বাঙালী সংস্কৃতির লৌকিক রূপ

বাঙালী সংস্কৃতির লৌকিক রূপ

বৈদিক সাহিত্য থেকে আমরা জানতে পারি যে, আর্যরা প্রথমে পঞ্চনদের উপত্যকায় এসে বসতি স্থাপন করে। তারপর তারা ক্রমশ পূর্বদিকে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু তাদের এই অগ্রগতি বিদেহ বা মিথিলা পর্যন্ত এসে থেমে যায়। সেখানে তারা প্রতিহত হয়েছিল প্রাচ্যদেশের লোকদের কাছে। প্রাচ্যদেশের লোকদের তারা ঘৃণায় চোখে দেখত ও তাদের ‘ব্রাত্য’ বলে অভিহিত করত। ব্রাত্যদের আচার-ব্যবহার ও পূজা-পদ্ধতি আর্যদের আচার-ব্যবহার ও পূজা-পদ্ধতি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল। তার কারণ, ব্রাত্যরা, তথা বাঙলাদেশের আদিম অধিবাসীগণ, বৈদিক আর্যগণ থেকে ভিন্ন নরগোষ্ঠীর লোক ছিল। বৈদিক আর্যরা ছিল নর্ডিক নরগোষ্ঠীর লোক। আর বাঙলার আদিম অধিবাসীরা ছিল অস্ট্রিকভাষাভাষী প্ৰাক্- দ্রাবিড়, দ্রাবিড়ভাষাভাষী দ্রাবিড়, আর্যভাষাভাষী আলপীয়-দিনারিক নরগোষ্ঠীর লোক। বাংলা ভাষার বহু শব্দই এই সকল নরগোষ্ঠীর শব্দ। (লেখকের ‘বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ ১৯৪২; জিজ্ঞাসা ১৯৭৫, ১৯৭৯ ও ১৯৮৬ ও এই বইয়ের ‘বাংলা ভাষা ও লিপির উৎপত্তি’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।

যদিও মৌর্যযুগ থেকেই বাঙলায় ব্রাহ্মণদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, তা হলেও ব্যাপকভাবে ব্রাহ্মণরা বাঙলায় আসতে শুরু করে গুপ্তযুগে। ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্রবেশের পূর্বে বাঙলাদেশের বাঙলার আদিম অধিবাসীদের ধর্মই অনুসৃত হত। মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস, মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা, বিবিধ ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া ও মন্ত্রাদি, প্রকৃতির সৃজনশক্তিকে মাতৃরূপে পূজা, লিঙ্গ, পূজা, কুমারী পূজা, ‘টটেম’-এর প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা, এবং গ্রাম, নদী, বৃক্ষ, অরণ্য, পর্বত ও ভূমির মধ্যে নিহিত শক্তির পূজা মানুষের ব্যাধি ও দুর্ঘটনা সমূহ দুষ্ট শক্তি বা ভূত-প্রেত দ্বারা সংঘটিত হয় বলে বিশ্বাস ও বিবিধ নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপক অনুশাসন ইত্যাদি নিয়েই বাঙলার আদিম আদিবাসীদের ধর্ম গঠিত ছিল। কালের বিবর্তনে এই সকল বিশ্বাস ও আরাধনা-পদ্ধতি ক্রমশ বৈদিক আর্যগণ কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল, এবং সেগুলি হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিক ধর্মকর্মে পরিণত হয়েছিল। বস্তুতঃ ব্রাহ্ম্যণধর্মের অনেক কিছু পূজা- পার্বণের অনুষ্ঠান, যেমন দুর্গাপূজার সহিত সংশ্লিষ্ট নবপত্রিকার পূজা ও শবরোৎসব, নবান্ন, পৌষপার্বণ, হোলি, ঘেঁটুপূজা, চড়ক, গাজন প্রভৃতি এবং আনুষ্ঠানিক কর্মে চাউল, কলা, কলাগাছ, নারিকেল, সুপারি, পান, সিঁদুর, ঘটা আলপনা, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, গোময় এবং পঞ্চগব্যের ব্যবহার ইত্যাদি সবই আদিম অধিবাসীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছিল। তাদের কাছ থেকে আরও নেওয়া হয়েছিল আটকৌড়ে, শুভচনী পূজা, শিশুর জন্মের পর যষ্ঠী পূজা, বিবাহে গাত্রহরিদ্রা পানখিলি, গুটিখেলা, স্ত্রী- আচার, লাজ বা খই ছড়ানো, দধিমঙ্গল, লক্ষ্মীপূজার লক্ষ্মী ঝাঁপি স্থাপন, অলক্ষ্মীর পূজা ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠান যা বর্তমান কালেও বাঙালী হিন্দু পালন করে থাকে। এসবই প্রাক্-আর্য সংস্কৃতির অবদান। এ ছাড়া নানারূপ গ্রাম্য দেবদেবীর পূজা, ধ্বজা পূজা বৃক্ষের পূজা, বৃষকাষ্ঠ, যাত্রাজাতীয় পর্বাদি যেমন স্নানযাত্রা, রথযাত্রা, ঝুলনযাত্রা, রাসযাত্রা-দোলযাত্রা প্রভৃতি এবং ধর্মঠাকুর, চণ্ডী, মনসা, শীতলা, জাঙ্গুলী, পর্ণশবরী প্রভৃতির পূজা ও অম্বুবাচী, অরন্ধন ইত্যাদি সমস্তই আমাদের প্রাক্-আর্য জাতিসমূহের কাছ থেকে নেওয়া (লেখকেরা “হিস্ট্রি অ্যাণ্ড কালচার অভ্ বেঙ্গল” ১৯৬৩ ও “বাঙলার সামজিক ইতিহাস”, জিজ্ঞাসা, ১৯৭৬ ও ১৯৮২ দ্রষ্টব্য)।

দুই

এই সকল উপাদানের ভিত্তিতেই গঠিত হয়েছিল বাঙলার লৌকিক সংস্কৃতি। দক্ষিণ আমেরিকার প্রাচীন মায়া জাতির ন্যায় বাঙলার সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য ছিল লৌকিক জীবনচর্যার ওপর জ্যোতিষের প্রভাব। সে প্রভাব বাঙালী আজও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সামাজিক জীবনে বিবাহই হচ্ছে সবচেয়ে বড় আনুষ্ঠানিক সংস্কার। বাঙালী পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের সময় কোষ্ঠী ঠিকুজিতে সপ্তম ঘরে মঙ্গল বা কোন পাপগ্রহ বা সপ্তমাধিপতি কোন্ ঘরে আছে, তার বিচার করে। যদি সপ্তম ঘরে কোন পাপগ্রহ থাকে, তবে সে বিবাহ বর্জন করে। তারপর গণের মিল ও অমিলও দেখে। আবার সব মাসেও বাঙালীর বিবাহ হয় না। বারো মাসের মধ্যে মাত্র সাত মাসে বিবাহ হয়। তারপর জ্যৈষ্ঠ মাসে বাঙালী জ্যৈষ্ঠ পুত্রের বিবাহ দেয় না। বিবাহের পর আসে দ্বিরাগমনের ব্যাপার। বাঙালী পঞ্জিকা দেখে দ্বিরাগমনের দিন স্থির করে। শুধু তাই নয়, এ বিষয়ে কালবেলা, বারবেলা, কালরাত্রি ইত্যাদি পরিহার করে। বাঙালী বিবাহিতা মেয়েদের জীবনে আরও অনেক অনুষ্ঠান ছিল, যথা গর্ভধান বা প্ৰথম রজোদর্শন পুংসবন, পঞ্চামৃত, সাধ সীমন্তোয়ন ইত্যাদি। এইসব অনুষ্ঠানের জন্যও পঞ্জিকা দেখে দিন স্থির করা হয়।

উপনয়নের ক্ষেত্রেও, বিবাহের মতো পঞ্জিকার নির্দেশ অনুসৃত হয়। এছাড়া আছে নামকরণ, নিষ্ক্রমণ, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ, কর্ণবেধ, বিদ্যারম্ভ, দীক্ষা ইত্যাদি অনুষ্ঠান। এসবও পঞ্জিকা অনুমোদিত দিনে অনুষ্ঠিত হয়।

বাঙালীর বৈষয়িক ও ধর্মীয় জীবনেও জ্যোতিষের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। গৃহারম্ভ, গৃহপ্রবেশ, নববস্ত্র পরিধান, রত্নধারণ, দেবগৃহারম্ভ, জলাশয়ারম্ভ জলাশয় প্রতিষ্ঠা, দেবতা গঠন, দেবতা প্রতিষ্ঠা, শিব প্রতিষ্ঠা, বৃক্ষ প্রতিষ্ঠা, বিষ্ণু প্রতিষ্ঠা, নৌকাগঠন, নৌকাচালন, নৌকাযাত্রা, ক্রয়বাণিজ্য, বিক্রয়বাণিজ্য বিপণ্যারম্ভ রজোদর্শন, ঔষধকরণ, ঔষধসেবন, গ্রহপূজা, শান্তিস্বস্ত্যয়ন, আরোগ্য স্নান, হলপ্রবাহ, বীজবপন, বৃক্ষাদিরোপণ, ধান্যরোপণ, ধান্যছেদন, ধান্যস্থাপন, ধান্য-নিষ্ক্রমণ, নাট্যারম্ভ, নবান্ন, ঋণদান, ঋণগ্রহণ ইত্যাদি এর অন্তর্ভুক্ত। যদিও আজকাল এ-সকল ব্যাপারে বাঙালী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর দিন-ক্ষণ দেখে না, তথাপি যারা মানে তাদের হিতার্থে পঞ্জিকায় এ-সকল ব্যাপারের প্রশস্ত দিন দেখানো থাকে। এ-সকল দিন যে পঞ্জিকায় দেখানো থাকে, তা থেকে পরিস্কার বুঝিতে পারা যায় যে, একসময় বাঙালীর লৌকিক জীবনে দিন-ক্ষণ দেখেই এ-সকল ব্যাপার অনুষ্ঠিত হত।

বাঙালীর লৌকিক জীবনে জ্যোতিষিক প্রভাবের শেষ এখানেই নয়। খাদ্যাখাদ্য ও উপবাস সম্বন্ধেও বাঙালীকে অনেক জ্যোতিষিক অনুশাসন মানতে হত, এবং এখনও হয়। উপবাস সম্বন্ধে যে বচন অনুসরণ করা হত, তা হচ্ছে—”শোয়া ওঠা পাশ মোড়া। তার অর্ধেক ভীমে ছোড়া ॥ ক্ষ্যাপার চৌদ্দ, ক্ষেপীর আট। এ নিয়েই কাল কাট ॥” তার মানে শয়ন একাদশী (আষাঢ় মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশী), পার্শ্বপরিবর্তন (ভাদ্র বা আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী), ভীম একাদশী (মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী), উত্থান একাদশী (কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের একাদশী), শিবরাত্রি (ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী) দুর্গাষ্টমী (আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী)—এইগুলিই হচ্ছে উপবাসের বিশিষ্ট দিন। প্রসঙ্গত এখানে বলা যেতে পারে এইসব জ্যোতিষিক অনুশাসন বা তথ্যসমূহ, এরূপ ছড়ার আকারেই বাঙালীর লৌকিক সমাজে প্রচলিত ছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ খনা ও ডাকের বচনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যুগে যুগে এগুলোর ভাষা পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু এগুলো এসেছে অতি প্রাচীনকাল থেকে।

বাঙালীর লৌকিক জীবনে খাদ্যাখাদ্য সম্বন্ধে আরও বিধিনিষেধ আছে। অরণ্যষষ্ঠী বা জামাইষষ্ঠীর দিন সন্তানবতী মেয়েরা মাছ খায় না। জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রতি মঙ্গলবার জয়মঙ্গলবার হিসাবে গণ্য হয়। ওদিনও মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ। অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার ইতুপূজার দিন। ওই সকল দিনেও মেয়েরা মাছ খায় না। পশ্চিমবঙ্গে শ্রীপঞ্চমীর দিনও স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে হিন্দুরা মাছ খায় না। দশহরার দিন ফলার আহার করবার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া, কোন কোন দিনে ঠাণ্ডা খাদ্য খাবার নিয়ম আছে। তার মধ্যে পড়ে ভাদ্রমাসের সংক্রান্তিতে অরন্ধন। ওই দিন তপ্ত খাদ্য খাওয়া নিষিদ্ধ। মাত্র পূর্বদিনের রান্না করা জিনিসই খাওয়া চলে। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী ‘শীতল যষ্ঠী’ নামে আখ্যাত। ওই দিনও ঠাণ্ডা খাওয়া হয়। এ ছাড়া, জ্যৈষ্ঠ মাসে লাউ খাওয়া নিষিদ্ধ। মাঘ মাসে মূল খাওয়া নিষিদ্ধ। এগুলির মধ্যে প্রায় সবগুলিই বাঙালী হিন্দু আজ পর্যন্ত পালন করে আসছে। তবে পঞ্জিকায় যে-সকল খাদ্য বা কর্ম বিভিন্ন তিথিতে নিষিদ্ধ বলে চিহ্নিত করা আছে, তার সবগুলি বাঙালী হিন্দু আর মানে না। সে-সকল নিষিদ্ধ দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে প্রতিপদে কুমড়া, দ্বিতীয়ায় ছোট বেগুন, তৃতীয়ায় পটল, চতুর্থীতে মূলা, পঞ্চমীতে বেল, যষ্ঠীতে নিম, সপ্তমীতে তাল, অষ্টমীতে নারিকেল, নবমীতে লাউ, দশমীতে কলমি শাক, একদশীতে শিম, দ্বাদশীতে পুঁই শাক, ত্রয়োদশীতে মাষকলাই। এগুলি থেকে বাঙালীর খাদ্যে তরিতরকারির একটা হদিশ পাওয়া যায়। লক্ষণীয় এর মধ্যে আলু বা কপি নেই। তার কারণ, এগুলো বিদেশী তরিতরকারি, মাত্র দু- তিন শো বছর আগে আমাদের দেশে আমদানি হয়েছে। এ ছাড়া, অষ্টমী, নবমী, চতুর্দশী ও পূর্ণিমা বা অমাবস্যাতে স্ত্রী, তৈল, মৎস্য- মাংসাদি সম্ভোগও নিষিদ্ধ।

তিন

আদিম সমাজসমূহের সংস্কৃতির গঠনে মেয়েদের প্রভাব বেশি পরিমাণে পরিলক্ষিত হয়। বাঙালীর লৌকিক সংস্কৃতিতেও আমরা সেই প্রভাবই লক্ষ্য করি। বাঙালী মেয়েদের জীবন শুরু হত কতকগুলি ব্রতপালন নিয়ে। যেমন, আট বছর বয়স পর্যন্ত কুমারী মেয়েরা বৈশাখ মাসে শিবপূজা ও পূণ্যিপুকুর, কার্তিক মাসে কুলকুলতি, পৌষ মাসে সোদর, মাঘ মাসে মাঘমন্ডল ইত্যাদি ব্রত করত। আর সধবা মেয়েদের তো সারা বছরই ধরেই কোন না কোন ব্রত লেগে থাকত। এ ছাড়া, বৈশাখ মাসে বিধবাদের ছিল কলসী উৎসর্গ ও আষাঢ় মাসে অম্বুবাচী। সীমান্ত অঞ্চলের (বাঁকুড় ও পুরুলিয়া) মেয়েরা পৌষমাসে টুসু ও ভাদ্রমাসে ভাদু ব্রত উৎসব করে। এই ব্রতগুলিই ছিল বাঙলার ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনের স্তম্ভস্বরূপ।

সামাজিক জীবনেও মেয়েদের শাস্ত্রবহির্ভূত কতকগুলি আচার-অনুষ্ঠান আছে। এ বিষয়ে বাঙালী মেয়েরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় বিবাহ সম্পর্কিত স্ত্রী-আচার সমূহের ওপর। (বাঙলা দেশের বিভিন্ন অংশে বিবাহের শাস্ত্রীয় পদ্ধতি এক হলেও, স্ত্রী-আচার সমূহের আঞ্চলিক পার্থক্য দেখা যায়।) এই সকল লৌকিক আচারের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে আইবুড়োভাত, দধি-মঙ্গল, গায়ে হলুদ, কলাতলায় স্নান করানো ও বরণ করা, হাই- আমলা, ছাদনাতলার অনুষ্ঠানসমূহ, গাঁটছড়া বাঁধা, দুধ-আলতা অনুষ্ঠান, কড়ি বা গুটিখেলা, কালরাত্রি পালন করা, ফুলশয্যা ইত্যাদি। এ ছাড়া বিয়ের কয়েকদিন বরের পক্ষে জাঁতি ও মেয়ের পক্ষে কাজললতা বহন করার বিধি আছে। এগুলো সবই প্রাক্-আর্যকালের মেয়েলি লৌকিক সংস্কৃতি। (বাঙালি বিবাহে স্ত্রী-আচার সম্পর্কে বিশদ বিবরণের জন্য আমার ‘ভারতের বিবাহের ইতিহাস’, আনন্দ পাবলিশার্স ও ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর ‘স্ত্রী-আচার,’ বিশ্বভারতী, বই দুটি দ্রষ্টব্য।)

আজকালকার দিনে মেয়েদের বেশি বয়সে বিয়ে হয়। সেজন্য প্রথম রজোদর্শনের উৎসব আর হয় না। কিন্তু আগেকার দিনে যখন মেয়েদের আট-দশ বছর বয়সে বিয়ে হত, তখন মেয়েরা খুব ধুমধাম করে প্রথম রজোদর্শনের উৎসব পালন করত। শুধু তাই নয়, মেয়েটিকে কয়েকদিন ধরে ঘরের নিভৃত কোণে লুকিয়ে থেকে নিয়মনিষ্ঠ আহারাদি ও একটি পোটলার মধ্যে নানরকম ফল ও একটি প্রস্তরখন্ডকে সন্তান কল্পনা করে প্রসবের অভিনয় করতে হত।

আগেকার দিনে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে হত বলে, মেয়েরা কিছুকাল বাপের বাড়িতেই থাকত। তারপর যখন দ্বিতীয়বার স্বামীগৃহে ফিরে আসত, তাকে ‘দ্বিরাগমন’ বলা হত। এটা বিহারের ‘গৌনা’ অনুষ্ঠানের সামিল। এখনও ধূমধাম করে বিহারে এই অনুষ্ঠান পালিত হয়। যদিও শাস্ত্রীয় অনুশাসন অনুযায়ী বারো বছরের পর মেয়ের বিয়ে হলে, দ্বিরাগমনের আর কোন প্রয়োজন নেই, তাহলেও লৌকিক আচার অনুযায়ী এখনও বিয়ের অব্যবহিত পরেই দ্বিরাগমন পালিত হয়। শাস্ত্রীয় অনুশাসনের অভাব সত্ত্বেও দ্বিরাগমন পালন, লৌকিক সংস্কৃতির ওপর ট্র্যাডিশন’ বা পরম্পরার প্রভাব জ্ঞাপন করে। তেমনই যদিও আগেকার দিনে সধবা স্ত্রীলোকগণ কর্তৃক পালিত শাস্ত্রীয় অনেক আচার-অনুষ্ঠান লুপ্ত হয়ে গিয়েছে, তা হলেও লৌকিক অনুষ্ঠানসমূহ এখনও প্রচলিত আছে। প্রচলিত লৌকিক ব্রতগুলি মেয়েরাই পালন করে, পুরুষরা নয়। এ সমস্ত ব্রতে পুরোহিতের প্রয়োজন হয় না। তা থেকে বুঝতে পারা যায় যে, এগুলি বাঙলায় ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুপ্রবেশের পূর্ব হতেই পালিত হয়ে আসছে। পৌষ, চৈত্র ও ভাদ্র মাসে যে লক্ষ্মীপূজা পুরোহিতের সাহায্যে করা হয়, তাকে আগেকরে দিনে (বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত) ‘খন্দ’ পূজা বলা হত। বোধ হয় গ্রামাঞ্চলে এখনও বলা হয়। ‘খন্দ’ শব্দটা খুবই অর্থবাচক শব্দ এবং আদিম ‘খন্দ’ জাতির সঙ্গে এর সম্পর্কের ইঙ্গিত করে কিনা তা বিচার্য; যদিও অভিধানে ‘খন্দ’ শব্দের অর্থ দেওয়া আছে ‘ফসলাদি’। তবে লক্ষ্মীপূজা যে আদিম সমাজ থেকে গৃহীত, তা লক্ষ্মীর বাহন ও ঝাঁপির উপকরণসমূহ থেকে বুঝতে পারা যায়। এ সম্পর্কে আরও লক্ষণীয় যে, আশ্বিন মাসের পূর্ণিমায় কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা, দেওয়ালীর দিনের লক্ষ্মীপূজা, পৌষ, চৈত্র ও ভাদ্র মাসের লক্ষ্মীপূজা পুরোহিতের সাহায্যে করা সত্ত্বেও, মেয়েরা নিজে নিজে প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপূজা করে ও লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ করে। নানা অঞ্চলে নানা নামে মঙ্গলচণ্ডীর পূজা হয়, যথা হরিষ মঙ্গলচণ্ডী, নাটাই মঙ্গলচন্ডী, সঙ্কট মঙ্গলচণ্ডী, ভাওতা মঙ্গলচণ্ডী, ভাদাই মঙ্গলচণ্ডী ইত্যাদি। দেবীভাগবতে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, মঙ্গলচণ্ডী নারীগণ কর্তৃক পূজিতা দেবতা—’যোষিতানাম্, ইষ্টদেবতাম্‌’ এবং চণ্ডী সম্বন্ধে মূর্তিনির্মাণ সম্পর্কিত কতকগুলি গ্রন্থে বলা হয়েছে— ‘গোধাসনে ভবেদ্ গৌরী লীলয়া হংস-বদনা/অলসূত্রম্ তথা পদ্মম্ অভয়ং চ বরং তথা। গোধাসনাশ্রিতা মূর্তি গৃহে পূজ্য স্ত্রীয় সদা’। (আমার ‘বাঙালীর সামাজিক ইতিহাস’, জিজ্ঞাসা, দ্রষ্টব্য।)

ষষ্ঠীর পূজার সঙ্গেও মেয়েদের সম্পর্ক দেখা যায়। সন্তানের মঙ্গল কামনায় ষষ্ঠীদেবী মাতৃজাতির একান্ত আরাধ্য। সন্তানের মঙ্গল কামনায় নানা সময়ে এঁর পূজা করা হয়। সন্তান জন্মের ছয়দিনে সন্ধ্যায় যেঠেরা পূজা করা হয়। একুশ বা ত্রিশ দিনে যষ্ঠীপূজা করার প্রথা প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত। অন্নপ্রাশন প্রভৃতি শুভকাজে, সকল কাজের আগে যষ্ঠীর পূজা করা হয়। তাছাড়া, বছরের বিভিন্ন মাসে নানা নামে ষষ্ঠী ঠাকরুনের পূজা করা হয়। যেমন, বৈশাখ মাসে চন্দনী ষষ্ঠী, জ্যৈষ্ঠ মাসে অরণ্য ষষ্ঠী, আষাঢ় মাসে কাদমী ষষ্ঠী, শ্রাবণ মাসে নোটন ষষ্ঠী, ভাদ্র মাসে চাপড়া ষষ্ঠী, আশ্বিন মাসে দুর্গা ষষ্ঠী, কার্তিক মাসে নাড়ি ষষ্ঠী, অগ্রহায়ণ মাসে মূলা ষষ্ঠী, পৌষ মাসে গুহ ষষ্ঠী, মাঘ মাসে শীতলা ষষ্ঠী, ফাল্গুন মাসে গো ষষ্ঠী ও চৈত্র মাসে অশোক ষষ্ঠী। ষষ্ঠী তিথি ছাড়া অন্য কোন দিনেও ষষ্ঠী পূজার প্রচলন আছে। যেমন অগ্রহায়ণ মাসের শুক্ল প্রতিপদে হরি ষষ্ঠী, চৈত্র মাসে সংক্রান্তির পূর্বদিনে নীল ষষ্ঠী। নদীয়া জেলায় হরি ষষ্ঠীতে কাঁচাঘট পূজা করা হয়। নীল ষষ্ঠীতে মেয়েরা উপবাস করে ও সন্ধ্যায় শিবের পূজা দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করে। মেয়েরা মনে করে যে নীলের দিনেই শিবের বিবাহ হয়েছিল। অনুরূপভাবে তারা শ্রাবণ মাসের যে কোন সোমবারে শিবের উপবাস করে, কেননা শ্রাবণ মাস হচ্ছে শিবের জন্মমাস। অরণ্য ষষ্ঠী যে এক সময় অরণ্যেই পূজিত হতেন, সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এ সম্বন্ধে যে উপাখ্যান আছে, তা থেকেও তাই প্রমাণ হয়। বাঙলায় দুটি জনপ্রিয় লৌকিক উৎসব হচ্ছে জামাই ষষ্ঠী ও ভাইফোঁটা। অরণ্য ষষ্ঠীর দিনই জামাই ষষ্ঠী। ওই দিন জামাইকে নিমন্ত্রণ করে শ্বশুরবাড়ি আনা হয় ও শাশুড়ি ঠাকরুন জামাইকে ‘বাটা’ প্রদান করেন। এ ছাড়া জামাইকে বিশেষ যত্ন করে আপ্যায়ন করা হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসে জামাই যেমন নিমন্ত্রিত হয়ে শ্বশুরবাড়ি আসেন, কার্তিক মাসে তেমনই জামাই নিমন্ত্রিত করে শ্যালক- সম্বন্ধীদের তাঁর বাড়ি নিয়ে যান, ও তাদের আদর-আপ্যায়ন করে খাওয়ান। বোন ওই দিন ভাইদের কপালে ফোঁটা দিয়ে বলে——ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে যেন পড়ে কাঁটা।’ জামাই ষষ্ঠীতের জামাইকে ‘বাটা’ দান ও ভাইফোঁটার দিন কপালে ফোঁটা দেওয়া সব বারে হয় না। কতকগুলো বার (যেমন সোম, শুক্র, শনি ও মঙ্গলবার) বর্জন করা হয়। বলা বাহুল্য, এই দুই অনুষ্ঠানেই পুরোহিতের কোন ভূমিকা নেই। মেয়েরাই এতে অংশ গ্রহণ করে।

অগ্রহায়ণ মাসে প্রতি রবিবারে মেয়েরা যে ইতুপূজা করে, তাও পুরোহিত ব্যতিরেকে মেয়েরাই করে থাকে। এটাও যে আদিম সমাজ থেকে গৃহীত হয়েছে তা ইতুপূজা সম্পর্কে যে উপাখ্যান আছে, তাতে উমনো- ঝুমনো, এই নাম দুটি থেকেই প্রকাশ পায়।

বাঙালি হিন্দু বিধবার পক্ষে অবশ্য পালনীয় একটা ব্রত হচ্ছে অম্বুবাচী। আষাঢ় মাসের সাত তারিখ থেকে তিন দিন অম্বুবাচীর কাল ধরা হয়। ওই তিন দিন কোন বিধবা রন্ধন করেন না ও সদ্য অগ্নিপক্ক কোন খাদ্য গ্রহণ করেন না। অম্বুবাচী মানে বর্ষার সূচনা। নববর্ষাকে অভিনন্দিত করবার জন্য ওই তিন দিন চাষবাসও বন্ধ রাখা হয়। ওই তিনদিন পৃথিবী রজস্বলা হন। এছাড়া, ভাদ্র মাসের চতুর্থীতে নষ্টচন্দ্রের দিন চাঁদ দেখা নিষিদ্ধ। কার্তিক মাসের ‘আকাশ প্রদীপ’ দেওয়া হয়। সমস্ত পালপার্বণের দিন গঙ্গাস্নান করা হয়। চৈত্রমাসে গাজন উৎসব পালন করা হয়।

চার

অরন্ধন ও পৌষপার্বণ এ দুটো ছিল গ্রামবাঙলার আনন্দময় উৎসব! অরন্ধনের দিন মেয়েরা প্রকাশ করত তাদের রন্ধনক্রিয়ার দক্ষতা। এই উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করা হত। নানা পদের খাদ্যসামগ্রী রন্ধন করে তাদের রসনার তৃপ্তি সাধন করা হত। আর পিঠে ছিল বাঙলাদেশের এক গৌরবময় ঐতিহ্যের নিদর্শন। পৌষপার্বণে মেয়েরা প্রদর্শন করত তাদের পিঠে তৈরির শিল্পচাতুর্য। সাধারণত সুগন্ধি আপত চাউলের গুঁড়া, দুধ, ক্ষীর, নারিকেল, ভাল খেজুরের গুড় প্রভৃতি দিয়ে পিঠে তৈরি করা হত। নানা প্রক্রিয়ায় ও বিচিত্র ছাঁদে পিঠে প্রস্তুত করা হত। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সমাজে বিয়ের পর নতুন জামাই যখন প্রথম শ্বশুরবাড়ি আসত, তাকে আপ্যায়িত করা হত নানা রকমের পিঠে দিয়ে। অন্তত চল্লিশ-পঞ্চাশ রকমের পিঠে তৈরি করা হত। ধনী-গরীব সকল ঘরেই এটা প্রচলিত ছিল। রন্ধনক্রিয়া ও পিঠে তৈরির এ নৈপুণ্য মেয়েরা ক্রমশই হারিয়ে ফেলেছে। অথচ বাঙলার এটাই ছিল এক বিশিষ্ট ঐতিহ্য।

পাঁচ

যখন আমরা চিন্তা করি যে, বাঙলা নদীবহুল ও পলিমাটির দেশ, তখন বাঙলার অর্থনীতিতে কৃষির প্রাধান্য আমরা সহজেই বুঝতে পারি। এজন্য বাঙলাদেশের সকল জাতির (ব্রাহ্মণ পর্যন্ত) লোকই কৃষিকর্মে লিপ্ত থাকত। বাঙলার কৃষিজাত ফসলের মধ্যে ধানই শীর্ষস্থান অধিকার করত। বস্তুত ধানের চাষ অস্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত জাতিসমূহের দান। চাউল যে বাঙালী নিজেই খায় (ভাত, মুড়ি, খই, চিড়ে ইত্যদি রূপে) তা নয়, তার দেবতাকে সে নিবেদন করে। চাল-কলা না হলে ঠাকুরের নৈবেদ্যই হয় না। বিহার ও উত্তর ভারতের যবচূর্ণ ব্যবহৃত হয়। নবান্ন, পৌষপার্বণ ইত্যদি বাঙালীর পাল- পার্বণও চালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আবার এই চালের পিটুলি তৈরি করে, তা দিয়ে বাঙালী প্রকাশ করে আলপনা রেখাচিত্রে তার নান্দনিক মননশীলতা।

কদলী ও কলাও অস্ট্রিক যুগ থেকে বাঙালীর প্রিয় খাদ্য। সেজন্য বাঙালী কলা নিবেদন করে তার দেবতাকে। আখের চাষ ও গুড়ের উদ্ভবও বাঙলা দেশেই হয়েছিল। পুন্ড্রবর্ধনে এক বিশেষ জাতের আখ জন্মাত, যার নাম ছিল ‘পৌন্ড্রকে’। এই জাতের আখ এখন ভারতের অন্যত্রও উৎপন্ন হয় এবং তার মৌলিক নাম অনুযায়ী তাকে ‘পৌড়িয়া’, ‘পুড়ি’, ‘পৌড়া’ নামে অভিহিত করা হয়। ‘গৌড়” শব্দটাও ‘গুড়’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। পাণিনি বলেছেন : “গুড়স্য অয়ং দেশ গৌড়।”

এটা সহজেই অনুমেয় যে, কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে কৃষির উপযোগী নানারূপ যন্ত্রাদি তৈরি করা হত। তামাশ্মযুগে এসব যন্ত্রপাতি তামা বা পাথর দিয়ে তৈরি করা হত। পরে এগুলি লৌহনির্মিত হতে থাকে। রাঢ়দেশের অরণ্য অঞ্চলে লৌহ উৎপাদন হত। এ সকল অঞ্চলে বহু লোহার খনি ছিল এবং এই সকল অঞ্চলের লোকরা লৌহ উৎপাদন প্রণালীর সঙ্গে সম্যভাবে পরিচিত ছিল। লৌহনির্মিত অস্ত্র ও লৌহ ঢালাইয়ের জন্য চুল্লি পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে পাওয়া গিয়েছে। বস্তুত বীরভূম ও বর্ধমান জেলায় উনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদ পর্যন্ত দেশজ প্রণালীতে লৌহ উৎপাদন হত ও তা দিয়ে মুঘল ও ইংরেজ আমলে কামান তৈরি করা হত। বিষ্ণুপুরের ‘দলমাদল’ কামান তার নিদর্শন। বস্তুত ধাতু শিল্পে বাঙালীর দক্ষতা ছিল অসমান্য। তার প্রমাণ আমরা পাই ঢোকরাদের ধাতুশিল্পের নিখুঁত নৈপুণ্যে, ও স্বর্ণকারদের সোনা ও রূপার অলঙ্কার নির্মাণে। এ ছাড়া, ধাতুশিল্পীরা তৈরি করত বাসন-কোসন ও গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় অনেক কিছু জিনিস।

বাঙালীর আরও অনেক লৌকিক শিল্প ছিল। তার মধ্যে হচ্ছে কার্পাস ও রেশম জাতীয় বস্ত্রাদি, যা বহন করত বাঙালী মনীষার গৌরবময় ঐহিত্যের স্বাক্ষর। প্রতি ঘরে ঘরে সূতা কাটা হত। মাটির দেশ বাঙলায় মাটি দিয়ে তৈরি করা হত পুতুল, যার মধ্যে প্রকাশ পেত অসামান্য সজীবতা। এই শিল্পেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল বাঙালীর প্রাণের দেবতাগণের প্রতিমা গঠন ও পোড়ামাটির মন্দিরসজ্জা, যাতে রূপায়িত হয়ে আছে নানা পৌরাণিক কাহিনী ও সামাজিক দৃশ্য। পটচিত্রও বাঙলার লৌকিক শিল্পের আর এক অবদান। পটে চিত্রিত করা হত নানারূপ পৌরাণিক কাহিনী, দেবদেবীর মূর্তি, পাপ- পুণ্যের পরিণাম ও নানরূপ বিষয়বস্তু। এর সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট ছিল লক্ষ্মী সরা তৈরি, যা দিয়ে বাঙালী তার শ্রী-সমৃদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীকে পূজা করত। ছউ নাচের মুখোশ ও দশাবতার তাস-ও বাঙালীর লোকসংস্কৃতির আর এক নিদর্শন। বাঙালীর নান্দনিক মননশীলতা আরও প্রকাশ পেত শাঁখের ও হাতির দাঁতের অলঙ্কারে, শোলার কাজে, কাঠখোদাইয়ের কাজে, গালার কাজে, ও আরও কত কি শিল্পে যা তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে সার্থক করে তুলত। মেয়েদের অনুশীলিত আলপনা, কেশবিন্যাস ও নক্‌শী কাঁথা ইত্যাদি বহন করত তাদের সৌন্দর্যবোধের স্বাক্ষর। বস্তুত বাঙালীর লৌকিক শিল্পসমূহ অনুরণিত হত তাদের প্রাণের স্পন্দন ও আনন্দময় জীবনচর্চা। (লেখকের ‘ফোক এলিমেন্টস্, ইন বেঙ্গলী লাইফ’, ১৯৭৫, ইণ্ডিয়ান পাবলিকেশনস দ্রষ্টব্য)।

ছয়

অস্ট্রিক যুগ থেকেই বাঙালীর লৌকিক জীবনে স্থান পেয়েছিল নানারূপ ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া। এখনও বাঙালী যদি দেখে রাস্তার তেমাথায় কেউ রেখে গিয়েছে সরায় করে জবা ফুল ইত্যাদি, তা হলে সে তা অতিক্রম করে না বা তার ত্রিসীমানায় ঘেঁসে না। শনি-মঙ্গলবারে রাত্রিকালে বাঙালী মেয়েরা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় বা ছেলে কোলে করে কখনও নিমগাছ বা বেলগাছের তলা দিয়ে যায় না। তাদের বিশ্বাস অপদেবতার দৃষ্টি লাগবে। গ্রামের লোক এখনও বিশ্বাস করে ‘নিশিডাক’-এ। সেজন্য রাত্রিকালে কেউ কারও নাম ধরে তিনবারের বেশি না ডাকলে কখনও উত্তর দেয় না। বাঙালী বিশ্বাস করে যে, ‘বাদুলে’ (বৃষ্টির দিনে যার জন্ম) ছেলে-মেয়ে বিয়ের দিনে নিশ্চয় বৃষ্টি হবে। তাই পাছে বিয়ের আনন্দ নষ্ট হয়, সেজন্য বৃষ্টি এড়াবার জন্য মেয়েরা হয় বাটনাবাটার শিল উলটে উঠানে স্থাপন করে, আর তা নয় তো কারুর বাড়ির থেকে একটা তৈজসপত্র না বলে নিয়ে এসে লুকিয়ে রাখে। তাদের বিশ্বাস এরূপ করলে আর বৃষ্টি হবে না। বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দুধ তুললে গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা বিশ্বাস করে নজর লেগেছে এবং তার জন্য জলপড়া খাওয়ায়। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের লোকের মনে ভূতপ্রেতের ভয়ও বিলক্ষণ। রাত্রিকালে আলগা জায়গায় কখনও ছেলেদের জামা-কাঁথা ইত্যাদি টাঙিয়ে রাখে না, পাছে অপদেবতার নজর লাগে। তা ছাড়া ‘ভূতে পাওয়া’ ব্যাপারও আছে। ভূতে পেলে ‘রোজা’ ডাকা হয়। ‘রোজা ভূত ছাড়িয়ে দেয়। বাঙলার লৌকিক জীবনে ‘রোজা, ‘গুণিন’ ইত্যাদির ভূমিকা একসময় খুব বেশি ছিল। যাঁরা প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পড়েছেন, তাঁরা জানেন ঠক- চাচা এ বিষয়ে সিদ্ধহস্ত ছিলেন।

সাপে কামড়ালেও ‘রোজা’ ডাকা হয়। ‘রোজার’ ক্ষমতা আছে সাপের বিষ ঝাড়বার। শুনেছি, যে সাপ লোকটাকে কামড়েছে, সেই সাপটা নাকি রোজার সামনে এসে হাজির হয়। এ ছাড়া, কিছু চুরি গেলে বাঙালী বাটি- চালা, চালপড়া, নখদর্পণ ইত্যাদির আশ্রয় নেয়। বাটিচালার বাটি নাকি অপরাধীর কাছে গিয়ে হাজির হয়। চালপড়াতে যে চুরি করেছে তার থুতুর সঙ্গে রক্ত দেখা দেয়। নখদর্পণে কালি লাগানো বুড়া আঙুলের নখের মধ্যে অপরাধীকে দেখা যায়।

এ ছাড়া বাঙালীর লৌকিক জীবনে স্থান পেত, বা এখনও গ্রামাঞ্চলে পায়, বশীকরণ, স্তম্ভন, বিদ্বেষণ, উচ্চাটন, মারণ ইত্যাদিতে বিশ্বাস। এসবের প্রক্রিয়া ও মন্ত্রাদি বিশদরূপে বর্ণনা করা আছে, আমরা “ফোক এলিমেন্টাল্ ইন বেঙ্গলী লাইফ’ বইয়ে (ইণ্ডিয়ান পাবলিকেশনস, ১৯৭৫)। এসব মন্ত্রাদি পর্যালোচনা করলে দেখতে পাওয়া যাবে এগুলো সবই প্রাক্- আর্য কালের।

আর্যপুরোহিতরাও কোন কোন ক্ষেত্রে, আদিম যুগের এসব প্রক্রিয়াকে যে অনুসরণ করেছিল সেটা ‘অর্থববেদ’ পড়লে বুঝতে পারা যায়। তা ছাড়া শান্তি-স্বস্ত্যয়ন ইত্যাদি সেই আদিম যুগের পদ্ধতিরই ফলশ্রুতি। এ ছাড়া, বিরুদ্ধ গ্রহের প্রশমনের জন্য কয়েকটি গাছের মূল, ধাতু ও রত্নও ব্যবহার করা হয়। কতকগুলি বীজমন্ত্র নির্দিষ্ট সংখ্যক বার প্রতিদিন জপ করার ব্যবস্থাও আছে। এগুলির কোনটাই মৌলিক আর্যসংস্কৃতির অবদান নয়।

বলা বাহুল্য, বাঙালীর লৌকিক জীবনে এই সকল ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি, আদিম সমাজ কর্তৃক অনুসৃত ‘সদৃশ-বিধানী (mimetic) ও সংস্পর্শ- বিধানী (contagious) ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত। আদিম সমাজে ‘সদৃশ বিধানী’ ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া বলতে বোঝায় সদৃশ প্রক্রিয়ার দ্বারা সদৃশ উদ্দেশ্য সাধন করা। যেমন কাউকে মারতে হলে, তার একটা মৃন্ময় পুত্তলিকা তৈরি করে তার বুকে একটা কাঁটা ফুটিয়ে দেওয়া হয়। তাদের বিশ্বাস এর ফলে শত্রু বিনষ্ট হবে। আর ‘সংস্পর্শ বিধান’ ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়ায় অপরের ব্যবহৃত কোন জিনিস (যেমন শাড়ির একটা কোণ বা ছেলের কাঁথার অংশ) এনে, তার ওপর ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করলে, তার অনিষ্ট হবে।

সাত

বাঙালীর লৌকিক জীবনে তুলসীর প্রভাব খুব বেশি। বাঙালীর কাছে তুলসী গাছ অত্যন্ত পবিত্র। বাঙালী মনে করে তুলসী যেখানে থাকে হরিও সেখানে থাকেন। সেজন্য বাঙালী বাড়িতে তুলসীমঞ্চ তৈরি করে। তুলসী পাতা না হলে নারায়ণের পূজা হয় না। শ্রাদ্ধাদি কাজও হয় না। আবার তুলসীপাতা না হলে ‘মৃতের দোষপ্রাপ্তি’ কাটানো যায় না। শপথ করতে গেলেও তামা ও তুলসীর দরকার হয়। মূমূর্ষুকে তুলসীতলায় শোয়ানো হয়। বৈষ্ণবেরা আবার তুলসীকাঠের কণ্ঠী ব্যবহার করে। তুলসী এই মাহাত্ম্যের জন্য তুলসীতলা পরিস্কার রাখা হয় ও সন্ধ্যাববেলায় প্রদীপ দেওয়া হয়। কিন্তু সধবা মেয়েরা তুলসীপাতা তোলে না কেন? উত্তর ঠিক জানি না। তবে মনে হয়, পৌরাণিক উপাখ্যানে তুলসীর সতীত্বনাশের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে। উপাখ্যানটা কিন্তু বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন রকম দেওয়া আছে। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ অনুযায়ী নারায়ণ তুলসীর স্বামী শঙ্খচূড়ের রূপ ধারণ করে তুলসীর সতীত্ব নষ্ট করেছিলেন। আবার পদ্মপুরাণ অনুযায়ী বিষ্ণু বৃন্দারূপী তুলসীর স্বামী জলন্ধরের রূপ ধারণ করে এই অপকর্ম করেছিলেন (লেখকের ‘দেবলোকের যৌনজীবন’ দ্রষ্টব্য) অশ্বত্থ, বট, বেল, ঘেঁটু, ইত্যাদি বৃক্ষের পূজাও বাঙালী করে।

ভাদ্রমাসের চতুর্থী তিথিকে নষ্টচন্দ্র বলা হয়। ওই দিন চাঁদ দেখা নিষিদ্ধ, কেননা পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী ওই দিন চন্দ্র গুরুপত্নীকে ধর্ষণ করেছিলেন। ওই দিন গৃহস্থের বাড়ি থেকে ফলমূল চুরি করার প্রথা আছে। কেউ এটা দোষ বলে মনে করে না।

সবশেষে কয়েকটা লৌকিক দেবতার কথা বলব। এদের মধ্যে আছে রক্ষাকালী, ওলাইচণ্ডী, শীতলা, ধর্মঠাকুর, টুসু, ভাদু, বরকুমার, বরকুমারী, বারামু, কালুরায়, গাজী, বনবিবি, ক্ষেত্রপাল, বাস্তুঠাকুর, দক্ষিণরায় প্রভৃতি। বারা ধড়হীন মনুষ্যমূর্তি, আর দক্ষিণরায় বাঘ বা ঘোড়ায় চাপা দিব্য দেবতামূর্তি। সন্তান কামনায় বাঙলা পঞ্চাননেরও পূজা করে। সন্তানলাভ করলে, সে ছেলেকে ‘পঞ্চাননের দোর-ধরা’ ছেলে বলে।

বারার পূজা হয় চব্বিশ পরগনায় পৌষসংক্রান্তি বা পয়লা মাঘ, বনে বা নদীর ধারে বা গাছতলায় বা ক্ষেতের আলে। অনেক জায়গায় এক পুরুষ-বারার পাশে, এক জলঘটকে স্ত্রীবারার প্রতীক হিসাবে রাখা হয়। আবার অন্যত্র স্ত্রী-পুরুষ যুগ্মমূর্তি স্থাপন করা হয়। এটা যে জাদুবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত লৌকিক উর্বরতা বা সুফলন বর্ধক পূজা সে-বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। (বাঙালীর লৌকিক সংস্কৃতির বিশদ বিবরণের জন্য লেখকের ‘ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ গ্রন্থ দ্রষ্টব্য)।

আট

বাঙালীর লৌকিক জীবনকে আনন্দময় করে রেখেছিল তার নিজস্ব খেলাধূলা ও আমোদ-প্রমোদ। ঘরের বাইরের খেলার মধ্যে ছিল কাবাডি, কুস্তি, লাঠিখেলা, সাঁতার, নৌকার বাইচ ইত্যাদি। আর ঘরের ভিতরের খেলার মধ্যে ছিল দাবা, পাশা, গুটিখেলা, বাঘবন্দি, বউ বাসন্তী, মোগল-পাঠান, দশ-পঁচিশ, কড়ি খেলা ও তাসের বিন্তি ও রঙের খেলা। এ ছাড়া, ছেলেমেয়েরা খেলত লুকোচুরি, কানামাছি, এককা-দোক্কা ইত্যাদি।

আমোদ-প্রমোদের মধ্যে লৌকিক জীবনে স্থান পেত, যাত্রা, পুতুলনাচ, ভোজবাজী ইত্যাদি। এ ছাড়া ছিল নানা রকমের সংগীত অনুষ্ঠান। বাঙালীর সমস্ত লৌকিক জীবনটাই ছিল গানে ভরা। ছেলে হলে মেয়েরা গান গাইত। গান গেয়ে মেয়েরা ছেলেদের ঘুম পাড়াতো। বিয়ে বা অন্য শুভানুষ্ঠানে ও মেয়েরা গান গাইত। মরে গেলেও লোককে শ্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া হত সংকীর্তন গান গেয়ে। তারপর তার শ্রাদ্ধের সময়ও নামকীর্তন করা হত।

মধ্যযুগে বাঙালীর লৌকিক জীবনে পালাগান খুব জনপ্রিয় ছিল। এ সকল পালাগান গাওয়া হত মনসা, ধর্মঠাকুর, শিব, শীতলা, চণ্ডী, কৃষ্ণলীলা, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতিকে আশ্রয় করে। রাতের পর রাত এ সকল পালাগান গ্রামবাসীদের মুগ্ধ করে রাখত। পালাগান ছাড়া, পাঁচালী গানও খুব জনপ্রিয় ছিল। পাঁচালীকারদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন দাশরথি রায়। পাঁচালী গানে মূল গায়েন পায়ে নূপুর পরে ও এক হাতে চামর ও অপর হাতে মন্দিরা নিয়ে, নাচতে নাচতে গান করত। পাঁচালীগানের নিজস্ব ছন্দ ও রচনাশৈলী ছিল। যাত্রাভিনয়ে যত লোক লাগে পাঁচালীগানে তত লোক লাগে না। এ ছাড়া গ্রাম্যজীবনে ছিল কথকতা। কথক ঠাকুর নিজ আসনে বসে পৌরাণিক কাহিনীসমূহ বিবৃত করতেন, আর মাঝে মাঝে গান গাইতেন। বলা বাহুল্য, নিরক্ষর গ্রামবাসীরা এসবের মাধ্যমেই প্রাচীন ঐত্যিহ্যর সঙ্গে পরিচিত হত।

অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙলায় কবিগানও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কবিগানের উৎপত্তি সম্বন্ধে একাধিক মত আছে। এক মত অনুযায়ী এগুলো বৈষ্ণব পদাবলী থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। অন্য মত অনুযায়ী সাধারণের মধ্যে প্রচলিত ঝুমুর ও ধামালীগান থেকে উদ্ভূত। অষ্টাদশ শতাব্দীর কবিওয়ালাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল গোঁজলা গুঁই, লালু, নন্দলাল, রামজী, রঘুনাথ দাস, কেষ্ট মুচি, রাসু নৃসিংহ, হরুঠাকুর, বলাই বৈষ্ণব, নীলমণি ঠাকুর, নিত্যানন্দ দাস বৈরাগী, এন্টনী ফিরিঙ্গি, ভোলা ময়রা, ভবানী বণিক প্রমুখ। কবিগান ছিল গানের লড়াই এতে দুই পক্ষ যোগদান করত।

কবিগানের সাধারণত চারটে অংশ থাকত—ভবানী-বিষয়, সথী- সংবাদ, বিরহ ও খেউড়। খেউড়ের মধ্যে আদি-রসাত্মক অনেক গান থাকত। এক পক্ষ অনেক সময় গানের মাধ্যমে অপর পক্ষকে গালি- গালাজও করত। কবিগান মুখে মুখে রচনা করা হত। এর জন্য একজন বাঁধনদার থাকত। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ হাফ-আখড়াই গানের অভ্যুদয়ের পর কবিগানের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়।

বাঙালীর লৌকিক জীবনে তরজা গানেরও জনপ্রিয়তা ছিল। তরজাও গানের লড়াই। এতে এক পক্ষ প্রশ্ন করত, অপর পক্ষ তার উত্তর দিত-সবই গানের মাধ্যমে।

যাত্রাভিনয়ও খুব জনপ্রিয় ছিল। যাত্রাভিনয়ের মধ্যে থাকত কথোপকথন ও গান। এর জন্য কোন মঞ্চ তৈরি করা হত না। মাটির ওপরই কাপড় বিছিয়ে আসর তৈরি করা হত। বদন অধিকারী, গোবিন্দ অধিকারী, লোকা ধোপা, সূর্যি হাঁড়ি নীলকণ্ঠ মুখুজ্যে, মণি রায়, কৃষ্ণকমল গোস্বামী প্রমুখ যাত্রার জন্য বিখ্যাত। বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদ পর্যন্ত কলকাতার লোকের কাছে যাত্রাভিনয় বেশ আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল। তারপর থিয়েটারের চাপে যাত্রাভিনয় গ্রামের আস্তানার মধ্যেই নিবদ্ধ হয়ে পড়ে। গ্রামের জমিদাররাই এর পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কিন্তু জমিদারি বিলোপের পর যাত্রাগানের জনপ্রিয়তা গ্রামে কমে গিয়েছে। এখন যাত্রাভিনয়কে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। কিন্তু এতে না আছে আগেকার দিনের যাত্রার পরিবেশ, না আছে তার বেশ। আগে যাত্রায় পুরুষরাই মেয়ে সেজে মেয়েদের ভূমিকা অভিনয় করত। এখন মেয়েরাই মেয়েদের ভূমিকা গ্রহণ করে। (বাঙালীর লৌকিক জীবনে আমোদ-প্রমোদ প্রভৃতির বিশদ বিবরণের জন্য লেখকের ‘ফোক্ এলিমেন্টস্ ইন বেঙ্গলী লাইফ্, ও ‘আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালী’ দ্রষ্টব্য)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *