বর্গীয় হাঙ্গামা : মহানিশার দুঃস্বপ্ন
বর্গীয় হাঙ্গামা বাঙালী জীবনে এক মহানিশার দুঃস্বপ্ন। এ হাঙ্গামার প্রতিধ্বনি এখনও পর্যন্ত বাঙালী মায়েদের ছেলে মেয়েদের ঘুম-পাড়ানো গানে সঞ্জীবিত হয়ে আছে। এটা ঘটেছিল আলিবর্দি খান যখন বাঙলার নবাব ছিলেন। বেরারের মারাঠা দলপতি রঘুজী ভোঁসলে চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী সমেত ভাস্কর পণ্ডিত নামে এক ব্যক্তিকে বাঙলায় পাঠিয়েছিলেন চৌথ আদায় করবার জন্য। বাঙলার নবাব আলিবর্দি খান তখন ওড়িশা অভিযানে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল যে তিনি রাজধানী মুর্শিদাবাদে ফিরে মারাঠাদের প্রতিরোধ করবেন। কিন্তু সে সুযোগ তিনি পেলেন না, কেননা মারাঠার ইত্যবসরেই ওড়িশার ভিতর দিয়ে বাঙলায় প্রবেশ করেছিল। বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধে বাঙালীরা অসীম বীরত্বের সঙ্গে মারাঠাদের প্রতিহত করেছিল, কিন্তু যুদ্ধের সম্মুখীন হওয়া মারাঠাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তরবারীর জোরে গ্রামসকল লুণ্ঠন করা। চতুর্দিকেই এতে এক সন্ত্রাস-পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বাঙলার লোক একে ‘বর্গীয় হাঙ্গামা’ আখ্যায় দেয়। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে এই হাঙ্গামা শুরু হয়, এবং প্রায় ন’বছর ধরে এই হাঙ্গামা চলে। সমসাময়িক তিনখানা বইয়ে আমরা বর্গীয় হাঙ্গামার এই ভীতিপ্রদ চিত্র পাই। এই তিনখানা বইয়ের মধ্যে একখানা হচ্ছে গুপ্তপল্লীর প্রসিদ্ধ কবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার রচিত ‘চিত্ৰচম্পূ’ নামক কাব্যগ্রন্থ। তিনি প্রথমে নদীয়াধিপতি কৃষ্ণচন্দ্রের সভাপণ্ডিত ছিলেন। কিন্তু কোন কারণে কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর ওপর রুষ্ট হলে বর্ধমানরাজ চিত্রসেনের আশ্রয়ে যান এবং তাঁর আদেশেই গদ্যেপদ্যে ‘চিত্রচম্পূ’ গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থখানির রচনাকাল ১৭৪৪। সুতরাং বইখানা বর্গীর হাঙ্গামার সমসাময়িক। লণ্ডনের ইন্ডিয়া অফিসের পুস্তকাগারে (এখন এই পুস্তকাগারের নাম পরিবর্তিত হয়েছে) এই গ্রন্থের একখানা পুঁথি আছে। এই গ্ৰন্থ বর্ণিত হয়েছে—বর্গীদিগের অতর্কিত আগমনের সংবাদে বাঙলার লোক বড়ই বিপন্ন ও ব্যাকুল হয়ে পড়ে। শকটে, শিবিকায়, উস্ট্রে, অশ্বে, নৌকায় ও পদব্রজে সকলে পালাতে আরম্ভ করে। পলায়মান ব্রাহ্মণগণের স্কন্ধোপরি, ‘লম্বালক’ শিশু, গলদেশে দোদুল্যমান আরাধ্য শালগ্রামশিলা, মনের মধ্যে প্রাণাপেক্ষা প্রিয়তর ‘দুর্বহ মহাভার’ সঞ্চিত শাস্ত্রগ্রন্থ-রাশির বিনাশের আশঙ্কা, গর্ভভারালস পলায়মান রমণীগণের নিদাঘ সূর্যের অসহনীয় তাপক্লেশ, যথাসময় পানাহারলাভে বঞ্চিত ক্ষুধাতৃষ্ণায় ব্যাকুল শিশুগণের করুণ চীৎকার ব্যথিত জননীগণের আর্তনাদ ও অসহ্য বেদনায় সমস্ত পৃথিবী ব্যাপ্ত।’ আর একখানা গ্রন্থ হচ্ছে ‘মহারাষ্ট্রপুরাণ’। এখানা রচনা করেছিলেন কবি গঙ্গারাম দাস, ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। ‘মহারাষ্ট্রপুরাণ’-এ বর্ণিত হয়েছে—’কারু হাত কাটে কারু নাক কান। একই চোটে কারু বধে পরাণ ॥ ভাল ভাল স্ত্রীলোক জত লইয়া জা এ। অঙ্গুষ্টে দড়ি বাঁধি দেয় তার গলা এ ॥ একজনে ছাড়ে তারে আর জনা ধরে। রমণের ভরে ত্রাহি শব্দ করে ॥’ বর্গীর হাঙ্গামাকে লক্ষ্য করে ভারতচন্দ্রও (১৭১২-১৭৬০) তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’-এর (১৭৫২-৫৩) লিখেছেন—’লুঠি বাংলার লোক করিল কাঙ্গাল। গঙ্গাপার হইল বাঁধি নৌকার জাঙ্গাল ॥ কাটিল বিস্তর লোক গ্রাম গ্রাম পুড়ি। লুঠিয়া লইল ধন ঝিউরী বহুড়ী॥’
সাধারণ লোকের মাঝে বর্গীয় হাঙ্গামা এমন এক উৎকট ভীতি জাগিয়েছিল যে তার পরবর্তীকালে বাঙলার মেয়েদের মুখে ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়ানো গানে প্রতিধ্বনিত হত।
বর্গীরা ভাগীরথী অতিক্রম করে মুর্শিদাবাদ শহর লুটপাট করে। জগৎশেঠের বাড়ি থেকে অনেক টাকা সংগ্রহ করে। ইংরেজদের কয়েকটা নৌকাও বর্গীরা লুটপাট করে। কলকাতার লোক ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে কাঠের রক্ষাবেষ্টনী থাকা সত্ত্বেও ভীতিগ্রস্ত হয়ে ইংরেজরা শহর সুরক্ষিত করবার জন্য দেশীয় বণিকদের সহায়তায় গঙ্গার দিক ছাড়া শহরের চারদিকে ঘিরে ‘মারাঠা ডিচ’ নামে এক খাল খুঁড়তে আরম্ভ করে।
আলিবর্দি খান যখন ওড়িশা অভিযানে থেকে ফিরছিলেন তখন বর্ধমান শহরে রাণীদীঘির কাছে বর্গীরা তাঁর শিবির অবরোধ করে। নবাব অতি কষ্টে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। আলিবর্দি খান যখন মুর্শিদাবাদে আসেন, বর্গীরা তখন কাটোয়ায় পালিয়ে যায়। পূজার সময় বর্গীরা কাটোয়ার কাছে দাঁইহাটায় দূর্গাপূজা করে। কিন্তু ওই পূজা অসমাপ্ত থাকে, কেননা নবমীর দিন আলিবর্দি খান অতর্কিত আক্রমণ করে তাদের তাড়িয়ে দেন। তারপর বালেশ্বরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মারাঠার চিলকা হ্রদের দক্ষিণে পালিয়ে যায়।
পরের বছর (১৭৪৩) রঘুজী ভোঁসলে নিজে বাঙলাদেশে আক্রমণ করেন। দিল্লীর বাদশাহ মহম্মদ শাহের অনুরোধে পেশওয়া বালাজী বাজীরাও বাঙলাদেশে থেকে বর্গীদের তাড়িয়ে দিতে সম্মত হন। আলিবর্দি খান স্বীকার করেন যে তিনি মারাঠা রাজা শাহুকে বাঙলাদেশের চৌথ এবং পেশওয়াকে যুদ্ধের খরচ বাবদ ২২ লক্ষ টাকা দেবেন। পেশওয়ার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রঘুজী ভোঁসলে পালিয়ে গেলেন বটে, কিন্তু তাতে কোন স্থায়ী ফল হল না। বর্গীরা প্রতি বছরই বাঙলাদেশে এসে উৎপাত করতে লাগল। ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে আলিবর্দি খান ভাস্কর পণ্ডিত ও তার সেনাপতিদের সন্ধির অছিলায় মুর্শিদাবাদের কাছে মানকরা নামক স্থানে নিজ শিবিরে আমন্ত্রণ করে হত্যা করেন। এই ঘটনার পর বর্গীরা বছরখানের হাঙ্গামা বন্ধ রাখে। কিন্তু তারপর হাঙ্গামা আবার শুরু হয়। শেষপর্যন্ত আলিবর্দি খান বর্গীদের সঙ্গে আর পেরে ওঠেননি, এবং সন্ধি করতে বাধ্য হন। ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দের সন্ধি অনুযায়ী আলবর্দি খান ওড়িশা বর্গীদের হাতে তুলে দেন। মারাঠারা প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা ওড়িশা থেকে সুবর্ণরেখা নদী অতিক্রম করে বাঙলাদেশে আর ঢুকবে না। জলেশ্বরের কাছে সুবর্ণরেখার পূর্বতীর পর্যন্ত আলিবর্দি খানের রাজ্যের সীমানা নির্ধারিত হয়। আলিবর্দি খান প্রতি বৎসর বাঙলাদেশের চৌথ হিসাবে ১২ লক্ষ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতিও দেন।
বর্গীর হাঙ্গামা নিয়ে বাঙলাদেশে অনেক কিংবদন্তীর সৃষ্টি হয়েছিল। বীরভূমের বৈষ্ণবগণের মধ্যে এক কিংবদন্তী আছে যে, যোগিনীসিদ্ধ ব্ৰাহ্মণ আনন্দচন্দ্র গোস্বামী (যাঁকে বৈষ্ণবগণ চৈতন্য মহাপ্রভুর অবতার ভাবেন) অলৌকিক শক্তিবলে বর্গীর হাঙ্গামা দমন করেছিলেন। আনাসহিদ নামে একজন পীর সাহেবও বর্গীদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে মারা যান। বীরভূমের রামপুরহাটের নিকট নলহাটিতে এক পাহাড়ের ওপর তাঁর স্মৃতি সমাধি বর্তমান।