চৈতন্য ও তাঁর ধর্ম
শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব ঘটেছিল মধ্যযুগের বাঙলার ইতিহাসের এক অতি সঙ্কটময়কালে। তিনশো বছর মুসলমান অধিকার ও শাসনের অত্যাচারে হিন্দুরা তখন প্রপীড়িত। বলপূর্বক হিন্দুকে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। হিন্দুর দেবদেউল ভাঙা হচ্ছে। হিন্দু তার ধর্মকৃত্য করলে তাকে দণ্ড দেওয়া হচ্ছে বা শূলে চাপানো হচ্ছে। হিন্দুরমণীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। তাদের অপহরণ করা হচ্ছে। এটাই ছিল ধর্মান্তরিতকরণের এক সোজা রাস্তা। কেননা, ধর্ষিতা বা অপহৃতা রমণীর হিন্দুসমাজে কোন স্থান ছিল না। ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান সমাজে সে বিবির আসন পেত। হিন্দুসমাজকে এই অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করবার প্রথম চেষ্টা করেছিলেন স্মার্ত রঘুনন্দ (১৬শ শতাব্দী)। তিনি বিধান দেন যে ধর্মান্তরিত, ধর্ষিতা, অপহৃতা বা পদস্খলিতা নারীকে সামান্য প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা পুনরায় হিন্দু সমাজে গ্রহণ করা চলবে। কিন্তু দেশ যখন মুসলমানদের অধিকারে, তখন কোন্ হিন্দু সাহস করবে ধর্মান্তরিতা নারীকে পুনরায় হিন্দুসমাজে স্থান দিয়ে রাজরোষ অর্জন করতে? সুতরাং মুসলমানের অত্যাচার পূর্ণমাত্রাতেই চলছিল। এটা তুঙ্গে উঠেছিল সুলতান হুসেন শাহের (১৪৯৩-১৫১৯) আমলে। এই হুসেন শাহের আমলেই নবদ্বীপে আবির্ভূত হয়েছিলেন, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে এক ফাল্গুনী গ্রহণ পূর্ণিমার দিন মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব। (১৪৮৫-১৫৩৩) হিন্দুর মনে সাহস সঞ্চার করে মুসলমান অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।
চৈতন্যদেবের আবির্ভাব ছিল হিন্দুসমাজের এক বৈপ্লবিক ঘটনা। সাম্যবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত তাঁর ধর্মে জাতিভেদ ছিল না। জাতিভেদ প্রথাই হিন্দুসমাজকে অবক্ষয়ের পথে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। কেননা, জাতিভেদ প্রথাই হিন্দুসমাজের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল এক অবজ্ঞেয়, উপেক্ষিত ও অবহেলিত নিম্নসম্প্রদায়, যা মুসলমানদের সাহায্য করেছিল তাদের সাম্যবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মে এই নিম্নসম্প্রদায়ের হিন্দুদের ধর্মান্তরিতকরণে। তাছাড়া, চৈতন্যদেব প্রচার করেছিলেন যে এক ধর্মের সহিত অপর ধর্মের কোন বিভেদ নেই। চৈতন্য-প্রবর্তিত ধর্মের ফলে ধর্মান্তরিতকরণের স্রোত বিপরীতগামী হয়ে মুসলমানকেও চৈতন্য প্রবর্তিত ধর্মে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছিল।
দুই
চৈতন্যদেবের পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল শ্রীহট্টে। চৈতন্যের পিতা জগন্নাথ মিশ্রই প্রথম নবদ্বীপের গঙ্গীতীরে এসে বাস শুরু করেন। তখন অধ্যাপনা ও বৈষ্ণব শাস্ত্রের চর্চায় অদ্বিতীয় ছিলেন শান্তিপুরের মহাপণ্ডিত অদ্বৈত আচার্য। তিনিই জগন্নাথকে আশ্রয় দেন ও তাঁর অভিভাবক হন। জগন্নাথ বিবাহ করেন নীলাম্বর চক্রবর্তীর মেয়ে শচীদেবীকে। তাঁদের প্রথম সন্তান বিশ্বরূপ সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান। চৈতন্য হচ্ছে দ্বিতীয় সন্তান তাঁর জন্মের পর তাঁর রূপ-লাবণ্য দেখে তাঁকে ডাইনীদের কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা করবার জন্য অদ্বৈত আচার্যের স্ত্রী সীতাদেবী নবজাতকের নাম রাখেন নিমাই অর্থাৎ নিমের মতো তিক্ত। আবার মতান্তরে তিনি নিমগাছের তলায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন বলে তাঁর নাম ছিল নিমাই। পিতা নাম রেখেছিলেন বিশ্বম্ভর। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তাঁর নাম হয়ে ছিল শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। আর অত্যন্ত গৌরবর্ণ ছিলেন বলে লোকে তাঁকে গৌর, গৌরাঙ্গ গৌরহরি, প্রভৃতি নামে অভিহিত করত।
সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে বিশ্বম্ভর হয়ে উঠেছিলেন একজন মহাপণ্ডিত। গঙ্গাদাস পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীতে ব্যাকরণ, অভিধান, কাব্য, অলঙ্কার, প্রভৃতি অধ্যয়ন করে তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হন। মুকুন্দ সঞ্জয়ের চণ্ডীমন্ডপে তিনি এক চতুষ্পাঠী খুলে ‘কলাপ ব্যাকরণ’ পড়াতে শুরু করেন। সেকালের পণ্ডিতদের মধ্যে বিদ্যা বিতরণ করা একটা প্রথা ছিল। সেজন্য বিদ্যা বিতরণ করবার জন্য বিশ্বম্ভর পূর্ববঙ্গে ও শ্রীহট্টে যান।
তিন
ঈশ্বর সাধনায় তাঁর একনিষ্ঠতা প্রকাশ পায় তাঁর পিতার মৃত্যুর পর। পিতা গত হবার পূর্বেই বিশ্বম্ভরের বিবাহ দিয়েছিলেন বল্লভাচার্যের কন্যা লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে। পিতার মৃত্যুর পর তিনি পিতৃকৃত্য করবার জন্য গয়ায় যান। সেখানে তিনি পরম ভাগবত একান্ত ঈশ্বরপ্রেমা মাধবেন্দ্রপুরীর প্রিয় শিষ্য ঈশ্বরপুরীর কাছে দশাক্ষর গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত হন। এই দীক্ষা গ্রহণের পরই তাঁর ভাবান্তর ঘটে। নবদ্বীপে ফিরে এসে তিনি শোনেন যে সর্পদংশনে লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু ঘটেছে। মা শচীদেবী রাজপণ্ডিত সনাতনের সুন্দরী কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে ছেলের আবার বিবাহ দেন। কিন্তু বিশ্বম্ভরের মন তখন ঈশ্বর প্রেমের উন্মাদনায় পরিপূর্ণ। নবদ্বীপে তিনি এক ঈশ্বরপ্রেমী বৈষ্ণবগোষ্ঠী গড়ে তোলেন। এই গোষ্ঠীতে ছিলেন অদ্বৈত, আচার্য, ইসলাম ধর্ম থেকে হিন্দুধর্মে দীক্ষিত হরিদাস, শ্রীবাস, পণ্ডিত ও তাঁর তিন ভাই, সুগায়ক মুকুন্দ দত্ত, মুরারি গুপ্ত সদাশিব পণ্ডিত, শুক্লাম্বর ব্রহ্মচারী প্রমুখ। বিশ্বম্ভর অধ্যাপনা ছাড়লেন। নবদ্বীপের পথে ঘাটে শিষ্যদের নিয়ে তিনি হরি সংকীর্তন করতে লাগলেন। সংকীর্তনের পদ-হরি হরয়ে নমঃ/গোপাল গোবিন্দ রাম শ্রীমধুসূদন।
এই সময় অবধূত নিত্যানন্দ নবদ্বীপে এসে বিশ্বম্ভরের সঙ্গে মিলিত হন। অদ্বৈতও সপরিবারে নবদ্বীপে চলে আসেন। এক অন্তরঙ্গ বৈষ্ণব পরিষৎ গঠিত হয়। ভক্তরা বিশ্বম্ভরকে দেবত্বে অভিষিক্ত করে পূজা করতে থাকে।
নবদ্বীপের আকাশ বাতাস এই নূতন বৈষ্ণব গোষ্ঠীর নাম-সংকীর্তনে মুখরিত হয়ে ওঠে। একদিন দুরাচার মদ্যপ নগর কোতোয়াল জগাই-মাধাই দুই ভাইয়ের হাতে তাঁরা লাঞ্ছিত ও প্রহৃত হন। লাঞ্ছনা ও প্রহার সত্ত্বেও তারা হরিনাম ছাড়ল না দেশে বিস্মিত ও জগাই-মাধাই। তাদের চরিত্র সম্পূর্ণ পালটে গেল। বিশ্বম্ভরের প্রতিষ্ঠা আরও বেড়ে গেল। সন্ধ্যাবেলা নগরে শাঁখ-ঘন্টা বাজিয়ে হরিনাম করতে লাগল। মুসলমানরা সন্ত্রস্ত হয়ে কাজীর কাছে গিয়ে নালিশ করল। কাজী নগরে সংকীর্তন নিষিদ্ধ করে দিলেন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা কেউই মানল না। কাজী ভয়ে পেয়ে নিষেধাজ্ঞা তুলে দিলেন। এ সম্বন্ধে কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ এক বেশ চিত্তাকর্ষক ঘটনার উল্লেখ আছে। চৈতন্য রোষান্বিত হয়ে যখন কাজীর বাড়ি চড়াও হলেন, তখন কাজী চৈতন্যের মাতামহ নীলাম্বর চক্রবর্তীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের দোহাই দিয়ে চৈতন্যের রোষ প্রশমিত করবার চেষ্টা করে। (‘বাঙলায় মুসলমান সমাজ’ অধ্যায় দেখুন। )
চার
এবার এল সন্ন্যাস গ্রহণের পালা। মিষ্ট কথা ও ছলনার দ্বারা মাকে ভুলিয়ে কাটোয়ায় গিয়ে কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস দীক্ষা নেন। তখন তাঁর বয়স চব্বিশ বছর। গুরু কেশব ভারতী তাঁর নূতন নাম দিলেন ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’। চৈতন্য বৃন্দাবনে গিয়ে থাকবার সঙ্কল্প করলেন। কিন্তু মা শচীদেবী ও ভক্তদের ইচ্ছা তিনি নিকটে থাকেন শ্রীক্ষেত্রে। শ্রীক্ষেত্রের পথে তিনি যাত্রা করলেন। শ্রীক্ষেত্রে পৌঁছে জগন্নাথ দেবের মূর্তি দেখে তিনি প্রেমে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। সেটা ফাল্গুন মাস। বৈশাখ মাসে তিনি দক্ষিণ দেশে তীর্থ করতে বেরুলেন। পথে অনেককেই তিনি বৈষ্ণব করলেন। কৃষ্ণনাম প্রবর্তন করলেন। বাসুদেব নামে জনৈক ব্রাহ্মণকে তিনি কুষ্ঠব্যাধি থেকে মুক্ত করলেন। সর্বত্রই তাঁর আগমন বার্তায় হৈ হৈ পড়ে গেল। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এ লিখেছেন—পুর্ববৎ কোন বিপ্ৰ কৈল নিমন্ত্রণ। সেই রাত্রি আঁহা রহি করিলা গমন। প্রভাতে উঠিয়া প্রভু চলিল বা প্রেমাবেশে। দিক বিদিক জ্ঞান নাহি রাত্রি দিবসে ॥ পূর্ববৎ বৈষ্ণব করি সব লোক সনে। গোদাবরী তীরে চলি আইলা কতদিনে n’
তারপর গোদাবরী পার হয়ে রাজমহেন্দ্রীতে উপস্থিত হলেন। ওড়িশায় রাজার প্রাদেশিক প্রতিনিধি পরমবৈষ্ণব রামানন্দ রায়ের সঙ্গে তাঁর দেখা হল। গোদাবরীতে স্নানার্থে এসেছিলেন রামানন্দ রায়। তিনিই যে রামানন্দ রায়, মহাপ্রভু তা জেনেও ‘তথাপি পুছিল তুমি রায় রামানন্দ তিঁহো কহে সেই মুই দাসশূদ্র মন্দ ॥ তবে প্রভু কৈল তারে দৃঢ় আলিঙ্গন। প্রেমাবেশে প্রভু ভৃত্য দোঁহে অচেতন ॥ স্বাভাবিক প্রেম দোঁহার উদয় করিলা। দোঁহে আলিঙ্গিয়া দোহে ভূমিতে পড়িলা ॥’ (চৈতন্যচরিত্রমৃত)। রামানন্দ বললেন—কাঁহা তুমি ঈশ্বর সাক্ষাৎ নারায়ণ। কাঁহা মুঞি রাজসেবী বিষয়ী শূদ্রাধম ॥ মোর স্পর্শে না করিলে ঘৃণা বেদভয়। মোরে দরশন তোমা বেদে নিষেধয় ॥” (চৈতন্যচরিত্রমৃত)।
এই দেখে রামানন্দের সঙ্গে যে হাজার হাজার ব্রাহ্মণ এসেছিলেন, তাদের সকলেরই মন দ্রবীভূত হয়ে গেল এবং তারা পুলকিত হয়ে কৃষ্ণ হরিনাম করতে লাগল। দশদিন রামানন্দের সহিত কৃষ্ণনাম আলাপে যাপন করে মহপ্রভু পুনরায় তার তীর্থযাত্রার পথে অগ্রসর হলেন। এক এক করে তিনি মল্লিকার্জুন তীর্থ, অহোবল, নৃসিংহক্ষেত্র, শ্রীরঙ্গম, ঋষভপৰ্বত, সেতুবন্ধন রামেশ্বর, কেরল দেশের তীর্থসমূহ, মহারাষ্ট্রের কোলাহপুর, পাণ্ডুপুর, নাসিক প্রভৃতি তীর্থ পর্যটন শেষ করে গোদাবরী ধরে পুনরায় পুরীতে ফিরে এলেন। তীর্থপর্যটনের সময় প্রতি তীর্থে তিনি বহু লোককে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। ওড়িশার রাজা প্রতাপরুদ্রও তাঁর ভক্ত হয়েছিলেন। প্রতাপরুদ্র প্রথমে বৌদ্ধধর্মের প্রথমে বৌদ্ধধর্মের পক্ষপাতী ছিলেন। চৈতন্যদেবের সংস্পর্শে এসেই তিনি বৈষ্ণবধর্মের অনুরুক্ত হন। এই ঘটনার পরই ওড়িশা থেকে বৌদ্ধধর্ম তিরোহিত হয়। চৈতন্য সমগ্র ওড়িশা দেশকে নামসংকীর্তনে মাতিয়ে তুলেছিলেন। তারপর দুই রথযাত্রা উৎসব কাটিয়ে চৈতন্য মথুরা-বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে গৌড়ে ফিরে আসেন। ফেরবার পথে তিনি পানহাটি, কুমারহট্ট ফুলিয়ে প্রভৃতি স্থানে নামেন। যখন শান্তিপুর আসেন, শচীদেবী পুত্রকে দেখতে আসেন।
তারপর শ্রীচৈতন্য গৌড়ের নিকট রামকেলী গ্রামে যান। সেখানে রাজমন্ত্রী রূপ ও সনাতন তাঁর পদধূলি নেন। রামকেলী থেকে শান্তিপুরে এসে তিনি অদ্বৈতের বাড়িতে দিন দশেক কাটান। মায়ের কাছ থেকে বৃন্দাবন যাবার অনুমতি নিয়ে তিনি নীলাচলে ফিরে যান। নীলাচলে বর্ষার কয়েক মাস কাটিয়ে তিনি বনপথে ঝাড়খন্ডের ভিতর দিয়ে বৃন্দাবনের উদ্দেশ্য যাত্রা করেন। পথে তিনি হরিনাম প্রচার করতে করতে অগ্রসর হন। ঝাড়খন্ডের বহু আদিবাসী ও যমুনার তীরে এক সম্ভ্রান্ত্র মুসলমান পরিবারকে তিনি বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত করেন। এদিকে রূপ ও সনাতন দুই ভাই সংসার পরিত্যাগ করে প্রয়াগে এসে মহাপ্রভুর সহিত মিলিত হন। ছয় বৎসর তীর্থযাত্রায় কাটিয়ে মহাপ্রভু আবার নীলাচলে ফিরে আসেন। শেষের আঠারো বৎসর তিনি নীলাচলে ছেড়ে আর কোথাও যাননি সেখানেই তিনি অপ্রকট হন।তাঁর অপ্রকট হওয়া সম্বন্ধে সঠিক কিছু জানা নেই, যা আছে তা পরবর্তীকালের চরিতকাব্য জয়ানন্দের ‘চৈতন্য মঙ্গল’-এ, কিন্তু সে বিবরণ প্রশ্নাতীত নয়। ১৪৫৫ শকাব্দে তিনি অপ্রকট হয়েছিলেন। কিংবদন্তী অনুযায়ী তিনি নীলাচলে নীলসমুদ্রে বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন। তবে অপর এক কিংবদন্তী অনুযায়ী তিনি পুরীর মন্দির মধ্যে পাণ্ডাগণ কর্তৃক নিহত হয়েছিলেন।
পাঁচ
চৈতন্যের জীবদ্দশায় তাঁর ধর্ম প্রচারে সহায়ক ছিলেন তাঁর প্রধান সহকারী ও ভক্তবৃন্দ। তাঁদের মধ্যে প্রধান সহকারী ছিলেন নিত্যানন্দ। বীরভূমের একচক্রা নগরীতে তাঁর জন্ম। বিশ বছর বয়সে তিনি চৈতন্যের সঙ্গে মিলিত হন নবদ্বীপে। ‘নিত্যানন্দ অক্রোধ ও পরমানন্দ পুরুষ ছিলেন, জ্ঞানের অপেক্ষা ভক্তির প্রাধান্য স্বীকার করতেন।’ চৈতন্য তাঁকে এবং ভক্ত হরিদাসকে নবদ্বীপবাসিগণের নিকট বৈষ্ণবধর্ম প্রচারার্থ নিযুক্ত করেন। ধর্মপ্রচারার্থ নিত্যানন্দ ব্রজের রাখাল বেশ ধারণ করে ভ্রমণ করতেন। অপর যাঁরা চৈতন্যের বৈষ্ণবধর্ম প্রচারে ব্যাপৃত ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন অদ্বৈতাচার্য, রঘুনাথ দাস, বাসুদেব ঘোষ, নরহরি সরকার, শিবানন্দ সেন, হরি হোড়, গৌরদাস পণ্ডিত, শ্রীবাস পণ্ডিত, পুন্ডরীক বিদ্যানিধি, লোকনাথ গোস্বামী, গদাধর মিশ্র, উদ্ধারণ দত্ত, জগদীশ পণ্ডিত, অভিরাম গোস্বামী, মুরারী গুপ্ত, শ্রীনিবাস চক্রবর্তী, নরোত্তম দত্ত, শ্যামানন্দ মণ্ডল, বীরভদ্র গোস্বামী, জীব গোস্বামী ও অদ্বৈতাচার্যের পুত্র অচ্যুতানন্দ।
ছয়
চৈতন্যের আবির্ভাবের পূর্বে হিন্দুসমাজে তন্ত্রধর্ম বিকৃতি লাভ করে বহু অনাচারমূলক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণসমাজের কঠোরতাও চরম শীর্ষে পৌঁছেছিল। ধর্মে মানুষের প্রতি মানুষের প্রেমপ্রীতির লেশমাত্র ছিল না। পরস্পরের প্রতি প্রেম স্থাপন করাই চৈতন্য প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের মূল ভিত্তি ছিল। এই ধর্মে এক জাতির প্রতি অপর জাতির বিদ্বেষ ও অবিচার এবং এক ধর্মের সঙ্গে অপর ধর্মের বিভেদের কোন স্থানই ছিল না। চৈতন্য বিশ্বাস করতেন যে প্রেম ও ভক্তিমূলক নৃত্যগীতের মাধ্যমে মানুষ এমন এক আনন্দময় স্তরে পৌঁছতে পারে যেখানে যে ভগবানের সাক্ষাৎ উপলব্ধি করতে পারে। কৃষ্ণের আরাধনা দ্বারা মানুষ মায়ার বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে কৃষ্ণপদ লাভ করতে পারে। প্রকৃত বৈষ্ণব জাতিভেদের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে কৃষ্ণের আশ্রয় গ্রহণ করে। মনে হয়, বৌদ্ধদের সহজিয়া ধৰ্ম, চণ্ডীদাস প্রমুখ মধ্যযুগের বৈষ্ণবদের মনকে যা প্রভাবান্বিত করেছিল, তা চৈতন্যের ধর্মপ্রচারে সহায়ক হয়েছিল। চৈতন্য তাঁর ধর্ম-সমাচার জাতি-নির্বিশেষে সর্বমানবের উদ্দেশ্যে প্রচার করেছিলেন এবং জনতার মধ্যে তাঁর ধর্ম বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেছিল। জীবে দয়া, ঈশ্বরের ভক্তি ও সে ভক্তি উদ্দীপনের জন্য নাম-সংকীর্তন—এরই ওপর ছিল চৈতন্য-প্রবর্তিত ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। জনতাকে এ ধর্ম বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল এবং তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অনেক মুসলমানও ছিল। মুসলিম সাহিত্যক্ষেত্রেও চৈতন্য প্রবর্তিত ধর্ম বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। চৈতন্যের প্রবর্তিত ধর্মেই বাঙালীত জাতির প্রথম জাগরণ। বাঙালীর চিন্তাধারাকে চৈতন্যের ধর্মই প্রথম আধুনিকতার দিকে প্রবাহিত করেছিল। যদিও চৈতন্য উত্তরকালে চৈতন্য প্রবর্তিত ধর্ম বিকৃত হয়েছিল সহজযানের পুতি-গন্ধময় প্রণালী দ্বারা এবং বৈষ্ণবী শক্তির উদ্বোধন যা মহাপ্রভুর চরম লক্ষ্য ছিল, তা বিকৃত হয়ে দাঁড়িয়েছিল মাধুর্য আস্বাদনে। সতীন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় মহাশয় বলেছেন, “বৈষ্ণবী শক্তিতত্ত্ব পরিবর্তিত ও বিকৃত হতে হতে ঠেকল এসে মাধুর্য আস্বাদনে, সে মাধুর্যের আধার হল নারী, তাও স্বকীয়া নয়, পরকীয়া।