প্রসন্ন পাষাণ – ২৪

২৪

আমি জানি বড় বেশি কথা বলেছি, গল্প বলেছি কম। এবার ধীরে ধীরে নকশি কাঁথাটি গুটিয়ে নেবার সময় হয়েছে। বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে গল্পের যে ভগ্নাংশগুলো ছড়িয়ে আছে, এইবার কেবল সেইটুকুই ছেঁকে তুলবার চেষ্টা করব। বাকিটা দিয়ে তোমাদের আর অযথা হাঁফ ধরিয়ে দেব না।

দু’দিন খুব বৃষ্টি গেছে। নিচে রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যে নালাটি পথের নর্দমায় গিয়ে পড়েছে, আজ দেখি সেটি কানায় কানায় ভরা। বাড়ির পোষা পাতিহাঁস দুটি ডানা গুটিয়ে তারই ওপর সাঁতার কাটছে। ক’দিন হলো একটি গরু কেনা হয়েছে। গরুটি একেবারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেবল তার মাথার ওপর তেঁতুল গাছের পাতা থেকে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি ঝরে পড়ছে। আকাশে এখনো ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ দেখা যায়—সূর্যকে এখন ঢেকে দেয় তো এখন তার পথ ছেড়ে দেয়। কৃষ্ণচূড়ার গাছটি ফুলের একটি বৃহৎ তোড়ার মতো পথের এ পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

বেলা অনেক হয়েছে। যে যার আপিস কাছারি স্কুল কলেজ বহুক্ষণ হলো চলে গেছে। বাড়ির মেয়েরা ইলিশ মাছ, শাক, কুমড়ো আর বঁটি নিয়ে ব্যস্ত। রান্নাঘরে কনিজ বুঝি এই মাত্র কড়াইয়ে মাছ ছাড়ল, তারই ছাঁত-করে-ওঠা দোতলায় আমার কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কনিজের পাশে জাফর বসে আছে নিশ্চয়ই। তাদের অলস মৃদু মন্থর ছেঁড়া ছেঁড়া অন্তরঙ্গ আলাপ বর্ষণ-শেষে গাছের পাতা থেকে বালতিতে ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোঁটার মতো বাজতে থাকে।

জানালার কাছে বসে আমার মনে হলো এই সংসারে কি আমিই কেবল একা? কিন্তু এই সময়ই একা থাকতে আর ভালো লাগল না।

এলাম নেবে একতলায়।

ছোট ফুপুকে যেন কতদিন দেখি নি। আসা-যাওয়ার পথে চোখে পড়েছেন তিনি—কিন্তু পাশে বসে সুখ-দুঃখের আলাপ বহুদিন হয় নি। আরো একটি কারণে ছোট ফুপুর সঙ্গে দেখা হওয়া খুব দরকার। মনে যা এলো কামিলকে তো তাই শুনিয়ে দিলাম; কিন্তু সেই কথাই কোথায় কতটা দাগ কেটেছে একবার জানা দরকার।

ছোট ফুপুর ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। হয়তো তিনি বিশ্রাম করছেন। একবার ভাবলাম ফিরে যাই; কিন্তু শেষ পর্যন্ত দরজার ওপর টোকা দিলাম।

—কে?

—আমি তিশনা!

একটু পরই দরজাটা অল্প খুলে গেল।

—আয়! দরজাটা আবার বন্ধ করে দে।

ছোট ফুপু এইমাত্র গা ধুয়ে এসেছেন। রাশি রাশি খোলা চুল ঝরনাধারার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে তাঁর কোমরের ওপর লুটিয়ে পড়ছে। এইমাত্র কাপড় ছেড়েছেন, ধোয়া শাড়ি এখনো গায়ে ওঠে নি। গায়ে পেটিকোট আর ব্লাউজ।

এক ধরনের সৌন্দর্য আছে যা চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেয় না। পূর্ণিমার আলোর মতো, মিঠে সুরের মতো মনটিকে নিবিষ্ট করে দেয়। ছোট ফুপুর রূপও তাই। এমন অপরূপ শরীর, আমার মেয়েমানুষের চোখকেও মুগ্ধ করে দিল।

—ছোট ফুপু, তোমাকে দেখেই কবি লিখেছিলেন, নয়ন না তিরপিত ভেল! বড় হিংসে হয়।

পোড়া কপাল। আমাকে হিংসে হয়!

ছোট ফুপু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। খাটের ওপর শুয়ে পড়ে বললেন : বড্ড গরম পড়েছে রে। আমি এইভাবেই শুলাম একটু। কিছু মনে করিস না।

—কিন্তু তুমি ওটা পড়ছিলে কি?

—চোখের বালি।

আমি আর কিছু বললাম না।

ছোট ফুপুর ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলাম। কপাটে খিল দেওয়া। সব দিকের সব কটি জানালাই বন্ধ। কেবল দক্ষিণ দিকে—যেদিকে ছোট ফুপু মাথা দিয়ে শুয়ে আছেন—সেইদিকের ওপরের জানালার দুটি পাটই খোলা। অবশ্য সেখান থেকে আকাশ আর সূর্য আর পাখি ছাড়া অন্য কারো দৃষ্টি এখানে পৌঁছবে না।

পূর্ব দিকের জানালাটি কেবল যে বন্ধ তাই নয়, জানালাটি এক পাশে ভেঙে গেছে, সেইখানটা খবরের কাগজ আঠা দিয়ে লাগানো। সেইখানেই একটা আলনাও দাঁড়িয়ে আছে, কয়েকটি শাড়ি-ব্লাউজ ঝুলছে। টিনের বাক্সটি যথাস্থানেই আছে। মাথার কাছে একটা ফ্রেমে বাঁধানো দুলদুলের রঙিন ছবি।

—ছোট ফুপু ঐ ছবিটি কার?

–তোর ছোট ফুপা দিয়েছিলেন।

—তাঁরই স্মৃতি?

—হ্যাঁ।

—আগে তো কখনো দেয়ালে দেখি নি!

—বাক্সে তোলা ছিল, ক’দিন হলো কামিল দেয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছে।

–কামিল?

— হ্যাঁ।

তারপর অনেকক্ষণ কোনো কথা হয় না। ছোট ফুপুর চোখ দুটি বইয়ের পাতায়। আমার মনের মধ্যে হাজার রকমের চিন্তা খেলা করতে থাকল।

—ছোট ফুপু, ফুপার কথা কি কামিলের মনে আছে?

—মনে থাকবে কি করে বল্। ওর বাপ যখন মারা যায় কামিল তো তখন কোলের বাচ্চা।

—তাহলে?

—তাহলে কি?

বলেই ছোট ফুপু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন।

কিন্তু আমি অত সহজে থামলাম না।

—কামিল কি আগে কখনো বাপের কথা জিগ্যেস করত?

—না।

—তাহলে?

ছোট ফুপু এক পলক আমার দিকে চাইলেন: পরমুহূর্তেই বইটিকে চোখের আরো কাছে টেনে আনলেন; কিন্তু আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না।

আমিও ছোট ফুপুর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

—সত্যি ছোট ফুপু। আমারও ভারি ইচ্ছে করে ছোট ফুপা সম্পর্কে জানতে।

ছোট ফুপু বইটি বুকের ওপর নাবিয়ে আনলেন। আড়ভাবে আমার দিকে আর একবার তাকিয়ে বললেন : তুই আমার কথা বুঝবি না। যেদিন বুঝতে শিখবি সেদিন আর কাউকে কিছু জিগ্যেস করতে হবে না। আজ এ প্রসঙ্গ থাক।

আমাদের খাটের নিচে একটি ইঁদুর অনেকক্ষণ থেকে কাগজ ছিঁড়বার চেষ্টায় খসখস আওয়াজ করছিল। সেই শব্দই আবার আমাকে অন্যমনস্ক করে দিল। খাটের নিচেই ছোট ফুপু মাটির হাঁড়িতে চাল-ডাল রেখেছেন। চাল-ডালের একটা মিশ্র গন্ধও নাকে আসছিল। আরো এক স্বল্প পরিচিত গন্ধ। চালের মধ্যে পাকবার জন্য কলা রেখে দিলে যে গন্ধটুকু পাওয়া যায়। ছোট ফুপু মাথায় দিয়েছেন তিলের তেল। তাঁর বালিশেও তেলের কালো দাগ।

হঠাৎ অবাক হয়ে আবিষ্কার করি, ছোট ফুপুর পাশে যে এইভাবে শুয়ে আছি, সে আমার বড় ভালো লাগছে। ইঁদুরের ঐ শব্দ, চাল-ডাল আর আধপাকা কলার সেই গন্ধ, তিলের তেলের সুবাস—এবং এমনকি, ছোট ফুপুর তেল চিটচিটে বালিশটা পর্যন্ত আমার ভালো লাগছে। ভালো লাগছে পাশে শুয়ে থাকা ছোট ফুপুকে, ভালো লাগছে তাঁর অর্ধ অবগুণ্ঠিত রূপ, ভালো লাগছে তাঁর সান্নিধ্য।

মনে হতে লাগল, এইসব ছোটখাট শব্দ আর দৃশ্য এত অন্তরঙ্গ যে সত্যকার জীবনের স্পর্শ দিয়ে যায়, যা আমার ওপরের ঘরের আসবাবে, বিলাসে, আর পরিচ্ছন্নতায় নেই।

আমি এবার পাশ ফিরলাম। দেখি তখনো বইয়ের ওপর ছোট ফুপুর চোখ। কি খেয়াল হলো, দুটি হাত দিয়ে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরলাম।

ছোট ফুপু অল্প একটু হাসলেন। বইটা পাশে রেখে দিয়ে আমাকে বুকে চেপে ধরলেন। আমি সেইভাবে পাশে পড়ে থাকলাম।

—ছোট ফুপু, তোমার গায়ের গন্ধ ভারি মিষ্টি।

—দূর পাগলা মেয়ে।

এই বলে আমার মুখটি কাছে টেনে এনে আমার দুটি ওষ্ঠের ওপর তাঁর ঠোঁট দুটি নাবিয়ে দিলেন। বললেন : মা আমার!

আমিও তাঁকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।

তারপর এক সময় আমি সরে এলাম। ছোট ফুপু আবার তাঁর বইয়ে মন দিলেন।

পাশে চুপ করে পড়ে আছি। ছোট ফুপু পড়ছেন বই। হঠাৎ একটি চিন্তা আবার মনের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধতে লাগল।

এত বই থাকতে ছোট ফুপু চোখের বালি পড়ছেন কেন? অবশ্য চোখের বালিও পড়বার মতো বই। কিন্তু ছোট ফুপুকে এতদিন ধরে দেখবার পর তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে চোখের বালির সাযুজ্য ঘটাতে পারছি না। বালিশের ওপর দিয়ে গড়িয়ে তাঁর মাথার চুল খাটের নিচে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়ছে; বইটি বুকের ওপর রেখে ছোট ফুপু পড়ছেন।

হঠাৎ এই রকমের আর একটি পরিচিত দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সেই দৃশ্যটিও ঐ চোখের বালির পটেই আঁকা দেখেছি। সেও অমনি করে খোলা চুল এলিয়ে দিয়ে বই পড়ছিল—অমনিই আর একটি বই।

মানুষের মনে কত রকম খেয়ালই না আসে। এও কি সম্ভব যে ছোট ফুপু সজ্ঞানে একটি বিখ্যাত উপন্যাসের দৃশ্য তাঁর খাটের ওপর মঞ্চস্থ করছেন? কিন্তু সজ্ঞানই করছেন কে বলছে- বা করছেনই এ কথাই-বা কে বলছে। বলছি শুধু একটা সম্ভাবনার কথা। মানুষের অবচেতন মন মানুষকে দিয়ে যে কত কি করিয়ে নেয় সেই রহস্যটি জানতে পারলে আমাদের লজ্জা ঢাকবার কি আর ঠাঁই থাকবে! একই মানুষের মনের মধ্যে কত রকম পরস্পরবিরোধী প্রবৃত্তি যে বাসা বেঁধে থাকে তার হিসাব কেই-বা রাখে। আমরা সকলে একেবারে ওপরের স্ফটিকটুকুই দেখতে পাই—একেবারে তলাকার ঘোলা পানিতে চোখ পড়ে না—তাই বেশ সুখেই থাকি। আমিই কি আমার মনের সব খবর রাখি?

কিন্তু ছিঃ। এ আমি কি করছি। ছোট ফুপুর ওপর এত বড় অবিচার করবার কোনো অধিকারই আমার নেই।

ছোট ফুপু বইটা মুড়ে এক পাশে রেখে দিলেন। ঘাসে তাঁর গলা তাঁর ব্লাউজ, তাঁর পেটিকোট, কপাল, হাত, সবকিছুই একেবারে ভিজে গেছে।

—নাঃ আর পারি না বাবা। এত চর্বিও মানুষের হয়!

এই বলে ছোট ফুপু উঠে পড়লেন।

আলনার কাছে গিয়ে ব্লাউজ নাবিয়ে গায়ে একটা শাড়ি চড়াতে যাবেন—হঠাৎ তাঁর মুখের রেখা, চোখের দৃষ্টি এবং দুটি হাত একেবারে স্থির হয়ে গেল।

আশ্চর্য লাগে ভাবতে, একটি শোনা ঘটনা বা গল্প মানুষের জীবনে কিভাবে অনেক সময় আবর্তিত হতে থাকে।

ছোট ফুপুর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও খাট থেকে উঠে পড়লাম। ছোট ফুপু ঝট করে জানালার পাশ থেকে সরে গেলেন। ভাঙা জানালাটি যেখানে খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা, সেখানেই কাগজটা একটু ছিঁড়ে গেছে। সেই ফাঁকটুকুতে দুটি চোখ।

ছোট ফুপু থরথর করে কাঁপছিলেন। তাঁর বিবর্ণ দৃষ্টি একটি অসহায় প্রশ্নের মতো আমার মুখের ওপর এসে পড়ল।

একটি নাম বিদ্যুতের মতো আমার মগজে ঠিকরে গেল। পরমুহূর্তে তার চাইতেও এক অসহ চিন্তা আমারও সারা শরীরটিকে অবশ করে দিল। খোদা মুখ রেখ, মনে মনে এই মোনাজাত করে, আমি ছুটে বেরিয়ে এলাম।

জানালার বাইরে ঠিক সেই জায়গাটিতেই এসে দাঁড়ালাম। কাছেই চৌবাচ্চা।

সেখানে এসে দেখি কেউ নেই। গরুটিকে ঘাস খেতে দেওয়া হয়েছে। সে তার কালো জিব দিয়ে অনেকটা লালা ঝরিয়ে পরম শান্তিতে ঘাসে কামড় দিচ্ছে। জানালার সেই ফুটোর ওপর তারই দুটি চোখ।

আমি এবার ওপরে উঠে এলাম। মনে মনে যে দুটি ব্যক্তির কাছে এক অমার্জনীয় অপরাধ করেছি, তারই অনুপাতে মনটা ভার হয়ে থাকল। ছোট ফুপু সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে সেখানে দেখে সবকিছু সত্ত্বেও আমি হঠাৎ হেসে ফেললাম।

ছোট ফুপু কিন্তু সে হাসিতে যোগ দিলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *