বাঙালীর বৈষয়িক জীবন
এবার প্রাচীন বাঙলার অর্থনৈতিক জীবন সম্বন্ধে কিছু বলা যাক। অতি প্রাচীন বাঙলার কৌমসমাজে পশুপক্ষী শিকার দ্বারাই খাদ্য আহরণ করা হত। পরে নবোপলীয় যুগ থেকে লোকরা কৃষিনির্ভর হয়েছিল। খ্রিস্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীর অনুশাসনসমূহে এদের ক্ষেত্রকরণ, কর্ষকরণ, কৃষিকরণ প্রভৃতি নাম অভিহিত করা হয়েছে। যেভাবে এদের উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে মনে হয় যে, এরা তৎকালীন গ্রামসমাজে বেশ বিশিষ্ট স্থান অধিকার করত। বস্তুত তারা গ্রামীণ অর্থনীতিতে সার্থবাহ বা বনিকদের সমান গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করত। এ এক যুগের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গ্রামে কৃষির উপযোগী ভূমির চাহিদা। এ থেকেই সে যুগের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে কৃষির ভূমিকা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। বর্তমানযুগের মানদণ্ডে তারা কৃষিকর্মে বিশেষ দক্ষতা লাভ করেছিল। ডাক ও খনার বচনসমূহ আলোচনা করলে বুঝতে পারা যায় যে, কৃষিকর্মের উদ্দেশ্য-সাধনের জন্য তারা আবহাওয়াতত্ত্বকে খুব জনপ্রিয় করে তুলেছিল।
বস্তুত যখন আমরা চিন্তা করি যে, বাঙলা নদীবহুল ও পলিমাটির দেশ, তখন বাঙলার অর্থনীতিতে কৃষির প্রাধান্য আমরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি। একটা কথা এখন মনে রাখতে হবে যে, বাঙলাদেশে সকল জাতির লোকই কৃষিকর্মে লিপ্ত থাকত। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে উয়াং চুয়াং যখন ভারতে এসেছিলেন, তখন ব্রাহ্মণরাও কৃষিকর্ম করত। পরে আমরা দেখতে পাব যে, পরবর্তীকালেও ঠিক তাই ছিল।
কৃষিজাত ফসলের মধ্যে ধানই শীর্ষস্থান অধিকার করত। বস্তুত ধানের চাষ অস্ট্রিকগোষ্ঠীভুক্ত জাতিসমূহের অবদান। গম ও যবের চাষ বাঙলায় আগন্তুক আর্যরা উত্তরভারত থেকে প্রবর্তন করেছিল। বাঙলায় নানাজাতির ধান্যের চাষ হত এবং তাদের মধ্যে শালিধানের প্রসিদ্ধি ছিল। কালিদাস তাঁর ‘রঘুবংশ’-এ কবিত্বপূর্ণ ভাষায় বিবৃত করেছেন যে, বাঙলাদেশের কৃষকপত্নীরা ইক্ষুক্ষেত্রের ছায়ায় উপবিষ্ট হয়ে শালিধান রক্ষার কাজে নিযুক্ত থাকত। বাঙলাদেশে ধান-রোপণ-প্রথার কথাও কালিদাস উল্লেখ করে গেছেন।
ধান্যের পর ইক্ষুই মনে হয় বড় কৃষিজাত পণ্য ছিল। সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর ‘রামচরিত’-এ উল্লেখ করেছেন যে বরেন্দ্রভূমের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম কারণ হচ্ছে তার ইক্ষুক্ষেত্রসমূহ। পূর্বকালে বরেন্দ্রের অপর নাম ছিল পৌণ্ড্র এবং সুশ্রুত লিখে গেছেন যে, পুণ্ড্রবর্ধনে এক বিশেষ জাতের আখ জন্মায় যার নাম হচ্ছে ‘পৌণ্ড্রক’। এই জাতের আখ এখন ভারতের অন্যত্রও উৎপন্ন হয় এবং তার মৌলিক নাম অনুযায়ী তাকে ‘পৌড়িয়া’, ‘পুড়ি’, ও ‘পৌড়া’ প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়। এই সম্পর্কে এখানে শব্দতত্ত্বের এক মতবাদের উল্লেখ করা যেতে পারে। এই মতবাদ অনুযায়ী ‘গুড়’ শব্দ থেকে ‘গৌড়’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছিল। গুড় যে বাঙলার বৈদেশিক বাণিজ্যের বিশেষ পণ্য ছিল, তা আমরা খ্রিস্টপূর্ব-কালের গ্রীসদেশীয় লেখক ইলিয়াস ও লুকেনের রচনা থেকে জানতে পারি। এ ছাড়াও তুলার চাষও বাঙলার সর্বত্র হত। যদি খনার বচন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ হয়, তা হলে ধানের চাষের দ্বিগুণ তুলার চাষ হত।
সরিষার চাষও প্রাচীন বাঙলায় খুব ব্যাপকভাবে হত। এটা অবশ্য খুব স্বাভাবিক ব্যাপার, কেননা অনাদিকাল থেকে বাঙালী সরিষার তেলের সাহায্যে রন্ধনক্রিয়া সম্পন্ন করে আসছে। বরেন্দ্রদেশে এলাচের চাষও খুব বিস্তৃতভাবে হত। অনুরূপভাবে অন্যান্য যে সমস্ত পণ্যের চাষ হত, তার অন্যতম ছিল আদা, লঙ্কা, লবঙ্গ, দারুচিনি, তেজপাতা, পিপুল, গুয়া (সুপারী) প্রভৃতি। বাঙলাদেশে এই সকল মসলাজাতীয় পণ্যের ব্যাপক চাষের কথা শুধু যে সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর ‘রামচরিত’-এ বলে গিয়েছেন তা নয়, তাঁর বহুপূর্বে টলেমী, পেরিপ্লাস-এর নাবিক- গ্রন্থকার ও অন্যান্য লেখকরাও বলে গিয়েছেন। বিশেষভাবে রোমসাম্রাজ্যে বাঙলার লঙ্কার বিশেষ আদর ছিল এবং এক সের লঙ্কার দাম ছিল ৩০ স্বর্ণ দীনার। অন্যান্য পণ্যেরও সেখানে রীতিমত চাহিদা ছিল।
আরও যে দুটি পণ্যের চাষ বাঙলাদেশে ব্যাপভাবে হত তা হচ্ছে সুপারি ও নারিকেল। এ ছাড়া সারা বাঙলাদেশব্যাপী ছিল পানের ‘বরজ’। পান খাওয়ার রীতিও বাঙলাদেশে অস্ট্রিক আমল থেকেই চলে এসেছে। কারণ ‘বরজ’ শব্দটাই হচ্ছে ‘অস্ট্রিক’ শব্দ। আর আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, তেঁতুল, আমলকী, ডুমুর প্রভৃতির গাছ ত ছিলই। কিন্তু খুব জনপ্রিয় গাছ ছিল মহুয়া। প্রাচীন বাঙলায় মহুয়াবৃক্ষের বিদ্যমানতা বিশেষভাবে চিত্তাকর্ষক ছিল। এখনও দেখা যায় মহুয়াবৃক্ষ ব্যাপকভাবে রোপিত হয় বিহারের সেই অংশে, যে অংশ একসময় রাঢ়দেশের উত্তর-পশ্চিম সীমানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। উত্তর-বাঙলায় প্রাপ্ত বহু অনুশাসনে মহুয়াবৃক্ষ-সমন্বিত জমির উল্লেখ আছে। বাঙলার অন্যত্রও যে মহুয়ার চাষ হত তার প্রমাণ পাওয়া যায় মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত দাঁতনের নিকটবর্তী স্থানে প্রাপ্ত ‘ইরদা’ তাম্রশাসন থেকে। অন্যান্য ফলের গাছের উল্লেখের মধ্যে আছে দাড়িম্ব, খেজুর, পর্কটি ও কদলী। নানা জায়গায় প্রাপ্ত ভাস্কর্যের মধ্যে ও পাহাড়পুরে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ‘প্লাকে’ কদলী অঙ্কিত দেখতে পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য যে কদলী অস্ট্রিক যুগ থেকেই বাঙলাদেশের প্রিয় খাদ্য ছিল।
খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রকের শেষার্ধের তাম্রপট্টসমূহ থেকে আমরা জানতে পারি যে বাস্তুভূমি অপেক্ষা কৃষিভূমি চাহিদাই বেশি ছিল। কৃষি প্ৰধান অর্থনীতিতে এটাই স্বাভাবিক। ভূমি পরিমাপের জন্য মান ছিল—৮ মুষ্টি= এক কুঞ্চি; ৮ কুঞ্চি= এক পুস্কল; ৪ পুস্কল = এক আড়ক বা আড়ি; ৪ আড়ক = এক দ্রোণ; ৮ দ্রোণ = এক কুল্যবাপ; ৫ কুল্যবাপ = এক পাটক। আবার সমসাময়িক দান পত্রসমূহ যে মান দেওয়া হয়েছে, তা হচ্ছে—৪ কাক বা কাঙ্কিনী= এক উয়ান; ৫০ উয়ান = এক আড়ি; ৪ আড়ি এক দ্রোণ। ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে জমির দামের হেরফের ছিল। কোথাও এক কুল্যবাপ জমির দাম ছিল চার দীনার, আবার কোথাও কোথাও তিন, দুই বা এক দীনার। তবে বাস্তুজমি অপেক্ষা কৃষিজমির মূল্য ছিল বেশি।
এটা সহজেই অনুমেয় যে কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে কৃষির উপযোগী নানারূপ যন্ত্রাদি তৈরি হত। তাম্রাশ্মযুগে বোধ হয় এসব যন্ত্রপাতি তামা দিয়ে তৈরি হত। পরে এগুলি লৌহনির্মিত হতে থাকে। রাঢ়দেশের অরণ্য অঞ্চলে লৌহ- উৎপাদনের উল্লেখ আছে। এই সকল অঞ্চলে বহু লোহার খনি ছিল এবং এই অঞ্চলের লোকরা লৌহ উৎপাদন প্রণালীর সঙ্গে সম্যকভাবে পরিচিত ছিল। বস্তুত বীরভূম ও বর্ধমান জেলায় ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদ পর্যন্ত লৌহের উৎপাদন হত।
তাম্রের উৎপাদনও বাঙলাদেশে বহুল পরিমাণে হত এবং তাম্রলিপি, তামা- জুড়ি প্রভৃতি তামার সহিত জড়িত। যা হোক, বর্তমান ভারতের সর্বাপেক্ষা বৃহদায়তন তামা ও লোহার খনি সেই অঞ্চলেই অবস্থিত যা একসময়ে রাঢ়দেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ‘গৌড়িক’ নাম এক প্রকার রৌপ্যের উল্লেখ কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রে’ আছে। নাম অনুযায়ী গৌড়দেশের সহিত এর সম্পর্ক সূচিত হয়। কৌটিল্য স্বর্ণ হীরক ও মুক্তার উল্লেখও করেছেন। বাঙলার হীরকখনিসমূহ মুঘলযুগ পর্যন্ত বর্তমান ছিল, কেননা ‘আইন-ই- আকবরী’তে গড়মন্দারণের হীরকখনির উল্লেখ আছে। মনে হয় এই সকল হীরকখনি বিহারের সীমান্তে অবস্থিত কোখরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কারণ সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় কোখরায় একাধিক হীরকখনি ছিল। অনেক প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থেও পুণ্ড্র ও বঙ্গদেশের হীরকখনির উল্লেখ আছে। আর মুক্তার কথা ত ‘পেরিপ্লাস’ গ্রন্থের রচয়িতা বিশেষভাবে উল্লেখ করে গেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এখানে গঙ্গা নামে একটি নদী আছে। এর তটে গঙ্গা নামে একটি নগর আছে। এই নগরে মুক্তা, অতি সুক্ষ্মবস্ত্র প্রভৃতি দ্রব্যাদি বিক্রয়ার্থে আনীত হয়। শোনা যায়, এর নিকটেই স্বর্ণের খনি আছে এবং ‘ক্যালটিস্’ নামে এক প্রকার স্বর্ণমুদ্রার এখানে প্রচলন আছে।’ যদিও স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রার প্রচলন ছিল, তা হলেও সাধারণ লোক কড়ির মাধ্যমেই কেনাবেচা করত।
বস্তুতঃ গুপ্তযুগ পর্যন্ত স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রার বহুল প্রচলন ছিল। পাল ও সেনযুগে রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রার প্রচলন ছিল, কিন্তু স্বর্ণমুদ্রা ছিল না। তখন সাধারণ লোক কড়িতেই কেনাবেচা করত। তার মান ছিল—২০ কড়া বা কড়ি= এক কাকিনী; চার কাকিনী = এক পণ; ১৬ পণ= এক দ্ৰক্ষ্ম (রৌপ্যমুদ্রা); ১৬ দ্রক্ষ্ম= এক নিষ্ক= এক দীনার।
প্রাচীন বাঙলার শিল্পজাত দ্রব্যের মধ্যে অতি সূক্ষ্ম কার্পাসবস্ত্রই খুব প্রসিদ্ধ ছিল। ইংরেজ আমলে এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মসলিন’। বাঙলার মলিন সারা বিশ্বের বিস্ময় উদ্রেক করত এবং রোমসাম্রাজ্যে এর সবচেয়ে বেশী কদর ছিল। বাঙলার এই সূক্ষ্মবস্ত্রের উল্লেখ কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, ‘পেরিপ্লাস’ এবং পরবর্তীকালের চীন, আরব ও ইতালীয় লেখকদের পুস্তকের পাওয়া যায়। কার্পাসজাত এই সুক্ষ্মবস্ত্র ছাড়া রেশমবস্ত্রের উল্লেখও পাওয়া যায়। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন যে, ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে দেখতে পাওয়া যায়, বাঙলাদেশে খ্রিস্টের তিন-চারিশত বৎসর পূর্বে রেশমের চাষ খুব হত।’রেশমের খুব ভাল কাপড়ের নাম ছিল ‘পত্রোর্ণ’ বা পাতার পশম। তিন জায়গায় এই ‘পত্রোর্ণ’ হত—মগধে, পৌণ্ড্রদেষে ও সুবর্ণকুড্যে। মগধ ও পৌণ্ড্রদেশের অবস্থান সম্বেন্ধে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সুবর্ণকুড্য কোথায়? শাস্ত্রী মহাশয়ের মতে সুবর্ণকুড্যে ও কর্ণসুবর্ণ অভিন্ন। কর্ণসুবর্ণ বলতে আমরা মুর্শিদাবাদ থেকে রাজমহল পর্যন্ত ভূখণ্ড বুঝি। এখানে এখনও রেশমের চাষ হয় এবং এখানকার রেশম খুব ভাল। ভারতের অন্যত্র যে রেশমের চাষ হয়, সেকথা কৌটিল্য বলেননি। তিনি পরিষ্কার বলে গেছেন যে, বাঙলায় ও মগধেই রেশমের চাষ হত। বাঙলার রেশমের চাষ বাঙলার নিজস্ব অবদান। এটা চীনদেশ থেকে এদেশে আসেনি, কেননা, চীনের রেশম তুঁতগাছে হত। বাঙলার রেশম হত নাগবৃক্ষ, লিকুচ, বকুল ও বটগাছে। তা ছাড়া চীনের রেশম সবই সাদা, পরে তা রঙ করে নিতে হত। বাঙলায় নাগবৃক্ষের পোকা থেকে হলদে রঙের রেশম, লিকুচের পোকা থেকে গমের রঙের রেশম, বকুলের পোকা থেকে সাদা এবং বটের পোকা থেকে ননীর রঙের রেশম হত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলেন, ‘বাঙালী চীন হতে কিছু না শিখে, সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে যে রেশমের কাজ আরম্ভ করেছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।