প্রসন্ন পাষাণ – ১৪

চৌদ্দ

সেদিন ছোট চাচার ঘরে কামিলকে আসতে দেখে আশ্চর্য হলাম। আমাদের এই সংসারেই কামিলের বাস, তবু তাকে সংসারের একজন বলে মনে হয় না। সে আজকাল থাকে একা একা, বাইরে গেলেও একাই যায়। তার ভ্রমণ তার আগমন তার আহার তার শয়ন তার আমোদ তার বিষাদ সে সম্পূর্ণ আর একান্তরূপেই নিজের এখতিয়ারের মধ্যে রাখে। এমনকি আলীমের সঙ্গে তার যে বন্ধুত্ব মুকুলিত হয়ে উঠছিল তাও মনে হয় ফুটবার আগেই ঝরে পড়ল। এমনকি সে যেন আজকাল তার নিজের মাকেও এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। বাড়িতে ছোট চাচা ফুপুজান আমি এই তিনটি প্রাণী বাস করি এ চেতনা পর্যন্ত তার ছিল বলে মনে হতো না। বিশেষ করে ইদানীং। তাই সেদিন সকালে ছোট চাচার কক্ষে কামিলের পদার্পণ আমার বক্ষেও একটা আন্দোলন উপস্থিত করল। তার আগমন অপ্রত্যাশিত কিন্তু আকাঙ্ক্ষিতও— তাই এই আন্দোলন।

আজ কামিলকে দেখে মনে হলো কতদিন যেন তাকে দেখি নি। তার চোখমুখের চঞ্চল রেখাগুলো স্থির হয়ে এসেছে; দৃষ্টিতে এক অনির্বচনীয় বিষ্ণণ্ণতা; চিবুকে এক প্রকার দৃঢ়তা। তার গায়ের রঙ আগের তুলনায় ফর্সা মনে হয়; আগের তুলনায় একটু মোটাও হয়েছে। সবকিছু মিলে বেশ একটা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অভিব্যক্তি যা পূর্বে অনুপস্থিত ছিল।

ছোট চাচা একটা টেবিলের কাছে চেয়ার টেনে নিয়ে চিঠি লিখছিলেন; সামনের জানালা খোলা। সকালবেলার হাওয়া তখন কামরার ভিতর কানাকানি শুরু করে দিয়েছে; টেবিলের উপরকার সাদা কাগজগুলো যদি কিছুতেই স্থির থাকে। ছোট চাচার পাশে দাঁড়িয়ে বাতাসের উপদ্রব বাঁচিয়ে আমি পাতাগুলোকে যথাসম্ভব সংযত রাখতে চেষ্টা করছিলাম। টেবিলের এক পাশে এক পেয়ালা গরম চা রাখা ছিল, এখন অবশ্য আর গরম বলা চলে না। চা খেতে হবে ছোট চাচার এ হুঁশ পর্যন্ত ছিল না। অবশ্য আমি বরাবর দেখেছি, ছোট চাচা যখনই বরাদ্দের অতিরিক্ত চায়ের ফরমায়েশ করতেন, তার একটু পরই ফরমায়েশ ভুলে যেতেন তা না হলে চায়ের কথাই ভুলে যেতেন।

কামিলকে দেখে ছোট চাচাও অবাক হলেন। ঘাড়টা কামিলের দিকে কাত করে জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে থাকলেন। সামনের চেয়ারটি দেখিয়ে কামিলকে বসতেও ইশারা করলেন।

—একটা নতুন খবরের কাগজ বের হচ্ছে; চেষ্টা করলে সাব-এডিটরের কাজ পেতে পারি। -চেষ্টা করছ না কি?

—আপনার অনুমতি পেলেই করি।

আমারই অনুমতির যদি অপেক্ষা তাহলে অনুমতি নেই; কিন্তু তোমার মা কি বলেন?

—মা কারো ইচ্ছায় বাধা দেন না।

—এমনকি তোমার ইচ্ছাতেও নয়? এমন বেয়াড়া ইচ্ছা তোমার হলো কেন?

—যা হোক একটা কিছু করতে তো হবে!

—যা হোক একটা কিছু করলেই কি হবে?

—সাংবাদিকতা এমন আর মন্দ কি!

—সাংবাদিকতা মন্দ আমি বলি নে। তুমি যদি মনে কর সাংবাদিকতার দিকেই তোমার সহজ প্রতিভা তাহলে আমি উৎসাহই দেব। কিন্তু সবকিছুরই একটা সময় আছে। আগে লেখাপড়া শেষ করে।

—সাংবাদিকতাই যদি করি, ডিগ্রি নিয়ে কি হবে!

ছোট চাচা অনেকক্ষণ কোনো জবাব দিলেন না। একটু পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

—তোমার বয়স হলো কতো?

—বিশ হয়ে গেছে।

—এখনো তো বললে না হঠাৎ রোজগার করবার প্রয়োজনটা কবে থেকে বোধ করছ।

—নিজের পায়ে দাঁড়াতে তো হবে!

—তা হবে। কিন্তু এভাবে যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাও, তোমার পা জোড়াই কমজোর হবে, তা দিয়ে দাঁড়াবার কাজ ভালো চলবে না। যদি শক্ত হয়ে দাঁড়াতে চাও লেখাপড়াটা শেষ কর। আর যে ডিগ্রি তোমার না হলেও চলে বলছ সেই অনাবশ্যক বাহুল্যটুকুর জন্যই এখন ভালো করে মন দাও। লেখাপড়া শেষ না করেই যদি এখন সংবাদপত্রের অফিসে প্রবেশ কর তাহলে বেরিয়ে আসবার আর পথ পাবে না। এটুকু সেরে নিলে তোমার সাংবাদিক অভিজ্ঞতা অরুচিকর ঠেকলে অন্য পথ খোলা পাবে। তাছাড়া সাংবাদিকতা করলে ডিগ্রি লাগবে না কেন তাওতো বুঝি না। আর হ্যাঁ তুমি বাড়ির ছেলে, আমি চাই বাড়ির ছেলের মতোই নিজের অধিকারটুকু প্রতিষ্ঠিত করে নেবে।

আমি বাস্তবিকই হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। এক সঙ্গে এত কথা কামিলের মুখে আমি কোনোদিনই শুনি নি। সে যে হঠাৎ উপার্জনের ফিকিরে ঘুরতে শুরু করেছে এ খবরটা বিস্ময়কর হলেও ছোট চাচার সঙ্গে বিতর্ক করতে পারার মতো অতটা বিস্ময়কর মনে করি নি। এ সেই কামিল যাকে আমি এতটাকাল আলীম গ্রহের উপগ্রহ বলেই মনে করে এসেছি। সেও যে ছোট চাচার কাছে দাঁড়িয়ে অল্প কথায় বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই নিজের মতামত ব্যক্ত করতে পারে তা আমি ভাবি নি। আমার মনে হয় ছোট চাচাও অবাক কম হন নি।

কামিল আর কোনো কথা না বলে চলে যাচ্ছিল।

ছোট চাচা বললেন : দাঁড়াও একটু।

এবার ছোট চাচা কামিলের কাছে চেয়ার টেনে এনে কামিলের ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে প্রশ্ন করলেন : এখানে কি তোমাদের কোনো কষ্ট হচ্ছে?

ছোট চাচার কণ্ঠ ভারাক্রান্ত; হঠাৎ তাঁর দৃষ্টিও যেন এক অজ্ঞাত অপরাধের লাঞ্ছনায় সঙ্কুচিত হয়ে এলো। এও আমার জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা। ছোট চাচাকে বচনে বা আচরণে আবেগ প্রকাশ করতে কেউ বড় একটা দেখে নি।

কামিল একটু যেন ইতস্তত করল। তারপর বললো : কষ্ট? একেবারেই না! এইখানে কামিলের গলাও একটু কেঁপে উঠল। তারপর সে যোগ করল : কিন্তু মায়ের প্রতি আমার একটা কর্তব্য আছে তো।

নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আপাতত তোমাদের উভয়ের প্রতি আমাদের একটা কর্তব্য আছে। সেখানেই কোনো ত্রুটি হচ্ছে কিনা জানতে চেয়েছিলাম।

কামিল বুঝল এখানেই এ প্রসঙ্গ শেষ। এবার সে চলে গেল।

ছোট চাচা চিঠি শেষ না করেই উঠে পড়লেন। রাস্তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন। কপালের ওপর চিন্তার রেখা। দৃষ্টিতে এক প্রশ্ন যার উত্তর মিলছে না মনে হয়।

অনেকক্ষণ পর তিনি আমাকে জিগ্যেস করলেন : কামিল কোন ক্লাসে পড়ে রে? —এবার আই.এ দেবে।

—পড়াশোনায় কেমন?

—আছে একরকম।

—হঠাৎ রোজগার করবার কথা ভাবছে কেন বলতে পারিস?

—না।

ছোট চাচা এবার চুপ করলেন। আয়নার কাছে দাঁড়িয়ে মাথায় দ্রুত চিরুনি বুলিয়ে নিলেন, তারপর আলনা থেকে পাঞ্জাবিটাও নিলেন টেনে।

চাচা বেরুচ্ছ না কি?

হ্যাঁ একটু ঘুরে আসি।

বলেই তিনি গমনোদ্যত হলেন; কিন্তু পরক্ষণেই দাঁড়িয়ে পড়ে আমাকে উদ্দেশ করে বললেন : একটু চোখ রাখিস রে। এ বাড়িতে কেউ যেন কষ্ট না পায়।

ফুপুজান সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। ছোট চাচাকে তাঁর কি যেন বলবার ছিল। কিন্তু ছোট চাচা সেদিকে একটিবার মাত্র দৃকপাত করেই একটু অকারণ দ্রুততার সঙ্গেই বেরিয়ে চলে গেলেন। একটুও অপেক্ষা করলেন না।

সন্ধ্যাবেলা ঠিক কোন সময়টিতে হঠাৎ অন্ধকার নেবে আসে, সকালবেলা অন্ধকারের যবনিকা সরে গিয়ে ঠিক কোন সময়টিতে পূর্ব দিগন্ত ফর্সা হয় তা যেমন শত চেষ্টা করেও বুঝতে পারা যায় না, তেমনি কামিল যে কবে তার কৈশোরের খোলস ছেড়ে এমন একটা সহজ আত্মপ্রত্যয়ে স্থির ব্যক্তিত্ব লাভ করল, সেই বিশেষ লগ্নটিও আমার চোখে পড়ে নি। সে যে এইভাবে পরিণত হয়ে উঠবে সেটাই স্বভাবের নিয়ম; কিন্তু তার এই বেড়ে ওঠাটা চক্ষুর অন্তরালেই ঘটেছে বলে আজ তার পরিণত রূপটি দেখে চমকই লাগল। জানি না কেন আমার মনটাও খুশিতে নেচে উঠল। আমিও যেন এই দিনটির অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সে যে এভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবার অঙ্গীকার করে বসবে তেমন সম্ভাবনার কথা কোনোদিনই আমার মনে হয় নি। তাই তার পরিবর্তনের এই দিকটায় মনে একটা খটকাও লাগল।

সকাল গড়িয়ে দুপুর এলো প্রায়। কনিজ এইমাত্র ধোপার কাছ থেকে কাপড় বুঝে নিয়ে উঠে এলো। খবরের কাগজঅলা অসময়ে কিছু আগামের জন্য দরখাস্ত পেশ করে দরজার কাছে অপেক্ষা করছে তার সাইকেলের টায়ার কিনতে হবে। ফুপুজান সে কথায় কর্ণপাতই করছেন না। ছোট ফুপু একরাশ তরিতরকারি মাছ-আঁশের মাঝখানে বসে বঁটি দিয়ে গোল করে কালো বেগুন কাটছেন। পাশের বাড়ির ছেলেরা ক্যারাম খেলছে, তারই অবিরাম খটাখট শব্দ কান ঝালাপালা করে দিতে চায়। সম্মুখের বাড়ির নতুন মাটির কোলে তার দু’মাসের শিশুটি শুধু কাঁদছে শুধু কাঁদছে; বেচারি মায়ের প্রাণপণ ঘুমপাড়ানি গান কোনো কাজেই আসছে না। রাস্তায় দেখি ফেরিঅলা একটা ঠেলায় পিরিচ পেয়ালায় দোকান সাজিয়ে ঝুনঝুনি বাজিয়ে চলেছে। ছেলেরা ভিড় করে আসে কিন্তু সওদা বিক্রি তেমন হয় না। কলাগাছের তলায় এই অবেলায় মোরগ ডাকছে।

আমি দোতলার সিঁড়ির কাছে রেলিংয়ে ভর দিয়ে সংসারযাত্রা দেখতে থাকি। এর মধ্যে আমার স্থান কোথায়? তরকারি কোটা কাপড় কাচা আর সময় হলে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানো, তারপর পাঁচজনকে পাঁচদিনের জন্য হাসিয়ে আর কাঁদিয়ে রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায়। এই তো জীবন। এ-ভাবে বেঁচে থেকেই-বা লাভ কি, মরে গেলেই-বা ক্ষতি কি। এই যে ফুপুজান খবরের কাগজঅলার আর্জিতে কান দিচ্ছেন না- কেন দিচ্ছেন না? ঐ যে দেখছি চৌবাচ্চার কাছে দাঁড়িয়ে জাফর কনিজের গায়ে মুঠি মুঠি পানি ছড়িয়ে দিচ্ছে, আর কনিজ কপট কোপে সাপের মতো ফোঁস করে উঠছেন এইবা কেন? এক অন্ধ ভিখিরিকে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক হাত ধরে রাস্তা পার করে দিলেন এটারই-বা কি দরকার ছিল। আমি কোনটা চাই? কাগজঅলাকে ফিরিয়ে দিতে? পানি ছুঁড়ে খেলা করতে? অন্ধকে পথ দেখাতে?

একদিন আমি থাকব না কিন্তু এসবই থাকবে। তবু সম্মুখে এক নিঃসীম শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই না। আমার জ্ঞান আমার বুদ্ধি আমার পরিবেশ সবকিছুরই সীমাবদ্ধতা আমার গলা টিপে ধরতে চায়। এটা ভালো সেটা খারাপ ওটা কাম্য এই রকম কতগুলো কথার শিকল দিয়ে আমাদের হাত পা মন সবকিছুই বাঁধা।

কখনো ছোট ফুপুর সঙ্গে বসে গল্প করতে, কখনো কামিলকে এক পলক দেখে নিলে ভালো লাগে। কিন্তু অল্পক্ষণেই এই ভালো লাগাটুকু ফুরিয়ে যায়। হয়তো নিমেষের আয়ু বলেই ভালো লাগে; মেয়াদ বেশি হলে হয়তো ক্লান্তির ঢেউ এসে মনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত।

পড়াশোনা ভালোই লাগে। কিন্তু বইয়ের জগৎ থেকে বেরিয়ে এলেই আবার হাঁফ ধরে যায়। কেতাব ছাড়াও এখন একটা অবলম্বন আবশ্যক হয়ে পড়েছে, যা আঁকড়ে ধরে আমি বেঁচে থাকব। আমি ভালোবাসতে চাই; ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে চাই; জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে আশ্চর্য মূল্যজ্ঞানে অপার করুণায় অসীম প্রেমে অফুরন্ত বিস্ময়ে উন্মীলিত দেখতে চাই। কে বলে দেবে আমি কি খুঁজে বেড়াই। কবে আমার দিনরাত্তির অর্থময় দৃষ্টি মেলে তাকাবে।

আব্বা সরকারি কাজে এলেন কলকাতায়। এমন মাঝে মাঝে আসেন। দিন তিনেক থেকে আবার ফিরে যান। একটি একটি করে দিনও গড়িয়ে যেতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *