বাঙালীর দিগ্বিজয়

বাঙালীর দিগ্বিজয়

বাঙলা নদীবহুল দেশ। সে জন্যই বাঙলার পরিবহণের জন্য ছিল নৌকার ব্যবহার। সম্প্রতি (১৯৮৯) রংপুর জেলার দেবীগঞ্জে এক পুকুর খুঁড়তে গিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে চার কিলোগ্রাম ওজনের বাহারী কাজ করা এক সোনার নৌকা। এর আগেই আমরা বলেছি মেদেনীপুরের পান্না গ্রামে এক পুকুর খোঁড়ার সময় ৪৫ ফুট তল থেকে পাওয়া গিয়েছে সমুদ্রগামী এক নৌকার কঙ্কালাবেশ। নৌকার সাহায্যে বাঙালী যে মাত্র বাঙলারই এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে যেত তা নয়। সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে সে সারা বিশ্বে যেত বাণিজ্য করতে। বাণিজ্য উপলক্ষে বাঙালী বণিকরা যে মাত্র ভূমধ্যসাগরীয়, পারস্য উপসাগরীয়, আরবসাগরীয় ও ভারতমহাসাগরের দেশসমূহে পাড়ি জমাত, তা নয় বঙ্গোপসাগর ও তার দক্ষিণের দেশসমূহের সঙ্গেও পণ্য বিনিময় করতে যেত। পণ্যদ্রব্যের সঙ্গে আরও অনেক নিয়ে যেত বাঙলার ধর্ম ও সাংস্কৃতিক উপাদানসমূহ।

ক্রীটদেশের সঙ্গে বাঙালীর বাণিজ্য, বাণিজ্য উপলক্ষে সিন্ধুসভ্যতার অন্যতম কেন্দ্র লোথালে বাঙালীর উপস্থিতি, স্বদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বাঙলার দামাল রাজপুত্র বিজয়সিংহের সিংহলে উপনিবেশ স্থাপন, প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সাম্রাজ্যে বাঙলার পণ্যদ্রব্যের সমাদর, এসব বিষয়ে আমরা আগেই আলোচনা করেছি। গ্রীক ও রোমান সাহিত্যে বাঙালীদের সম্বন্ধে কথার উল্লেখও আমরা আগে করেছি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাঙালী সংস্কৃতির কথা আজ সুবিদিত। বৌদ্ধ জাতক গ্রন্থের যুগ থেকেই ভারতীয়দের কাছে এসব দেশ জানা ছিল। যেসব দেশে গিয়ে এদেশের লোক অতি প্রাচীনকাল থেকে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, তার অন্তর্ভুক্ত ছিল চম্পা (ভিয়েনাম), কম্বোজ, (কাম্পুচিয়া), শ্যাম (থাইল্যাণ্ড), যবদ্বীপ (জাভা), ব্রহ্মদেশ ইত্যাদি। সঙ্গে করে তারা নিয়ে গিয়েছিল ভারতীয় সংস্কৃতি ও শিল্পের ধারা। বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে সেকালে বাঙলার তাম্রলিপ্তি বন্দরেরই ছিল সবচেয়ে বড় ভূমিকা।

স্থলপথে হিমালয় অতিক্রম করে বাঙলার বৌদ্ধ আচার্য ও পণ্ডিতেরা যেতেন নেপাল, তিব্বত ও মধ্য এশিয়ায়। চীনদেশের সঙ্গেও বাঙলার আদান-প্ৰদান ছিল। সম্প্রতি আমেরিকার প্রাপ্ত ৯২৩ খ্রিস্টাব্দের এক শিলালিপি থেকে জানা গিয়েছে যে ভারতীয় বণিকরা আমেরিকাতেও যেত। (বৰ্তমান, ফেব্রুয়ারি ১৩, ১৯৮৯)।

দুই

ব্রহ্মদেশের প্রাচীন স্থাপত্য যে বাঙালীর সৃষ্টি, সে বিষয়ে কোন মতদ্বৈত নেই। ‘গৌড়’ নামের পদাঙ্কেই ব্রহ্মদেশের এক নাম ছিল ‘গৌড়। দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার দ্বীপসমূহে বৌদ্ধ ও হিন্দু সংস্কৃতির বিস্তারে বাঙালীর প্রভাবই ছিল সবচেয়ে বেশি। মালয় উপদ্বীপের এক অভিলেখে বাঙলার রক্তমৃত্তিকাবাসী বুদ্ধগুপ্ত নামে এক মহানাবিকের নাম খোদিত আছে। যবদ্বীপের শৈলেন্দ্রবংশীয় রাজগণের গুরু ছিলেন এক বাঙালী। শৈলেন্দ্ররাজবংশীয় রাজগণের সঙ্গে বাঙলার পালসম্রাটগণের যে বিশেষ সম্প্রীতি ছিল তা দেবপালের সময়ের এক অভিলেখ থেকে জানা যায়। দেবপাল শৈলেন্দ্ৰবংশীয় মহারাজ বালপুত্রদেবকে নালন্দা বিহারে এক মঠ প্রতিষ্ঠা করবার অনুমতি দিয়েছিলেন ও তার ব্যয় নির্বাহের জন্য পাঁচখানা গ্রাম দান করেছিলেন। যবদ্বীপের কতকগুলি মূর্তিতে উৎকীর্ণ লিপি বাংলা অক্ষরেই লিখিত হয়েছিল। তা ছাড়া, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় ব্রাহ্মণ-ধর্মেরও যে বিস্তার ও প্রসার ঘটেছিল, তা ওইসব দেশের ভাস্কর্যশিল্পে রামায়ণ ঘটিত নানান দৃশ্যাবলী থেকে প্রকাশ পায়।

তিন

বাঙালী পণ্ডিতগণ যে তিব্বতদেশে বিশেষরূপে সমাদৃত হতেন, তা আমরা তিব্বতীয় গ্রন্থসমূহ থেকে জানতে পারি। তিব্বতের রাজা খ্রী সং-দে-ব‍- সন বাঙালী বৌদ্ধাচার্য শান্তিরক্ষিতকে বৌদ্ধধর্ম সংস্কারের জন্য তিব্বতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ভগ্নপতি পদ্মসম্ভবও ওই একই উদ্দেশ্যে রাজনিমন্ত্রণে তিব্বতে যান। তাঁরাই তিব্বতে বিখ্যাত ‘লামা’ সম্প্রদায় সৃষ্টি করেন। তা ছাড়া তিব্বতের রাজা মগধের ওদন্তপুরী বিহারের আদর্শে তাঁর রাজধানী লাসায় বসময়া নামে এক বিহার নির্মাণ করেন ও শান্তিরক্ষিতকে তারা অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। শান্তিরক্ষিত তেরো বৎসর ওই পদে অধিষ্ঠিত থেকে বহু বৌদ্ধগ্রন্থ তিব্বতীয় ভাষায় অনুবাদ করেন।

শান্তিরক্ষিতের মৃত্যুর পর তাঁরা শিষ্য কমলশীল তাঁর আরব্ধ কাজসমূহ সমাপ্ত করেন। নেপাল ও তিব্বতে যাবার পূর্বে শান্তিরক্ষিত নালন্দা মহাবিহারের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি ‘মধ্যমকালঙ্কার’-কারিকা’ ও তার বৃত্তি এবং ‘সত্যদ্বয়বিভঙ্গপঞ্জিকা’ নামে দুই মহাযানী গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

তিব্বতে যেসব বৌদ্ধ আচার্য গিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানই সুপ্রসিদ্ধ। তিনি অতীশ নামে সুপরিচিত। তিনি ভারতের বিভিন্ন পণ্ডিতের নিকট শিক্ষাগ্রহণ করেন ও দন্ডপুরীর মহাসঙ্ঘিকার্য শীলরক্ষিত কর্তৃক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন এবং “শ্রীজ্ঞান” উপাধি পান। ‘গুহ্য-জ্ঞানবজ্ৰ’ উপাধিও তিনি পেয়ে ছিলেন। সুবর্ণদ্বীপের প্রধান বৌদ্ধাচার্য চন্দ্রগিরির নিকটও তিনি বারো বৎসর শিক্ষালাভ করেছিলেন। পালসম্রাট নয়পাল তাঁকে বিক্রমশীলার মহাস্থবির নিযুক্ত করেন। তিব্বতরাজ হলা-লামা নিজ রাজ্যে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য যখন তাঁকে প্রথম আমন্ত্রণ করেন, তখন তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তী রাজা চ্যানচাব জ্ঞানপ্রভ পুনরায় তাঁকে আহ্বান করলে তিনি তিব্বত যাত্রা করেন (১০৪০ খ্রিস্টাব্দে) পথে তিনি নেপালরাজ অনন্তকীর্তি কর্তৃক সম্বর্ধিত হন ও রাজপুত্র পথপ্রভাকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেন। তিব্বতে তিনি ক-দম (পরবর্তী নাম গো-লুক) সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভোট ভাষায় বহু সংস্কৃত গ্রন্থ অনুবাদ করেন। তিনি নিজেও অনেকগুলি গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলির মধ্যে ‘রত্নকরোণ্ডোদঘাট’, ‘বোধিপাঠ-প্রদীপপঞ্জিকা’ ও ‘বোধিপাঠপ্রদীপ’ প্রসিদ্ধ। ভোট ভাষায় তিনি যে সকল সংস্কৃত গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন, তার মাধ্যমেই বৌদ্ধধর্ম এখনও তিব্বতে টিকে আছে। সেজন্য তিব্বতের লোকরা তাঁর স্মৃতির প্রতি এখনও শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

নেপালেও বহু বৌদ্ধ আচার্য বিশেষরূপে সমাদৃত হতেন। এখানে মনে রাখতে হবে যে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত নিদর্শন চর্যাপদসমূহ নেপাল থেকেই আবিষ্কৃত হয়েছিল।

এছাড়া ভারতের অভ্যন্তরেও বাঙালী পণ্ডিতরা বহুরাজ্যে আমন্ত্রিত হতেন, এবং তাঁরা বিচারযুদ্ধে অন্যান্য প্রদেশের পণ্ডিতদের পরাজিত করতেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *