কালান্তরের সমাজ ও তার রূপান্তর

কালান্তরের সমাজ ও তার রূপান্তর

কলকাতার লোক যে জীবনচর্যা অনুসরণ করে, তাই আজ বাঙলার সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হচ্ছে। কলকাতার লোকের জীবনচর্যার রূপান্তর ঘটেছে বিংশ শতাব্দীতে। শহরে সমাজ, ধর্ম, আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, পাল-পাৰ্বণ ও জন-সংস্কৃতির এক অভূতপূর্ব রূপান্তর ঘটেছে। অথচ, আমরা ইতিহাসে দেখি যে যারা প্রথম গ্রাম থেকে কলকাতায় এসেছিল তারা গ্রামকেই শহরে তুলে নিয়ে এসেছিল। গ্রামীণ ধর্মকর্ম কলকাতায় অনুসরণ করা যাতে বিঘ্নিত না হয়, তার জন্য তারা সঙ্গে করে এনেছিল তাদের বামুন-পুরুত, নাপিত ইত্যাদি। সঙ্গে করে তারা আরও নিয়ে এসেছিল গ্রামের আচার-ব্যবহার, রীতিনীতিও শিক্ষাব্যবস্থা। তখনকার কলকাতার গ্রাম্যরূপ, তাদের এখানে গ্রামীণ জীবন-চর্যা অনুসরণ করাকে সহজতর করেছিল। কিন্তু ক্রমশ শহরের বিবর্তন, তাদের এটা ব্যাহত করল।

দুই

গ্রামীণ সমাজ যা শহরে স্থানান্তরিত হয়েছিল, তা প্রথম আঘাত পায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে শহরে এক ‘অভিজাত’ সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থানে। শহরের অভিজাত সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা-প্রণালী প্রথম সাধারণ লোককে প্রভাবান্বিত করেনি। সাধারণ লোক নিষ্ঠাবান ও গ্রামীণ সংস্কৃতিরই ধারক রয়ে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতিটাই বিংশ শতাব্দীর ঘোড়ার দিক পর্যন্ত বজায় ছিল, বিশেষ করে পাল-পার্বণ, ধর্মকর্ম ও সামাজিক আচার-বিচারে। গোড়ার দিকে গ্রামের লোক যেসব অপপ্রথা সঙ্গে করে শহরে নিয়ে এসেছিল সেগুলো বিংশ শতাব্দীর সূচনার অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছিল। দু’টি প্রধান অপপ্রথা ছিল—সহমরণ ও কৌলীন্যপ্রথা।

সহমরণের বিরুদ্ধে রামমোহনের আন্দোলন ও কৌলীন্যপ্রথার বিরুদ্ধে ও বিধবা বিবাহের সপক্ষে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আন্দোলন সার্থকতা লাভ করেছিল মুদ্রিত পুস্তক দ্বারা প্রচারের মাধ্যমে ও ইংরেজের প্রণীত আইনের সহায়তায়।

মুদ্রিত বইয়ের প্লাবন শিক্ষাজগতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল, তা ত্বরান্বিত হয়েছিল যখন ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের পর শহরের নানাস্থানে স্কুল-কলেজ স্থাপিত হয়। ফলে এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের সৃষ্টি হয়। এই সমাজের ছেলেরা নানারকম পেশা গ্রহণ করে। কেউ হন ডাক্তার, কেউ আইনবিদ, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বিজ্ঞানী ইত্যাদি। সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষিত সমাজ পত্তন করল এক নতুন সাহিত্যের। সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভূত হলেন বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও আরো অনেক। তাঁদের লেখা ভাষাই কলকাতার ভাষা তথা বাংলা ভাষার মানরূপে গৃহীত হয়। এই সাহিত্যেরই দিপাল হিসাবে বিংশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হলেন রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র।

মধ্যবিত্ত সমাজের যারা পেশা গ্রহণ করল না, তারা সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহে কর্ম গ্রহণ করল। সীমিত-দায়-যুক্ত যৌথ মূলধনী কোম্পানি আইন বিধিবদ্ধ (১৮৫০) হবার পর ম্যানেজিং এজেন্টসমূহ স্থাপন করলেন চটকল, কয়লাখনি, চা-বাগিচা, ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি ইত্যাদি। কলকাতা একটা বিরাট কর্মসংস্থানের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে রেলপথে যোগাযোগ স্থাপন শহরতলির লোকদের কলকাতার কর্মকেন্দ্রের দিকে টেনে নিয়ে এল। তারা কলকাতা-সমাজের সংস্কৃতি গ্রামে নিয়ে গেল। এইভাবে নাগরিক সভ্যতার সঙ্গে গ্রামীণ সভ্যতার একটা যোগ্যসূত্র স্থাপিত হল।

কলকাতায় যে নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের উদ্ভব হল, তাদের পুরুষরা ইংরেজি শিক্ষা পেয়ে যদিও উদারনীতিক হলেন, কিন্তু তাঁদের অন্দরমহলের মেয়েরা রক্ষণশীলা থেকে গেলেন। যদিও ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বেথুন স্কুল স্থাপিত হবার পর থেকে স্ত্রীশিক্ষার কিছু কিছু প্রসার ঘটেছিল, তা হলেও যেমন মেয়ে স্কুলে পড়তে যেত (অধিকাংশই দশ বছরের কম) তাদের রক্ষণশীলতা বজায় রেখে ঢাকা গাড়িতে করে স্কুলে যেতে হত।

দশ বছর বয়সের আগেই হিন্দু মেয়েদের বিয়ে হয়ে যেত, সেজন্য তাদের উচ্চশিক্ষা লাভের কোন সুযোগ ছিল না। দু-চারজন যারা উচ্চশিক্ষা লাভ করত তারা হয় ব্রাহ্ম পরিবারের কিংবা খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে সরদা আইন দ্বারা যখন মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স স্থির করা হয়, তখন থেকেই হিন্দু মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা লাভের প্রবণতা প্রকাশ পায়। তারা শিক্ষাক্ষেত্রের নানাবিভাগে পুরুষদের তুলনায় যথেষ্ট এগিয়ে যেতে থাকে। যে রূপান্তরটা গত পঞ্চাশ—ষাট বছরের মধ্যে ঘটেছে, তা একেবারে অবিশ্বাস্য। আজ নামজাদা মহিলা ডাক্তার, আইনজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, অধ্যাপিকা, ম্যাজিষ্ট্রেট, সাংবাদিক, কোম্পানি এগজিকিউটিভ, কোম্পানি ডিরেক্টর শহরের মহিলা বিচারপতিও নিযুক্ত হয়েছেন। অথচ পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে এঁদের মা-মাসি-পিসিদের দশ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যেত।

তিন

বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন দশক পর্যন্ত মধ্যবিত্ত হিন্দুসমাজের অন্দরমহল অত্যন্ত রক্ষণশীল ছিল। সেটাই ছিল হিন্দু রক্ষণশীলতার দুর্গ। যার কোনো ট্রাডিশন্যাল ধারাবাহিতা ছিল না, তা ছিল মেয়েদের কাছে অপকর্ম। সেই মানদণ্ড দিয়েই তারা পাপ-পুণ্য বিচার করত। বাড়ির বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, বাড়ির অন্দরমহলেও তারা বুক পর্যন্ত ঘোমটা দিয়ে ঘুরে বেড়াত। পরপুরুষের সামনে বেরুনো একেবারে নিষিদ্ধ ছিল। ভাশুর- ভাদ্দর বউয়ের সম্পর্কের মধ্যে ছিল চৈনিক প্রাচীর। সেইসব মেয়েদের নাতনীরাই আজ ভাশুরের সঙ্গে কথা বলে এবং সিনেমায় ও খেলার মাঠে গিয়ে পাশাপাশি বসে। তখনকার দিনে কথা বলা তো দূরের কথা, ঘোমটার ভিতর থেকে দেখতে না পেয়ে দৈবাৎ যদি ছোঁয়াছুয়ি হয়ে যেত, তা হলে ধান-সোনা উৎসর্গ করে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। এখন আর ভাশুর- ভাদ্দর বউয়ের মধ্যে সে নিষিদ্ধ সম্পর্ক (taboo) নেই। সম্পূর্ণ খোলামেলাভাবেই তারা মেলামেশা করে।

বিবাহের পর থেকেই সেকালের লোকের ধর্মীয় জীবন শুরু হত। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কুলগুরুর কাছ থেকে মন্ত্র নিত। কেননা সেকালের মেয়েদের সংস্কার ছিল যে মন্ত্র না নিলে দেহ পবিত্র হয় না। যারা মন্ত্র নিত, তাদের প্রতিদিনই ইষ্টমন্ত্র জপ করতে হত। যাদের মন্ত্র হয়নি, তাদের ঠাকুরঘরে যেতে দেওয়া হত না। এমনকি শ্বশুর-শাশুড়িও তাদের হাতের পক্কান্ন শুদ্ধ বলে মনে করত না।

সেকালের মেয়েরা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই সদর দরজা থেকে শুরু করে বাড়ির অন্দরমহল পর্যন্ত সর্বত্র গোবরজলের ছিটা দিত। সাধারণ গৃহস্থলোকের বাড়ি দু’মহল হত। ধনী লোকদের বাড়ি তিনমহল চারমহলও হত। প্রতি বাড়িতেই তুলসীমঞ্চ থাকত এবং সন্ধ্যাবেলা তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বেলে দেওয়া হত। তা ছাড়া, বোশেখ মাসে তুলসীগাছের ওপর একটা জলপূর্ণ পাত্র বেঁধে ‘ঝারা’ দেওয়া হত।

সেকালের মেয়েদের ধর্মবিশ্বাস এখনকার মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। শিশুকাল থেকেই নানারকম ব্রতপালনের ভিতর দিয়ে তাদের ধর্মীয় জীবন গড়ে উঠত ও মনের মধ্যে পাপ-পুণ্যের একটা ভাব সঞ্চারিত হত। পাঁচ থেকে আট বছরের মেয়েরা নানারকম ব্রত করত; যেমন বোশেখ মাসে শিবপূজা ও পুণ্যিপুকুর, কার্তিক মাসে কুলকুলতি, মাঘমাসে মাঘমণ্ডল ইত্যাদি। সধবা মেয়েদের ব্রতের অন্ত ছিল না। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন কলসী উৎসর্গ করা হত। কার্তিক মাসে আকাশপ্রদীপ দেওয়া হত। এসবই পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে পর্যন্ত কলকাতায় পালিত হত। বাঙালীর বার মাসে তের পার্বণ ছিল, তার অধিকাংশই আজ উঠে গিয়েছে। তবে সীমান্ত অঞ্চলের মেয়েরা আজও পৌষ মাসে টুসু ও ভাদ্র মাসে ভাদুর ব্রত ও উৎসব পালন করে।

আগে ঘেঁটুপূজার খুব ব্যাপক প্রচলন ছিল। কিন্তু আজকাল ছেলেদের মধ্যে খোসপাঁচড়ার প্রকোপ কমে গিয়েছে বলে ঘেঁটুপূজার আর চলন নেই। অরন্ধনও একটা বড় পরব ছিল এবং এই উপলক্ষে পাঁচ বাড়ির ছেলেমেয়েদের নিমন্ত্রণ করা হত। পৌষপার্বণে পিঠেপুলি তৈরির ভীষণ ঘটা হত। তখনকার কালে গ্রহণের দিন লোক হাঁড়ি ফেলে দিত। রান্নার জন্য আবার নতুন হাঁড়ি ব্যবহার করত। দশহরার দিন ফলাহার করত। অরন্ধনের আগের দিন রান্না ভাত-তরকারি পর দিন (অরন্ধনের দিন ) খেত। শ্রীপঞ্চমীর দিন কড়াই সিদ্ধ করত ও পরদিন শীতল ষষ্ঠীর দিন তা খেত। চৈত্র সংক্রান্তিতে যবের ছাতু খেত। শীতলা অষ্টমীর দিন শীতলাতলায় গিয়ে বনভোজন করত।

সেকালে বর্ষীয়সী মহিলারা নিত্য গঙ্গাস্নান করতেন। তাঁরা অসূর্যস্পশ্যা ছিলেন বলে ভোর রাতেই গঙ্গাস্নানে বেরুতেন ও সূর্যোদয়ের পূর্বেই বাড়ি ফিরে আসতেন। ধনী পরিবারের মহিলারা পালকি করে গঙ্গাস্নানে যেতেন, এবং গঙ্গার ঘাটেও পালকি থেকে নামতেন না। পালকিটাকে জলে নামিয়ে দেওয়া হত এবং তাঁরা পালকির ভিতরেই স্নান সেরে নিয়ে বস্ত্র পরিবর্তন করতেন।

চার

ধর্মীয় পরবগুলির ন্যায় সামাজিক উৎসবগুলির মধ্যেও অনেকগুলি উঠে গিয়েছে। আজকালকার দিনে মেয়েদের বেশি বয়সে বিয়ে হয়; সেজন্য রজঃ অনুষ্ঠান উঠে গিয়েছে। ষাট বছর আগে পর্যন্ত এটা একটা বড় সামাজিক অনুষ্ঠান ছিল। অনুরূপভাবে আজকাল মেয়েরা হাসপাতালে বা নার্সিং হোমে প্রসব করে বলে, আটকৌড়ে ও চারকৌড়ে উঠে গিয়েছে। যেটেরা পূজাও লুপ্ত হয়েছে। ষষ্ঠীপূজা এখনো আছে। মেয়েদের সাধভক্ষণ ইত্যাদি কোনো কোনো জায়গা পালিত হয়, কোনো কোনো জায়গায় হয় না। আগেকার দিনে এগুলো বড় সামাজিক উৎসব ছিল ও অনেক আত্মীয়স্বজন নিমন্ত্রিত হতেন। রজঃদর্শন উৎসবে নাচগানও হত।

অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে অন্নপ্রাশন এখনো হয়, কিন্তু সেটা অন্য রূপ নিয়েছে। ব্রাহ্মণদের উপনয়ন এখনো হয়, যদিও অনেকক্ষেত্রে যথা-সময়ে নয়। বিবাহের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও স্ত্রী-আচারসমূহ এখনো পালিত হয়, যদিও এগুলো সংক্ষিপ্ত হয়েছে। ছাদনাতলায় নাপিতদের ছড়াকাটা কোনো কোনো জায়গায় হয়, কোনো কোনো জায়গায় হয় না। আজকালকার নাপিতরা আগেকার দিনের সেসব ছড়া ভুলে গিয়েছে। বিবাহ উপলক্ষে নাড়ুভাজা ইত্যাদি (যার বর্ণাঢ্য বর্ণনা ইন্দিরা দেবীচৌধুরানী তাঁর ‘বাংলার স্ত্রী আচার’ বইয়ে দিয়েছেন) উঠে গিয়েছে। বিবাহ সম্পর্কে আরো অনেক সামাজিক রীতি উঠে গিয়েছে। তা ছাড়া, আগেকার দিনে সবর্ণেই বিবাহ হত; এখন অসবর্ণ বিবাহ প্রায়ই হচ্ছে। ষাট বছর আগে পর্যন্ত কর্মবাড়িতে ব্রাহ্মণ ও শূদ্রদের জন্য আলাদা পংক্তি হত। তা ছাড়া, ব্রাহ্মণরা ভোজন-দক্ষিণা পেতেন। আজ আর পান না। এখন ব্রাহ্মণরা সকলের সঙ্গে একই পংক্তিতে খান।

শ্রাদ্ধের ঘটাও এখন অনেক কমে গিয়েছে। আগে নিয়মভঙ্গের দিন সর্বজনীন নিমন্ত্রণ করা হত। এখন মাত্র জ্ঞাতি ও নিকট-আত্মীয়দের করা হয়। তা ছাড়া, যারা ব্রাহ্মণ নয়, তারা অশৌচকাল ত্রিশ দিন থেকে দশ- পনেরো দিনে নামিয়ে এনেছে।

শিক্ষারম্ভ বা হাতেখড়ি দেওয়া প্রথা এখন উঠে গিয়েছে। নামকরণের বেলাতেও তাই। আগেকার দিনের অনেক নাম এখন লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, যেমন গদাধর, জলধর, জগন্নাথ, পীতাম্বর, এককড়ি, দু’কড়ি, পাঁচকড়ি, সাতকড়ি ইত্যাদি। মেয়েদের ক্ষেত্রেও তাই। এখন আর কেউ মেয়ের নাম রাখে না থাকমণি, পরশমণি, এলোকেশী, জগদম্বা, মহামায়া, কালীমতি ইত্যাদি।

পাঁচ

সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটেছে পোশাক-আশাকে ও প্রতিবেশীর সঙ্গে আচার-ব্যবহারে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যাহ্ন পর্যন্ত সাধারণ লোক মাথায় শিখা রাখত ও ধুতি-চাদর ব্যবহার করত। মাথায় পাগড়ি বাঁধত। সেলাইবিহীন বসন ব্যবহার করা বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ছিল। শার্ট কামিজ পিরান ব্যবহার ছিল না। মেয়েদের গোড়ায় কোনো অন্তর্বাস ছিল না বা উত্তরবাসও ছিল না। শাড়িখানাই উপরের অঙ্গে জড়িয়ে রাখত। অন্তর্বাস ছিল না বলে মেয়েরা পাছাপাড় কাপড় পরত। পাছাপাড় কাপড় পরা বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের পর থেকে উঠে গিয়েছে। ছোটো ছেলেমেয়েদের হাফপ্যান্ট পরা রীতি ছিল না। ছেলেরা পাঁচ-সাত বছর বয়স পর্যন্ত দিগম্বর থাকত। তার পর পাঁচহাতি কাপড় পরত। ছোটো মেয়েরা প্রথমে ফ্রক্ পরত ও বয়স্ক মেয়েরা অন্তর্বাস ও উত্তরবাস হিসাবে প্রথম শেমিজ, তারপর সায়া, জ্যাকেট ও ব্লাউজ। নিমন্ত্রণ বাড়ি যাবার সময় একটা ভেলভেটের জ্যাকেট ও বেনারসী শাড়ি পরত। মেয়েরা এখন আবার অনেকে পাজামা, কামিজ ও সালওয়ার পরে। কেউ কেউ আবার প্যান্ট পরে। ম্যাকসি পরাও ফ্যাশন হয়েছে। আবার অনেকে সিগারেট খায়। উত্তরবাস ও অন্তবাসের একটা সার্থকতা আছে। কিন্তু বাকিগুলো কি? পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে পর্যন্ত পুরুষরা চটিজুতা পরত। আপিস যাবার সময় কেউ কেউ চীনা বাড়ির বার্নিশ করা জুতা পরত। মাত্র উচ্চপদস্থ কর্মচারীরাই প্যান্ট, কোট ও ওয়েস্টকোট পরত। তাদের টুপিও পরতে হত। সাধারণ বাঙালীর প্যান্ট ও লুঙ্গি পরা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় থেকে শুরু হল। হাওয়াই শার্টের চলনও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের দান। ছেলেবেলায় পূজার সময় আমাদের পোশাক কেনা হত দেশি তাঁতের ধুতি ও জরির কাজ করা ভেলভেটের কোট। তা ছাড়া ছেলেরা (আমিও পরেছি) নানারকম গহনা পরত। আর মেয়েদের গহনার তো পরিসীমা ছিল না। এক-একজন গৃহস্থ বধূর পঞ্চাশ-ষাট ভরি গহনা থাকত। থাকবেই বা না কেন? সোনার ভরি তো ছিল মাত্র আঠারো টাকা। তবে অনেক গহনা এখন উঠে গিয়েছে, যেমন কোমরে সোনার গোট, নাকে নখ ও নোলক পরা।

ছয়

খেলাধূলা ও আমোদপ্রমোদের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। হা-ডু-ডু খেলাটাই খুব জনপ্রিয় খেলা ছিল। তা ছাড়া, ছেলেরা নিয়মিত ব্যায়াম করত, লাঠি খেলত, কুস্তি লড়ত, সাঁতার কাটত ও মুগুর ভাঁজত। এখন এসব জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। আরো যে-সব জনপ্রিয় খেলা ছিল, তা হচ্ছে ড্যাং-গুলি, মারবেল খেলা ও ঘুড়ি ওড়ানো। এখন এসবের পরিবর্তে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, হকি ইত্যাদি প্রচলিত হয়েছে। এখন খেলার মাঠে বাঙালীরা অসাধারণ দক্ষতা দেখাচ্ছে। আমোদ-প্রমোদের ক্ষেত্রে পাঁচালী, তরজার লড়াই, পুতুল নাচ, যাত্রা প্রভৃতি প্রায় উঠেই গিয়েছে। যাকে এখন যাত্রা-অভিনয় বলা হয়, তা প্রকৃত সেকালের যাত্রাভিনয় নয়। থিয়েটার এখনো আছে, তাবে সিনেমা বেশি জনপ্রিয় হয়েছে। সিনেমার ছবির পরিচালনায় বাঙালী বিশ্ব-পুরস্কার পাচ্ছে। তা ছাড়া রেডিও এবং টিভি থেকেও শহরবাসীরা বেশ আমোদ পাচ্ছে। বাড়ির ভিতরের খেলার মধ্যে এক্কা-দোক্কা, লুকোচুরি ইত্যাদি খেলা উঠে গিয়েছে। দশ-পঁচিশ খেলাও তাই। তার পরিবর্তে ক্যারম, লুডো, স্নেক-অ্যাণ্ড-ল্যাডারস ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। বয়স্কদের মধ্যে দাবা ও পাশাখেলা এখনো কোথাও কোথাও প্রচলিত আছে। তবে তাসখেলার ক্ষেত্রে রঙের খেলার বদলে এখন ‘ব্রিজ’ খেলা প্রচলিত হয়েছে: এসব গ্রামেও প্রচলিত হয়েছে।

রান্নাঘরেরও পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। উনুনের স্থান অধিকার করেছে জনতা স্টোভ বা গ্যাস। মাটির হাঁড়ির পরিবর্তে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি; পাথরের ও কাঁসার থালার পরিবর্তে অ্যালুমিনিয়াম, স্টেনলেন স্টীল ও পোরসিলেনের থালা-বাসন প্রচলিত হয়েছে। আর্থিক চাপ ও দুষ্প্রাপ্যতার জন্য মাছ খাওয়া ও নানা-রকম ব্যঞ্জন রাঁধা হ্রাস পেয়েছে। ফ্রিজের প্রচলনের ফলে একদিনের রান্না দু-তিনদিন খাওয়া অভ্যাস হয়েছে।

শেষ কথা। সেকালের তুলনায় বাঙালী জীবনে আজ যে পরিবর্তন ঘটেছে, তা অভূতপূর্ব। এই অভূতপূর্ব পরিবর্তনকে সহায়তা করেছে মুদ্রণের প্রবর্তন, শিক্ষার প্রসার, সাহিত্যসৃজন, যন্ত্রশিল্প, পরিবহণব্যবস্থা এবং নানা প্রদেশের ও বিদেশীয় লোকের সংস্পর্শ।

কিন্তু এই অভূতপূর্ব পরিবর্তন ঘটলেও কতকগুলো মৌলিক উপাদান এখনো রয়ে গিয়েছে, যথা ষষ্ঠী পূজা, লক্ষ্মীপূজা, ইতুপূজা, বিপত্তারিণীর পূজা, জয়মঙ্গল বারের ব্রত, নবান্ন, রক্ষাকালী ও শীতলাপূজা ইত্যাদি। বিয়ের পর লোকে এখনও সত্যনারায়ণ ও শুভচনী পূজা করে। এছাড়া আছে গোরুর গাড়ি ও ঘুঁটের ব্যবহার। এগুলো সবই আদি-অস্ত্রাল যুগ থেকে বাঙালী সমাজে সজীব রয়ে গিয়েছে। সেখানেই বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক চরিত্রের সূত্র ধরা পড়ে।

তবে শেষ প্রশ্ন। যে সকল মৌলিক উপাদান থেকে বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক চরিত্রের সূত্র ধরা পড়ে, সেগুলো আর কতদিন টিকে থাকবে? গত চল্লিশ- পঞ্চাশ বছর ধরে সামাজিক রূপান্তরের গতি যেরূপ দ্রুত হারে চলেছে, তাতে মনে হয় না যে এই মৌলিক উপাদানগুলো খুব বেশিদিন টিকে থাকবে। বাঙালী সমাজের রূপান্তরটা মাত্র নাগরিক সভ্যতাকেই আচ্ছন্ন করেনি, গ্রামীণ সভ্যতাকেও করেছে। যারা প্রথম গ্রাম থেকে শহরে বাস শুরু করেছিল, তারা গ্রামকেই শহরে তুলে নিয়ে এসেছিল। আজ তার বিপরীত প্রক্রিয়া চলছে। আজ গ্রামের লোকরাই শহরকে গ্রামে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। নাগরিক সভ্যতার চটক আজ গ্রামের লোকের মনকে আচ্ছন্ন করেছে। ফলে বাঙালী তার স্বকীয় সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে। কিসের বিনিময়ে? পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার মোহের বিনিময়ে। সে সভ্যতা ভাল কি খারাপ তার বিচার আজ আর এখানে করব না। আগামীকালের ইতিহাস তা প্রমাণ করবে। তবে যাঁরা পাশ্চাত্ত্য সভ্যতার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জানতে উৎসুক, তাঁদের অনুরোধ করি তাঁরা যেন ওই সম্পর্কে Oswald Spengler-এর ‘Decline of the West’ বইখানা পড়ে নেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *