তিন
কলকাতা শহরেই আমার জন্ম। এই শহরের বাইরে বাংলাদেশের যে ভূখণ্ডটি পড়ে থাকত তা বিশ্ববিধাতার সৃষ্টিক্ষমতার এক বিপুল অপচয়, অন্যান্য বহু নাগরিকের মতোই আমারও এই অহমিকা ছিল। পল্লী অঞ্চল সম্পর্কে আমার জ্ঞান প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রবন্ধ সঙ্কলন থেকেই আহরিত। ‘ম্যালেরিয়া’ শীর্ষক প্রবন্ধে পল্লীর যে ছবি আঁকা হয়েছে তাকে রোমাঞ্চকরই বলতে হবে—এবং যদিচ ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ যে ফ্রেমে আঁটা দৃশ্য চোখের সামনে ঝুলিয়ে দেয় তার সঙ্গে প্রথমোক্তর কোনোই সদ্ভাব নেই, তথাপি পল্লী বলতেই আমি বুঝতাম এমন এক অঞ্চল যেখানে পদে পদে খানা-ডোবা, মশা মাছি, সাপ খোপ, সন্ধ্যা হলেই অন্ধকার আর ঝিল্লীরব, গৃহে গৃহে প্লীহা আর ম্যালেরিয়া এবং মাঠে আবর্জনা। নিকোন উঠোনে হারিকেন লণ্ঠন এবং বর্ষার দিনে বড় বড় চাকার দাগ কেটে ছাউনি দেওয়া গরুর গাড়ির মন্থর অধিগমন কেবল এই দুটি দৃশ্যই ব্যতিক্রমের মতো আমার চিত্তকে বড়ই টানত।
গোলমালটাও বাধল সেই কারণেই।
শিরগ্রাম থেকে আমার বিধবা ফুপু—দূর সম্পর্কের—তাঁর একমাত্র সন্তান কামিলকে নিয়ে কলকাতায় আমাদের আশ্রয়ে এসে উঠলেন। তাঁদের বেশবাস চালচলন দেখে আমিও বাড়ির আর দশজনের মতো তাঁদেরকে অনুকম্পার চোখে দেখতে শুরু করলাম। তাঁরা আমাদের মুখাপেক্ষী এইটিই অনুকম্পার কারণ নয়। আমাদের সংসারযাত্রায় সুনির্দিষ্ট সুউচ্চ পথে চলতে গিয়ে যখন পদে পদে তাঁদের পদস্খলন হতে লাগল তখন বাড়ির দাস-দাসীসহ আমিও হাস্য গোপনের কপট চেষ্টায় বরং হাসিটিকে আরো নির্ভুল করে তুলতাম। এই ভাগ্য বিড়ম্বিতা শহুরে সভ্যতার নবারুণ সইতে না পেরে আড়ালে-অন্ধকারে আত্মগোপন করেই আত্মরক্ষার চেষ্টা করলেন। নিঃসঙ্গ একাকীত্বের প্রাচীর চারদিকে তুলে দিয়েই কি তিনি পরিত্রাণ পেয়েছিলেন? আঘাত করবার জন্যই যে উদ্যত প্রতিপক্ষকে পশ্চাদপসরণ করতে দেখলে বরং তার বিক্রম বেড়েই যায়। তাই ছোট ফুপু যতই পিছপা হলেন আমাদের খড়গহস্তও ততই অগ্রসর হলো। আমি ছিলাম এই স্নায়ুযুদ্ধের প্রবল পক্ষের একেবারে শেষ সারিতে, কারণ আত্মগোপন করেও সেখান থেকে তর্জন-গর্জন করা যায়। এমন নয় যে নির্মম এর প্রতিই আমার সমর্থন ছিল; বরং নিগৃহীতের প্রতিই আমার সত্যিকার টান ছিল। এক নিরপরাধ আশ্রয় প্রার্থীকে এভাবে নির্যাতিত করা যে গৌরবের নয় আমি জানতাম—এবং এই নিষ্ঠুর খেলায় আমার অন্তরের সায় ছিল না। তবু আমি ছিলাম শহরের প্রতিনিধি এবং ছোট ফুপু গ্রামের এবং লড়াইটি গ্রাম বনাম শহরের মধ্যে। সুতরাং যতই অন্যায় হোক বিপক্ষের দলে ভিড়ে বিশ্বাসঘাতকতা তো আর করতে পারি না। তাই ধরেই নিয়েছিলাম, বাড়ির দাস-দাসীসহ ফুপুজানের পক্ষে এবং ছোট ফুপুর বিপক্ষে দাঁড়ানোই আমার কর্তব্য। আরো একটি কারণ ছিল।
ছোট ফুপু আর কামিলকে সংস্কার করাই বাড়িসুদ্ধ সকলের যুদ্ধাভিযানের বিঘোষিত উদ্দেশ্য। সমস্ত বাড়ির রোষই এই মাতা-পুত্রের ওপর। সুতরাং গোটা বাড়ির প্রতিকূলতা করে এই মাতা-পুত্রের পক্ষে দাঁড়ালে তারা আমার পিছনেও সংহার মূর্তি নিয়ে ছুটে আসবে কেন বাবা আমি সে হাঙ্গামা পোহাই, কি দরকার আমার। বেশ তো আছি।
কিন্তু এই স্ববিরোধিতার ফলে আমার হৃদয়ের প্রতিটি তার যেভাবে বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠত তা থেকে জীবনে এই একটি শিক্ষা লাভ করেছি। অন্তরের তাগিদ আমাদেরকে যে পথে চালিত করে বাহির যখন তারই বিরোধিতা করে তখন বাহিরের বিরোধিতা যতই কঠিন হতে থাকে অন্তরের টানও ততই নিবিড় হয়। ছোট ফুপুর আর কামিলের প্রতি বাড়ির দশজনের আচরণ যদি স্বাভাবিক হতো, তা হলে আমিও তাঁদের বাড়ির আর দশজনের মতো অবিশেষ ব্যক্তি মনে করতে পারতাম। কিন্তু সকলের বিরোধিতার ফলে তাঁরা আমার কাছে সবিশেষ হয়ে উঠলেন। এই রকমটি না ঘটল আমার জীবনের পরিণতিটাও হয়তো অন্যরকম হতো।
আমাদের বাড়ির একতলায় যেখানে ঝি-চাকরেরা চৌবাচ্চাটিকে কেন্দ্র করে আসর জমায়, তারই পাশে একটি আলোকবঞ্চিত কক্ষে পুঞ্জীভূত অন্ধকারের সঙ্গে আমাদের বংশ পরম্পরায় বর্জিত বাক্স-প্যাটরাও সঞ্চিত হয়ে উঠছিল। ছোট ফুপুরা আসবার পর সেই কামরা থেকে ভাঙা আসবাব বাইরে এলো—এবং ছোট ফুপুরা ভিতরে গেলেন। কিন্তু সেই প্রায় নিরন্ধ্র কক্ষটির অন্ধকারের শান্তি কেউ বিচলিত করতে পারল না। ছোট ফুপুদের থাকবার জন্য ফুপুজান যখন এই কামরাটিই নির্দিষ্ট করে দিলেন তখন বাড়ির সকলেই বুঝে নিল, আমাদের সংসারের ‘অর্ডার অফ প্রিসিডেন্সে’ ছোট ফুপুরা কোনো তৃণ অবলম্বন করে ভাসছেন। তার আগে পর্যন্ত বর্ণাশ্রমের কোন মার্গে তাঁদের স্থান সে সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহ ছিল।
কিন্তু সম্পূর্ণ দোষ ফুপুজানের নয়। বলতে গেলে ছোট ফুপু নিজেই এই কামরাটি বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর দগ্ধ হৃদয়টিকে এই কামরার নিভৃতে নিয়ে গিয়ে তিনি শান্তি পেতে চেয়েছিলেন।
সত্য কথা বলতে কি ছোট ফুপুকে যেদিন প্রথম দেখি সেদিনই তিনি আমার মন কেড়ে নিয়েছিলেন। মানুষটি ছোটখাটো, গোলগাল, আঁটসাঁট গড়ন, ফর্সা রঙ, ঠোঁট দুটি পানের রসে টসটস। তাঁর আঁচলে ঝুলত চাবির গুচ্ছ। তিনি যখন চলতেন মৃদুভাবে তার ঝনাৎ শব্দ শোনা যেত। কিছুতেই তিনি পায়ে কিছু রাখতে পারতেন না। তাঁর নগ্ন পা দুটিও ছিল আশ্চর্য। আমার সেই কচি বয়স—চোখের দৃষ্টিও ছিল রঙিন। আমার চোখে মনে হতো, ছোট ফুপুর প্রতিটি পদক্ষেপে যেন পদ্মফুল ফুটছে। তাঁর চরণে চরণে এক মিষ্টি ছন্দ বাজত।
কামিল, বয়স তার ষোলো, সে এই ছোট ফুপুরই ছেলে, একথা সহজে বিশ্বাস হতে চায় না। কামিল তার মা-র রূপ পায় নি। তার গড়ন লম্বা, এবং পেশিগুলো দড়। তার নাকের অগ্রভাগ অনেকটা বিলম্বিত এবং চোখের দৃষ্টি শাণিত, যা একবার কাছে টানত একবার দূরে সরিয়ে দিত। চোখ-মুখের নকশা তীক্ষ্ণ; চুলগুলো ঠিক ততটাই কোঁকড়া যার বেশি হলে অশোভন হতো। তার গায়ের রঙের কথা একেবারে শেষে বলছি, কারণ সেটি কালো।
যাই হোক কোণের ঘরটিতে এইভাবে আশ্রয়লাভ করে ছোট ফুপু সকলের চোখে যাবজ্জীবন অসম্মানের দণ্ড ভোগ করলেন।
ছোট ফুপুর সঙ্গে আমার প্রথম দেখার বিস্ময় আজও ভুলতে পারি নি। আমাকে দেখে তাঁর দুটি চোখে আনন্দ নেচে উঠল; তাঁকে দেখে আমার মুগ্ধ দৃষ্টি বোবা হয়ে গেল। এইভাবেই আমাদের শুভদৃষ্টি হলো। আমাদের বাড়ির রেওয়াজ ছিল মুরুব্বিদের পা ধরে সালাম করা। এই প্রথার বিরুদ্ধে আমার মনটি অবাধ্য ঘোড়ার ঘাড়ের মতো বাঁকা হয়ে থাকত; কিন্তু ছোট ফুপুকে কদমবুসি করবার জন্য যখন আনত হলাম তখন সেই দুটি পায়ের শ্রী দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। আমার মনের সর্বপ্রকার বিরুদ্ধতা সেই চরণ প্রান্তেই প্রণত হয়ে পড়ল। তাঁর পা যখন স্পর্শ করলাম মনে হলো দিঘির ঠাণ্ডা পানি দিয়ে কে আমার সর্বশরীর জুড়িয়ে দিল, এমনই আশ্চর্য সে স্পর্শ।
আশ্চর্য, ছোট ফুপুও একটুখানি মিষ্টি হাসি হেসে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। অতটুকুন মানুষ তিনি, কিন্তু কি অনায়াসেই তিনি আমাকে কোলে বসালেন। আমিও এতটা সহজেই কোলেই স্থান করে নিলাম যেন এত স্বাভাবিক আর কিছুই নয়। ছোট ফুপু আমাকে নিবিড়ভাবে বেষ্টন করে আমার মাথায় হাতে পিঠে চিবুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আমিও লোভীর মতো বসে বসে এই স্পর্শটুকু উপভোগ করতে লাগলাম, যেন এই স্পর্শটুকুর জন্যই আজীবন আমার চিত্ত পিপাসিত ছিল। আমি যেন একটি খেলনা, ছোট ফুপু আমাকে নিয়ে এতই বিভোর হয়ে পড়লেন। আমার কপালে তিনি যখন ছোট্ট একটি চুমু এঁকে দিলেন তখন আমার মনে হলো, মাতা চাঁদ মামাকে তাঁর শিশুর কপালে এই টিপই দিয়ে যেতে বলেন।
একটা বিস্কুটের জং-ধরা টিন থেকে তিনি নাড়ু, মণ্ডা এই রকম কত কি বের করে আমার মুখে একটির পর একটি পুরে দিতে লাগলেন। আমিও এমনই অসঙ্কোচে তাই গিলতে লাগলাম যেন ছোট ফুপুর দুটি হাত এবং তাঁর তৈরি খাবারের ওপর আমার নিরঙ্কুশ অধিকার।
ফুপুজান ছিলেন কাছেই। তিনি চুপ করে কিছুকাল এই দৃশ্যটির তাৎপর্য গ্রহণের চেষ্টা করলেন। কিন্তু আর পারলেন না, এইবার বলে উঠলেন : থাক ময়না থাক! অমন ঘটা করে আর আদর দেখাতে হবে না। সবই বুঝি।
তখনো আমি ছোট ফুপুর কোলে বসা ছিলাম। ফুপুজানের কথা শুনে ছোট ফুপুর কোল তরঙ্গাহত নৌকার মতো নড়ে উঠল, তারই সাথে আমিও। ছোট ফুপু কিন্তু কিছু বললেন না। আমাকে কোল থেকে নাবিয়ে একদিকে উঠে চলে গেলেন।
কনিজও দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দর্শকের মতো রঙ্গমঞ্চের নাটক দেখছিল; কিন্তু তাকেও যে একটি ভূমিকা নিতে হবে সে জানত না।
ফুপুজান চেঁচিয়ে উঠলেন : যা নিয়ে যা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিস কি। মোয়া-নাড়ু তোরা ভাগ করে খেয়ে নে। যত সব।
আমিও বুঝলাম, ছোট ফুপুর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতাও চলবে না। ছোট ফুপুর স্নেহস্পর্শ আমার হৃদয়ে ভালোবাসার যে শিখাটি জ্বলে উঠেছিল, এক ফুৎকারেই তা নির্বাপিত হলো।