লোকায়ত ধর্ম ও যুক্তসাধনা

লোকায়ত ধর্ম ও যুক্তসাধনা

বাঙলার গৌরবময় প্রাচীন সংস্কৃতির অবসান ঘটেছিল মুসলমানগণ কর্তৃক বাঙলা বিজিত (১২০৪) হবার পর। মনে হয়, ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তুর্কি আক্রমণের ফলে বাংলাদেশে সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যক্ষেত্রে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল। এই বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে অভ্যুত্থান ঘটেছিল অনেক লোকায়ত দেবদেবীর। পূর্বে এই সকল দেবদেবী সমাজের নিম্নকোটির লোকগণ কর্তৃক পূজিত হতেন। মুসলমান রাজগণের আমলে ব্রাহ্মণশাসিত সমাজের মধ্যে শৈথিল্য ঘটায় নিম্নশ্রেণি কর্তৃক পূজিত বহু দেবদেবী প্রাধান্য লাভ করতে থাকেন। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন শীতলা, বাশুলী, মনসা, চণ্ডী ইত্যাদি। হিন্দু দেবতামণ্ডলে স্থান দেবার জন্য তাঁদের অধিকাংশকে শিবজায়া উমার সহিত অভিন্ন করা হয়। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, এ যুগের হিন্দুসমাজে গৃহিত এই সকল দেবদেবী বাঙলাদেশে সুপ্রাচীন কাল থেকেই পূজিত হয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সমাজের নিম্নশ্রেণি কর্তৃক পূজিত এই সকল দেবদেবী ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যে স্বীকৃতি লাভ করতে পারেনি। তার প্রধান কারণ ছিল এই যে, আর্যসমাজের প্রধান দেবতাসমূহ ছিল পুরুষদেবতা, আর আর্যের সমাজের প্রধান দেবতাসমূহ ছিলেন নারীদেবতা। আর্যদেবতাসমূহ যতই প্রাধান্য লাভ করতে লাগলেন, আর্যেতর এই সকল নারীদেবতাসমূহ ততই পর্বতকন্দরে, ঝোপজঙ্গলে বা গাছতলায় আশ্রয় লাভ করলেন। কিন্তু মধ্যযুগে যখন ব্রাহ্মণ্যধর্মের ভিত্তি টলমল করে উঠল, তখন এই সকল নারীদেবতা তাঁদের পর্বতকন্দর, ঝোপজঙ্গল ও গাছতলার আশ্রয় পরিহার করে ক্রমশ হিন্দুর আনুষ্ঠানিক ধর্মসংস্কারের মধ্যে প্রবেশ লাভ করতে লাগলেন। এই অনুপ্রবেশকে সহজ করবার জন্য তাঁদের পৌরাণিক মাতৃদেবীর সঙ্গে অভিন্ন প্রতিপন্ন করা হল।

আর্যেতর এই সমস্ত দেবদেবীকে নিয়ে এক নতুন সাহিত্য গড়ে উঠেছিল। মধ্যযুগের এই সাহিত্যকে ‘মঙ্গল সাহিত্য’ বলা হয়। ‘মঙ্গল সাহিত্য’ সাধারণত চার শ্রেণিতে বিভক্ত— মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল ধর্মমঙ্গল ও শিবায়ন। মনসামঙ্গলের আখ্যান বিষয় ছিল মনসা বা সর্পদেবীর পূজামাহাত্ম্য প্রচার করা। ইনি যোষিগণ কর্তৃক নানা নামে পূর্জিতা হতেন। মধ্যযুগে তাঁর দুই নাম প্রাধান্য লাভ করেছিল, যথা— মনসা ও পদ্মা। যোষিগণ কর্তৃক পূজিতা এই দেবীকে পুরুষসমাজের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মনসামঙ্গলসমূহের কাহিনীতে সেটাই প্রকাশিত হয়েছে। মনসার কোপে পড়ে চাঁদ সদাগর তার সাতপুত্র ও সাতডিঙ্গিভরা পণ্যসম্ভার হারালেন, কিন্তু, তথাপি তিনি মনসার পূজা থেকে বিরত রইলেন। যখন পুত্রবধূ বেহুলা মনসার কৃপালাভ করে নিজ স্বামী ও ছয় ভাশুরের পুনর্জীবন দান করাল ও নিমজ্জিত সাতখানি ডিঙ্গি পণ্যসম্ভার সমেত ফেরত আনল, তখনও বেহুলা তার শ্বশুরকে মাত্র একবারের জন্যও মনসাদেবীর পূজায় সম্মত করাতে পারল না। ঘৃণার সঙ্গে চাঁদ সদাগর পুত্রবধূকে উত্তর দিলেন, ‘আমার সাতপুত্র ও সাতডিঙি ধনদৌলত রসাতলে যাক্, তবুও আমি মনসার পূজা করব না।’ যেহেতু চাঁদ শিবোপাসক ছিলেন, সেই হেতু শিবপত্নী চন্ডীকে তখন হস্তক্ষেপ করতে হল। স্বপ্নে আবিভূতা হয়ে তিনি চাঁদকে বললেন, চাঁদ, তুমি পদ্মাবতীকে পূজার্ঘ্য দাও, কেননা পদ্মাবতী আমি ছাড়া আর কেউ নয়। এই স্বপ্নাদেশের পরেই চাঁদ সম্মত হয়েছিলেন পদ্মাবতীকে পূজার্ঘ্য দিতে। এইরূপে মনসার পূজা নিষ্ঠাবান হিন্দুসমাজে প্রতিষ্ঠিত হল। হিন্দুসমাজ তখন মনসাকে পুরাণেও স্থান দিলেন। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের কাহিনী অনুযায়ী মনসা সর্পগণের দেবী। ব্রহ্মার আদেশে কশ্যপমুনি সর্পমন্ত্রের সৃষ্টি করেন ও তপোবলে মন দ্বারা তাকে সৃষ্টি করে তাঁকে মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী করেন। এজন্যই তাঁর নাম মনসা। কুমারী অবস্থায় মহাদেবের কাছে যান ও তাঁর কাছে থেকে স্তব, পূজা ও মন্ত্র ইত্যাদি শিক্ষা করে সিদ্ধা হন ও সর্পদংশন মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে পরিগণিত হন। সেই থেকেই দেবতা, মনু, মুনি, নাগ, মানুষ সকলেই মনসাদেবীর পূজা করতে থাকেন।

‘মঙ্গল’ সাহিত্যসমূহের প্রধানা দেবী ছিলেন মঙ্গলা বা চণ্ডী। তিনি সর্ববিষয়েই সকলে ইষ্টসাধন করেন। মনসার ন্যায় চণ্ডীও পূর্বে নারীগণ কর্তৃক পূজিতা হতেন। দেবীভাগবতে পরিস্কার বলা হয়েছে যে, মঙ্গলা নারীগণ কর্তৃক পূজিতা দেবতা—’যোষিতানাম্ ইষ্টদেবতাম্’। বোধ হয় এই কারণেই ‘মঙ্গলা’-কে অষ্টযোগিনীর অন্যতমা বলা হয়েছে। (‘মঙ্গল পিঙ্গলা ধন্যা ভ্রামরী ভর্তৃকা তথা উল্কা সিদ্ধি সঙ্কটা চ যোগিনী অষ্ট প্রকীর্তিতা’)। এখনও পর্যন্ত মেয়েরা মঙ্গলবার মঙ্গলচণ্ডীর ব্রত পালন করে থাকে। অনুরূপভাবে অষ্টযোগিনীর অন্যতমা সঙ্কটার ব্রতও মেয়েরা পালন করে। সর্ব বিষয়ে যিনি সকলের ইষ্টসাধন করেন তিনিই ‘সর্বমঙ্গল’। ওড়িশার শাক্ত কবি সারলাদাস তাঁর ‘চণ্ডীপুরাণ’ ও ‘বিলঙ্করামায়ণ’-এ সর্বমঙ্গলাকে কালীর সঙ্গে অভিন্নরূপে গণ্য করেছেন। সেখানে বিবৃত হয়েছে যে দুর্গা যখন মহিষাসুর নিধনে অসমর্থা হন, তখন তাঁর সহচরী মনোরমা তাঁকে কালীর বিবস্ত্রা রূপ ধারণ করতে বলেন। সহচরীর এই উপদেশ অনুযায়ী দুর্গা যখন কালীরূপে ধারণ করেন, তখনই তিনি মহিষাসুরকে বিনাশ করতে সক্ষম হন। মনুষ্যসমাজের মঙ্গলসাধক মনোরমার এই উপদেশ কার্যকরী হওয়ায় দুর্গা মনোরমাকে বলেন, তোমার মঙ্গল হউক। আজ থেকে তুমি ‘সর্বমঙ্গলা’ নামে অভিহিতা হবে।

চণ্ডিকা পূজার প্রচার সম্বন্ধে বাংলা চণ্ডীমঙ্গল কাব্যসমূহে দুটি আখ্যান বিবৃত হয়েছে। প্রথমটি ব্যাধ কালকেতু সম্বন্ধে ও দ্বিতীয়টি বণিক ধনপতি সম্পর্কে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই যে সাহিত্যে অন্তর্ভুক্ত হবার অনেক আগে থেকেই যোষিগণ কর্তৃক পূজিতা এই সকল নারীদেবতা-সম্পর্কিত কাহিনী বাঙলার অলিখিত জাতীয় সাহিত্যমানসে সজীব ছিল। সেদিক থেকে মনে হয় যে ব্যাধ কালকেতু সম্পর্কিত কাহিনীটি বণিক ধনপতির কাহিনী অপেক্ষা প্রাচীনতর। এ সকল কাহিনী যে অতি প্রাচীনকালের অলিখিত সাহিত্যের কাহিনী, তা এই উভয় কাহিনীর সারল্যপূর্ণ বর্ণনা থেকেই বুঝতে পারা যায়। বণিক ধনপতির দুই বনিতা ছিল-লহনা ও খুল্লনা (নাম দুটি অষ্ট্রিক সমাজের বলে মনে হয়)। সপত্নী লহনা খুল্লনাকে ছাগল চরাতে পাঠিয়েছিলেন। একটি ছাগল দলচ্যুত হয়ে হারিয়ে যায়। খুল্লনা দুঃখে ও ভয়ে অভিভূত হন। দলচ্যুত ছাগলটিকে খুঁজতে খুঁজতে তিনি এক জায়গায় এসে দেখেন যে পাঁচটি মেয়ে উলুধ্বনি-সহ এক দেবীর পূজায় রত রয়েছে। তারা খুল্লনাকে বলে যে, সে যদি ওই দেবীর পূজা করে, তা হলে সে তার ছাগল খুঁজে পাবে। তাদের কথামত খুল্লনা ওই দেবীর পূজায় প্রবৃত্ত হন এবং অচিরে তাঁরা ছাগল খুঁজে পান। গৃহে প্রত্যাগমন করে খুল্লনা ওই দেবীর পূজা করতে আরম্ভ করেন। কিন্তু শিবোপাসক ধনপতি দেবীপূজা পছন্দ করেন না। ধনপতি খুল্লনার পূজার ঘট ভেঙে দেন। এর কিছুকাল পরে ধনপতি বাণিজ্য উপলক্ষে সিংহল দ্বীপে যান। সিংহল দ্বীপের রাজা তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। এরপর ধনপতির পুত্র শ্রীমন্ত যখন চণ্ডিকার পূজা করেন তখনই ধনপতি কারামুক্ত হন ও দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তারপর থেকে ধনপতিও চণ্ডিকার পূজা করতে শুরু করেন। এর ফলে বাঙলার বণিকসমাজে চণ্ডিকা পূজার প্রবর্তন হয়।

বণিক ধনপতির কাহিনী অপেক্ষা ব্যাধ কালকেতুর কাহিনী প্রাচীনতর সমাজের ইঙ্গিত বহন করে। কালকেতু সমাজের নিম্নকোটির লোক ছিল। তীর, ধনুক ও জাল (পাশ) নিয়ে বন-জঙ্গলে ঘুরে পশু শিকার করে সে তার আহার্য ও জীবিকা সংগ্রত করত। শিকার করে আনা পশুর মাংস ও চর্ম তার স্ত্রী হাটে নিয়ে গিয়ে বেচে আসত। একদিন কালকেতুর জালে এক স্বর্ণগোধিকা ধরা পড়ে। কালকেতু সেটিকে ঘরে নিয়ে আসে। সেই গোধিকা দেবীমূর্তি ধারণ করে। কালকেতু তাঁকে পূজা করতে শুরু করে। এর ফলে অল্পদিনের মধ্যেই কালকেতু বিত্তশালী হয়ে ওঠে। তখন সে জঙ্গল পরিস্কার করে এক নগর স্থাপন করে। উচ্চকোটির লোকেরা প্রথমে সেই নগরে গিয়ে বাস করতে অসম্মত হয়। কিন্তু পরে তার ধন-ঐশ্বর্য ও প্রতাপ নিষ্ঠাবান সমাজকে আকৃষ্ট করে। তারা সেখানে গিয়ে কালকেতু কর্তৃক পূজিতা দেবীর পূজা করতে শুরু করে। কালকেতু কর্তৃক পূজিতা দেবী, চণ্ডিকা ব্যতীত আর কেউই নন। এই আখ্যানে গোধিকার উল্লেখ দেখে মনে হয় যে, কালকেতু কর্তৃক পূজিতা দেবী প্রথমে আর্যেতর জাতি কর্তৃক পূজিতা কোন দেবী ছিলেন, যিনি পরে নিষ্ঠাবান সমাজে চণ্ডিকারূপে গৌরবান্বিত স্থান অধিকার করেছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতে গঠিত কয়েকটি দেবীমূর্তি বাঙলার বিভিন্ন স্থানে পাওয়া গিয়েছে; তাদের পাদমূলে গোধিকামূর্তি দৃষ্ট হয়। সংস্কৃত ভাষায় রচিত মূর্তি নির্মাণ সম্পর্কিত কতকগুলি গ্রন্থে আমরা গোধিকা- বাহিনী দেবীমূর্তির উল্লেখ পাই—’গোধাসনে ভবেদ্ গৌরী লীলয়া হংসবদনা’ ও ‘অক্ষসূত্রং তথা পদ্মম্ অভয়ং চ বরং তথা। গোধাসনাশ্রিতা মূর্তি গৃহে পূজ্যা স্ত্ৰীয়া সদা ॥’ লক্ষণীয় যে এখানেও তাঁকে যোষিগণ কর্তৃক পূজিতা দেবী বলা হয়েছে। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য যে মঙ্গলকাব্যের কতকগুলি কাহিনীতে দেবীকে ‘কমলে কামিনী’ বা ‘পদ্মাসনা দেবী’ বলা হয়েছে। এর দ্বারা লক্ষ্মীর সঙ্গে চণ্ডিকার সম্পর্ক সূচিত হয়।

দুই

আর্যের সমাজে যে কেবল নারীদেবতাই ছিলেন, তা নয়। পুরুষদেবতাও ছিলেন। তবে নারীদেবতার তুলনায় তাঁরা সংখায় অল্প। শিব ও ধর্মঠাকুর তাদের অন্যতম। তাঁদের আশ্রয় করেও মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল। এগুলিকে ধর্মমঙ্গল ও শিবায়ন আখ্যা দেওয়া হয়। ধর্মমঙ্গলের বিষয়বস্তু হচ্ছে ধর্মরাজার পূজা। তিনি আসলে কে? শিব, না বুদ্ধ? না অনার্যসমাজের অপর কোন দেবতা? সে সম্বন্ধে কোন মতৈক্য নেই। তবে তিনি যে আর্যের সমাজের দেবতা, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কেননা, ধর্মঠাকুরের পূজার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে কেবল ডোমজাতীয় লোকরাই এঁর পুরোহিতের কাজ করে। হিন্দু সমাজে ধর্মঠাকুরের পূজা-প্রবর্তন প্রসঙ্গে রাজা কর্ণসেনের পত্নী রঞ্জাবতী ও তাঁর পুত্র ময়নাগড়ের লাউসেনের নাম জড়িত। পালসম্রাট মহীপাল (৯৭৭-১০২৭ খ্রিস্টাব্দ) তখন গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তা থেকে প্রমাণ হয় যে, খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে ধর্মঠাকুরের পূজা হিন্দুসমাজে গৃহীত হয়েছিল। হিন্দুসমাজে গৃহীত হবার পর ক্রমশ ব্রাহ্মণ পুরোহিতরাও ধর্মঠাকুরের পূজায় অংশ গ্রহণ করতে থাকেন। তা ধর্মের গাজন-উৎসবের অনুষ্ঠান ও আচার-পদ্ধতি থেকেও বুঝতে পারা যায়। ধর্মঠাকুর হচ্ছেন নিরাকার, তবে বীরভূমের কয়েক স্থানে তাঁকে শ্যামরায় প্রভৃতি নামেও অভিহিত করা হয়। বলা বাহুল্য এ সকল নাম পরবর্তী কালের নিষ্ঠাবান সমাজ কর্তৃক আরোপিত হয়েছিল।

শিবের সঙ্গে ধর্মঠাকুরের নৈকট্য সূচিত হয় শিবের গাজন-উৎসবের মাধ্যমে। ধর্মঠাকুরের গাজন, শিবের গাজন, আদ্যের গম্ভীরা প্রভৃতি উৎসবের আচার-অনুষ্ঠান প্রায়ই এক। বস্তুত মধ্যযুগের হিন্দুসমাজে শিবই ছিলেন প্রধান উপাস্য দেবতা। বাঙলায় শিবমন্দিরসমূহের প্রাচুর্য থেকেও তাই প্রমাণ হয়। শিবকে অবলম্বন করে যে কাব্য রচিত হয়েছিল তার নাম দেওয়া হয়েছিল শিবায়ন। এই সকল কাব্যে শিবঠাকুরকে আমরা সাধারণ বাঙালী গৃহস্থরূপে দেখি। গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের মতো তিনিও মাঠে চাষ করেন এবং গৌরীর সঙ্গে গৃহস্থজীবন যাপন করেন। বস্তুত মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে গৌরীর বিবাহের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তা সাধারণত বাঙালী মেয়েরই বিবাহ। পতি হিসাবে শিবের মতো পতিই বাঙালী মেয়ের কাঙ্ক্ষিত আদর্শ হয়ে উঠেছিল। এর প্রকাশ পাই কুমারীগণ কর্তৃক বৈশাখ মাসে পালিত শিবপূজায়

তিন

মধ্যযুগে ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে এসে এবং তাঁর দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে হিন্দু সমাজে আরও অনেক দেবদেবী আবির্ভূত হন। তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন সত্যপীর, গাজী সাহেব, বনবিবি প্রভৃতি। এর মধ্যে সত্যপীরের পূজা বিশেষ ব্যাপকতা লাভ করে। সত্যপীরের পূজা কথায় বলা হয়েছে যে, সত্যপীর ও নারায়ণ অভিন্ন। সেজন্য সত্যপীর বর্তমানে সত্যনারায়ণ নামে পূজিত হন।

বলা বাহুল্য, মধ্যযুগে এই সকল যুক্তসাধনামূলক গণতান্ত্রিক দেবদেবীর পূজার উদ্ভবের ফলে, হিন্দুসমাজে মুসলমান কর্তৃক ধর্মান্তর করণের ফলে যে ভাঙনের সম্মুখীন হয়েছিল, তা থেকেই রেহাই পায়।

ধর্মীয় সাধনার ক্ষেত্রে মধ্যযুগের আর এক সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল। এ সম্পদ্রায় হচ্ছে বাউল (সংস্কৃত ‘বাতুল’, তুলনীয় হিন্দী ‘বাউরা’) সম্প্রদায়। এরা সন্ত ও ফকিররূপে বিচরণ করত। মনে হয়, বৈষ্ণব সহজিয়াদের সঙ্গে সুফীদের যোগাযোগের ফলে এদের উদ্ভব ঘটেছিল। বাউলদের সাধনার লক্ষ্য হচ্ছে ‘মনের মানুষ’ লাভ করা। ‘মনের মানুষ’ অনন্ত পরম সত্য, আবার ব্যক্তিগত প্রেমের আধার। বাউলদের ‘মনের মানুষ’ আছে দেহসীমার মধ্যে। এক কথায় তার সীমার মধ্যে অসীমকে অনুভব করতে চায়। তারা ‘মনের মানুষ’-এর সঙ্গে সমন্বিত হতে চায় প্রেমের দ্বারা। সেজন্যই ‘প্রেম-ব্যাকুলতায় বাউলেরা উন্মত্ত’। বাউল সাধনার একটা ঘনিষ্ঠ অঙ্গ আছে বাউল গান। বাউলেরা এই গানের মাধ্যমেই নিজেদের সাধন-ভজনের গূঢ়তত্ত্ব নানারূপ রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করে। রবীন্দ্রনাথ বাউল গানের অনুরাগী ছিলেন। অনেকে বলেন বাউলদের আধ্যাত্মিক অনুভূতি রবীন্দ্র-জীবন-দর্শনের ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। জয়দেবের জন্মতিথি উপলক্ষে কেন্দুলিতে যে মেলা হয়, সেখানে সকল স্থানের বাউলরা একত্রিত হয়।

মধ্যযুগের ধর্মীয় যুক্তসাধনার ক্ষেত্রে সুফীবাদের অবদানও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সূফীবাদ মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে এদেশে এসেছিল। সূফীগণ ঈশ্বর সম্বন্ধে পূর্ণজ্ঞান দিতেন ও ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগলাভের পথনির্দেশ করতেন। তাঁরা পবিত্র জীবনযাপন করতেন ও অনেক অলৌকিক শক্তির পরিচয় দিতেন। তা ছাড়া, তাঁরা বহু লোকহিতকর কার্যে নিজেদের নিযুক্ত রাখতেন। নানা জনহিতকর কাজের জন্য তাঁরা সাধারণ লোকের প্রণম্য হয়েছিলেন, এবং তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের দরগাগুলি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকদের কাছেই পবিত্র স্থান বলে বিবেচিত হত, যদিও অধিকাংশ দরগাগুলি হিন্দুদের পবিত্র স্থানগুলির ওপর নির্মিত হত। যেমন বগুড়া জেলার মহাস্থানে সৈয়দ সুলতান শাহী সওয়ারের দরগা এক শিব মন্দিরের ওপর প্রতিষ্ঠিত। রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে সত্যপীরের স্থান এক বৌদ্ধ মঠের ওপর নির্মিত।

হিন্দু-মুসলমানের যুক্তসাধনায় পীরপূজা এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করত। পীর বলতে শাহ, শেখ, মুরশিদ, ওস্তাদ, সুফী, প্রমুখ সাধুসন্তদের বুঝাত। মুসলমান সেনাপতিগণও যুদ্ধে নিহত হলে গাজী-পীর রূপে পূজিত হতেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বহু পীরের বন্দনা আছে। পীরের দরগাসমূহের প্রতি হিন্দু-মুসলমান উভয়েই সমানভাবে তাদের শ্রদ্ধা ও অর্ঘ্য নিবেদন করত। পীর পূজাকে অবলম্বন করে হিন্দুসমাজে অনেক দেবদেবীর উদ্ভব হয়েছিল। তাঁদের অন্যতম হচ্ছে সত্যপীর, গাজীসাহেব, বনবিবি ইত্যাদি। এর মধ্যে সত্যপীরের পূজা বিশেষ ব্যাপকতা লাভ করে। সত্যপীরের পূজা কথায় বলা হয়েছে যে সত্যপীর ও নারায়ণ অভিন্ন। সত্যপীরকে অবলম্বন করে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কবিরাই অনেক পাঁচালী রচনা করেন। ফৈজুল্লার পাঁচালীতে আছে—’তুমি ব্ৰহ্মা, তুমি বিষ্ণু, তুমি নারায়ণ। শুন গাজী আপনি আসরে দেহ মন।’ সত্যপীর বর্তমান সত্যনারায়ণ নামে পূজিত হন।

উনবিংশ শতাব্দীর এক ফরাসী লেখকের রচনা থেকে আমরা জানতে পারি যে হিন্দুরা যেমন মুসলমান পীর ও সাধুসন্তদের প্রতি ভক্তি দেখাতেন, মুসলমান পীর ও সন্তদের মধ্যে অনেকেই ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুগামী ছিলেন। এক কথায় মধ্যযুগে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যুক্তসাধনার একটা ধারা প্রবাহিত হয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *