২০
থিয়েটার হয়ে গেল।
আমাদের কলেজের মঞ্চটা বেশ ভালো। সামনে লাল ভেলভেটের পুরু পর্দা, পিছনে পটের ছবিগুলো, হলের সুসজ্জিত জেনানামহল এবং মায়াবি আলো—সব মিলে আজকের এই সন্ধ্যাটি স্বপ্নলোকের মনে হচ্ছিল। আমরা যারা অভিনয় করলাম, আমাদের পরনেও নাটকোপযোগী সজ্জা। সত্যকার মণিপুর রাজকন্যা এমনই কি স্বতন্ত্র ছিলেন?
গান, বাজনা, আলোকসজ্জা, দর্শকের নিশ্বাসের অন্তরঙ্গতা, অনেক মূল্য দিয়ে কেনা সুগন্ধ, নৃত্য—সবকিছুই একই সূত্রে গাঁথা। একই সমগ্রের বিভিন্ন অঙ্গ। একটিকে বাদ দিলে সমগ্ৰ পরিবেশের অঙ্গহানি হয়।
যতক্ষণ অভিনয় চললো প্রেক্ষাগৃহ একেবারে নীরব ছিল। অভিনয় শেষ হলো, তারপরও বেশ কিছুটা সময় কক্ষটি মৌন। তারপর যেভাবে বৃষ্টি ভেঙে পড়ে সম্বৃত অম্বর থেকে, হঠাৎ তেমনি তুমুল করতালির আতশবাজি শুরু হয়ে গেল। দর্শকেরা অন্ধকারে বসেছিলেন, আবছা আবছা ছায়ার অতিরিক্ত কোনো অস্তিত্বই তাঁদের নেই; ঘরটির অন্ধকার একটি সমুদ্রের মতো স্তব্ধ হয়ে আছে; দর্শকেরা তারই তলায় ডুবে আছেন। আলো জ্বলল, অন্ধকার গেল তলিয়ে নিচে, দর্শকেরা ভেসে উঠলেন।
আমি দ্রুত সাজঘরে গিয়ে কাপড় বদলে এলাম। সত্য কথা বলতে কি, আমার সব কটি স্নায়ু যেন শরীরের ভিতর ছোট ছোট বালবের মতো জ্বলে উঠেছিল—উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছিল। এখনো আমি কারো বাহবা শুনি নি, কিন্তু বেশ জানতাম, অভিনয় আমার ভালোই হয়েছিল। বস্তুত নাটকটিকে আমিই উতরে দিয়েছি। এটা দম্ভ নয়। শিল্পকর্ম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে বোধ করি সব শিল্পীই তা সর্বান্তকরণ দিয়ে উপলব্ধি করেন। এ ব্যাপারে দর্শক বা পাঠক বা শ্রোতাকে ফাঁকি দিতে পারলেও শিল্পী নিজেকে ফাঁকি দিতে পারেন না।
অল্পক্ষণ পরই আমি আবার সবার মাঝে ফিরে এলাম। মানুষগুলো চক্রাকার স্রোতের মতোই তখনো সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখলে মনে হবে সকলেই কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে; কিন্তু ঠিক কোন বস্তুটি তা বুঝি জানে না। এখনই সেখানে ছুটে গেল, পরক্ষণেই আবার সেখান থেকেই দ্রুততর বেগে ফিরে এলো।
প্রেক্ষাগৃহের একেবারে প্রথম দু’তিন সারি চেয়ারগুলোর নিচে কার্পেট পাতা ছিল। একেবারে সামনে একটি বড় সোফার ওপর প্রধানমন্ত্রী বসে আছেন। তাঁকে ঘিরে আছেন প্রিন্সিপাল, স্টাফের অন্যান্য সিনিয়র অধ্যাপিকা এবং আরো অনেকে যাঁদের চিনতাম না।
আমাকে দেখেই প্রিন্সিপাল ছুটে এলেন।
—এই যে তিশনা! আচ্ছা মেয়ে যা হোক। আমরা তোমাকে পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর তুমি ছিলে কোথায়?
আমি কেমন অভিভূত হয়ে পড়লাম। কোনো জবাব দিতে পারলাম না। প্রিন্সিপাল যে একটা জবাব আশা করছিলেন তাও মনে হলো না।
প্রিন্সিপাল আমার হাত ধরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে টেনে আনলেন।
পর্বতের মতো উঁচু আর বিশাল লোকটি। কেমন করে যেন বটগাছের কথা মনে করিয়ে দেয়। চোখের দৃষ্টি আকাশের মতো অবারিত অমল উদার। একটু যেন উদাসীনও। মাথায় লাল রঙের তুর্কি টুপি, পরনে শেরওয়ানি আর পাজামা। শেরওয়ানির দু’একটা বোতাম খোলা, ভিতরে মলমলের পাঞ্জাবি স্থানে স্থানে ছেঁড়া—চোখে পড়ে।
—স্যার, এই মেয়েটিই তিশনা। এর কথাই আপনাকে বলছিলাম। কলেজের গৌরব।
প্রধানমন্ত্রী একটুখানি হাসলেন। মাথাটি ক্লান্তভাবে চেয়ারের এক পাশে কাত করে তাঁর সেই দুটি চোখ তুলে একবার প্রিন্সিপালের দিকে তাকালেন। তাঁর সে দৃষ্টিতে কি যে ছিল বোঝাতে পারব না। তারপর সেখান থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন—এমনভাবে সরিয়ে নিলেন দেখে মনে হলো তিনি প্রিন্সিপালের সান্নিধ্য থেকে উঠে অন্য কোথাও চলে গেলেন। এবার তাঁর দুটি চোখ এসে পড়ল আমার ওপর। আর একবার তাঁর হাসি দেখলাম। মৃন্ময় পর্বত চিন্ময় হলো। আশ্চর্য সে হাসি। শিশুর মতো সরল, ক্ষমায় ধৌত; চোখ দুটি অপার স্নেহে মোমবাতির শিখার মতো স্নিগ্ধ, প্রসন্ন আর শান্ত।
একটি হাত বাড়িয়ে তিনি আমাকে কাছে টেনে আনলেন।
—মা তোমার নাম?
জলদগম্ভীর কণ্ঠ। কিন্তু মনে হলো মমতার সমুদ্র মন্থন করে কোনো এক অতল থেকে তাঁর আওয়াজ উঠে এলো।
—জি, আমার নাম—তিশনা ইয়াসমিন।
—তোমার আব্বা?
—মৌলবী নজরে পীর।
—দেশ কোথায় মা?
—শিরগ্রাম।
–যশোরের শিরগ্রাম?
—জি।
—তোমার আব্বার নাম নজরে পীর না? নোয়াখালীর ডি.এম?
–জি।
—বসো মা বসো। আমার কাছে একটু বসো।
বৃদ্ধ চেয়ারে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে সম্মুখে স্টেজের পর্দার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কিন্তু সে দৃষ্টি যে তখন কোন সুদূরে কে বলতে পারবে। তাঁর চোখে অতীতের কত যে বিস্মৃতিপ্রায় স্মৃতির আলোছায়া খেলা করতে লাগল। আমাদের দু’জনের মাঝখানে নীরবতার একটা পর্দা ঝুলতে থাকল। কিন্তু এই নীরবতার দিগন্তকে আবার বিদ্যুতের মতো ঠিকরে দিল তাঁর সেই হাসি—একমাত্র মাতৃক্রোড়ে শিশুর মুখে যে হাসি দেখেছি, সে হাসি।
তিনি বললেন : তোমার বড় চাচা যখন ছোট কি করেছিল জানো? মোতাহার নামে তোমার এক চাচা ছিলেন—শোনো নি তাঁর কথা? ভালো সেতার বাজাতেন। একদিন লাট্টু খেলবার সময় ঝগড়া করে তোমার বড় চাচা মোতাহারের পেটের মধ্যে একটা নরুণ ঢুকিয়ে দিল। তোমার বড় চাচাকে দেখেছ?
—জি না।
—কি করেই-বা দেখবে। তোমার চাচাদের মধ্যে সবচাইতে বড়। তোমার আব্বার চাইতে অনেক বড়। বেচারা ডিপটি হয়েছেন শুনে গ্রামে ফিরলেন, খোদার কি মর্জি, সেইদিনই সাপের কামড়ে শেষ। তোমার দাদা সেই যে গ্রাম ছাড়লেন আর কোনোদিন ও-মুখো হন নি। তোমার দাদাও মস্ত লোক ছিলেন। ওঁর মতো পণ্ডিত সে জমানায় খুব কম ছিল। তুমি কখনো দেদে গেছ?
বলেই তিনি হেসে ফেলেন।
আমারও হাসি এলো।
বললাম : জি না।
—তোমার ছোট চাচা শুনি এখানেই থাকে। কিন্তু কোনোদিন দেখা করল না। ভাবে আমি বুঝি উমেদার মনে করব। কিন্তু ওকে মনে করিয়ে দিও ওস্তাদের কাছে মাঝে মাঝে আসতে হয়। আমার কাছে ও ফার্সি শিখত শোন নি! তুমি আরবি-ফার্সি পড়? চর্চাটা রেখো।
এইবার তিনি উঠে পড়লেন।
হলে লোক গমগম করছে। কিন্তু সবার ওপরে তাঁর মাথা। লাল টুপিটাও গিরিশৃঙ্গের মতো চোখে পড়ে। সবার আগে চোখে তাঁকেই পড়ে। তার কারণ এ নয় যে তিনি উজির। ফকির হলেও তাঁকেই সবার আগে চোখে পড়তো।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিনি অনেকের সাথেই আলাপ করলেন। বিগত দিনের কত কাহিনী। সবাই ভুলে গেল তিনি প্রধানমন্ত্রী; সকলের মাথার ওপর সূর্যের মতো জেগে উঠল শুধু একটি মানবিক সত্তা। সকলের, সকলের পিতার এবং অনেকের পিতামহের বন্ধু। আর কিছু নয়, একটি মানুষ।
লোকজন দু’পাশে সরে গিয়ে পথ করে দিল। পথে পুলিশ আর সার্জেন্টরা ডিউটিতে ছিল। তারা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তিনি কোনোদিকে দৃকপাত না করে সোজা অপেক্ষমাণ মোটরের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর লাল-সাদা কম্বিনেশন স্যুর মৃদু আওয়াজ শোনা যায়। লাল টুপিটার বেণির মতো ফিতেগুলো অবাধ্য কিশলয়ের মতো একটু একটু নড়তে থাকে।
সার্জেন্টের হুইসিল পড়ল। তাঁর গাড়ি দিল ছেড়ে। মোটরে জানালার শার্সির কাছে তাঁর মাথাটি আর একবার দেখা গেল। আমিও যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলাম। মনে পড়ল সেই বিখ্যাত লাইন : Here is God’s plenty…
একে একে সকলেই বিদায় নিলেন। আমি নাট্যের নায়িকা। কলেজের কর্তৃপক্ষস্থানীয়দের অন্যতম হয়ে আমিও অভ্যাগতদের একে একে বিদায় দিলাম। কেউ হাস্য দিয়ে কেউ অল্প একটু স্পর্শ দিয়ে, কেউ মাল্য দিয়ে আমার অভিনয়ের তারিফ করে গেলেন। এতক্ষণে কক্ষটি শূন্য হলো।
কিন্তু ঠিক শূন্য নয়। এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা এক কোণে তখনো দাঁড়িয়েছিলেন। আমি বহুক্ষণ তাঁকে লক্ষ করছি। শুধু তাঁর চোখমুখই নয়, ডিবা থেকে পান বের করা থেকে শুরু করে তাঁর হাসিটুকু তাঁর দৃষ্টিটুকু তাঁর দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটুকু সবকিছুর ভিতর দিয়েই এক অসামান্য আভিজাত্য উচ্চারিত হচ্ছিল। কিন্তু বিশেষ করে তাঁর হাসিটুকু। চোখ আর ঠোঁট একই সঙ্গে এমন প্রসন্নভাবে হেসে ওঠে যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেবল তাই দেখতে ইচ্ছে করে। বেশ মোটাসোটা মানুষটি; গায়ের রঙ একেবারে ধবধবে ফর্সা। পরনে দামি সিল্কের সাদা শাড়ি।
—তুমিই তিশনা! ঐ দেখ, আবার জিগ্যেস করছি। আমি যেন জানি না! তুমি করে বললাম বলে কিছু মনে করলে না তো।
—না না। কি যে বলেন।
—তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?
আমি অবাক হলাম। তবু বলতে হলো, এই ফুপু আছেন, চাচা আছেন!
—তোমার আব্বা?
—তিনি সরকারি কাজ করেন। মফস্বলে থাকেন।
—আর আম্মা?
—আম্মা নেই।
—আহা!
বলেই তিনি আমাকে বুকের কাছে টেনে নিলেন।
–তোমার বাড়ির ঠিকানাটা আমাকে একবার দেবে না!
তাও দিতে হলো।
একটি ছেঁড়া কাগজে তাড়াতাড়ি তিনি ঠিকানাটা লিখে নিলেন।
—আল্লাহ্ চাহেতো আবার দেখা হবে। এবার আসি।
বলে তিনি চলে গেলেন।