শব্দজাল – ১১

১১

প্রফেসর একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লোকটার দিকে। সে কিছু বলার আগেই কানের ভেতরে লাগানো এয়ার পিসে আফসারের গলা ভেসে এলো, ‘স্যার, লোকটা আপনাকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে।

প্রফেসর এখনও কিছু বলেনি, একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে সে মৃদু হেসে উঠল। “আপনার জন্য আরেকটা দুঃখের ব্যাপার মি. অ্যালবার্ট, আমি এক্সপার্ট কেউ তো নয়ই, অথরিটির লোকও নই। এমনকি আমি আইন প্রয়োগকারী সংস্থারও কেউ নই। আমি শুধুই একজন রিটায়ার্ড প্রফেসর।”

প্রফেসর ভেবেছিল লোকটা আবারও হেসে উঠবে কিংবা তীক্ষ্ণ কিছু বলবে আঘাত করার জন্য কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখল হঠাৎ মানুষটা সিরিয়াস হয়ে উঠল।

“সর্বনাশ! কী বলেন আপনি! এই দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবস্থা বর্তমানে এতটা খারাপ যে তাদের সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থায় একজন নন প্রফেশনালের সাহায্য নিতে হচ্ছে! ওহো গড! আর আমি কি না এদেশে বোম মারতে এসেছিলাম,” বলে সে আবারও বাঁশ ফাটা হাসি হাসতে লাগল। তার সাথে সাথে প্রফেসরও হেসে উঠল। “হয়তোবা। আপনি কিছু মনে না করলে,” বলে সে সামনে থাকা কাঠের বাক্সটা এগিয়ে দিল ফাত্তাহর দিকে।

ফাত্তাহ একটু অবাক হয়ে তাকাল বাক্সটার দিকে, তারপর অনেক বেশি অবাক হওয়ার ভান করে সে বলে উঠল, “ওমা, কী আছে ওটার ভেতরে? বোমা-টোমা নেই তো,” বলে সে বাচ্চাদেরকে যেভাবে ভয় দেখানো হয় সেরকম করে উঠল।

“মি. অ্যালবার্ট,” প্রফেসর সামান্য ভুরু নাচিয়ে বলল, “আমি যখন তামাক নেওয়ার জন্য বাক্সটা খুলেছিলাম আপনি তখনই দেখেছিলেন কী আছে ওটার ভেতরে। ওর ভেতরে বোম-টোম নেই। তবে সিগার আছে। আমি জানি আমাকে পাইপ টানতে দেখে আপনার ধোঁয়ার তৃষ্ণা পেয়েছে। কাজেই চাইলে ধরাতে পারেন,” ইচ্ছে করেই সে আরও একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে দিল টেবিলের মাঝ বরাবর।

ফাত্তাহ খানিকটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে নিজের ঠোঁট নাচিয়ে বাক্সটা নিজের দিকে টেনে নিতে নিতে বলে উঠল, “এর জন্য আবার মূল্য চুকাতে হবে না তো?”

“কীরকম?” প্রফেসরও তার বলার ঢংটা নকল করেই জানতে চাইল।

“এই যেমন ধরেন আমাকে একটা সিগার খাইয়ে আপনি জানতে চাইলেন আমি বোমা কোথায় লুকিয়ে রেখেছি,” বাক্সটা থেকে সে একটা সিগার উঠিয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে উঠল।

প্রফেসরও হেসে উঠল তার সাথে। নিজের কাচা-পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলে উঠল, “ট্রাস্ট মি, এত অল্প কিছু চাইব না আমি। চাইলে আরও বেশি কিছু চাইব।’

“আপনি খুব মজার লোক প্রফেসর,” বলে সে কাঠের বাক্সটার ভেতরে দুই পার্টের এক পাশে রাখা একটা সিগার তুলে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। “মাই গুডনেস, আসল হন্ডুরান সিগার,” সিগারটার স্টিলের কভারটার ক্যাপটাকে মোচড় দিয়ে খুলে ভেতর থেকে কফি কালারের সিগারটা বের করে নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রাণ নিল সে। “এই জিনিস এরা পেল কোথায়?” বলে সে ভালো চোখটা সামান্য সরু করে সে জানতে চাইল, “নাকি এই আয়োজন আপনার?” বলে মাথাটাকে সামান্য ঝাঁকিয়ে মন্তব্য করার মতো করে বলে উঠল। “আমি যা ভাবছিলাম আপনি আসলে তা নন প্রফেসর। তা না হলে এই জিনিসটা আপনি আমাকে অফার করতেন না,” বলে সে বাক্সটা থেকে সিগার কাটারটা তুলে নিয়ে ওটার এক মাথা কেটে তাতে আগুন দিয়ে সামান্য নীলচে ধোঁয়া ছাড়ল। ধোঁয়া টানতে টানতে সিগার ধরা হাতের একটা আঙুল তুলে প্রফেসরের দিকে ইঙ্গিত করে বলে উঠল, “তবে আপনি একটা ভুল করেছেন।”

প্রফেসর কিছু না বলে নিজের একটা ভুরু উঁচু করল প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে।

“আমার ধারণা আপনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মানুষ না হওয়াতে এই ভুলটা করেছেন,” বলে সে আবারও হেসে উঠল। তাতে আগের তাচ্ছিল্যের ভাবটা নেই কিন্তু শুষ্কতা পুরোদমেই বিদ্যমান। “এই কাটার ও লাইটার আপনি ইন্টারোগেশন রুমে একজন অপরাধীর হাতে তুলে দিতে পারেন না। এটা মস্ত বড় ভুল।”

তার কথা শুনে প্রফেসর হেসে উঠল, “আপনি এই কাটার আর লাইটার দিয়ে এখন আমাকে আক্রমণ করবেন?”

ফাত্তাহ এক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল প্রফেসরের দিকে, তারপর জোরে হেসে উঠল। “ইউ আর ফানি প্রফেসর, আই টোল্ড ইউ। কিন্তু আমি এখনও বুঝতে পারছি না আপনি কে এবং আপনি এখানে কেন। এই সিগার প্রমাণ করে আপনি বিস্তারিত হোম-ওয়ার্ক করে এখানে এসেছেন। হাভানার চুরুট সারা বিশ্বে জনপ্রিয় কিন্তু আমি নিজে ল্যাটিন আমেরিকান দেশ হন্ডুরাসের চুরুট বিশেষভাবে পছন্দ করি –”

“কারণ এটা অনেক বেশি কড়া,” প্রফেসর নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে চোখ তুলে তাকাল ফাত্তাহর দিকে। “ঠিক এ কারণেই আপনি এটা পছন্দ করেন। তাই না?”

ফাত্তাহর মতো মানুষ জীবনের এমন সব ধাপ পার হয়ে এসেছে যে এদের অবাক হওয়ার ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হেসে উঠলেও তার ভালো চোখটার দৃষ্টিতে কয়েক স্তরের ভেতরে একটা স্তরে অন্তত বিস্ময় দেখতে পেল প্রফেসর।

ফাত্তাহ একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতেই জানতে চাইল, “কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, আপনি এই প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পেলেন কখন?”

“আপনি যেটাকে প্রস্তুতি বলছেন আমি সেটাকে এখন পর্যন্ত বলব লাক, বলে প্রফেসর একমুখী কাচের দিকে তাকিয়ে একটা ইশারা করল। প্রফেসরের ইশারার একটু পরেই রুমের একমাত্র দরজাটা নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো শব্দ করে খুলে গেল। দরজাটা খুলে যেতেই সেখানে উদয় হলো অস্ত্র হাতে একজন কমান্ডো। তার পেছনে ট্রে হাতে একজন মানুষ। ট্রে হাতে নিয়ে মানুষটা টেবিলের সামেন এসে টেবিলের ওপরে দুটো কফির মগ নামিয়ে রাখল। দুটো থেকেই ধোঁয়া উড়ছে। কাপ দুটো টেবিলে রেখে মানুষটা ফিরে যাচ্ছিল প্রফেসর পেছন থেকে বলে উঠল, “এক মিনিট। এটা খোলার ব্যবস্থা করো, ফাত্তাহর হাতে লাগানো হাতকড়াটার দিকে ইশারা করল প্রফেসর।

“স্যার?” লোকটা বেকুবের মতো একবার প্রফেসরের দিকে দেখল, আরেকবার ভীত দৃষ্টিতে ফিরে তাকাল ফাত্তাহর দিকে। সবশেষে সে একবার কমান্ডোটাকে দেখে নিয়ে বলে উঠল, “স্যার, আমার সে অনুমতি নেই। আফসার স্যার বললে অবশ্য আলাদা কথা।”

প্রফেসর নিজের ডান দিকে থাকা কাচটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “আফসার, এটা খোলার ব্যবস্থা করো। আমি এভাবে কথা বলতে পারব না।”

সাথে সাথে এয়ারপিসের ভেতর দিয়ে আফসারের গলা ভেসে এলো, ‘স্যার, এটা কী বলছেন আপনি?’ একটু থেমেই সে আবারও বলে উঠল, ‘আতিক স্যারও আপত্তি করছেন।’

“আফসার, আমার সামনে একজন মানুষ বাঁধা থাকলে আমি তার সাথে এভাবে কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারব না। তুমি হাতকড়া খোলার ব্যবস্থা করো।” ওপাশে আফসার নীরব, একটু পরে সে অসহায়ের মতো বলে উঠল, ‘স্যার, ব্যাপারটা আপনার জন্য অনেক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।’

“আফসার, যা বলছি করো, বাকিটা আমি দেখব,” বলেই নিজের কফির মগটা উঠিয়ে নিয়ে চুমুক দিয়ে ফাত্তাহকে অনুরোধের ভঙ্গিতে কাপটা নিতে বলল। ফাত্তাহ একদৃষ্টিতে তার ভালো চোখটা দিয়ে তাকিয়ে আছে প্রফেসরের দিকে। সেভাবে তাকিয়ে থেকেই সে তুলে নিল মগটা। দুজনেই নীরবে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। একটু পরে আফসার নিজেই রুমে প্রবেশ করে চাবি দিয়ে ফাত্তাহর হাত থেকে হ্যান্ডকাফ খুলে চেনটা ধরিয়ে দিল কফি নিয়ে আসা লোকটার হাতে। “স্যার, একজন গার্ড কি ভেতরে থাকবে?”

প্রফেসর তার দিকে তাকিয়ে একবার মৃদু হেসে বলে উঠল। “লাগবে না।” আফসার নীরবে আরেকবার দুজনকে দেখে নিয়ে বের হয়ে গেল নিজের লোকদের নিয়ে।

“প্রথমে সিগার,” ফাত্তাহর এক হাতে সিগার অন্য হাতে কফির মগ। কিন্তু সে তাকিয়ে আছে প্রফেসরের দিকে। “এরপর স্পেশাল ব্রাজিলিয়ান বাটার নাটের কফি? আমার পারটিকুলার ফেভারেট। এটাও কি লাক প্রফেসর? আপনি যাই বলেন এটাকে আমি সাধারণ ‘গুড কপ-ব্যাড কপ’ রুটিন মানতে নারাজ।”

নিজের কফির কাপে চুমুক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল প্রফেসর। পাইপটাকে নামিয়ে রেখে একটা আঙুল তুলে চশমার ঘোলাটে কাচের অন্যপাশ থেকে নিজের দৃষ্টি স্থাপন করল ফাত্তাহর ভালো চোখে। তারপর বলে উঠল— “এটা লাক নয় মি. অ্যালবার্ট, এটা হলো প্রস্তুতি।”

ফাত্তাহ কফির কাপে চুমুক দিয়ে সিগারটাকে ডান থেকে বাম হাতে নিয়ে চেয়ারটাকে টেনে নিয়ে এলো টেবিলের একেবারে কাছে। নিজের বিকৃত ক্ষতবিক্ষত চেহারাটা এগিয়ে নিয়ে এলো প্রফেসরের দিকে। তার নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখটার লালচে শিরাগুলো যেন রেডিয়ামের মতো জ্বলজ্বল করছে। না চাইতেও বিকৃত চেহারাটার দিকে তাকিয়ে একাধিকবার নিজের চোখের পলক ফেলল প্রফেসর।

নিজের শক্তিশালী হাত দুটোকে টেবিলের ঠিক মাঝখানে এনে প্রফেসরের থেকে ঠিক এক ফুট দূরত্বে মুখটাকে স্থির করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল, “তুমি প্রফেসর আমাকে সিগার অফার করে, কফি খাইয়ে আর হাতকড়া খুলে দিয়ে যদি ভেবে থাকো আমাকে প্রভাবিত করতে পেরেছ, তাহলে আমি তোমাকে জানাতে চাই, তুমি আমার কাছে তৃতীয় শ্রেণির একটা গর্দভ ছাড়া আর কিছুই নও। তোমার প্রস্তুতি, তোমার পরিকল্পনা যাই থাক না কেন, কোনোটাই কোনো কাজে লাগবে না। বোঝা গেছে?”

মানুষটার ভয়ংকর আর বিকৃত চেহারার দিকে স্থির তাকিয়ে থেকে একবার নিজের ধূসর দাড়িতে হাত বুলিয়ে নিল প্রফেসর জাকারিয়া আহমেদ জ্যাক। তারপর যেন বিকেলের আড্ডায় গল্প করছে এমন সুরে বলে উঠল, “আপনার এত সিরিয়াস হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই মি. অ্যালবার্ট,” বলে সে পাইপের প্রায় শেষ হয়ে আসা তামাকে শেষবারের মতো টান দিয়ে বলে উঠল, “আমি শুধুই আপনার সাথে কথা বলতে চাই। দ্যাটস ইট,” বলে সে টেনে নেওয়া ধোঁয়াটুকু ছেড়ে দিল নিঃশ্বাসের সাথে। সেইসাথে তার মুখে খেলা করে গেল মৃদু হাসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *