অকাল, বিপ্লব ও বিদ্রোহ

আকাল, বিপ্লব ও বিদ্ৰোহ

বাঙলা শস্যশ্যামল হলেও, দুর্ভিক্ষ বাঙালীকে প্রায়ই বিব্রত করেছে। মৌয- সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সময়েও বাঙলা দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট হয়েছিল। তারপর বহুবার হয়েছে। এখনও হয়। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের ন্যায় মর্মান্তিক ঘটনা, আর কখনও ঘটেনি। মন্বন্তর বাঙলাদেশকে এমনভাবে বিধ্বস্ত করেছিল যে, পরবর্তীকালে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বাঙলার লোকের কাছে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নরূপ কিংবদন্তীতে দাঁড়িয়েছিল। সমসাময়িক দলিলসমূহের ওপর প্রতিষ্ঠিত নিজ অনুশীলনের ভিত্তিতে লিখিত ডবলিউ.ডবলিউ. হান্টার তাঁর ‘অ্যানলস্ অভ রুরাল বেঙ্গল’ বইতে এর এক বিশ্বস্ত বিবরণ দিয়েছেন। হান্টারের বর্ণনা- ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে গ্রীষ্মকালে রৌদ্রের প্রবল উত্তাপে মানুষ মরিতে লাগিল। কৃষক গরু বেচিল, লাঙ্গল-জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, তারপর ছেলেমেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ক্রেতা নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল। ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল। তারপর মৃতের মাংস খাইতে লাগিল। সারাদিন সারারাত্রি অভুক্ত ও ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ বড় বড় শহরের দিকে ছুটিল। তারপর মহামারী দেখা দিল। লোকে বসন্তে মরিতে লাগিল। মুর্শিদাবাদের নবাবপ্রাসাদও বাদ গেল না। বসন্তে নবাবজাদা সইফুজের মৃত্যু ঘটিল। রাস্তায় মৃত ও নির্ধনীর শবে পূর্ণ হইয়া পাহাড়ে পরিণত হইল। শৃগাল কুকুরের মেলা বসিয়া গেল। যাহারা বাঁচিয়া রহিল, তাহাদের পক্ষে বাঁচিয়া থাকাও অসম্ভব হইয়া দাঁড়াইল।’ অনুরূপ বর্ণনা বঙ্কিমও তাঁর ‘আনন্দমঠ’-এ দিয়েছেন। বঙ্কিম লিখেছেন—১১৭৬ সালে গ্রীষ্মকালে একদিন পদচিহ্ন গ্রামে রৌদ্রের উত্তাপ বড় প্রবল।…সম্মুখে মন্বন্তর… লোক রোগাক্রান্ত হইতে লাগিল। গোরু, বেচিল, লাঙ্গল বেচিল, জোয়াল বেচিল, বীজধান খাইয়া ফেলিল, ঘরবাড়ি বেচিল, জোতজমা বেচিল। তারপর মেয়ে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর ছেলে বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর স্ত্রী বেচিতে আরম্ভ করিল। তারপর মেয়ে, ছেলে, স্ত্রীকে কেনে এমন খরিদ্দার নাই, সকলেই বেচিতে চায়। খাদ্যাভাবে গাছের পাতা খাইতে লাগিল, ঘাস খাইতে আরম্ভ করিল, আগাছা খাইতে লাগিল। অনেকে পলাইল, যাহারা পলাইল তাহারা বিদেশে গিয়া অনাহারে মরিল, যাহারা পলাইল না, তাহারা অখাদ্য খাইয়া, না খাইয়া রোগে পড়িয়া প্রাণত্যাগ করিল। বসন্তের বড় প্রাদুর্ভাব হইল, গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল।’

লর্ড মেকলেও তার বর্ণাঢ্য ভাষায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের এক করুণ চিত্র দিয়েছেন—

“In the summer of 1770 the rains failed,; the earth was parched up, and a famine, such as is known only in the countries where every household depends for support on its own little patch of cultivation filled the whole valley of the Ganges with misery and death. Tender and delicate women, whose veils had never been lifted before the public gaze, came forth from their inner chambers in which Eastern Zealousy had kept watch over their beauty, threw themselves on the earth before the passerby, and, with loud wailing, implored a handful of rice for their children. The Hooghly everyday rolled down thousands of corpses close to the porticos and gardens of the English conquerors. The very streets of Calcutta were blocked up by the dying and dead. The lean and feeble survivors had not energy enough to bear the bodies of their kindred to the funeral pyre or to the holy river or even to scare away jackals and vultures who fed on human remains in the face of the day…It was rumoured that the Companys servants had created the famine by engrossing all the rice of the country. (Macaulay in eassy on Clive quoted in A. K Sur’s History & Culture of Bengal’ 1963, pages 177-178; 1993).

ছিয়াত্তরে মন্বন্তর ঘটেছিল অনাবৃষ্টির জন্য। তার আগের বছরেও বৃষ্টির স্বল্পতার জন্য ফসল কম হয়েছিল। তার জন্য চাউল মহার্ঘ্য হয়েছিল। কিন্তু লোক না খেয়ে মরেনি। কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময় লোক না খেয়ে মরেছিল। তার কারণ, যা চাউল বাজারে ছিল, তা কোম্পানী আকালের আশাঙ্কায় সিপাইতের জন্য বাজার থেকে কিনে নিয়েছিল। কোম্পানি যখন চাউল কিনতে শুরু করল, তখন তারই পদাঙ্কে কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে যারা গোপন ব্যবসায়ে লিপ্ত থাকত, তারাও লাভের প্রত্যাশায় চাউল কিনে মজুত করল। সমসাময়িক এক বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে কোম্পানির যে কর্মচারীর এক বৎসর পূর্বে ১০০ পাউন্ডেরও সংস্থান ছিল না, পর বৎসর সে ৬০,০০০ পাউন্ড দেশে পাঠাল।

দুই

ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের প্রকোপে বাঙলা দেশের এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা গিয়েছিল। আর কৃষকদের মধ্যে মারা গিয়েছিল শতকরা ৫০ জন। জনবহুল গ্রামসমূহ জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল। বীরভূমের বহু গ্রাম এমন জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল যে এই ঘটনার পর দশ বছর সৈন্যদের পক্ষে সে সকল স্থান অতিক্রম করা সম্পূর্ণভাবে দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। এত কৃষক মারা গিয়েছিল যে মন্বন্তরের পর নিজ নিজ জমিতে চাষী বসাবার জন্য জমিদারদের মধ্যে এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঘটেছিল। তখন থেকেই বাঙলাদেশে খোদকস্ত রায়ত অপেক্ষা পাইকস্ত রায়তের সংখ্যা বেড়ে যায়।

মন্বন্তরে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছিল জমিদাররা। কেননা, এই সময় বাঙলার নায়ের দেওয়ান মহম্মদ রেজা খাঁ শতকরা দশটাকা হারে রাজস্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল। তার ফলে বাঙলায় কান্নার কোলাহল পড়ে গিয়েছিল। একে তো মন্বন্তরের বছর। লোক না খেতে পেয়েই মরে যাচ্ছে। জমিদারকে তারা খাজনা দেবে কি করে? জমিদারও প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা না পেলে সরকারের রাজস্ব জমা দেবে কেমন করে? জমিদারদের ওপরই গিয়ে পড়ল চূড়ান্ত নির্যাতন। তাদের উলঙ্গ করে বিছুটির চাবুক মেরে সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত করে দেওয়া হল। তারপর অচৈতন্য অবস্থায় তাদের অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করা হল। শুধু তাই নয়। স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ও পিতার সামনে কন্যাকে বিবস্ত্রা করে শুরু হল নিষ্ঠুর নির্যাতন। বর্ধমানের মহারাজা, নদীয়ার মহারাজ, নাটোরের রানী ভবানী, বীরভূম ও বিষ্ণুপুরের রাজাদের যে কি দুর্গতি হয়েছিল, সেসব হান্টার তাঁর ‘অ্যানালস অভ্ রুরাল বেঙ্গল’ বইয়ে লিখে গিয়েছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় জনগণ যে ক্ষিপ্ত হয়ে একটা সমাজবিপ্লব ঘটাবে তা বলাই বাহুল্য মাত্র। হান্টার বলেছেন—’অরাজকতা প্রসব করে অরাজকতা এবং বাঙালার দুর্দশাগ্রস্ত কৃষক সম্প্রদায় আগামী শীতকালে খাদ্যফসল থেকে বঞ্চিত হয়ে ও দস্যুদ্বারা বিধ্বস্ত হয়ে, নিজেরাই দস্যুতে পরিণত হল। যারা প্রতিবেশীর নিকট আদর্শ চরিত্রের লোক বলে পরিগণিত হত, সে সকর কৃষকও পেটের দায় ডাকাতে পরিণত হল এবং সন্ন্যাসীর দল গঠন করল। তাদের দমন করবার জন্য যখন ইংরেজ কালেক্টররা সামরিকবাহিনী পাঠাল, তখন এক এক দলে পঞ্চাশ হাজার সন্ন্যাসী, সিপাইদের নস্যাৎ করে দিল। মন্বন্তর এবং তার পরবর্তী কয়েক বছর এরূপই চলল। পরে অবশ্য ইংরেজদের হাতে তারা পরাভূত হল।’ এটা সবই হান্টারের কাহিনী। এই কাহিনীকেই পল্লবিত করে বঙ্কিম তাঁর উপন্যাসে ‘আনন্দমঠ’-এর রূপ দিয়েছিলেন।

তিন

মন্বন্তর মাত্র এক বছরের ঘটনা। কিন্তু তার জের চলেছিল বেশ কয়েক বছর। মন্বন্তরের পরের দু’বছরে বাঙলা আবার শস্যশ্যামল হয়ে উঠেছিল। লোক পেট ভরে খেতে পেল বটে, কিন্তু লোকের আর্থিক দুর্গতি চরমে গিয়ে পৌঁছাল। অত্যধিক শস্য ফলনের ফলে কৃষিপণ্যের দাম এমন নিম্নস্তর গিয়ে পৌঁছাল যে হান্টার বলেছেন—’হাটে শস্য নিয়ে গিয়ে বেচে গাড়িভাড়া তোলাও দায় হল।’ সুতরাং বাঙলার কৃষক নিঃস্বই থেকে গেল। এদিকে খাজনা আদায় পুরাদমে চলতে লাগল, এবং তার জন্য নির্যাতনও বাড়ত লাগল। কিন্তু নির্যাতনের পরেও আধা রাজস্ব আদায় হল না। এটা পরবর্তী কয়েক বছরের খাজনা আদায়ের পরিমাণ থেকে বুঝতে পারা যাবে।

বৎসরদেয় রাজস্ব (পাউন্ডে লিখিত)আদায়ীকৃত রাজস্ব
১৭৭২৯৯,৪১০৫৫,২৩৭
১৭৭৩১০৩,০৮৯৬২,৩৬৫
১৭৭৪১০১,৭৯৯৫২, ৫৩৩
১৭৭৫১০০,৯৮০৫৩,৯৯৭
১৭৭৬১১১,৪৮২৬৩,৩৫০

যেখানে উৎপন্ন শস্য হাটে নিয়ে গিয়ে বেচতে গেলে, গাড়িভাড়াই ওঠে না, সেক্ষেত্রে নিঃস্ব কৃষক খাজনা দেবে কি করে? উপরে যে আদায়ীকৃত খাজনার পরিমাণ দেখানো হয়েছে, তা হচ্ছে নির্যাতন-লব্ধ খাজনা। সুতরাং নির্যাতন-লব্ধ খাজনা সন্ন্যাসীরা লুঠ করতে লাগল। দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন, এই ছিল এদের ধর্ম। সন্ন্যাসীদের এরূপ সংগঠন ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের অনেক আগে থেকেই ছিল। এরূপ এক মঠাধ্যক্ষই রক্ষা করেছিল রানী ভবানীর বালবিধবা সুন্দরী কন্যা তারা সুন্দরীকে সিরাজের কুৎসিত কামলালসা থেকে।

সন্ন্যাসীদের একজন মঠাধ্যক্ষ কৃপানাথ এক বিরাট বাহিনী নিয়ে রংপুরের বিশাল ‘বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গল’ অধিকার করেন। তাঁর ২২ জন সহকারী সেনাপতি ছিল। রংপুরের কালেকটর ম্যাকডোয়াল পরিচালিত বিরাট সৈন্যবাহিনী দ্বারা জঙ্গল ঘেরাও হলে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের খন্ডযুদ্ধ হয়। বিদ্রোহীগণ বিপদ বুঝে নেপাল ও ভূটানের দিকে পালিয়ে যায়।

‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহী’ নামে অভিহিত হলেও এতে ফকির সম্প্রদায় ও যোগ দিয়েছিল। সন্ন্যাসী বিদ্রোহে সক্রিয় অংশ গ্রহণের জন্য আরও যাঁরা প্রসিদ্ধ হয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন ইমামবাড়ী শাহ, জয়রাম, জহুরী শাহ, দর্পদেব, বুদ্ধু শাহ, মজনু শাহ, মূসা শাহ, রামানন্দ গোঁসাই, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী ও সোভান আলি। (পরে দেখুন )

চার

কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের এই দুর্যোগের সময় ইংরেজরা ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্নবিলাসে মত্ত হয়ে, দক্ষিণ ভারতের যুদ্ধসমূহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। বস্তুত ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে বাঙলার আর্থিক সঙ্গতি নিম্নদিকে এমনই স্তরে গিয়ে পৌঁছায় যে, এক সমসাময়িক প্রতিবেদনে বলা হল— “the company seemed on the verge of ruin”। কিন্তু দেশের এই শোচনীয় অবস্থা হলেও, কোম্পানীর কর্মচারীরা (তাদের ‘নবাব’ আখ্যা দেওয়া হত)। স্বদেশে ফেরবার সময় প্রচুর অর্থ সঙ্গে করে নিয়ে যেত। এটা বিলাতের কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়ালো না, এবং তারা বিলাতের শাসনতন্ত্রের সঙ্গে কোম্পানীর সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য পার্লামেন্টে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ করলেন যথা রেগুলেটিং অ্যাক্ট, পিটস্ ইণ্ডিয়া অ্যাক্ট ইত্যাদি।

পাঁচ

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে উৎকটভাবে প্রকাশ পেয়েছিল বাঙালীর বিদ্রোহী মানসিকতার। এই সময়ের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ হচ্ছে সন্ন্যাসী বিদ্ৰোহ। আগেই বলেছি এটা ঘটেছিল ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিকায়। এর বিদ্রোহেই আমরা এক মহিলাকে নেতৃত্ব করতে দেখি। সেই মহিলা হচ্ছে দেবী চৌধুরানী। বিদ্রোহের অন্যতম নেতা হচ্ছে ভবানী পাঠক। দুজনেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি। দুর্গাপুরের নিকট ভবানী পাঠকের টিলা ভবানী পাঠকের মূল ঘাটি ছিল। ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় ইংরেজদের কাছে অভিযোগ আসে যে ভবানী পাঠক নামে এক ব্যক্তি তাদের নৌকা লুট করেছে। ইংরেজরা তাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু তাকে বন্দি করতে সক্ষম হয় না। ভবানী পাঠক ইংরেজদের দেশের শাসক বলে মানতে অস্বীকার করেন। দেবী চৌধুরানীর সহায়তায় তিনি ইংরেজদের ওপর হামলা চালান। তার ফলে ময়মনসিংহ ও বগুড়া জেলায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শাসন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে। লেফটানেন্ট ব্রেনোর নেতৃত্বে পরিচালিত ইংরেজবাহিনী তাঁকে এক ভীষণ জলযুদ্ধে পরাজিত করে ও ভবানী পাঠক নিহত হন। উত্তরবঙ্গ এই বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ছিল ফকির সম্প্রদায়ের মজনু শাহ। মজনুর কার্যকলাপে উত্তর-বঙ্গ, ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলায় ইংরেজরা নাস্তানাবুদ হয়। সশস্ত্র বাহিনীর সাহায্যে তাকে দমন করা সম্ভবপর হয় না। ভবানী পাঠকের সন্ন্যাসীর দলের সঙ্গে মজনুর ফকির দলের একবার সঙ্ঘর্ষ হলেও, তারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়েই নিজেদের কার্যকলাপ চালাত। তাদের কার্যকলাপের অন্তর্ভুক্ত ছিল জমিদারদের কাছ থেকে কর আদায় করা, ইংরেজ সরকারের কোষাগার লুণ্ঠন করা ইত্যাদি। তবে জনসাধারণের ওপর তারা অত্যাচার বা বলপ্রয়োগ করত না। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর তারিখে মজনু পাঁচশত সৈন্যসহ বগুড়া জেলা থেকে পূর্বদিকে যাত্রা করবার পথে কালেশ্বর নামক জায়গায় ইংরেজবাহিনী কর্তৃক মারাত্মকভাবে আহত হয়। মজনুর দল বিহারের সীমান্তে পালিয়ে যায়। মাখনপুর নামক স্থানে মজনুর মৃত্যু হয়।

সন্ন্যাসীদের একজন মঠাধ্যক্ষ কৃপানাথের কথা আমরা আগেই বলেছি। বাইশ জন সহকারী সেনাপতিসহ তিনি রংপুরে ইংরেজ বাহিনী দ্বারা ঘেরাও হলে বিপদ বুঝে নেপাল ও ভুটানের দিকে পালিয়ে যান।

উত্তরবঙ্গে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অপর একজন নেতা ছিলেন। দর্পদেব। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজবাহিনীর সঙ্গে তিনি এক খণ্ডযুদ্ধ করেন।

কোচবিহারে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক ছিলেন রামানন্দ গোঁসাই। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে দিনহাটা নামক স্থানে তাঁর বাহিনীর সঙ্গে লেফটানেন্ট মরিসনের এক প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ইংরেজবাহিনীর তুলনায় অস্ত্রশস্ত্র স্বল্প ও নিকৃষ্ট থাকায় তিনি গেরিলা যুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে মরিসনের বাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাজিত করেন। ইংরেজবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়।

সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ১৭৬৩ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। এই বিদ্রোহের শেষ পর্বের যাঁরা নায়ক ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখনীয় ইমামবাড়ী শাহ, বুদ্ধু শাহ, জহুরী শাহ, মূসা শাহ, সোভান আলি প্রমুখ। আরও একজন ছিলেন, তাঁর নাম জয়রাম। তিনি ছিলেন একজন এদেশীয় সুবেদার। ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে সন্ন্যাসীবাহিনীর যে সংগ্রাম হয়, তাতে তিনি কয়েকজন সিপাইসহ সন্ন্যাসীদের সাহায্য করেছিলেন। সেই যুদ্ধে ইংরেজবাহিনী পরাজিত হয়েছিল। জয়রাম কিন্তু ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েন। ইংরেজরা তাঁকে কামানের তোপে হত্যা করে।

ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অপর একজন নেতা জহুরী শাহও ধরা পড়ে। বিদ্রোহের অপরাধে তাকে ১৮ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

সন্ন্যাসী বিদ্রোহের শেষ পর্বের শ্রেষ্ঠতম নায়ক ছিল মুশা শাহ। তিনি ছিলেন মজনু শাহের যোগ্য শিষ্য ও ভ্রাতা। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে মজনুর মৃত্যুর পর তিনিই বিদ্রোহ অব্যাহত রাখেন। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে তিনি রাজশাহী জেলায় প্রবেশ করেন। সেখানে রানী ভবানীর বরকন্দাজ বাহিনী তাঁর প্রতিরোধ করে। কিন্তু মুসা বরকন্দাজ বাহিনীকে পরাজিত করেন। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে লেফটানেন্ট ক্রিস্টির নেতৃত্বে ইংরেজবাহিনী মুশাকে আক্রমণ করে। ইংরেজবাহিনী মুশার পশ্চাদ্ধাবন করেও তাঁকে বন্দি করতে পারে না। পরে ফেরাগুল শাহের মুশার নেতৃত্ব নিয়ে যে দ্বন্দ্ব হয়, সে দ্বন্দ্বে মুশা ফেরাগুলের হাতে নিহত হন।

সন্ন্যাসী বিদ্রোহের শেষ পর্বের অপর এক প্রধান নেতা ছিলেন সোভান আলি। একসময় তিনি বাঙলা, বিহার ও নেপালের সীমান্ত জুড়ে এক বিরাট এলাকায় ইংরেজশাসক ও জমিদারগোষ্ঠীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিলেন। দিনাজপুর মালদহ ও পূর্ণিয়া জেলায় ইংরেজকুঠি ও জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবার সময় তাঁর সহকারী জহুরী শাহ ও মতিউল্লা ইংরেজদের হাতে ধরা পড়ে ও কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। পালিয়ে গিয়ে তিনি আমুদী শাহ নামে এক ফকির নায়কের দলে যোগ দেন। কিন্তু ইংরেজদের হাতে এরাও পরাজিত হয়। এই পরাজয়ের পর ৩০০ অনুচর নিয়ে ১৭৯৭- ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় তিনি ছোট ছোট আক্রমণ চালান। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য ইংরেজ সরকার চার হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। তাঁর শেষজীবন সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না।

শেষ পর্যন্ত ইমামবাড়ী শাহ ও বুদ্ধু শাহ বগুড়ার জঙ্গলকীর্ণ অঞ্চলে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের ঝাণ্ডা উড্ডীন রেখেছিলেন।

ছয়

একদিকে যেমন ‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ চলছিল, অপরদিকে তেমনই ইংরেজশাসক ও জমিদারগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশের মধ্যে গণ-আন্দোলনও চলছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখনীয় চুয়াড় বিদ্রোহ (১৭৬০,১৭৮৩), চাকমা বিদ্রোহ (১৭৮৩-৯৫), ঘরুই বিদ্রোহ (১৭৭৩), হাতিখেদা বিদ্ৰোহ (১৭৯৯), বাখরগঞ্জের সুবান্দিয়া গ্রামের বিদ্রোহ (১৭৯২), ত্রিপুরার রোশনাবাদ পরগনায় সমশের গাজীর বিদ্রোহ (১৭৭০) ও তন্তুবায়দের ওপর ইংরেজ বণিকদের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তন্তুবায়দের বিদ্রোহ (১৭৭৮)।

ইংরেজ রাজত্বের গোড়া থেকেই বরাভূম ও মালভূম অঞ্চলে জমির মালিকানা স্বত্ব ও জমিদারদের খাজনা আদায় পদ্ধতি নিয়ে বিশৃঙ্খলা ও অসন্তোষ প্রকাশ পায়। ইংরেজ যখন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম করে একদল রাজভক্ত জমিদার শ্রেণি সৃষ্টি করে, তখন থেকেই ওটা বাধা পায় ওইসব অঞ্চলের কৃষকদের কাছ থেকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চুয়াড় বিদ্রোহ ও বাগড়ি নায়েক বিদ্রোহ ঘটে। বাগড়ি বিদ্রোহের নেতা ছিল, অচল সিংহ, আর চুয়াড় বিদ্রোহের নায়ক ছিল গোবর্ধন দিক্‌পতি। চুয়াড় বিদ্রোহের সূচনা হয় মেদিনীপুরে কর্ণগড়ের রাজা অজিত সিংহের মৃত্যুর পর। অজিত সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর দুই পত্নী রানী ভবানী ও রানী শিরোমণি জমিদারী পরিচালনা করেন। তাদের সময়ে সৈন্যদলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এর ফলে জঙ্গলের চুয়াড়গণ গোবর্ধন দিক্‌পতি নামে এক ব্যক্তি নেতৃত্বে কর্ণগড় আক্রমণ করে। (১৭৬০)। রানীরা ভীত হয়ে নাড়াজোলের রাজা ত্রিলোচন খানের আশ্রয় নেন। ত্রিলোচনা খান চুয়াড়দের পরাস্ত করেন। কিন্তু ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে আবার দ্বিতীয়বার চুয়াড় বিদ্রোহ হয়। দিপতির নেতৃত্বে প্রায় ৪০০ বিদ্রোহীর এক বাহিনী চন্দ্রকোণা পরগনা ও মেদেনীপুর জেলার বৃহত্তম গ্রাম আনন্দপুর আক্রমণ ও লুণ্ঠন করে। ইংরেজ সরকার রানী শিরোমণিকে এই বিদ্রোহের নেত্রী ভেবে তাঁকে কলকাতায় এনে বন্দি করে রাখে। পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিছুদিন অবস্থা শান্ত হলেও মেদেনীপুরের শালবনি অঞ্চলে ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে বাগড়ি বিদ্রোহ হয়। অচলসিংহ এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন। বহু প্রাণ বিনষ্ট করেও সরকার এই বিদ্ৰোহ দমন করতে সক্ষম হননি। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে আবার অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছিল।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে তন্তুবায়দের ওপর ইংরেজ বণিকদের উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তন্তুবায়রা বিদ্রোহ করে। ইতিহাসে একে তন্তুরায় আন্দোলন বলা হয়। শান্তিপুরে এই আন্দোলনের প্রধান নায়ক বিজয়রাম ও ঢাকায় দুনিরাম পাল। এদের পর এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় লোচন দালাল, কৃষ্ণচন্দ্র, বড়াল, রামরাম দাস, বোষ্টমদাস প্রভৃতি। ইংরেজ বণিকদের শর্ত মেনে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর না করায় ইংরেজরা বোষ্টমদাসকে তাদের কুঠিতে আটক করে তার ওপর অত্যাচার করে। সেই অত্যাচারের ফলে বোষ্টমদাস মারা যায়।

চাকমা উপজাতির মধ্যেও একাধিকবার বিদ্রোহ হয়। প্রথম চাকমা বিদ্রোহের (১৭৭৬-৭৭) নায়ক ছিল রামুখা। রামু চাকমা জাতিকে একত্রিত করে প্রথম কার্পাস কর দেওয়া বন্ধ করে ও তার সঙ্গে ইংরেজদের বড় বড় ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। ইংরেজবাহিনী এসে এই বিদ্রোহ দমন করে। এই বিদ্রোহে চাকমা দলপতি শেষ দৌলত অসাধারণ বীরত্ব দেখিয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পর শের দৌলতের ছেলে জান বকস্ খাঁ দ্বিতীয় চাকমা বিদ্রোহের নেতৃত্ব করে। তার সময় (১৭৮৩-৮৫ খ্রিস্টাব্দে) কোন ইজারাদারই চাকমা অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারেনি। বহুদিন সে স্বাধীনভাবে শাসন করেছিল।

এই সময়ের (১৭৯৩) আর এক বিদ্রোহ হচ্ছে দক্ষিণ বাখরগঞ্জের সুবান্দিয়া গ্রামের বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের নেতা ছিল বোলাকি শাহ। সুবান্দিয়া গ্রামের চাষীদের নিয়ে সে এক সৈন্যদল গঠন করে। একটা দুর্গও তৈরি করে। সেখানে মুঘলদের পরিত্যক্ত সাতটা কামান বসিয়ে ইংরেজ সরকার ও জমিদারবৃন্দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কয়েকটা খন্ডযুদ্ধ হয়। শেষ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সে আত্মগোপন করে।

১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে সন্দ্বীপের জমিদার আবু তোরাপ খাঁ অন্যান্য জমিদারদের বিতাড়িত করে ইংরেজ নিয়োজিত সন্দ্বীপের ক্ষমতাশালী রাজস্ব সচিব গোকুল ঘোষালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ইংরেজ সৈন্য দ্বারা এই বিদ্রোহ দমিত হয়।

১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা জেলার রোশনাবাদ পরগনার কৃষকরা সমশের গাজী নামক এক ব্যক্তির নেতৃত্বে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। সমশের কৃষকদের সঙ্ঘবদ্ধ করে ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী উদয়পুর দখল করে ও সেখানে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে কৃষকদের মধ্যে জমিবন্টন ও কর মকুব, জলাশয় খনন প্রভৃতি জনহিতকর কাজ করে। নবাব মীরকাশিম ইংরেজ সৈন্যের সহায়তায় সমশের বাহিনীকে পরাজিত করে। সমশেরকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হয়। পরে নবাবের হুকুমে তাকে তোপের মুখে ফেলে হত্যা করা হয়।

এ সময়ে মেদিনীপুরের ঘরুই উপাজাতির বিদ্রোহ করে। দুবার বিদ্রোহ হয়। প্রথমবার জমিদার শত্রুঘ্ন চৌধুরীর পুত্র নরহর চৌধুরী রাত্রিতে নিরস্ত্র ঘরুইদের এক সমাবেশের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৭০০ ঘরুইকে হত্যা করে। দ্বিতীয়বার বিদ্রোহ হয় ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে। এবারও ঠিক আগের মতই রাত্রিকালে আক্রমণ চালিয়ে বহু ঘরুইকে হত্যা করা হয়।

পূর্বাঞ্চলের উপজাতি গারো হাজংদের মধ্যেও বিদ্রোহ প্রকাশ পায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে। ইতিহাসে এটা হাতিখেদা বিদ্ৰোহ নামে পরিচিত। এর নেতৃত্বে করে হাজং সরদার। জমিদাররা কোন প্রকারে তাকে হাতির পায়ের তলায় ফেলে হত্যা করে। তাতে গারো-হাজংদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন কিন্তু নিভে যায় না। কেননা, ওরই পরম্পরায় ঘটে ১৮০২ খ্রিস্টাব্দের গারো হাঙ্গামা, ১৮২৭-৩২ খ্রিস্টাব্দের শেরপুরের বিদ্রোহ ও ১৮৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দের গারো হাঙ্গামা। ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ছপাতি পাগলা নামে এক ব্যক্তি গারো অঞ্চলের বিভিন্ন উপজাতির লোকেদের বশীভূত করে একটি স্বাধীন গারো রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে। যদিও তার চেষ্টা সফল হয়নি, তা হলেও তারই সম্প্রদায়ভুক্ত গারো হাজংদের সর্দার টিপু নিপীড়ক জমিদারদের হাত থেকে কৃষকদের বাঁচবার জন্য এক সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করে ঘোষণা করে যে বিঘা পিছু চার আনার বেশি কর দেওয়া হবে না। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে সেরপুরের জমিদার টিপুর ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে ইংরেজ কালেকটর ভ্যামপিয়েরের সাহায্য প্রার্থনা করে। টিপু ‘জরিপাগড়’ নামে এক পুরাণো কেল্লায় গিয়ে রাজা হয়ে বসে। ভ্যামপিয়ের তাকে গ্রেপ্তার করলে সে সৎজীবন যাপনের প্রতিশ্রুতিতে মুক্তি পায়। কিন্তু ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে যখন হাঙ্গামার আবার পুনরাবৃত্তি ঘটে, তখন তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয় ও ময়মনসিংহের সেসন জজের বিচারে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। কারবাসকালেই তার মৃত্যু হয়। টিপুর আন্দোলনের আরও দুজন নায়ক ছিল, দেবরাজ পাথর ও জানকু পাথর। এরাই পরে সেরপুরের আন্দোলনের চালিয়েছিল। সেরপুরের পশ্চিম দিকে কড়িবাড়ি পাহাড়ের পাদদেশে তাদের প্রধান আস্তানা ছিল। শেষের দিকে (১৮৩২-৩৩) আর যারা এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব করেছিল তাদের মধ্যে ছিল গুমাকু সরকার ও উজী সরকার।

এই সময় আরও ঘটে তিতুমীরের (১৮৭২-১৮৩১) বিদ্রোহ। তিতুমীরের বিদ্রোহের (১৮৩০-৩১) উদ্দেশ্য ছিল জমিদার ও নীলকর সাহ্বেদের উৎসাদন করা ও ভূমিজ কর হ্রাস করা। চব্বিশ পরগনার বাদুড়িয়া গ্রামে তার জন্ম। দাঙ্গা-হাঙ্গামার অপরাধে তার কারাদণ্ড হয়। কারামুক্তির পর তিতু মক্কায় যায় ও সেখানে ওয়াহাবি নেতা সৈয়দ আহম্মদের কাছে ওয়াহাবি আদর্শে দীক্ষিত হয়ে দেশে ফেরে। বারাসত থেকে এক বিস্তৃত অঞ্চলে তার আন্দোলন প্রসারিত হয়। নীলকর ও জমিদারদের অত্যাচারের সাধারণ চাষীরা বিদ্রোহের জন্য উন্মুখ হয়েছিল। তিতু তাদেরই নেতৃত্ব দিয়ে জনশক্তিকে সংহত করবার চেষ্টা করে। গরীব চাষী ও তাঁতীরাই তার অনুগামী হয়। পুঁড়া, টাকী, গোবরডাঙ্গা, গোবরা- গোবিন্দপুরের জমিদারদের বাড়ী আক্রমণ করে তিতু তাদের কাছ থেকে কর দাবী করে। গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার তিতুর হাতে নিহত হয়। তারপর নারিকেল বেড়িয়ায় তিতু এক বাঁশের কেল্লা তৈরি করে পাঁচশ অনুগামীয় সঙ্গে সেখানে বাস করতে শুরু করে ও নিজেকে স্বাধীন বাদশাহ বলে ঘোষণা করে। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর তারিখে কলকাতা থেকে যে সৈন্যদল আসে তারা, তিতুর কাছে পরাজিত হয়। তারপর ইংরেজরা অশ্বারোহী সৈন্য ও কামানের সাহায্যে তিতুর দুর্গ ধ্বংস করে ও তিতুকে যুদ্ধে নিহত করে।

১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ত্রিপুরা বিদ্রোহের নায়ক ছিল কীর্তি। ত্রিপুরার যুবরাজ উপেন্দ্রচন্দ্রের চক্রান্তে গুপ্তঘাতকের হাতে কীর্তি নিহত হয়। ফরাজী আন্দোলনের নেতা ছিল ফরাজী ধর্মমতের প্রবর্তক শরিয়তুল্লার ছেলে দুদুমিঞা। তার উদ্দেশ্য ছিল এদেশের স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা, নীলকর সাহেবদের কুঠি পুড়িয়ে দেওয়াও জমিদারদের খতম করা। জনসাধারণের ওপর থেকে কর বিলোপ করে দুদুমিঞা শোষক শ্রেণির কাছ থেকে কর আদায় করত ও গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিদের নিয়ে আদালত স্থাপন করে বিচারকার্য চালাত। আন্দোলনটা ফরিদপুর জেলার মধ্যেই নিবদ্ধ ছিল ওখানে পাঁচচর গ্রামের নীলকর ডানলপ সাহেবের কুঠি পুড়িয়ে দেওয়া হয় ও জমিদার গোপীমোহনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুদুমিঞা বেঁচে ছিল। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সময় তাকে রাজবন্দি হিসাবে আটক করে রাখা হয়। দীর্ঘ কারবাসের ফলেই তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।

১৮৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দে ঘটে ‘খেরওয়ারী হুল’ বা সাঁওতাল বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহ ছিল ইংরেজ শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে। তৎকালীন ভাগলপুর জেলায় অন্তর্গত দামিন-ই-কো অঞ্চল হতে বীরভূম পর্যন্ত অঞ্চলে বিদ্রোহীদের কার্যকলাপ চলতে থাকে। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন গোক্কো ও বীর সিং নামে দুই দলপতির নেতৃত্বে সাঁওতালরা পাঁচখেতিয়ার বাজারে উপস্থিত হয়ে নির্বিচারে লুণ্ঠন এবং দারোগা ও মহাজনদের হত্যা করে। ক্রমশ বিদ্রোহ বীরভূম অঞ্চলেও পরিব্যাপ্ত হয়। সরকার প্রথম বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করতে বলে ও পরে সামরিক আইন জারি করে। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে দলপতি সিধু, চাঁদ ও ভৈরব ভ্রাতৃবৃন্দের সঙ্গে পনেরো থেকে পঁচিশ হাজার সাঁওতাল নিহত হয়। অচিরেই বিদ্রোহের অবসান ঘটে। এরপর বিট্রিশ সরকার স্বতন্ত্র সাঁওতাল পরগনা গঠন করেন, কিন্তু রাজস্ব হ্রাস করেন না।

এরই অব্যবহিত পরে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ ঘটে; যার ফলে ভারতের শাসনভার ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের হাতে চলে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *