প্রসন্ন পাষাণ – ৭

সাত

এর পরদিন দু’ই গত হয়েছে। সেদিন সন্ধ্যাবেলা আমি আমার কামরার সামনের বারান্দায় চুপটি করে দাঁড়িয়েছিলাম। এইখানটায় আমাকে দেখতে পাওয়া সহজ ছিল না।

টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল, যদিও সময়টা ঠিক বর্ষাকাল নয়। শরীরে বাদলা হাওয়ার স্পর্শ লাগছিল বেশ। সারাটা দিন অস্বাভাবিক গরম গেছে। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পর মাটি থেকে তপ্ত বাষ্প আর এক আশ্চর্য গন্ধ উঠে আসছিল। কোনো ফুলের গন্ধও বুঝি এত মিষ্টি। একেই কি বলে ভিজে মাটির গন্ধ?

বাতাসে মাথার চুল কোনো শাসন মানছিল না। আঁচলও অবাধ্য। মনটাও ছিল খারাপ। সবকিছুই মনে হচ্ছিল সৃষ্টিছাড়া। কিছুতেই যেন কিছু এসে যায় না। কিছুই চাইবার নেই। এমন কিছুই নেই যা না পেলে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি আছে। আমাদের সংসারে বৃহৎ কোনো ঘটনাও বিরল, তাই আন্দোলিত হবো বা কোনো কাজে নিয়োজিত থাকব তার সুযোগ ছিল কম। তাই আমি আমার কল্পলোকে এক নিজস্ব জগৎ সৃষ্টি করে নিয়েছিলাম। এখানে অনেক কিছুই ঘটত, যা চমকপ্রদ কিন্তু সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় তার বিবরণ থাকবার কথা নয়। মানসিক পরিণতির জন্য এইসব কল্পিত ঘটনাবলির প্রভাব কিছু কম নয়—বরং কিছু বেশি।

এখানে একটি কথা স্বীকার করব—এবং আশা করি আমার সততাকে তোমরাও উদারতা দিয়েই পুরস্কৃত করবে। বয়স অল্প হলেও, বরং বয়স অল্প বলেই আমি যে কেন এবং কোন রহস্যময় কারণে নিজেকে কোনো একটি বাংলা উপন্যাসের নায়িকার সগোত্র ও সতীর্থ কল্পনা করে এসেছি সে এক রহস্য। সে নায়িকার নাম বলব না। বলা বাহুল্য, সেই নায়িকার সঙ্গে কোনোপ্রকার অবয়বিক সদৃশতা এই দুর্বিনীত বিশ্বাসের হেতু নয়। বোধ করি বাল্যকাল থেকেই আমরা কোনো না কোনো জ্ঞাত-অজ্ঞাত, বাস্তব-অবাস্তব চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত হতে থাকি; বিশেষ করে যে ব্যক্তিটির গলার আওয়াজ, চলার ভঙ্গি, চোখমুখের নকশা বাল্যকালে আমাদের ভালো লাগে তাঁরই ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা অনুকরণ ও অনুশীলন করতে থাকি। আমাদের প্রত্যেকের রক্ত-মাংসের এই আমির মধ্যে আর একটি আমি লুকিয়ে থাকে; আমার এই দ্বিতীয় অন্তরতম আমিটি আমার পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চির এই শরীরটার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে এক স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সত্তারূপে ঘুরে বেড়ায়। সে আমার শারীরিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা প্রভাবান্বিত নয়, সে আমার শারীরিক পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমার এই রক্ত-মাংসের আমিটি এক কোণে স্থির হয়ে বসে থাকে, এবং অপর আমিটি স্বাধীনভাবে যথেচ্ছা ঘুরে বেড়ায়, এবং যেমন খুশি বৈশিষ্ট্য সে নিজের ওপর আরোপ করে এবং যখন যেখান থেকে পারে যত খুশি ঐশ্বর্য সে দু’হাত দিয়ে আহরণ করে আনে। নিজের আত্ম থেকে নিজের পরমাত্মকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব বলেই আমিও নায়িকা হতে পারি এবং বহু ললনাই ছলনাময়ী হতে পারেন।

শরীরে বেশ বড় বড় কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ল। আমি সরে এলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল কামিল দ্রুত পায়ে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। কামিল, আমার কামরায়? তাও এই অবেলার অন্ধকারে। এমন দ্রুত পলায়নই-বা কেন? পলায়ন নয়তো কি!

একবার দেখতে হয় ব্যাপারখানা কি! দ্রুত ঘরে এসে আমি সুইচ টিপে দিলাম।

দেখলাম আমার টেবিলের ওপর লাল গোলাপ ফুল, একটি নীল খাম, এবং নীল খামের ওপর পেপার-ওয়েটের মতো এক বাক্স চকোলেট।

লাল গোলাপ! নীল খাম! এরপর কোন তরুণীর হৃদয়ে সপ্তবর্ণের ঘোর না লাগবে!

ফুল? এখন থাক! চকোলেট? তাও পরে দেখা যাবে। কিন্তু নীল খামটিকে দুটি হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলাম। কম্পিত হস্তে খামটি কোনোমতে খুলে ফেললাম; চিঠিটির একটি কোণ ছিঁড়ে গেল। হ্যাঁ। চিঠিই!

আমার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র। কোনো সম্বোধন নেই এবং প্রেরকের নামও নেই। আছে শুধু লেখা এই ক’টি লাইন :

“হিন্দুদের ধর্মকাহিনীতে পড়েছি দেবী সরস্বতীর আবির্ভাবে চতুর্দিকে জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়; এবং লক্ষ্মীর আবির্ভাবে শ্রীমণ্ডিত। তোমার আবির্ভাবে পরিবেশ যুগপৎ জ্যোতির্ময় এবং হিরন্ময় হয়।”

এক নম্বর তরুণীর কাছে লক্ষ্মী-সরস্বতীর সম্মিলিত পরাভবে নিষ্ঠাবান হিন্দুর মনের অবস্থা কি হবে জানি না—আমার কিন্তু ভালো গেলেছিল।

কি এক একটা কথা। বুকের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

জ্যোতির্ময়তার গুণটি স্বভাবতই সরস্বতীর কাছ থেকে ঠিকরে আসছে; এবং লক্ষ্মী যে স্বর্ণ নিয়ে আসবেন তাও জানা কথা। কিন্তু আজ তবু আমার সন্দেহ হয় জ্যোতির্ময়তার সঙ্গে হিরণ্ময়তার আবির্ভাব নিতান্তই মিলের জন্য।

তাছাড়া প্রেমপত্রে হিন্দু দেবদেবীর এহেন আবির্ভাবের আরো একটি কারণ ছিল। হিন্দুরা প্রেমপত্র রচনায় সূক্ষ্মশিল্পে একেবারে সিদ্ধহস্ত; আমাদের সমাজের যুবকেরা তখনো শিক্ষানবিশ। তাই অনুমান করি, আমার পত্র লেখকের ‘মাস্টারপিসটি’ অন্য কোনো রচনার প্রভাব বর্জিত নয়। আমাদের ছেলেরা তখনো প্রেমপত্র প্রেরণের দুঃসাহস খুব একটা চট করে দেখাতে পারত না। কখনো চটুল কখনো গভীর এবং কখনো-বা উদাসীন দৃষ্টির ভীরু আবেদন দিয়েই তাদের হৃদয়ের ভাব নিবেদন করত।

যাই হোক, তোমরা নিশ্চয়ই জানতে চাইবে, চিঠি পেয়ে আমার লেগেছিল কেমন।

এক কথায় এ প্রশ্নের জবাব হয় না।

হাত-পা কাঁপতে থাকা, হঠাৎ বুকের ভিতর সমুদ্রের কল্লোল শুনতে পাওয়া, চকিতে চারদিক তাকিয়ে বেড়ানো, যেন কি একটা চুরি করেছি—এরই নাম যদি ভালো লাগা হয়, তাহলে আমার ভালোই লেগেছিল!

কিন্তু হাত-পা যে বাঁশপাতার মতো কাঁপছিল সে কি অসহ্য পুলকে? না গো না। এক অজ্ঞাত ভীতির রোমাঞ্চে! তার মধ্যে যে সুখের ভেজাল একেবারেই ছিল না তা আমি বলব না। কিন্তু ভয়ের আকারটাই ছিল প্রবল।

কার যেন পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম। চিঠিটাকে তাড়াতাড়ি ব্লাউজের মধ্যে দিলাম গুঁজে। দ্রুত নিশ্বাস পড়তে লাগল। চিঠিটি নদীর ঢেউয়ে মোচার খোলের মতো আমার বুকের ওপর আছাড় খেতে লাগল।

—তোর চোখমুখ অমন পাংশু কেন? অসুখ-বিসুখ করে নি তো!

ছোট চাচা ব্যস্ত ছিলেন। আমাকে একবার উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে দেখে তাঁর প্রশ্নটির উত্তরের জন্য অপেক্ষাও করলেন না, নিচে চলে গেলেন।

ঘরের দরজা দিলাম বন্ধ করে, আলো দিলাম নিভিয়ে। তারপর বিছানায় এসে আশ্রয় নিলাম। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে, আকাশে একটি দুটি তারা দেখা যাচ্ছে। আমার এই নির্জন ঘরে খাটের ওপর একা শুয়ে আমি কতদিন সন্ধ্যাকাশের তারা দেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি।

আজ দু’চোখের কুল ছাপিয়ে অশ্রু এলো নেবে।

কে জানে কেন।

.

এত সহজেই তরুণী হৃদয়ের পতন সচরাচর গল্প-উপন্যাসে ঘটে না। কিন্তু আমার তখন যে বয়স সেই বয়সে মেয়েরা ঠিক কোনো পাত্রের সঙ্গে প্রেমে পড়ে না; প্রেমের সঙ্গেই প্রেমে পড়ে। পাত্র মোটের ওপর একটা হলেই হলো। তাছাড়া প্রেমে পড়েছি বা প্রেম করছি এমন কোনো চেতনাই আমার ছিল না। একেবারে অল্প বয়সে পড়ার চাইতে যেমন পড়া-পড়া খেলা করেছি বেশি, তখন তেমনি প্রেম-প্রেম খেলারই বয়স। অন্তত আমি ময়দানে নাবলাম এই রকমেরই একটা মনোভাব নিয়ে।

তোমরা বলবে, পাত্র একটা হলেই হলো, আমার অবস্থাটা এতই যদি সঙিন হয়ে পড়েছিল, তাহলে আলীম তো আগে থেকেই হাতের কাছে ছিল। সে দোষ করল কি। আকাশে কামিল দেখা দেবে তবে আমি প্রেমের অরুণ কিরণ ছড়াব—এটার প্রয়োজন ছিল কি?

ছিল প্রয়োজন। আমার মন বলত, কামিলের কাছে আমি নিরাপদ। প্রেম স্বীকার করে নিয়েও নিজেকে ধরা না দেবার একটা কৌশল সব মেয়ের জানা আছে। ভালোবাসি, হৃদয়ের এই আবেগটির অর্থ দু’জনে কথা বলব, রোদে পিঠ রেখে কুল খাব, লাইব্রেরি থেকে তাকে দিয়ে বই আনিয়ে নেব, বড় জোর সূচি দিয়ে রুমালে নামের আদ্যাক্ষর লিখে দেব; বাস্—–এর বেশি নয়। আমি জানতাম কামিল তাতেই থাকবে খুশি কিংবা হয়তো অতটাও চাইবে না। তার বেশি সে বোঝেও না। কিন্তু আলীমের কথা আলাদা। সে হ্যাঁ বোঝে সে নাও বোঝে; কিন্তু মাঝামাঝি কোনো অবস্থা বুঝতে চাইবে না। তাকে ভালোবাসি কথাটির মানে দেহপ্রাণে ভালোবাসি; সে বয়সে আমার পক্ষে প্রাণ দেওয়া সহজ ছিল—কিন্তু অন্যটা? একেবারেই নয়। ভাবলেও আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠত; পুলকে নয়, ভয়ে।

তাছাড়া সত্যি সত্যি একটি গোটা পুরুষ মানুষের সঙ্গে প্রেম করছি মন এ কথাটি জানতে পারলে এর মধ্যে যে নির্দোষ ক্রীড়াটুকু ছিল তা আর নির্দোষ থাকত না।

সুতরাং কামিল—আলীম নয়।

সেই কারণেই কামিলের চিঠি আমি খুলে পড়েছিলাম; আলীমের হলে পড়তাম না।

অতগুলো চকোলেট একা বসে বসে খাব, এটা কেমন হয়; তাই একটা রুমালে কিছু চকোলেট বেঁধে নিয়ে নিচে এলাম। ছোট ফুপুর ঘরে কেউ ছিল না। সাবধানে চারদিক দেখে নিয়ে সকলের অগোচরে সেই ঘরে প্রবেশ করলাম। বস্তুত এই প্রথম আমি কামিলদের কামরায় এলাম। কামিলের পড়বার টেবিলটি কোথায় আমি বারান্দা থেকে দেখে রেখেছিলাম। কতগুলো বইয়ের আড়ালে রুমালসুদ্ধ চকোলেট রেখে দিয়ে আমি আবার সন্তর্পণে বেরিয়ে এলাম।

পরদিন বিকেলবেলা ছাতের ওপর মাদুর বিছিয়ে একা বসে আছি। একটু আগেই গা ধুয়েছি। গায়ে বাসন্তী রঙের শাড়ি; খোঁপায় বেলফুল। বিকেলের হাওয়া চোখেমুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। সোনা মাখা রোদ মিষ্টিমিষ্টি হাসছিল। আকাশের গায়ে অনেকগুলো ঘুড়ি উড়ছে; বসে বসে তাই দেখতে থাকি।

এমন সময় কামিলও এলো ছাতে। সত্য বলতে কি আমি যেন এইটেই আশা করছিলাম, এরই অপেক্ষায় বসেছিলাম। তবু ত্রস্ত হয়ে পড়লাম।

কামিল সোজা আমার কাছে এগিয়ে এসে বললো : তোমার মন বড় ভুলো।

এতক্ষণ কামিল সম্পর্কে যা বলেছি তা শুনে তাকে তোমাদের নির্বোধ মনে হয়েছে কিনা জানি না। নির্বোধ সে ছিল না। তার মধ্যে এমন একটা সারল্য ছিল যে তারই আড়ালে তার বুদ্ধিমত্তা গোপন থাকত।

—তোমার বড় ভুলো মন। আমার টেবিলে রুমাল আর চকোলেট ফেলে এসেছ!

আকাশে একটি ঘুড়ি কেটে গেল। পাক খেতে খেতে ঘুড়িটি যে কোথায় ভেসে যাচ্ছে কে জানে। সেদিকে চোখ রেখে বললাম : ভুলো মন নয়। ফেলেও আসি নি কিছু।

—চিঠি, পেয়েছ?

জবাব দিলাম না।

—পড়েছ?

এবারও নিরুত্তর।

—তা এ সম্পর্কে তোমার মনোভাব কি?

এবার জবাব দিলাম : মনোভাব তো মনোভাবই। তা জানতে চাও কেন?

—আমি তো চাইনে।

আমার দৃষ্টিতে বিস্ময় দেখে কামিল আবার বললো : আমি তো চাইনে। জানতে চায় আলীম ভাই।

—চিঠি কার?

—চিঠি, চকোলেট সবই আলীম ভাইয়ের। আমাকে তোমার পড়বার টেবিলে রেখে আসতে বলেছে।

সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশা কেটে গেল। আগেই বোঝা উচিত ছিল। লাল গোলাপ। চকোলেট। নিজেকে শতভাবে ধিক্কার দিতে লাগলাম। এত বড় ভুল কি করে করলাম।

আর বসে থাকতে পারলাম না। উঠে পড়লাম।

—তোমার রুমাল যে পড়ে থাকল!

রুমালটি তুলে নিলাম; চকোলেটগুলো ফেললাম ছুঁড়ে। কামিল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। আমি আর বিলম্ব না করে নিজের ঘরে ফিরে এলাম।

চুপ করে বসে থাকি জানালার ধারে। এখন বেশ জোরে হাওয়া দিচ্ছে। হু-হু শব্দে জানালার পর্দা নড়ছে। গাছের পাতায় আর বাড়ির দেয়ালে হাহাহা করে আছড়ে খাচ্ছে বাতাস।

আমার কানে তা আলীমের সেই হাহ হাহ হাসির মতোই বীভৎস হয়ে বাজতে থাকল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *