্তাহ এই পর্যন্ত বলে থেমে গিয়েও আবারও ভেজা গলায় বলতে লাগল, “যে জিনিসটা ছিল তোমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান। কিন্তু সেটা আর তোমার নেই। সময়ের সাথে হারিয়ে গেছে। তবুও হয়তোবা দূর থেকে সেটাকে নিজের চোখে বেড়ে উঠতে দেখছ তুমি, সেটাও যে কত শান্তির আর স্বস্তির। আর সেই ভালোবাসা যে কত গভীর। প্রফেসর তুমি জানো না একজন বাবার জন্য নিজের সন্তানকে এমনকি দূর থেকেও ভালোবাসতে পারা কতটা আনন্দের।”

মুখে কিছু না বললেও আনমনেই মাথাটা নড়ে উঠল প্রফেসরের, সন্তান দূরে সরে যাওয়ার যন্ত্রণা এই পৃথিবীতে তার চেয়ে ভালো আর কে জানে।

এক বুক যন্ত্রণা আর ভেজা চোখ নিয়ে বলে চলেছে ফাত্তাহ। “তারপর সেই ভালোবাসা একদিন পরিণত হলো ঘৃণায়। আমার একমাত্র সন্তান প্রফেসর, একদিন সে তার মামার কাছে জানতে পারে তার অরিজিন এই বাংলাদেশের মাটিতে। জাপানিজ কোম্পানির সাথে চলে আসে এখানে কাজ করতে। সে যেদিন আমাকে বলল, সে বাংলাদেশকে ভালোবাসে, সেদিন মনে হয়েছিল আমি অকারণেই এত বছর বেঁচে ছিলাম। পৃথিবীর সাথে, পরিবারের সাথে সমাজের সাথে আমার শেষ সুতোটা সেদিনই কেটে গিয়েছিল। বেঁচে ছিল শুধু এই দেশের ওপরে একটা প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে।”

“নাকি নিজের সন্তানের চোখে—”

“প্রফেসর তুমি কিছুই জানো না,” ফাত্তাহর গলায় আবেগের ঝড়। “যে দেশটাকে তুমি চিরকাল ঘৃণা করেছ, তোমার একমাত্র সন্তান যখন সেই দেশকেই ভালোবেসে তার অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখতে চায় তখন কেমন লাগে। আমার নিজের সন্তান প্রফেসর। এই বোমা, এইসব আসলে তার চোখে নিজেকে… আমি বোমাটা এমনভাবে সেট করেছিলাম যাতে সে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে শহরের ধ্বংসস্তূপ দেখতে পায়। কিন্তু সেটা তো হলো না তোমার কারণে। বরং—” দুই হাতে মুখ ঢেকে ফাত্তাহ ফুঁপিয়ে উঠল।

“তার মানে ধর্ম-রাষ্ট্র-অর্থ এসব কিছুই না। পুরো ব্যাপারটাই ছিল আসলে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ। মানসিক প্রতিশোধ। শুরু থেকেই তাই ছিল,” প্রফেসর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল একবার। “বোমাটা কোথায় আছে আমি সে ব্যাপারে সামান্য আন্দাজ করতে পারি ফাত্তাহ, তবুও আমার অনুরোধ থাকবে তুমিই সেটা বলো।”

ফাত্তাহ মুখ নিচু করেই বলতে লাগল। “যেখানে সিটি রেলের মূল স্টেশনের উদ্বোধন হবে, বোমাটা তার থেকে এক ব্লক দূরে সাতাশ তলা জুম সেন্টারের বেইজমেন্টের নিচে একটা খালি পানির ট্যাংকের ভেতরে রাখা আছে। ওটা ডি-অ্যাকটিভেট করতে কোনো কোড লাগবে না,” ফাত্তাহর মুখ থেকে শব্দগুলো উচ্চারিত হওয়ার সাথ সাথে আফসার টকিতে সেটা জানিয়ে দিল।

“বোমাটা ওখানে সেট করা হয়েছে একাধিক কারণে। প্রথমত, ভবনটা সিটি রেলের উদ্বোধন অনুষ্ঠানের মূল সিকিউরিটি জোনের বাইরে হওয়াতে কারো জন্যই ওটার খোঁজ পাওয়া কঠিন। দ্বিতীয়ত, সম্ভবত ওই বিল্ডঙেই বোমাটা বাস্ট করলেই সেটা ধসে পড়বে সিটি রেলে মূল লাইনের ওপরে। ঠিক কি না? রেলটা উদ্বোধন হয়ে এক ব্লকও যেতে পারত না। তার আগেই বিল্ডিংটা ধরে পড়ে ট্রেনসহ লাইনটাকে ভূপতিত করত। কত মানুষ মরত ফাত্তাহ, স্রেফ তোমার ইগোকে সন্তুষ্ট করতে…!” আফসোসের সাথে মাথা নাড়ল প্রফেসর।

ফাত্তাহ মাথা নিচু করে আছে স্থির ভঙ্গিতে।

প্রফেসর একবার আনমনে মাথা নাড়তে নাড়তে বলে উঠল, “ফাত্তাহ তুমি ভেবেছ তুমিই একমাত্র ব্যক্তি যে কি না এই সমাজের এই সিস্টেমের কষাঘাতে জর্জরিত। আসলে তুমি একেবারেই ভুল,” বলে সে নিজের চোখে পড়ে থাকা কফি কালারের চশমাটা ডান হাতে ধরে সাবধানে খুলে ফেলল।

আফসার দেখল অপূর্ব সুন্দর বাদামি একটা চোখ তাকিয়ে আছে ফাত্তাহর দিকে। কিন্তু অপর চোখটার বাদামি মণির ভেতরে বিশ্রী সাদোটে মেঘের মতো দাগ বিকৃত করে তুলেছে ওটাকে। একজন সাইকোলজির স্টুডেন্ট হিসেবে আফসার জানে এই দাগগুলোকে মেডিকেলের ভাষায় বলা হয় ‘ট্রমাটিক ক্যাটেরাক্ট”। কোনো মানুষ ভয়ংকরতম ট্রমার মধ্য দিয়ে গেলেই একমাত্র এই দাগ হওয়া সম্ভব। তীব্রতর সাইকোলজিক্যাল নির্যাতন কিংবা মানসিক চাপ ছাড়া এরকমটা হওয়া সম্ভব নয়। প্রফেসরের পালিশ করা চেহারার আড়ালে এরকম ভয়ংকর মানসিক আঘাতের ক্ষত আছে, ভাবাই যায় না।

প্রফেসরের খোলা চোখের দিকে খুব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফাত্তাহ এবং আফসার দুজনেই। নিজের চোখের দিকে ইশারা করে প্রফেসর বলে উঠল, “তুমি মূল খেলাটাই ধরতে পারোনি ফাত্তাহ। আমাদের সমাজ আমাদের সিস্টেম আমাদেরকে প্রতিনিয়ত কষাঘাতে জর্জরিত করেই চলেছে। ব্যাপারটা আঘাতের নয়, ব্যাপারটা আঘাত সহ্য করে ঘুরে দাঁড়ানোর। তোমার আর আমার মধ্যে পার্থক্য কি জানো ফাত্তাহ?” প্রশ্নটা করে প্রফেসর নিজেই বলে উঠল।

“আমরা দুজনেই সময়-সমাজ আর জীবনের আঘাতে জর্জরিত হয়েছি। তুমি সেই আঘাত পৃথিবীকে তিন গুণ ফিরিয়ে দিতে চেয়েছ। আর আমি সবসময় চেষ্টা করেছি যে আঘাত আমি পেয়েছি সেই আঘাত যেন অন্য কেউ না পায়। এই হলো আমাদের দুজনের মধ্যে পার্থক্য,” বলে সে চশমা আর পাইপটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো রুমের বাইরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *