বাঙালী সংস্কৃতির উৎস

বাঙালী সংস্কৃতির উৎস

একথা স্মরণ রাখতে হবে যে, আর্য বলতে এক বিশেষ ভাষাভাষী গোষ্ঠীসমূহকে বোঝায়। এটা কোনও জাতিবাচক (racial) শব্দ নয়। কেননা, আর্যভাষাভাষীদের মধ্যে আমরা যেমন ‘নর্ডিক’ নরগোষ্ঠীর লোক পাই, তেমনই আবার আলপীয়’ ‘দিনারিক’ প্রভৃতি গোষ্ঠীর লোকও পাই।

ভাষাতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের ভিত্তিতে আধুনিক পণ্ডিতগণ সিদ্ধান্ত করেছেন যে, রুশদেশের উরাল পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত শুষ্ক তৃণাচ্ছাদিত সমতল ভূখন্ডই আর্যজাতির আদি বাসস্থান ছিল। এখানে ‘নর্ডিক’ ও ‘আলপীয়’ এই উভয় গোষ্ঠীর আর্যরাই বাস করত। ‘নবোপলী’ যুগের বিকাশকালে আল্পীয়রা কৃষি পরায়ণ হয়, আর নর্ডিকরা পশুপালনে রত থাকে। এর ফলে উপাস্য-দেবতা সম্বন্ধে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ও বিবাদের সৃষ্টি হয়। নর্ডিকরা প্রকৃতির বিভিন্ন প্রকাশের উপাসক ছিল এবং উপাস্যদের ‘দেব’ বলে অভিহিত করত। আর ‘আলপীয়রা’ কৃষির সাফল্যের জন্য সৃজনশক্তি- রূপ দেবতাসমূহের পূজা করত। তাদের তারা ‘অসুর’ নামে অভিহিত করত। মনে হয় আলপীয়রাই প্রথম নিজেদের এক বিশেষ শাখায় বিভক্ত করে শিরদরিয়া ও আমুদরিয়া নদীদ্বয়-বেষ্টিত সুবিস্তীর্ণ সমতল ভুখণ্ডে বসবাস শুরু করে। তারপর তারা পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ইরান থেকে এশিয়া মাইনর পর্যন্ত নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। অপরপক্ষে তার কিছুকাল পরে নর্ডিকরা দুই দলে বিভক্ত হয়ে একদল পশ্চিমে ইউরোপের দিকে অগ্রসর হয় ও অপরদল ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রবেশদ্বার দিয়ে পঞ্চনদের উপত্যকায় এসে বসবাস শুরু করে।

কিন্তু বৈদিক আর্যগণ পঞ্চনদের উপত্যকায় উপনিবেশ স্থাপন করেই ক্ষান্ত হল না। অনার্যগণের সঙ্গে অবিরাম সংগ্রাম করে তারা ক্রমশ পূর্বদিকে অগ্রসর হতে লাগল। যেমন যেমন অগ্রসর হল তেমন তেমন তারা উত্তর-ভারতের আর্য-প্রভাবান্বিত অঞ্চলসমূহের নামকরণ করল। যেমন, ব্রহ্মর্ষিদেশ, ব্রহ্মাবর্ত, আর্যাবর্ত ইত্যাদি। কিন্তু মাত্র সংগ্রাম করেই তারা আর্য-ঐতিহ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। আর্যেতর অধিবাসিগণের সঙ্গে অনেকক্ষেত্রেই তাদের আপস করতে হয়েছিল। বস্তুত উত্তরভারতের আর্য সভ্যতার ক্রমবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে একটা সংমিশ্রণ প্রক্রিয়াও সমানভাবে চলেছিল। তার ফলে সৃষ্ট হল হিন্দুসভ্যতা- যেটা আর্য ও অনার্য সভ্যতার মিশ্রণের ফসল। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা তাদের মগধ ও প্রাচ্যের দেশসমূহকে, যেমন অঙ্গ, বঙ্গ,

কলিঙ্গ এবং পশ্চিমের প্রত্যন্তদেশ সিন্ধু-সৌবীর, সৌরাষ্ট্র প্রভৃতি অঞ্চলের লোকদের প্রতি ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করতে দেখি। কেন? তার উত্তর আমরা পরবর্তী অনুচ্ছেদে দেব।

দুই

মনে হয়, বৈদিক আর্যগণ পঞ্চনদে এসে উপনিবেশ স্থাপনের পূর্বেই আর্যভাষা-ভাষী অসুররা ভারতে এসেছিল। আরও মনে হয়, তাদের মধ্যে যারা বণিক শ্রেণি ও শ্রেষ্ঠী শ্রেণি ছিল তারাই সর্বপ্রথম এখানে এসে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। তারা জলপথেই এসেছিল বলে মনে হয়।

আলপীয় গোষ্ঠীভুক্ত অসুরদের বর্তমান ভারতে অবস্থান লক্ষ্য করলে বুঝতে পারা যায় যে, তারা সমুদ্রপথে রীতিমত বাণিজ্য করত এবং এই বাণিজ্য উপলক্ষেই তারা বাঙলাদেশে এসে উপস্থিত হয়েছিল। প্রাচীন বাঙলার বণিকরা ‘হট্ট’ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এদের ‘হাটী’ বলা হয়। বর্ধমান জেলায় ‘হাটী’ পদবিবিশিষ্ট জাতি এখনও বর্তমান আছে। এই শব্দগুলি যে অসুর-বণিকদের ‘হাউস’ বা হিটী’ শব্দেরই রূপান্তর সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এই অসুররাই বাঙলাদেশে থেকে তাম্র আহরণ করে জগতের সর্বত্র সভ্যতার সূচনায় সহায়ক হয়েছিল। তাম্রাশ্মযুগের সিন্ধু সভ্যতা যে অসুর সভ্যতার এক প্রতীক সেরূপ মনে করবার যথেষ্ট কারণ আছে। আগেই বলা হয়েছে যে খুব সম্ভবত অসুররা দ্রাবিড়দের অনুসরণেই ভারতে এসেছিল। সুতরাং ওই সভ্যতার সঙ্গে যে দ্রাবিড় সভ্যতাও খানিকটা মিশে গিয়েছিল এমনও অনুমান করা যেতে পারে।

তিন

যদিও অসুররা আর্যভাষাতেই কথা বলত, তবুও তাদের ভাষার সঙ্গে বৈদিক আর্যভাষার কিছু পার্থক্য ছিল। গ্রিয়ারসন এটা লক্ষ্য করেছিলেন। সেজন্য তিনি ভারতের আর্যভাষাগুলিকে দু’টি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিলেন (১) বহির্বর্তী আর্যভাষা ও (২) অন্তর্বর্তী আর্যভাষা। প্রথম শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে গুজরাটী, মারাঠী, ওড়িয়া, বাংলা ও অসমীয়া ভাষাসমূহ। আর দ্বিতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে হিন্দী, রাজস্থানী ইত্যাদি। (লেখকের ‘ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় দ্রঃ)।

‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ নামক গ্রন্থে বাঙলাভাষাকে ‘অসুর জাতির ভাষা’ বলা হয়েছে। (অসুরনাম ভবেৎ বাচ গৌড়-পুন্ড্রোদ্ভবা সদা’)। অথর্ববেদে প্রাচ্যদেশের লোকদের ‘ব্রাত্য’ বলা হয়েছে এবং ‘পঞ্চবিংশতি ব্ৰাহ্মণ’ অনুযায়ী ব্রাত্যরা ‘প্রাকৃত’, উদ্ভুত ভাষায় কথা বলত।

আগেই বলা হয়েছে যে, বৈদিক সংস্কৃতির বাহক নর্ডিক আর্যরা নিজেদের পূর্বদিকে বিস্তৃত করেছিল বিদেহ বা মিথিলা পর্যন্ত। এই পর্যন্তই ছিল আর্যাবর্ত বা বৈদিক সংস্কৃতির লীলাভূমি। এর বাইরের লোকদের তারা হীন বা হেয় মনে করত। সেজন্য আর্যাবর্তের কোন লোক যদি তীর্থযাত্রা উপলক্ষে বাঙলাদেশে আসত, তা হলে তাকে পুনোষ্টম নামে এক যজ্ঞ সম্পাদন করে শুদ্ধ হতে হত। এই বিধান থেকে পরিস্কার বুঝতে পারা যায় যে, বাঙলাদেশের লোকরা তখন সংস্কৃতিবিহীন জাতি ছিল না। তাদের ও স্বকীয় সংস্কৃতি ছিল, স্বকীয় ধর্ম ছিল এবং তাদের দেবদেবীকে কেন্দ্র করে তীর্থস্থানও ছিল। আর্যদের মধ্যে উদারপন্থী কেউ কেউ সে সকল তীর্থ দর্শন করতে আসত।

বাঙলার সংস্কৃতির সঙ্গে উত্তরভারতের সংস্কৃতির পার্থক্য আজও লক্ষিত হয়। এটা বিশেষ করে প্রকাশ পায় তাদের আহার-বিহারের পদ্ধতিতে।

বাঙালীর আহারের একটা বিশেষ উপাদান হচ্ছে মাছ। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় ভাষাভাষী লোকরা মাছ খেত। কিন্তু বৈদিক আর্যরা মাছ খেত না। তারা খেত মাংস। এমনকি আর্যরা গোমাংসও আহারত করত। কিন্তু অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোকরা গরুকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত। পোশাক-আশাকের ব্যাপারেও বাঙালীর সঙ্গে উত্তরভারতের লোকদের পার্থক্য দেখা যায়। আসাম, বাঙলা, ওড়িশা, গুজরাট ও দক্ষিণভারতের লোকরা উপর-গায়ের জন্য চাদর ও পায়ে গোড়ালির দিকে খোলা জুতা পরে। তা ছাড়া, তারা রাঁধবার জন্য তেল ব্যবহার করে। কিন্তু উত্তরভারতের লোকরা উপর-গায়ের জন্য সেলাই করা জামা ও পায়ে গোড়ালি-ঢাকা জুতা ব্যবহার করে এবং রাঁধবার জন্য তেলের পরিবর্তে ঘি ব্যবহার করে। রন্ধন ক্রিয়ার বৈচিত্র্যেও বাঙালীর দক্ষতা সুবিদিত। বাঙালীর আহারে ৬৪ রকমের ব্যঞ্জন ব্যবহৃত হত। কিন্তু উত্তরভারতের লোকরা এত বেশি ব্যঞ্জন প্রস্তুত করতে জানত না।

আহার-বিহার ও বস্ত্রের বিভেদ ছাড়া অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়গোষ্ঠীর লোকদের সঙ্গে আর্যাবর্তের লোকদের ধর্মীয় সংস্কারেরও অনেক পার্থক্য ছিল। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়গোষ্ঠীর ধর্মীয় সংস্কারের অন্তর্ভুক্ত ছিল মৃত্যু-উত্তর জীবনে, বিশ্বাস, পিতৃপুরুষগণের পূজা, কৃষি-সম্পর্কিত অনেক উৎসব, যেমন—পৌষপার্বণ, নবান্ন প্রভৃতি; মেয়েদের দ্বারা পালিত অনেক ব্রত এবং ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে চাউল, দূর্বা, কলা, হরিদ্রা, সুপারি ও পান, নারিকেল, সিঁদুর ও কলাগাছ প্রভৃতির ব্যবহার; শিলা, বৃক্ষ ও লিঙ্গপূজা, পূজায় ঘটের ব্যবহার ইত্যাদি। এগুলি আর্য-অন্তর জাতিসমূহের ধর্মীয় আচারের অন্তর্গত। চড়ক, গাজন প্রভৃতি উৎসবও বাঙলাদেশের বৈশিষ্ট্য। এরূপ অনুমান করার সপক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে যে, বাঙলীর এই সকল বৈশিষ্ট্য প্রাক্ আর্য যুগ থেকে প্রচলিত আছে। যোগ অভ্যাস এর অন্যতম। লিঙ্গরূপী শিবপূজা, মাতৃদেবীর পূজা প্রভৃতি বাঙলাদেশে প্রাক্-আর্য কাল থেকেই চলে এসেছে। তন্ত্রধর্মের উদ্ভবও বাংলাদেশেই হয়েছিল। বাঙলী সংস্কৃতির আরও অনেক বৈশিষ্ট্যে কথা মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলেছেন, যেমন—হস্তিবিদ্যা, রেশমবয়ন, সাংখ্যদর্শন, প্রেক্ষগৃহ (বা রঙ্গালয়), নৌকা বা জাহাজ নির্মাণ প্রভৃতি। এসব বাঙালী সংস্কৃতির অবদান। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উলুধ্বনি দেওয়া, আলপনা অঙ্কন প্রভৃতিও বাঙালী সংস্কৃতির নিজস্ব অবদান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *