বিদেশী বণিক ও বাঙালী সমাজ

বিদেশী বণিক ও বাঙালী সমাজ

বিদেশী বণিকরা বাঙলাদেশে এসে বাঙালী সমাজের ওপর গভীর প্রতিঘাত হেনেছিল। এ সকল বিদেশী বণিক প্রথম আসতে শুরু করেছিল খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতাব্দী থেকে। যারা সবচেয়ে আগে এসেছিল, তারা হচ্ছে পর্তুগীজ। এরা সকলেই এখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।

পর্তুগীজরাই সমুদ্রপথে ভারতে আসবার পথের সন্ধান পেয়েছিল। পর্তুগালের রাজা প্রথম ম্যানুয়েলের রাজত্বকালে ভাস্কো-ডা-গামা নামে এক নাবিক উত্তমাশা অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করে ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে এসে পৌছান। কিন্তু ভারতে আসবার পথ তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল। দৈব্যক্রমে ওই সময় তাঁর সঙ্গে একটি গুজরাটি মুসলমান নাবিকের সাক্ষাৎ ও বন্ধুত্ব হয়। ওই গুজরাটি মুসলমান নাবিকই তাঁকে ভারতের পথ দেখিয়ে, ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে কপ্পাট নামক গ্রামে তাঁকে পৌঁছে দেয় (১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দ)। ওই গ্রামের পাঁচ-ছয় ক্রোশ দূরেই ছিল মালাবারের রাজধানী কালিকট। কালিকটের রাজা ছিলেন মুসলমান। তিনি পর্তুগীজদের সঙ্গে খুব সদয় ব্যবহার করেন।

মালাবার উপকূলে নিজেদের শক্তি সুদৃঢ় করে পর্তুগীজরা গোয়ায়, তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। বাঙালী বণিকরা গোয়ার হাটে তাদের মাল বেচতে যেত। সেজন্য পর্তুগীজরা বাঙলার পণ্যদ্রব্য ও তার সুলভতার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠেছিল।

সরাসরি বাঙলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করবার উদ্দেশ্য ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে তারা বাঙলায় দু-একজন নাবিক পাঠিয়ে দেয়। প্রথম এসে চট্টগ্রামে উপস্থিত হয় যোয়াও কোয়েলহো (Joao Coelho) নামে একজন নাবিক। চট্টগ্রামই তখন ছিল বাঙলাদেশের বড় বন্দর। কেননা এখান থেকে মেঘনা নদীর জলপথে বাঙলার রাজধানী গৌড়ে পৌঁছান যেত।

যোয়াও কোয়েলহো নিজে কোন জাহাজ আনেননি। তিনি মালাক্কা থেকে এক মুসলমানী জাহাজে চেপে এসেছিলেন। পর্তুগীজ জাহাজ নিয়ে বাঙলায় প্রথম আসেন যোয়াও দ্য সিলভিরা (Joao de Silveira) ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে। তিনি বাঙলার সুলতান মামুদ শাহের কাছে প্রার্থনা জানান যে, পর্তুগীজরা যেন তাঁর রাজ্যে বাণিজ্য করতে পারে, এবং চট্টগ্রামে যেন তাদের একটা কুঠি নির্মাণ করতে দেওয়া হয়। মামুদ শাহ পর্তুগীজদের এই প্রার্থনা অগ্রাহ্য করেন।

পর্তুগীজরা কিন্তু দমবার পাত্র ছিল না। প্রতি বৎসরই তারা বাঙলাদেশে বাণিজ্য অভিযান পাঠাতে থাকে। এই কারণে মামুদ শাহের সঙ্গে তাদের বিরোধ ঘটে।

দুই

সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্তুগীজদের সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়। এই সময় বাঙলাদেশে শেরশাহ (১৫৩৯-৪০) ও হুমায়ুনের (১৫৩৮-৩৯) মধ্যে যুদ্ধের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়। পর্তুগীজরা এই যুদ্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এটা ১৫৩৫-৩৭ খ্রিস্টাব্দের ব্যাপার। ঠিক এই সময়ে পশ্চিম বাঙলার শ্রেষ্ঠ ও অতি প্রাচীন বন্দর সপ্তগ্রামে দিওগো রিবেলো নামে এক পর্তুগীজ বণিক এসে হাজির হয়। শেরশাহ বাঙলাদেশে আক্রমণ করবার উপক্রম করছে দেখে সুলতান মামুদ শাহ (১৫৩৩-৩৮) পর্তুগীজদের প্রতি তাঁর মনোভাব পরিবর্তন করেন। তিনি দেশরক্ষার জন্য পর্তুগীজদের সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং তাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে তার পরিবর্তে তিনি পর্তুগীজদের সপ্তগ্রাম ও চট্টগ্রাম এই উভয় জায়গাতেই কুঠি ও দুর্গ নির্মাণ করতে দেবেন। যদিও শেরশাহের সঙ্গে যুদ্ধে সুলতান মামুদ শাহ জয়ী হলেন না, তথাপি তিনি পর্তুগীজদের সাহায্য স্বীকার করে নিলেন। তিনি সপ্তগ্রাম ও চট্টগ্রামে পর্তুগীজদের কুঠি নির্মাণ ও বাঁকশাল (Customs house) স্থাপন করতে দিলেন, কিন্তু দুর্গ নির্মাণ করবার অনুমতি সম্বন্ধে মত পরিবর্তন করলেন। সুলতান মামুদ শাহ পর্তুগীজদের সপ্তগ্রাম ও চট্টগ্রামে শক্তিকেন্দ্র স্থাপন করতে দিলেন দেখে দেশবাসীরা অবাক হয়ে গেল। এইভাবে ১৫৫৭ খ্রিস্টাব্দে থেকে বাঙলাদেশের লোক পর্তুগীজদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠল। বাঙলাদেশের লোকরা তাদের ফিরিঙ্গি (frank শব্দের অপভ্রংশ) বা হারমাদ ( armada শব্দের অপভ্রংশ) বলে অভিহিত করতে লাগল।

ইতিমধ্যে পাঠান মোগলে সংঘর্ষ চলতে লাগল। ১৫৪০ থেকে ১৫৫৩-র মধ্যে খিজুর খান (১৫৪০-১৫৫১), কাজী ফজীলৎ (১৫৪১?) ও মুহম্মদ খান (?-১৫৫৩) প্রমুখ শেরশাহ ও ইসলাম শাহের অধীন শাসনকর্তারা বাঙলাদেশ শাসন করতে লাগলেন। ১৫৫৩ থেকে ১৫৭৬ পর্যন্ত মুহম্মদ শাহী বংশের সুলতানগণ ও তাঁদের সমসাময়িক অন্যান্য শাসকগণ এবং কররানী বংশের শাসকগণ বাঙলার সিংহাসন দখল করে রইল। কররানী বংশের শেষ শাসক দাউদ করবানীকে মুঘল সম্রাট আকবর পরাজিত করেন ও বাঙলা মুঘলগণ কর্তৃক নিযুক্ত সুবেদারদের দ্বারা শাসিত হতে থাকে। কিন্তু প্রথম চল্লিশ বৎসর কোন শৃঙ্খলাবদ্ধ শাসন প্রণালী ছিল না। এই সুযোগে ‘বারভূইঞা’ নামে পরিচিত বাঙলার জমিদারগণ (যথা ঢাকা ও মৈমনসিংহের ঈশা খাঁ, বিক্রমপুরের কেদার রায়, ঈশা খাঁর পুত্রে মূসা খাঁ, বাকলার রামচন্দ্র, যশোহরের প্রতাপাদিত্য, ভাওয়ালের বাহাদুর গাজী, সরাইলের সোনা গাজী, চামোহরের মিরাজ মমিন, খলসীর মধু রায়, চাঁদ প্রতাপের বিনোদ রায়, ফরিদপুর ফতেবাদের মজলিস কুতব, মাতঙ্গার পালওয়ান, ভূষণার শত্রুজিৎ, সুসঙ্গের রাজা রঘুনাথ ও ভুলুয়ার আনন্দমাণিক্য) স্বেচ্ছামত নিজেদের রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু মুঘলগণ এঁদের বিদ্রোহ দমন করে। বলা বাহুল্য, সমসাময়িক বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা পর্তুগীজদের আধিপত্য বিস্তারের সহায়ক হয়ে দাঁড়ায়।

তিন

সপ্তগ্রামেই পর্তুগীজরা বাঙলার সঙ্গে তাদের বাণিজ্যের মূল ঘাটি স্থাপন করল। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে সপ্তগ্রামের ছিল খুব সুনাম। সাতখানা গ্রামের সমষ্টি নিয়ে ‘সপ্তগ্রাম’ নামের উৎপত্তি। এই সাতখানা গ্রাম যথাক্রমে বংশবাটি (বা বাঁশবেড়িয়া), কৃষ্ণপুর, বাসুদেবপুর, নিত্যানন্দপুর, শিবপুর, সম্বোকায়া ও বলদঘাটি। এই সাত গ্রামের বণিকদের মিলনস্থান ছিল সপ্তগ্রাম। সপ্তগ্রাম ছিল সরস্বতী নদীর ওপর অবস্থিত। সরস্বতীই এককালে ভাগীরথীর প্রধান খাত ছিল। সেজন্য সপ্তগ্রাম পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রধান বন্দর ও নগর হিসাবে পরিগণিত হত। উত্তর ভারতের নানাস্থানে থেকে ব্যবসায়ীরা সপ্তগ্রামের হাটে মাল কেনাবেচা করতে আসত। পর্তুগীজরা যে সময় সপ্তগ্রামে আসে, তার অব্যবহিত পরেই শেরশাহ সপ্তগ্রাম থেকে দিল্লী পর্যন্ত এক প্রশস্ত রাজপথ তৈরি করে দিয়েছিলেন। (এটাই পরবর্তীকালের গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড।) এর ফলে, উত্তর ভারতের ব্যবসায়ীদের সপ্তগ্রামের হাটে আসার পথ আরও সুগম হয়ে দাঁড়ায়। তার ফলে, পর্তুগীজদের সঙ্গে বাণিজ্য করবার জন্য সপ্তগ্রামের বাজারে আরও অনেক ব্যাপারীর সমাগম হয়। সমসাময়িক সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে, সপ্তগ্রামের বাজার সব সময়েই অগণিত জনগণের কলরবে মুখরিত থাকত।

পর্তুগীজরা সপ্তগ্রামে আসবার পর তাদের সঙ্গে ব্যবসা করবার জন্য আরও এগিয়ে এসেছিল বাঙালী বণিকের দল। এর ফলে, উভয় পক্ষই রাতারাতি বড়লোক হয়ে গেল। সপ্তগ্রাসের বণিকদের ধনাঢ্যতর পরিচয় পাওয়া যায় সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে’। চৈতন্যচরিতামৃত’ – মধ্যলীলায় লিখিত আছে—”হিরণ্য গোবর্ধন নামে দুই সহোদর। সপ্তগ্রামে বারো লক্ষ মুদ্রার ঈশ্বর।” সপ্তগ্রামের আরও দুই বণিকের নাম আমরা সমসাময়িক মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে পাই। এরা হচ্ছে শ্রীধর হাজরা ও রাম দাঁ। অন্যান্য স্থানের যে সকল বণিকের নাম আমরা মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে পাই, তারা হচ্ছে— বর্ধমানের ধুস দত্ত, চম্পাইনগরের চাঁদ-সদাগর ও লক্ষ্মী সদাগর, কর্জনার নীলাম্বর ও তার সাত সহোদর, গণেশপুরের সনাতন চন্দ্র ও তাঁর দুই সহোদর গোপাল ও গোবিন্দ, দশঘরার বাশুলা, সাঁকোরের বিষ্ণুদত্ত ও তাঁর সাত সহোদর, সাকোরের শঙ্খ দত্ত, কয়েতির যাদবেন্দ্র দাস, ঝাড়গ্রামের রঘু দত্ত, তেখরার গোপাল দত্ত, ত্রিবেণীর রাম রায় ও তার দশ সহোদর, লাউগাঁয়ের রাম দত্ত, পাঁচড়ার চণ্ডীদাস খাঁ, বিষ্ণুপুরের ভগবন্ত খাঁ, খণ্ডঘোষের বাসু দত্ত ও গোতনের মধু দত্ত ও তাঁর পাঁচ সহোদর। বলা বাহুল্য যে, এঁরা সকলেই ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। আর পর্তুগীজদের ধনাঢ্যতা সম্বন্ধে হ্যামিলটন লিখে গিয়েছেন যে পর্তুগীজ বণিকরা যে ঘোড়ায় চেপে বাঙলার হাটে-বাজারে ঘুরে বেড়াত, সেই সকল ঘোড়ার লাগাম ছিল সোনার চুমকি বসানো ও এদেশে রেশম দিয়ে তৈরি। আর চাবুক ছিল নানা রঙের মিনে করা রূপার পাতের। আর তাদের পরনে থাকত বহুমূল্য বর্ণাঢ্য পোশাক।

পরবর্তীকালের অন্যান্য ইওরোপীয় বণিকরা দালাল মারফত আগে থাকতে দাদন দিয়ে নমুনা অনুযায়ী মাল সংগ্রহ করত। পর্তুগীজরা কিন্তু তা করত না। তারা বাজার থেকে নগদ দামের সরাসরি মাল কিনে নিত। এজন্য প্রথম প্রথম (১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) তাদের স্থায়িভাবে থাকবার কোন প্রয়োজন হত না। প্রতি বছর তারা নূতন করে আসত, এবং সপ্তগ্রামের কাছাকাছি জায়গায় চালাঘর তৈরি করে বাস করত। তারপর কেনাবেচা শেষ হয়ে গেলে চালাঘরগুলো পুড়িয়ে দিয়ে আবার ফিরে যেত।

চার

পরবর্তী ৪০ বৎসর রাজনৈতিক চঞ্চলতা ও নদীপ্রবাহের পরিবর্তন পর্তুগীজদের বাণিজ্যপ্রসারকে বিব্রত করে তোলে। তার বিশেষ করে মুশকিলে পড়ে সরস্বতী নদীর জল শুকিয়ে যাওয়ার কারণে। ষোড়শ শতাব্দীর গোড়া থেকেই সরস্বতী নদী শুকিয়ে যেতে আরম্ভ করেছিল। ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে দিওগো রিবেলো যখন সপ্তগ্রামে এসে উপস্থিত হয়েছিল, তখনও বড় জাহাজ সপ্তগ্রাম পর্যন্ত এসে হাজির হত। তারপর জল ক্রমশ শুকিয়ে যাওয়ার ফলে পর্তুগীজদের পক্ষে বড় জাহাজ সপ্তগ্রাম পর্যন্ত নিয়ে আসা সম্ভবপর হত না। তখন তারা বড় জাহাজ শিবপুরের (কলকাতার অপর পারে) নিকট বেতোড়ে নোঙর করত ও ছোট নৌকায় সপ্তগ্রাম যেত। সরস্বতীর নাব্যতা যখন একবারে নষ্ট হয়ে গেল, তখন তারা ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে আগরায় গিয়ে সম্রাট আকবরকে বহু উপঢৌকন দিয়ে সন্তুষ্ট করে তার কাছে থেকে সপ্তগ্রামের নিকট হুগলীতে কুঠি নির্মাণ করবার নিমিত্ত একখানা ফারমান সংগ্রহ করে। এরপর তারা হুগলীতে একটা স্থায়ী নগর স্থাপন করবার জন্য আগরায় ক্যাপটেন ট্যাভারেজকে পাঠায়। আকবর তাদের প্রতি সদয় হয়ে অনুমতি দেন যে, তারা হুগলীর নিকট এক স্থায়ী নগর স্থাপন করতে পারবে, এবং সেখানে গীর্জা তৈরি করে খ্রিস্টের সুসমাচার প্রচার করতেও পারবে। হুগলী তখন একটা নগণ্য স্থান ছিল। মাত্র দশ-বারো খানা মেটে বাড়ি ছাড়া, আর কিছুই ছিল না। কিন্তু পর্তুগীজরা সেখানে রীতিমত চিরস্থায়ী উপনিবেশ স্থাপন করে সেটাকে নগরে পরিণত করে। ব্যবসার সুবিধার জন্য সপ্তগ্রামের বণিকরা হুগলীতে উঠে আসে। এইভাবে সম্রাট আকবরের আনুকূল্যে পর্তুগীজরা হুগলীকে বাঙলাদেশের শ্রেষ্ঠ ও সমৃদ্ধিশালী বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত করে। আবদুল হামিদ লাহোরী তাঁর ‘বাদশাহনামা’য় লিখে গিয়েছেন যে, পর্তুগীজরা হুগলীতে এসে সুদৃঢ় ঘরবাড়ি নির্মাণ করে ও সেগুলি তারা কামান ইত্যাদি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করে। নদীর দিক ছাড়া, বাকী তিনদিক তারা পরিখা খনন করে জায়গাটাকে সুরক্ষিত করে। মোট কথা, এখন থেকে পর্তুগীজরা প্রতি বৎসর আর যাওয়া-আসা না করে, বাঙলায় স্থায়ী বসবাস শুরু করে (১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে)।

পাঁচ

অত্যন্ত বিস্ময়কর ক্ষিপ্রতার সঙ্গে পর্তুগীজরা হুগলীতে তাদের শক্তি বিস্তার করে। বহু পর্তুগীজ এসে হুগলীতে বসবাস শুরু করে। এ ছাড়া, পর্তুগীজ পাদরীরা এদেশের বহু লোককে ধর্মান্তরিত করে। পর্তুগীজরা ছাড়া, বহু বাঙালী হিন্দুস্থানী, মুঘল, পারসিয়ান ও আর্মেনিয়ান বণিকরাও এসে হুগলীতে বসবাস শুরু করে। হুগলী একটা জনবহুল নগরে পরিণত হয়। হুগলীর বন্দরে নোঙর করতে আরম্ভ করল চীন, মালাক্কা, মানিলা ও ভারতের বিভিন্ন বন্দরের পণ্যবাহী জাহাজসমূহ। মোট কথা, ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে বাঙলার সমস্ত বাণিজ্য পর্তুগীজদের হাতে গিয়ে পড়ে। এ ছাড়া, লবণ তৈরির একচেটিয়া অধিকারও তারা পায়।

ক্রমশ পর্তুগীজরা তাদের বসতি বাড়াতে লাগল। বহু পতিত জমিতে চাষ করবার অধিকারও তারা পেল। হুগলী থেকে দুশো মাইল অভ্যন্তরস্থ অঞ্চলসমূহ পর্তুগীজদের প্রভাবে এসে পড়ল। এ ছাড়া, ভাগীরথীর উভয় তীরে, তারা আরও জমিজমা কিনল। ক্রমশ তারা এমন শক্তিশালী হয়ে পড়ল যে, এই সকল জমিজমা থেকে তারা নিজেরাই রাজস্ব আদায় করতে লাগল, এবং মুঘলদের অধীনতার নিদর্শন স্বরূপ যে নামমাত্র কর তাদের মুঘল-রাজকোষে দেবার কথা ছিল, তাও দিতে অস্বীকার করল। এক কথায়, তারা আর মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করল না। হুগলীতে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবেই শাসন আরম্ভ করল। এমনকি পর্তুগীজ কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে মুঘলরা পর্তুগীজদের নগরের মধ্যে প্রবেশ করতেও পারত না। বন্দরে জাহাজ প্রবেশ সম্বন্ধে পর্তুগীজরা যে সকল নিয়ন্ত্রণ বিধি প্রবর্তন করেছিল, সেগুলো মুঘলদের জাহাজের ওপরও প্রয়োগ করল। তাদের জোর-জুলুম, অত্যাচার, শোষণ, বলপূর্বক ছেলেমেয়েদের ধরে ধর্মান্তরিতকরণ ও নারীধর্ষণ বঙ্গবাসীকে সন্ত্রস্ত করে তুলল।

ছয়

এদিকে পূর্ববাঙলার লোকরাও পর্তুগীজদের নামে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। পাঠান রাজত্বের দুর্বলতার সময় পূর্ববঙ্গের নানাস্থানে অনেক জমিদার স্বাধীন রাজার ন্যায় রাজত্ব করতে আরম্ভ করেছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘলরা যখন পূর্ববঙ্গ জয় করে, মুঘলদের তখন এঁদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল। এঁদের ‘বারভূঞা’ বলা হত। এঁরা পর্তুগীজদের বরকন্দাজ হিসাবে রাখতেন। পর্তুগীজরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, বিশেষ করে আরাকানের রাজার সঙ্গে যুদ্ধের সময়। ঢাকা থেকে শ্রীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল পর্তুগীজ দ্বারা ছেয়ে গিয়েছিল এবং যখন স্থানীয় লোকরা পর্তুগীজদের ওপর রুষ্ট হল, তখন সম্রাট আকবর আদেশ পাঠিয়ে দিলেন যে, পর্তুগীজদের ওপর যেন কোন রকম হামলা করা না হয়। পর্তুগীজরা ঢাকায় গীর্জা স্থাপন করে এবং স্থানীয় লোকদের ধর্মান্তরিত করে।

ঢাকার নবাবের সঙ্গে মিত্রতাই পর্তুগীজদের পূর্ব বাঙলায় অগ্রগতির কারণ। শায়েস্তা খাঁর আমলে তারা বিশেষ অনুগ্রহ লাভ করে, এবং ইছামতী নদীর তীরে প্রায় ১৩ মাইল বিস্তৃত এলাকায় ফিরিঙ্গি বাজার স্থাপন করে। এ ছাড়া, ঢাকা, বাখরগঞ্জ ও নোয়াখালি জেলায় পর্তুগীজরা আরও বসতি স্থাপন করে। এগুলি ক্রীশ্চান অঞ্চলে পরিণত হয়। যেসব জায়গায় পর্তুগীজরা তাদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, তার অন্তর্ভুক্ত ছিল শ্রীপুর, চান্দেকান, বাকলা, কাট্রাকো, লরিকুল ও ভুলুয়া।

পশ্চিমবঙ্গেও তারা তমলুক, হিজলি, পিপলি ও বালেশ্বর পর্যন্ত বসতি স্থাপন করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছিল ও বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার পেয়েছিল। বলা বাহুল্য, এসব জায়গায় তারা গীর্জা স্থাপন করে বহু স্থানীয় লোককে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছিল।

কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যাহ্ন থেকে আরম্ভ হয় পর্তুগীজদের অবনতি। বাঙলাদেশ থেকে মাল কিনে, বিদেশের হাটে দশবিশ গুণ চড়া দামে বেচে তারা অতি ধনী হয়ে পড়েছিল। ধনী সমাজের যে সকল গুণাগুণ দেখতে পাওয়া যায়, তা তাদের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিল। বাঙলায় তারা বিলাসিতা ও লাম্পট্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এর ফলে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং শীঘ্রই আগন্তুক ওলন্দাজ ও ইংরেজদের কাছে তারা বাণিজ্যে পরাহত হয়ে যায়।

সাত

পর্তুগীজ আধিপত্যের প্রভাবে বাঙালী সমাজ বিশেষভাবে বিপর্যস্ত হয়ে উঠে- ছিল। অবশ্য বাঙালী সমাজের বিপর্যয় অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল হিন্দু রাজত্বের অবসানের পর থেকে। আগেই বলেছি ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খিলজি কর্তৃক বাঙলা বিজিত হবার পর, মুসলমান পীর, দরবেশ ও মোল্লা কর্তৃক বাঙলার ধর্মান্তরিতকরণের এক অভিযান চলেছিল।

হিন্দুসমাজ যখন এই বিপর্যের সম্মুখীন হয়েছিল, তখন আবির্ভূত হন দুই মহাপুরুষ—স্মার্ত রঘুনন্দন ও শ্রীচৈতন্য। আগের আধ্যায়েই বলেছি মুসলমানগণ কর্তৃক অপহৃতা নারীকে অল্প প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা হিন্দুসমাজে আবার গ্রহণ করবার বিধান দেন রঘুনন্দন। হিন্দুসমাজে কিন্তু সাম্যনীতির অভাব ও জাতিভেদ প্রথা রয়ে যায়। এটা দূর করবার প্রয়াসী হয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য।

১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের তিরোভাব হয়। বাঙলায় তখন চলেছিল এক রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা (আগে দেখুন)। ঠিক সেই সময় পর্তুগীজরা বাঙলাদেশে এসে উপস্থিত হয়। প্রায় একশ বছর ধরে বাঙলার বুকে চলে পর্তুগীজদের শোষণলীলা, অত্যাচার, ধর্মান্তরিতকরণ, লাম্পট্য, নারীধর্ষণ ও দস্যুতা। পর্তুগীজদের নামে সাধারণ বাঙালী সন্ত্রস্ত হয়—শুধু ধনবান ও ঐশ্বর্যশালী হয় বাঙালী বণিকের দল। সম্রাট আকবর যখন (১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ) পর্তুগীজদের হুগলীতে একটা স্থায়ী নগর স্থাপন, গীজা নির্মাণ ও খ্রিস্টের সুসমাচার প্রচার করবার অনুমতি দেন, তখন তিনি নির্দেশ দেন যে, তার পরিবর্তে পর্তুগীজরা বাঙলাদেশকে লুণ্ঠন ও বর্বরোচিত অত্যাচারের হাত থেকে মুক্ত করবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সাধারণ লোকদের ওপর পর্তুগীজদের অত্যাচার, জুলুম ও নিগ্রহ কমেনি। পর্তুগীজ দস্যুরা প্রায়ই বাঙলার উপকূলস্থ গ্রামগুলির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, গ্রামবাসীদের যথাসর্বস্ব লুঠ করত, এবং মেয়েদের ধর্ষণ করে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিত। স্ত্রীপুরুষ ছেলে-মেয়ে সকলকে বন্দি করে বলপূর্বক নৌকায় তুলে নিয়ে চালান দিত দূরদূরান্তরের দাসদাসীর হাটে বেচবার জন্য। দু’শ বছর পর উইলসন সাহেব গঙ্গার মোহনায় সুন্দর সুন্দর দ্বীপ দেখে অনুমান করেছিলেন যে, এগুলি একসময় সমৃদ্ধিশালী ও জনবহুল গ্রাম ছিল। তিনি বলেছিলেন যে, পর্তুগীজ দস্যুদের অত্যাচারের ফলেই সেগুলো তাঁর সময় পরিত্যাক্ত ও শূন্য অবস্থায় ছিল।

মেয়েদের ধর্ষণ করা ও জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করা বা রক্ষিতা হিসাবে রাখা পর্তুগীজদের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এমন কি তার সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে এক ফারমানও সংগ্রহ করেছিল, যার বলে তার বাঙালী মেয়েদের রক্ষিতা হিসাবে রাখবার অধিকার পেয়েছিল। বাঙালী মেয়েদের কমনীয়তা ও কৌতূকরসবোধই তাদের প্রতি পর্তুগীজদের আকৃষ্ট করেছিল। বোধহয় অনেক ক্ষেত্রে পর্তুগীজদের প্রতি বাঙালী মেয়েদেরও অনুরাগ ছিল। এই অনুরাগ অত্যন্ত সজীবতার সঙ্গে চিত্রিত হয়ে রয়েছে কাঁচরাপাড়ার এক মন্দিরে পোড়ামাটির এক মৃৎফলকে। এই সকল বাঙালী মেয়েদের সঙ্গে পর্তুগীজদের যৌনমিলনের ফসলই হচ্ছে ফিরিঙ্গি বা দো-আঁশলা জাতি।

নৃতত্ত্বের ছাত্র হিসাবে এখানে একটা কথা বলতে চাই। হুগলী জেলায় বহুলোকের চোখের রঙ নীল দেখা যায়। এদের ধমনীতে যে পর্তুগীজ রক্ত আছে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে (১৬২৮-৫৬ খ্রি.) বার্নিয়ার এদেশের এসেছিলেন। তিনি বলে গিয়েছেন হুগলীতে তখন আট-নয় হাজার পর্তুগীজ বাস করত। সমগ্র বাঙলাদেশে পর্তুগীজদের সংখ্যা ছিল পঁচিশ হাজার এদের প্রত্যেকেরই বহু ধর্মান্তরিত দাসদাসী ছিল। এদের জীবনযাত্রা- প্রণালী। অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও বিলাসময় ছিল।

হুগলী ও চব্বিশ পরগনা জেলার বহু কৃষিভূমি পর্তুগীজদের অধিকারভুক্ত হয়েছিল। এই সকল কৃষিভূমিতে তারা বিদেশীয় ফসলের চাষ করত; এই সকল বিদেশী ফসলের মধ্যে ছিল, আলু, তামাক, বজরা, সাগু, কাজুবাদাম, আনারস, আতা, আমড়া, পেঁপে, পেয়ারা ও লেবু। গোড়ার দিকে নিষ্ঠাবান হিন্দু সমাজ এগুলো গ্রহণ করেনি, কিন্তু পরে এগুলো বাঙালির নিত্য খাদ্যে পরিণত হয়েছিল। তা ছাড়া তামাক খাওয়ার প্রথাও বাঙালীর পর্তুগীজদের কাছ থেকেই গ্রহণ করেছিল। জরদা, সুরতি, নস্য, গুণ্ডি ইত্যাদি তামাকেরই সহোদর ভাই। পর্তুগীজগণ কর্তৃক আনীত তামাক থেকেই এগুলো উদ্ভূত।

কৃষি, বাণিজ্য ও যৌনমিলন যে বাঙালী সমাজকে বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত করেছিল, তা বাংলাভাষার অন্তর্ভুক্ত পর্তুগীজ শব্দসমূহ থেকে প্রকাশ পায়। যে সকল পর্তুগীজ শব্দ বাঙলা ভাষায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে সেগুলো হচ্ছে আচার, আয়া, আলমিরা, আমড়া, আনারস, আরক, বালতি, ভাঙ, বাট্টা, বৃঞ্জল, বুটিক, কাজু, কামরা, কামিজ, চা, চাবি, কোকো, গুদাম, গীর্জা, ঝিলমিলি, লঙ্কর, নিলাম, মিস্ত্রি, পাদ্রি, পালকি, পমফ্রেট, পেঁপে, পিওন, রসিদ, সাগু, বারাণ্ডা, কাবার, আলকাতরা, আতা, বাসন, ভাপ, বজরা, বিসকুট, বয়া বোতাম, বোতল, কেদারা, কাফি, কাফ্রি, কাতাতুয়া, কামান, ছাপ, কৌচ, কম্পাস, খ্রিস্টান, ইসপাত, ইস্ত্রি, ফিতা, ফর্মা, গারদ, জোলাপ, জানালা, লানটার্ন, লেবু, মাস্তুল, মেজ, পেয়ারা পিপা, পিরিচ, পিস্তল, পেরেক, রেস্ত, সাবান, তামাক, টোকা, তুফান, তোয়ালে, বরগা, বেহালা ইত্যাদি। বলাবাহুল্য এসব জিনিসের ব্যবহার পর্তুগীজদের প্রভাবেই বাঙালী সমাজে প্রবেশ করেছে।

আট

পর্তুগীজদের পতনের ইতিহাসটা বলা দরকার। যতদিন সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি.) ও তাঁর পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৮ খ্রি.) বেঁচে ছিলেন, ততদিন পর্তুগীজরা মুঘল দরবারে অনুগ্রহে পুষ্ট হয়েছিল। কিন্তু জাহাঙ্গীরের পুত্র শাহজাহানের (১৬২৮-১৬৬৮ খ্রি.) সঙ্গে পর্তুগীজদের বিরোধ ঘটে। শাহজাহান যখন পিতার বিরুদ্ধে বিদ্ৰোহ করেছিলেন তখন তিনি পর্তুগীজদের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। পর্তুগীজরা তা দিতে অস্বীকার করেছিল। সেজন্য পর্তুগীজদের ওপর শাহজাহানের পুরানো রাগ ছিল। সিংহাসনের অধিষ্ঠিত হয়ে, তিনি তাঁর বন্ধু কাসিম খানকে বাঙলায় শাসনকর্তা। নিযুক্ত করে, হুগলী থেকে পর্তুগীজদের বিতাড়িত করবার ছুতা অন্বেষণের জন্য নজর রাখতে বলেন। ছুতা পেতে দেরি হল না, তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে বিভিন্ন রকমের বিবরণ পাওয়া যায়। এই বিবরণ অনুযায়ী একজন পর্তুগীজ কাপ্তেন চট্টগ্রাম থেকে এক সুন্দরী মুঘল যুবতীকে অপহরণ করেছিল। অপর কাহিনী অনুযায়ী তারা সম্রাজ্ঞী মমতাজমহলের দুই বাঁদীকে অপহরণ করেছিল এবং সেই ছুতা অবলম্বন করে মুঘলরা হুগলীতে পর্তুগীজদের অধিকৃত অঞ্চল আক্রমণ করেছিল। অপর এক কাহিনী অনুযায়ী কাসিম খান সম্রাট শাহজাহানকে লিখে পাঠিয়েছিলেন যে, হুগলীতে পর্তুগীজরা বাঙলা দখল করবার জন্য সুসজ্জিত হচ্ছে এবং শুধু যে এ দেশবাসীর ওপর নানারকম জুলুম নির্যাতন করছে তা নয়, তারা বাঙলাদেশের ছেলেমেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে বিদেশে হাটে দাসদাসী হিসাবে বিক্রি করেছে। এ ছাড়া, তাদের বসতির সামনে দিয়ে যত, জাহাজ ও নৌকা যায়, তাদের কাছ থেকে জোর করে শুল্ক আদায় করছে।’ যাই হোক, ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তারা বাদশাহী মহলের ওপর হামলা করে। শীঘ্রই তারা মুঘলদের কাছে পরাজিত হয়। ১,৫৬০ জন পর্তুগীজ যুদ্ধে নিহত হয়, ও ৩,০০০ পর্তুগীজ পালিয়ে গিয়ে সাগরদ্বীপে আশ্রয় নেন। বহু পর্তুগীর্জকে বন্দি করে আগরায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে পুরুষদের দাস করা হয়, আর মেয়েদের উপভোগের জন্য হয় বাদশাহী হারেমে, আর তা নয়তো ওমরাহদের হারামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

কিন্তু পর্তুগীজরা শীঘ্রই আবার সম্রাট শাহজাহানের অনুগ্রহ লাভ করে এবং ১৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ৭৭৭ বিঘা নিষ্কর জমি পায়। ওই জমি পেয়েই তারা ব্যাণ্ডেলে এক নূতন নগর প্রতিষ্ঠা করে, এবং সেখানে একটি গির্জা নির্মাণ করে। এছাড়া, তারা বিনা শুল্কে বাণিজ্য করবার অধিকার পায়। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার এই যে, তারা যে ফারমান লাভ করে তাতে উল্লিখিত হয় যে, যদি কোন পর্তুগীজ কোন বাঙালী মেয়েকে রক্ষিতা রাখে, তা হলে মুঘল দরবার তাতে হস্তক্ষেপ করবে না। এই সকল অনুগ্রহ লাভের ফলে পর্তুগীজদের অধিকৃত অঞ্চলে ব্যাণ্ডেল-কনভেন্ট গড়ে ওঠে। কিন্তু হুগলী ও চুঁচুড়ায় ইংরেজ ও ওলন্দাজরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ানোর ফলে, তারা আর তাদের পূর্বশক্তি ফিরে পায় না।

নয়

ইংরেজরা যখন কলকাতা শহরে পত্তন করে তখন কলকাতায় বাস করত পর্তুগীজ ও আরমেনিয়ানরা। পর্তুগীজরা তখন চীনাবাজার অঞ্চলে বাস করত। আরমেনিয়ানরা বাস করত আরমেনিয়ান স্টীট অঞ্চলে। পুরুষরা ইংরেজদের অধীনে হয় দোভাষী, আর তা নয়তো কেরানীর কাজ করত। আর মেয়েরা আয়া বা রক্ষিতার পেশা অবলম্বন করেছিল। ব্যাণ্ডেল তখন এই সকল মেয়েছেলে পাঠাবার আড়তে পরিণত হয়েছিল। সেখানে আর কোন পণ্যের ব্যবসা হত না। আরমেনিয়ানদের মধ্যে খোজা সরহাদ ইংরেজদের দূত হিসাবে ঢাকায় নবাবের কাছে প্রেরিত হয়েছিল।

জোব চার্নক যখন প্রথম কলকাতায় এসেছিলেন, তখন কলকাতার জমিদার মজুমদারদের পর্তুগীজ বরকন্দাজ ছিল। ওঁদের অ্যান্টনি নামে এক পর্তুগিজ বরকন্দাজকে জোব চার্নক চাবুক মেরেছিলেন। অপমানিত হয়ে সে কাঁচরাপাড়ার কাছে এক গ্রামে গিয়ে বাস করে। তারই বংশধর অ্যান্টনি এক বিধবা বামুনের মেয়েকে বিয়ে করে কবিওয়ালা হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। জনশ্রুতি যে এই অ্যান্টনিই কলকাতার বৌবাজারে ফিরিঙ্গি-কালীর মন্দির স্থাপন করেন।

১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হুগলী থেকে পর্তুগীজরা বিতাড়িত হবার পরই, তাদের শূন্যস্থান এসে দখল করে ইংরেজরা। ইংরেজরা এদেশে এসেছিল পর্তুগীজদের অনেক পরে, সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। ওলন্দাজরা ঠিক ওই একই সময়ে এদেশে আসে। পরে এসেছিল দিনেমার ও ফরাসীরা। সকলেই এদেশে আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইংরেজরাই জয়ী হয়।

হুগলী ছাড়া, ইংরেজরা কাশিমবাজার ও পাটনাতেও কুঠি স্থাপন করে। যুগটা ছিল ঘুষের যুগ। দিল্লীর বাদশাহকে দেওয়া হত উপঢৌকন, আর বাঙলার নবাবকে ইনাম। এই উপঢৌকন ও ইনাম দিয়ে ইংরেজরা নিজেদের বাণিজ্যের অনেক সুযোগ-সুবিধা করে নেয়। ইনাম পেয়ে পেয়ে নবাবের লোভ বেড়ে যায়। এর ফলে, নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের বিরোধ ঘটে। ইংরেজরা পাটনার কুঠির অধ্যক্ষ জোব চার্নককে কাশিমবাজারে ডেকে পাঠায়। ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে, চার্নকের বিরুদ্ধে দেশীয় ব্যবসাদারগণ কর্তৃক আনীত এক মামলায় হুগলীর কাজী ইংরেজদের বিরুদ্ধে ৪৩,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবার রায় দেন। চার্নক ওই টাকা দিতে অস্বীকার করেন। নবাবের সৈন্য কাশিমবাজার অবরোধ করে। কিন্তু চার্নক কৌশল অবলম্বন করে কাশিমবাজার থেকে পালিয়ে একেবারে হুগলীতে এসে হাজির হন। চার্নক দেখেন যে, ইংরেজকে যদি বাঙলায় কায়েমী ব্যবসা-বাণিজ্য স্থাপন করতে হয়, তা’হলে মাত্র ব্যবসায়ীর তুলাদণ্ড হাতে নিয়ে থাকলে চলবে না। তাদের অসিধারণও করতে হবে।

শীঘ্রই ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের বিরোধ ঘটে। ইংরেজদের নৌবহর ও সৈন্য-সামন্ত হুগলীতে এসে হাজির হয়। ইংরেজরা নবাবকে পরাজিত করে হুগলী তছনছ করে দেয়। কিন্তু হুগলীতে থাকা ইংরেজরা আর নিরাপদ মনে করে না। সেজন্য চার্নক বেরুলেন ইংরেজদের এক শক্তিকেন্দ্র স্থাপনের জন্য জমির সন্ধানে। ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে চার্নক সুতানটি গ্রামে এসে উপস্থিত হন। এটাকেই তিনি ইংরেজদের শক্তিকেন্দ্র স্থাপনের উপযুক্ত স্থান বলে মনে করেন। এরপর হিজলীতে মুঘলদের সঙ্গে ইংরেজদের লড়াই হয়। চার্নক সেখানে যান। লড়াইয়ের শেষে চার্নক সুতানটিতে আবার ফিরে আসেন। তারপর মাদ্রাজে যান। কিন্তু ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ আগস্ট তারিখে আবার সুতানটিতে ফিরে আসেন এবং এখানেই ইংরেজদের শক্তিকেন্দ্র স্থাপন করেন।

১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে ইংরেজরা মাত্র ষোল হাজার টাকায় কলিকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর গ্রামের জমিদারী স্বত্ব কিনে নেয়। এখানেই তাদের প্রথম দুর্গ, ফোর্ট-উইলিয়াম নির্মাণ করে। এইভাবে ইংরেজ শাসনকালের ভাবী রাজধানী কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠিত হয়। (কলকাতা শহরের ইতিহাসের জন্য লেখকের “কলকাতার এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস, “৩০০ বছরের কলকাতা” ও “কলকাতার চালচিত্র” দেখুন)।

তারপর ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ২২ জুন তারিখে ইংরেজরা ভাগীরথীর তীরে পলাশীর মাঠে নবাব সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করে। কিছুদিন পরে (১৭৬৫) সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকা কর দানের বিনিময়ে তারা বাঙলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানী পদও আদায় করে নেয়। এতে বাঙলায় দ্বৈতশাসনের উদ্বোধন হয়। তারপর চলে ইংরেজদের শাসন ও শোষণলীলা। কোম্পানীর বিলাতের লোকেরা মোটা অঙ্কের মুনাফা পেলেই সন্তুষ্ট থাকত। আর এদিকে কোম্পানীর কর্মচারীরা অসৎ উপায়ে হাজার হাজার টাকা উপায় করত। টাকা উপায়ের জন্য তারা চালাতে লাগল এদেশের লোকের ওপর অত্যাচার ও প্রতিহিংসা। একবার তাদের কোপে পড়লে কারুরই রেহাই ছিল না। বিচার বলে কোন বস্তুতই ছিল না। নির্দোষ নন্দকুমারের ফাঁসিই তার প্রমাণ। (লেখকের “আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালী” দেখুন)।

দশ

দেওয়ানী পাবার পর ইংরেজরা বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে বাঙলার শিল্পসমূহকে ধ্বংস করে এ দেশকে কাঁচামালের আড়তে পরিণত করতে। দেওয়ানী পাবার মাত্র চার বছর পরে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ তারিখে কোম্পানির বিলাতে অবস্থিত ডিরেকটররা এখানকার কাউনসিলকে আদেশ দেয়—’বাঙলার রেশম-বয়ন শিল্পকে নিরুৎসাহ করে মাত্র রেশম তৈরির ব্যবসায়কে উৎসাহিত করা হোক।’ শীঘ্রই অনুরূপ নীতি তুলাজাত বস্ত্র ও অন্যান্য শিল্প সম্বন্ধেও প্রয়োগ করা হয়। ইংরেজ এখান থেকে কাঁচামাল কিনে বিলাতে পাঠাতে লাগে। আর সেই কাঁচামাল থেকে প্রস্তুত দ্রব্য বাঙলায় এনে বেচতে লাগে। বাঙলা ক্রমশ গরীব হয়ে পড়ে।

কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ায় বাঙলার জনগণের জীবন দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়ায়। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও বন্যা তো এখানে লেগেই আছে, সুতরাং যে বৎসর ভালো শস্য উৎপাদন হত না, সে বৎসর লোককে হয় অনশন, আর তা নয় তো দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হতে হত।

সেদিন ইংরেজ একদিকে যেমন বাঙলার গ্রামগুলিকে হীন ও দীন করে তুলেছিল অপরদিকে তেমনই নগরে এবং তার আশেপাশে গড়ে তুলেছিল এক নূতন সমাজ। সে সমাজের অঙ্গ ছিল দেওয়ান, বেনিয়ান, ব্যবসাদার, ঠিকাদার, দালাল, মহাজন, দোকানদার, মুনসী, কেরানী প্রভৃতি শ্রেণি। বস্তুত অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে বাঙলার সমাজজীবনে এক বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। শহরে গড়ে ওঠে এক নতুন সমাজ, যার নাম হয় মধ্যবিত্ত সমাজ। কলকাতা শহরই এই সমাজের কেন্দ্ৰমণি হয়ে দাঁড়ায়। শহরটা এই রূপান্তরিত সমাজেরই যাদুঘরে পরিণত হয়। এই সমাজের শীর্ষে আবির্ভূত হয় মুষ্টিমেয় ধনী, যাদের ‘বাবু সমাজ’ বলা হত, যারা রাত্রে নিজ গৃহে থাকাটা মর্যাদার হানিকর মনে করত ও রাত্রিটা বারবনিতার ঘরে কাটাত, আর নীচের দিকে ছিল সাধারণ লোক- সাহেবরা যাদের বলত “ভদ্দর লোক”। এই সমাজের শীর্ষে বিলাসিতা ও জাঁকজমকে মত্ত হয়ে থাকলে ধনীরা, আর সাধারণ লোক মুদ্রাযন্ত্রের প্রসার ও শিক্ষা- বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শহরে এক শিক্ষিত শ্রেণি হয়ে দাঁড়াল। এই শিক্ষিত শ্রেণিই প্রতিবাদ জানাল সামাজিক, বিকৃতি, ধর্মীয় কুসংস্কার ও অন্ধ মূঢ়তার বিরুদ্ধে। সহমরণ বন্ধ হয়ে গেল (১৮২৯), বিধবাবিবাহ পেল আইনের স্বীকৃতি (১৮৫৬), সাগরমেলায় শিশুবলি দেওয়া রুদ্ধ হয়ে গেল (১৮৩০), দাসদাসীর হাট উঠে গেল (১৮৪৩) ও নানারূপ সামাজিক সংস্কার ও উন্নতি সাধনের ফলে সমাজ মুক্ত হল নানারূপ অপপ্রথা ও কুসংস্কারের নাগপাশ থেকে। সামাজিক রীতিনীতি সম্বন্ধে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণসমাজের ‘পাতি’ দেওয়ার অধিকার বন্ধ হয়ে গেল, এবং ‘পাতি’ দেওয়া বিধানসভার একচেটিয়া অধিকারে দাঁড়াল। নানান জাতের লোক বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হল, এবং নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণসমাজকে তা মাথা পেতে স্বীকার করে নিতে হল। মোটকথা, ইংরেজ আমলে বাঙালী সমাজ আদ্যোপান্ত রূপান্তরিত হল। এটা ঘটল বাঙালী সমাজে ইংরেজি শিক্ষার প্রসার ও এক যুক্তিনিষ্ঠ চিন্তাধারার উদ্ভবের ফলে।

এগার

ইতিমধ্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটে গেল কলকাতার চেহারায় ইংরেজ উঠে পড়ে লাগর একে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় মহানগরীতে পরিণত করতে। ১৮২০-৪০ সময়কালের মধ্যে লটারী কমিটির উদ্যোগে এক রূপ খানিকটা পালটে গেল। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটল ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ‘ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট অ্যাক্ট’ পাশ হবার পর। তারপর এর চেহারা একেবারে পালটে গেল স্বাধীনতা উত্তর যুগে CMDA-এর কর্মকাণ্ডে। কতলাকাতা মহানগরীতে পরিণত হবার পর হুড়হুড় করে এখানে আসতে লাগল অন্য রাজ্য থেকে অগণিত অবাঙালীর দল। তারাই আজ কলকাতার মালিক এবং তারাই বিপর্যস্ত করেছে বাঙলার জনজীবনকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *