প্রসন্ন পাষাণ – ৩৮

৩৮

আমার গল্প শেষ হয়ে এসেছে। বাকিটা তাড়াতাড়ি সেরে নিচ্ছি।

বিয়ের পর দু’বছর গত হয়েছে। আমার কোলে এসেছে একটি মেয়ে।

ছোট চাচা আর নেই। করোনারি থ্রমবোসিসে হঠাৎ একদিন রাত্রে তিনি মারা যান। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুসারে কবর হয়েছে শিরগাঁতে।

আমি বেশ ভালোই আছি।

একদিন সকালবেলা জানালা ছিল বন্ধ। কিন্তু দুই জানালার মধ্যকার ফাঁক দিয়ে সূর্যের রশ্মি এক ফালি সুতোর মতো কামরার মধ্যে প্রবেশ করছে। আমাদের মেয়ে তার খাটে শুয়েছিল। রশ্মি তার নাকের কাছে নড়ছে। মেয়ে দু’হাত দিয়ে মুঠির মধ্যে তা বারবার ধরতে চায়। কিন্তু পারে না। রাগে হাত-পা ছুঁড়তে থাকে।

পরিপূর্ণ সুখও বুঝি এমনি জিনিস। আমরা মুঠিতে পুরতে চাই। কিন্তু পারি না।

আরো পাঁচ বছর গড়িয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমরা তখন চাটগাঁয়। কাস্টমস- এর কর্মচারীদের এক ডিনার ছিল। সেখানে লোকের মুখে এক নতুন কবির উচ্চ প্রশংসা শুনে এলাম। সে আর কেউ নয়, আমাদের কামিল। তার প্রথম কবিতার বই সমালোচকদের মুগ্ধ করেছে। ডিনার থেকে ফিরছি। পথে গাড়িতে বসে বহুদিন আগেকার ঘটনাগুলো চোখের সামনে চলচ্চিত্রের মতো ভাসতে শুরু করল। বাড়ি পৌঁছে চিঠি পেলাম।

ছোট ফুপুর চিঠি। তিনি লিখেছেন : একবার শিরগাঁ আসতে পারবে কি? তোমাকে একবার দেখতে বড় ইচ্ছে করে। যদি সম্ভব হয়, পত্র পাঠ চলে এসো। আমার ডাক এসেছে।

আমরা পরদিনই শিরগাঁ রওয়ানা হয়ে গেলাম।

ছোট চাচাই না কি আমাদের পূর্বপুরুষদের এই ভিটেটি মেরামত করিয়ে গেছেন। হুকুম আলী বললো : মামণি, ছোট সাহেব তাঁর কথা রেখেছিলেন। দেশে এসেছিলেন তিনি।

আমি বললাম : হ্যাঁ। দেশকে কোনোদিন চোখে দেখেন নি। কিন্তু বড় ভালোবাসতেন। তাইতো এখানকার মাটিই তাঁকে টানল।

—চোখে দেখেন নি কেন বলছ মা। বললাম তো, তিনি এসেছিলেন।

আমি আর আলীম সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।

হুকুম আলী বললো : হ্যাঁ মা এসেছিলেন।

—কবে?

ছোট চাচার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল। কবরের পাশেই হুকুম আলী বসে পড়ল। বললো : হ্যাঁ এসেছিলেন।

আর কিছু বললো না।

আমি জিগ্যেস করলাম : হুকুম আলী, কবরে কোরআন শরীফ পড়ানো হয় তো?

হুকুম আলী হাসল। বললো : আমি বেঁচে আছি, আর কোরআন মজিদ পড়ানো হবে না? আমার পরও, পড়াবার লোকের অভাব হবে না।

—তাহলে চলো এবার। বাড়ি যাই।

আমাদের দালানের কাছেই গোরস্তান। ফিরতে দেরি হলো না। ছোট ফুপু আছেন হুকুম আলীর কুঁড়েতে। কেন সে প্রশ্ন করেও কোনো জবাব পাই নি। হুকুম আলী আর আলীম আমাদের ঘরে বিশ্রাম করছে। হুকুম আলী আলীমকে বললো : দুলহা মিঞা, তুমি গ্রামে এসেছ। দেখবে সারা গাঁ তোমাকে জিয়াফত করে নিয়ে যাবে। কাউকে না করো না।

হুকুম আলী যে কোনোদিন বুড়ো হবে ভাবি নি। কিন্তু আজ তার যে ছবি দেখলাম, তা বৃদ্ধের হুকুম আলীর মেয়ে আমিনাকে নিয়ে ছোট ফুপুকে দেখতে চললাম। বিশ গজ দূরেই তার বাড়ি।

ঘর আঁধার হয়ে এসেছে। দক্ষিণ দিকের ছোট জানালা দিয়ে লাউ-কুমড়ো আর শাকের বাগান দেখা যায়। এই ঘরের মধ্যে তারই লতাপাতার ছায়া নড়তে থাকে। ছোট ফুপু খাটে শুয়ে আছেন। একেবারে ঘুম কি না বুঝতে পারলাম না। তবে তাঁর সারা শরীরে যে নিশ্চিত মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে তা সহজেই বোঝা যায়। আজ না কি বারো দিন হয়ে গেল, জ্বর ছাড়ে নি। অসুখটা যে কি কেউ জানে না।

মৃত্যু ছায়াতে এমন এক নির্ভুল স্বাক্ষর থাকে যে দেখলেই চেনা যায়। ঘরে পা দিয়েই আমি বুঝলাম ছোট ফুপু ঠিকই লিখেছিলেন। তাঁর ডাক এসেছে।

একটা মোড়া টেনে নিয়ে খাটের পাশে বসে পড়লাম। আমি যে এসেছি ছোট ফুপু তা বুঝতে পারলেন; কিন্তু কোনো কথা বললেন না। তেমনি পড়ে থাকলেন।

হঠাৎ তাঁর দুটি চোখ অশ্রুতে ভরে গেল।

—ছিঃ ছোট ফুপু!

এই বলে তাঁর শীর্ণ হাতটি তুলে নিলাম।

ছোট ফুপু বললেন : মা তোকে ডেকেছি, ক’টি কথা বলবার ছিল তাই।

শুনলাম, ছোট চাচা এসেছিলেন গ্রামে। তখন তাঁর শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছে। বহু রাতে ছোট ফুপুও হুকুম আলীর ঘরে এলেন। ছোট চাচা তাঁকে বললেন : ময়না, এবার যদি তুমি আমার কথা না শোনো, সারাটা জীবন আফসোস করবে, এই বলে রাখলাম।

সেই রাত্রে ঝড় আর বৃষ্টি থামতে চায় না। ছোট ফুপুও রাজি হলেন, একটি শর্তে : এই নিকার কথা কেউ জানবে না। তাঁরা স্বামী-স্ত্রীর মতো বাসও করবেন না। সেই রাত্রেই তাঁদের বিয়ে হয়ে গেল। গ্রামের আটজন মুরুব্বি ছাড়া সে কথা ঠিকমতো কেউ জানে না। শুধু সেই একটি রাতেই ছোট চাচা আর ছোট চাচি এক সাথে ছিলেন।

—তাই বুঝি তুমি হুকুম আলীর কাছে থাক?

—হ্যাঁ। গ্রামের লোক কিছু কিছু অনুমান করে কিন্তু ঠিকমতো কিছুই জানে না।

—কামিলকে বলবে না?

—এবার বলব। সে যদি আসে।

ছোট চাচির গণ্ড বেয়ে আবার এক ফোঁটা তপ্ত অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

—জানিস তিশনা, এতদিনে আমার দুঃখের অবসান। তাই অশ্রু ফেললাম।

খুব ভোরে ছোট চাচির কাছে চলে এলাম।

দেখলাম, তাঁর দুটি পায়ের ওপর মাথা রেখে একটি লোক স্থির হয়ে পড়ে আছে। আমার বুক লাফিয়ে উঠল। এ কামিল। সেই মাথাভরা কালো চুল, সেই দীর্ঘ বলিষ্ঠ গড়ন, সেই লম্বা দুটি হাত, শরীরের প্রতিটি রেখায় সেই নির্মম দাঢ্য।

আমি নিঃশব্দে ফিরে এলাম।

কামিলের আব্বার কবরের পাশেই গ্রামের লোকজন কবর খুঁড়তে চলে গেছে। এখান থেকে সবটাই দেখা যায়। লাশ পড়ে আছে। লোবান, আগরবাতি, ধূপ-ধুনোর ধূম্র একটি একটি রেখার মতো কিছুটা ঊর্ধ্বে উঠে কোমর ভেঙে হঠাৎ পড়ে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। কামিল চুপ করে বসে আছে। তার দুটি চোখ আগরবাতির ধোঁয়ার ওপর। কিন্তু সে কিছু দেখছে মনে হয় না। কোরআন শরীফের খতম পড়তে বসে গেছেন মৌলবী সাহেবেরা।

কবর খোঁড়া হচ্ছে কামিলের আব্বারই কবরের পাশে। দোকাল আর শাবল উঠছে আর পড়ছে দেখতে পাই।

এক সময় কামিল উঠে পড়ল। হুকুম আলীকে ইশারা করে ডেকে নিয়ে গেল। লাশ গোসল করানো হবে। লোকজন আসছেন। মেয়েরা একত্র হয়েছেন। এইবার গোসল দেবেন। তাঁবুও তৈরি হচ্ছে সামনেই। মিস্ত্রিরা কাঠ চিরছে, পেরেক ঠুকছে। দূরে কোদাল উঠছে আর নাবছে।

কাফনের কাপড় এলো। এক আত্মীয়া সাদা থান তুলে রাখলেন। এলো আতর আর গোলাপ পানি।

গ্রামে আর কেউ মরেছে। ছোট চাচার কবরের পাশে আরো একটি কবর খোঁড়া হচ্ছে। কাঁচা কাঁচা ভিজে মাটি কোদালের সঙ্গে উপরে উঠে আসছে। একটি দুটি হাড়ও। অল্পক্ষণেই দুটি কবরই তৈরি।

নামাজে জানাজা হলো। লাশ উঠল। হাজবি রাব্বি জিল্লেললাহ—নুর মোহাম্মদ সাল্লাললাহ—লা ইলাহা ইল্লাললাহ—

লাশ কাঁধে চড়ল। চলল জানাজা। গোরস্তানে যাবার একটিই পথ।

আমরা সকলে হঠাৎ স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। জানাজা এসে থামল ছোট চাচার কবরের কাছে। সেইখানেই আস্তে আস্তে লাশ নাবিয়ে দেওয়া হলো। সকলের আগে মাটি দিল কামিল নিজে

একে একে সবাই ফিরে এলেন। কেবল কামিল নতুন কবরের পাশে চুপ করে বসেই থাকল। লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল কামিলের আব্বা ধান মিয়ার কবরের পাশে। কামিলই হঠাৎ বললো : না। কবর হবে এখানে।

বলে সে ছোট চাচার কবরের পাশে নতুন খোঁড়া কবরটি দেখিয়ে দিল।

আলীম জানতে চাইল : ফিরবে কবে?

বললাম : আজই। কামিল কি করছে?

—হুকুম আলীর ঘরে ছিল একটু আগে।

—একবার দেখা করতে পারি?

—যাবে? আচ্ছা যাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *