বাঙালীর নিজস্ব স্থাপত্য ও ভাস্কর্য
চৈতন্যের যুগে বাঙলায় উদ্ভূত হয়েছিল বাঙলার এক স্বকীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্য যাঁরা চৈতন্য (১৪৮৫-১৫৩৩) কর্তৃক প্রচারিত ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেক বিত্তবান ও প্রভাবশালী লোক ছিলেন। চৈতন্যের তিরোভাবের পর তাঁরা অনেকেই বাঙলার নানাস্থানে রাধাকৃষ্ণ ও গৌর- নিতাই এর মন্দির স্থাপন করেছিলেন। অধিকাংশ স্থলেই এই সকল মন্দির নির্মাণে এক নূতন স্থাপত্যরীতি অনুসৃত হয়েছিল।
বাঙলার মন্দিরসমূহকে সাধারণত তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করতে পারা যায়—(১) চালা, (২) রত্ন ও (৩) দালান-রীতিতে গঠিত মন্দির। এগুলি ভারতীয় মন্দির-স্থাপত্যের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে স্বীকৃত রেখ, ভদ্র ইত্যাদি শৈলীরীতিতে নির্মিত মন্দিরসমূহ থেকে ভিন্ন। তার মানে বাঙলার মন্দিরসমূহ বাঙলার নিজস্ব স্থাপত্যরীতিতে গঠিত। প্রথমে ধরা যাক ‘চাল’ মন্দির। এগুলি বাঙলার কুঁড়ে ঘরের অনুকরণে গঠিত। এ থেকে মনে হয় যে বাঙলার দেবালয়গুলি অতীতে সহজলভ্য উপকরণ, যেমন-বাঁশ, খড়, কাঠ, ইত্যাদি দ্বারাই নির্মিত হত। পরে সেগুলি পোড়া ইটের তৈরি হতে থাকে। চালা-মন্দিরসমূহকে দোচালা জোড় বাংলা, চারচালা, আটচালা ও বারোচালা শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। দোচালা মন্দিরকে এক-বাংলা মন্দিরও বলা হত, তবে বাঙলাদেশে দোচালা মন্দির খুব বিরল। দুটি দোচালা মন্দিরকে পাশপাশি স্থাপন করে যখন মন্দির তৈরি করা হত, তখন তাকে জোড়বাংলা মন্দির বলা হত। জোড়বাংলা মন্দিরের সুন্দর নিদর্শন হচ্ছে হুগলী জেলার সেনেটের বিশালাক্ষীর মন্দির। গ্রাম-বাঙলার সর্বত্র খড়ের যে চারচালার কুটির দেখতে পাওয়া যায়, তার অনুকরণে যে সকল মন্দির তৈরি হত, সেগুলিকে চারচালা মন্দির বলা হত। একটি চারচালা মন্দিরের মাথার ওপর আর একটি ছোট চারচালা মন্দির নির্মাণ করে, আটচালা মন্দির গঠন করা হত। আটচালা মন্দিরের নিদর্শনই বাঙলার সর্বত্র পরিদৃষ্ট হয়। সাধারণত এগুলি শিবমন্দির হিসাবেই ব্যবহৃত
হয়।
বাঙলার শিখরযুক্ত মন্দিরগুলিকে ‘রত্ন মন্দির বলা হয়। ‘রত্ন’ শব্দটি শিখর’ বা ‘চূড়া’ শব্দের সমার্থবোধক শব্দ। যখন মাত্র একটি শিখর থাকে, তখন তাকে ‘একরত্ন’ মন্দির বলা হয়। যখন কেন্দ্রীয় শিখর ব্যতীত ছাদের চারকোণে আরও চারটি ক্ষুদ্র শিখর থাকে তখন তাকে ‘পঞ্চরত্ন’ মন্দির বলা হয়। আবার যখন পঞ্চরত্ন মন্দির মাঝের চূড়াটির স্থানে একটি দোতলা কুঠরি তৈরি করে তার ছাদের চারকোণে চারটি ছোট চূড়া ও মাঝখানে একটি বড় চূড়া তৈরি করা হয়, তখন তাকে ‘নবরত্ন’ মন্দির বলা হয়। অনুরূপভাবে যখন আরও একতলা তৈরি করে, তার মাঝখানে একটি বড় শিখর ও চারকোণে চারটি ছোট শিখর বসানো হয়, তখন তাকে ‘ত্রয়োদশরত্ন’ মন্দির বলা হয়। বিষ্ণুপুরের শ্যামরায়ের মন্দির হচ্ছে পঞ্চরত্ন মন্দিরের নিদর্শন। দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণীর মন্দির হচ্ছে নবরত্ন মন্দিরের নিদর্শন ও বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরীর মন্দির হচ্ছে ত্রয়োদশরত্ন মন্দিরের নিদর্শন। কুমিল্লায় সতেরো রত্ন মন্দিরও আছে। ‘দালান’ রীতিতে গঠিত মন্দিরের কোন শিখর নেই। তার মানে, মন্দিরে ছাদটি হচ্ছে সমতল। ‘দালান রীতিতে গঠিত অনেকগুলি মন্দির বীরভূমের নানাস্থানে আছে, যথা— উচকরণ, কনকপুর, নানুর ও লাভপুরে অবস্থিত মন্দিরসমূহ।
বাঙলার নিজস্ব স্থাপত্যরীতিতে গঠিত এইসকল মন্দির ছাড়া, ভারতীয় ‘রেখ’ রীতিতে গঠিত মন্দিরও বাঙলার কয়েক স্থানে আছে। ‘রেখ’ রীতিতে গঠিত প্রাচীন মন্দিরগুলি প্রস্তরনির্মিত। কিন্তু পরবর্তীকালে এই রীতিতে গঠিত মন্দিরগুলি ইষ্টকনির্মিত হয়েছিল। ‘রেখ’ মন্দিরের গঠনশৈলী বাঙলায় অনুপ্রবেশ করেছিল ওড়িশা থেকে, যদিও ওড়িশা-শৈলীর আদিবৈশিষ্ট্য বাঙলায় অনুসৃত হয়নি। ওড়িশা থেকে এর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বলে এই রীতিতে গঠিত মন্দিরের সংখ্যাধিক্য আমরা সবচেয়ে বেশি দেখতে পাই মেদিনীপুর জেলায়। বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলাতেও এই শৈলীর মন্দির দৃষ্ট হয়। ২৪-পরগনার জটার দেউল এই রীতিতে গঠিত মন্দিরের জীর্ণ নিদর্শন।
দুই
বাঙলাদেশের বহু ইটের মন্দিরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গ হচ্ছে ‘টেরাকোটা’ বা পোড়ামাটির অলঙ্করণ। পোড়ামাটির অলঙ্করণ ভারতে খুব প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল। এর নিদর্শন আমরা পাই ভিটা, অহিচ্ছত্র, রাজগীর, ভিতরগাঁও প্রভৃতি স্থানে। বাঙলাদেশেও পাল যুগে পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় প্রভৃতি স্থানের বৌদ্ধবিহারের গায়েও আমরা পোড়ামাটির অলঙ্করণ দেখতে পাই। খ্রিস্টীয় একাদশ ও দ্বাদশ শতকে নির্মিত বাঁকুড়ার বহুলাড়া ও সোনাতোপলের মন্দিরে, বীরভূম ও হুগলী জেলার বহু মন্দির এবং মালদহ জেলার গৌড়, আদিনা ও পাণ্ডুয়ার মসজিদগুলির গায়ে আমরা পোড়ামাটির অলঙ্করণ দেখতে পাই। এগুলি সাধারণত তৈরি করা হত টালির আকারে ছাঁচে ফেলে, বা কাঁচামাটির ওপর উৎকীর্ণ করে ‘পোনা’ বা ভাটিতে পুড়িয়ে। পোড়ামাটির ইটে সাধারণত ৩০/৪০ বছরে মধ্যের নোনা ধরে যায়। কিন্তু বাঙলার মন্দিরগাত্রের পোড়ামাটির অলঙ্কারসমূহ তিন-চারশ বছরেও অক্ষত অবস্থায় আছে। সেজন্য অনুমান করা হয়েছে যে এগুলির নির্মাণে বিশেষ ধরনের মাটি ও খুব উচু দরের দক্ষতা ও নৈপুণ্য ব্যবহৃত হত। অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন যে, এগুলির নির্মাণের জন্য সমাজে এক বিশেষ শ্রেণির শিল্পী ছিল। তিনি বলেছেন ‘কোথায় এসব শিল্পীদের ঘাঁটি ছিল এবং কি ভাবেই বা তাঁরা মন্দির তৈরি করে বেড়াতেন সে বিষয়ে বিস্তৃত সমীক্ষার প্রয়োজন। আমার অসম্পূর্ণ অনুসন্ধান থেকে বলতে পারি, মেদিনীপুর জেলায় চেতুয়া-দাসপুর, হাওড়া জেলায় থলিয়া-রসপুর, হুগলী জেলার খানাকুল-কৃষ্ণনগর, রাজহাটি, সেনহাটি, বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর, সোনামুখি, গলসি ও বর্ধমান জেলার গুসকরা ও কেতুগ্রাম প্রভৃতি স্থানে এসব শিল্পী প্রধানত কেন্দ্রীভূত ছিলেন। এই মূল ঘাঁটিগুলির কাছাকাছি বহু ছোট বড় গ্রামে তাঁদের বসতি ছিল। আমার দেখার অনেক মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপিতে তাঁদের ‘সূত্রধর’, ‘রাজা’ ‘বা মিস্ত্রি’ বলা হয়েছে ও তাঁদের পদবি পাল, শীল, চন্দ্র, দত্ত, কুণ্ড, দে মাইতি, রক্ষিত, পতিত প্রভৃতি উল্লিখিত হয়েছে।’
পোড়ামাটির অলঙ্করণের বিষয়বস্তু হচ্ছে—রামায়ণ, মহাভারত ও পৌরাণিক কাহিনী, কৃষ্ণলীলা-বিষয়ক বৃত্তান্ত, সমকালীন, সমাজচিত্র, বন্যপশুর অনায়াস বিচরণ-ভঙ্গী, ও সাবলীল গতিবেগ এবং ফুল, লতাপাতা ও জ্যামিতিক নকশা প্রভৃতি। রামায়ণের কাহিনীর মধ্যে চিত্রিত হয়েছে হরধনুভঙ্গ, রামসীতার বনগমন, সুর্পনখার নাসিকাছেদন, মারীচবধ, রাবণ-জটায়ুর যুদ্ধ, জটায়ুবধ, অশোকবনে সীতা প্রভৃতি এবং মহাভারতের কাহিনীর মধ্যে অর্জুনের লক্ষ্যভেদ শকুনির পাশাখেলা, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধদৃশ্য, ভীষ্মের শরশয্যা প্রভৃতি। পৌরাণিক বিষয়বস্তুর মধ্যে রূপায়িত হয়েছে বিষ্ণুর দশ অবতার, দশ দিক্পাল, দশ মহাবিদ্যা ও অন্যান্য মাতৃকা-দেবীসমূহ এবং অন্যান্য জনপ্রিয় পৌরাণিক উপাখ্যান, যথা—শিববিবাহ, দক্ষযজ্ঞ, মহিষাসুরমর্দিনী ইত্যাদি। সামাজিক দৃশ্যসমূহের মধ্যে আছে বারাঙ্গনা-বিলাস ও নানাবিধ আমোদ- প্রমোদ, বেদে-বেদেনীর কসরৎ, মোহান্ত-সম্প্রদায়ের আচার-আচরণ ও নানারূপ ঘরোয়া দৃশ্য। এই প্রসঙ্গে ‘বাঙালীর ধর্মীয় চেতনার প্রকাশ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।