বাংলা ভাষা ও লিপির উৎপত্তি
ভাষা থেকেই জাতির পরিচয়। কিন্তু এখন বাংলা সাহিত্য যে ভাষায় রচিত হয়, তা হচ্ছে এক বিশেষ নগরের ভাষা। সে নগর হচ্ছে মহানগরী কলকাতা। যদিও কলকাতার ভাষায় রচিত সাহিত্য সমগ্র বাঙলাদেশেই লোকই পড়তে সক্ষম, তা হলেও বাঙলাদেশের প্রত্যেক অঞ্চলেরই এক একটি নিজস্ব ভাষা আছে। সম্প্রতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ‘গবেষণা পরিষদ’ এরূপ আঞ্চলিক ভাষার একখানা অভিধান সংকলন করেছেন। তাঁরা যে হাজার হাজার আঞ্চলিক ভাষার শব্দ সংগ্রহ করেছেন, তার একটাও কলকাতার লেখকরা যখন বিভিন্ন জেলায় পটভূমিকায় সাহিত্য রচনা করেন তখন ব্যবহার করেন না।
দুই
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ হতেই কলকাতার ভাষার আরম্ভ। তবে আগেকার যুগের ভাষাকে আমরা তিন কাল-স্তরে ভাগ করি- (১) আদি, (২) মধ্য ও (৩) আধুনিক। আদি যুগের ভাষার স্থিতিকাল আনুমানিক ৯৫০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ। এ যুগের ভাষার নিদর্শন হচ্ছে ‘চর্যাচর্যা বিনিশ্চয়’-এর গীতিগুলি। মধ্যযুগের ভাষায় স্থিতিকাল আনুমানিক ১৩৫০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এ যুগকে আবার দুই স্তরে ভাগ করা হয়—(১) আদি-মধ্য (১৩৫০-১৬০০ খ্রিস্টাব্দ) ও (২) অন্ত-মধ্য (১৬০০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)। আদি-মধ্যযুগের ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায় বড় চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ। অন্ত-মধ্য যুগের ভাষায় নিদর্শন পাওয়া যায় যেসব গ্রন্থে তাদের অন্যতম হচ্ছে কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’ কবিকঙ্কণের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাশীরাম দাসের ‘মহাভারত’ কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্যচরিতামৃত, কবিচন্দ্রের ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ ঘনরাম চক্রবর্তীর ‘ধর্মমঙ্গল’ ও ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ প্রভৃতি গ্রন্থে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীকালের ভাষাকে আমরা আধুনিক যুগের ভাষা বলি। (বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।
তিন
বাংলা ভাষার ভিত্তি অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও মাগধী-প্রাকৃত। এই তিন ভাষার শব্দগুলিকেই আমরা ‘দেশজ’ শব্দ বলি। এই তিন ভাষা ছেড়ে দিলে, বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে সংস্কৃত ভাষা থেকে। কিন্তু সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার কিছু প্রভেদ আছে। উচ্চারণের দিক দিয়ে বাংলার ‘অ’ সংস্কৃতের ‘অ’ থেকে পৃথক। সংস্কৃতে ‘আ’ দীর্ঘধ্বনি’ বাংলায় হ্রস্বধ্বনি। ‘এ’, ‘ও’, ‘ঐ’, ও ‘ঔ’ ধ্বনিও বাংলায় সংস্কৃতের ন্যায় উচ্চারিত হয় না। ‘শ’ ‘ষ’ ও ‘স’ এই তিনটি ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ বাংলায় প্রায় এক, সংস্কৃতে বিভিন্ন। ‘ণ’ ধ্বনি এখন বাংলায় লুপ্ত। এর উচ্চারণ ‘ন’-এর মতো। উচ্চারণের প্রভেদ ছাড়া বাংলায় মাত্র দুটি লিঙ্গ ব্যবহৃত হয়। সংস্কৃতে ক্লীবলিঙ্গও আছে। বাংলার বিশেষণে কারক বিভক্তি যোগ হয় না, সংস্কৃতে হয়। এ ছাড়া, আরও অনেক প্রভেদ আছে। আবার আদি ও মধ্যযুগের বাংলার সঙ্গে আধুনিককালের বাংলায় অনেকে পার্থক্য ঘটেছে।
মোটামুটি বর্তমান বাংলায় দুই শ্রেণির শব্দ আছে (১) মৌলিক ও (২) আগন্তুক। মৌলিক শব্দগুলি সংস্কৃত ভাষা থেকে গৃহীত। তবে সেগুলি তিন শ্রেণিতে পড়ে (১) তদ্ভব (২) তৎসম ও (৩) অর্ধ-তৎসম। আর আগন্তুক শব্দগুলির মধ্যে আছে, (১) দেশজ (তার মানে সূচনায় যার ওপর বাংলা ভাষার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল), যথা অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, হিন্দি ইত্যাদি, ও (২) পরবর্তীকালে গৃহীত বিদেশী শব্দ যথা আরবী, ফারসী, পর্তুগীজ, ইংরেজি, ফরাসী, ওলন্দাজ আমেরিকান ইত্যাদি।
প্রাচীনকালে লেখার জন্য তাম্রপট্ট, তালপত্র ও ভূজপত্র ব্যবহৃত হত। কাগজেরও ব্যবহার ছিল, তবে কাগজ ব্যাপকভাবে হতে থাকে ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে।
চার
মৌর্যযুগে ব্রাহ্মীলিপি সর্বত্র প্রচলিত ছিল। কিন্তু মৌর্যসাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ব্রাহ্মীলিপি বিবর্তিত হয়ে, ভিন্ন ভিন্ন। প্রাদেশিক রূপ ধারণ করে। তা হলেও এক প্রদেশের লোক অন্য প্রদেশের লিপি পড়তে পারত। লিপির বিবর্তনে বাঙলাদেশের লিপিতে একটা স্বকীয়তা আমরা প্রথম লক্ষ্য করি গুপ্তযুগে। এই স্বকীয় লিপি থেকেই বাংলা লিপির উৎপত্তি হয়। এর একটা বিশিষ্ট রূপ আমরা লক্ষ্য করি সমাচারদেবের কোটালিপাড়ায়, তাম্রশাসনে। সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে আর অনেক পরিবর্তন ঘটে। প্রথম মহীপালের বাণগড় লিপিতে অ, উ, ক, খ, গ, জ, ন, ম, ল, ক্ষ, অনেকটা বাংলা অক্ষরের রূপ ধারণ করে। দ্বাদশ শতাব্দীর বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তির ২২টা অক্ষর পুরাপুরি বাংলা অক্ষরের মতো। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষে এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ায় তাম্রশাসনসমূহের অক্ষর দেখা যাচ্ছে আধুনিক বাংলা অক্ষরের মতো হয়ে গেছে। পরে তার আর কোন বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। উনবিংশ শতাব্দী হতে মুদ্রাযন্ত্রের প্রচলনের ফলে বাংলা অক্ষরগুলি একটা নির্দিষ্ট রূপ হয়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি।