প্রসন্ন পাষাণ – ৩১

৩১

সেদিন বিকেলবেলা কি কারণে জানি না, আলীম আসতে পারে নি। ‘আসে নি’ বললাম না। কারণ পারলে সে যে নিশ্চয়ই আসত তা জানতাম।

ছোট চাচার কামরায় আমি আর একবারও যাই নি। তাঁর জ্ঞান ফিরেছে অনেকক্ষণ। তিনি এখন ভালোই আছেন। জাফরই তাঁর দেখাশোনা করছে। মাঝে মাঝে কনিজও খবর নিয়ে যায়। আমিও আমার খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে তাঁর সেবাযত্ন ঠিকমতো হচ্ছে কি না তার খবরদারি করছিলাম। ছোট ফুপু অনেক আগেই নিচে তাঁর ঘরে ফিরে গেছেন! তিনি সারাদিন কি করলেন—এখনই-বা কি করছেন, কিছুই জানি না। আজ সকালের ঘটনার পর আমার ও ছোট চাচার মাঝখানে একটা পর্দা নেবে এসেছে, সেটা এক হাত দিয়ে তুলে ফেলব ছোট চাচা বা আমি কেউ সে সাহস পাচ্ছি না।

এখন কত রাত হবে জানি না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। তবে রাত অনেক হবে। কোথাও এতটুকু সাড়াশব্দ নেই। শুধু ইলেকট্রিক সাবস্টেশনের ডাইনামো অবিশ্রান্ত আওয়াজ করে চলেছে, রোজকার মতোই। সেই শব্দটুকুই কানে বাজতে থাকে। আর কিছু নয়।

ছোট চাচাকে সারাদিন দেখি নি! এই সুযোগে একবার লুকিয়ে দেখে আসি। দরজা খুলে ভিতরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।

প্রথমে কিছুই চোখে পড়তে চায় না, যদিও রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো আমার ঘরের জানালার ভিতর দিয়ে আমার ঘরে ঢুকে এই দরজাটা খোলা পেয়ে এই বারান্দা পর্যন্ত পৌঁছেছে।

দরজা খুলে দোরগোড়াতেই কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে থাকলাম। আস্তে আস্তে অন্ধকার চোখে অভ্যস্ত হয়ে এলো। এখন অন্ধকারের ভিতর দিয়ে আমার দৃষ্টি ছুঁচের মতো পথ করে নিতে পারছে। এভাবে বোধহয় দু’তিন মিনিটও কাটে নি।

তারপর সেই দৃশ্যটি চোখে পড়ল।

ছোট চাচার ঘরের দরজা সাবধানে বন্ধ করে ছোট ফুপু এইমাত্র ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন।

আমার সমস্ত হাত-পা আবার ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করে দিল। কপাট শক্ত করে ধরে তবু দাঁড়িয়ে থাকলাম।

ছোট ফুপু চোরের মতো চারদিকে একবার সাবধানে দেখে নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেবে যাবেন এমন সময় ছোট ফুপুরই কামরার সামনেকার বারান্দার তীব্র আলো জ্বলে উঠল। ছোট ফুপু আর আঁধারে ডুবে থাকতে পারলেন না। এই আলোর সবটুকু যেন তাঁর মুখের ওপর এসে পড়েছে। এই আলোর অন্য কোনো কাজই নেই। ছোট ফুপু একটি পা উপরের ধাপে একটি নিচের—আর ঠিক সেই মুহূর্তেই বাতি জ্বলে উঠল। বিজলি বাতির আলোটুকু যেন এক ফণা তোলা সাপ—ছোট ফুপু সেইভাবেই একটি পাষাণমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়লেন। তাঁর মাথা একেবারে হেঁট হয়ে গেল, দৃষ্টি পায়ের ওপর।

আর নিচে যে কামিল আলো জ্বাললো, তার দুটি চোখের অভিব্যক্তিতে বিশ্বের সমস্ত বিস্ময় একেবারে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

তার মুখ দিয়ে কেবল এই দুটি কথা বেরিয়ে এলো : মা তুমি? তুমি মা?

এইবার ছোট ফুপু প্রাণপণ শক্তিতে দ্রুত এগিয়ে এসে কামিলকে শক্ত করে ধরে ফেললেন। কামিল তার মা-কে দু’বাহু দিয়ে বেষ্টন করে তাঁর বুকে মুখ রেখে ধীরে ধীরে মেঝের ওপর তাঁর পায়ের কাছে গড়িয়ে পড়ল। দু’হাত দিয়ে আবার তাঁর পা জড়িয়ে ধরে সেই দুটি পায়ের ওপর মুখ রেখে কামিল সেখানেই শুয়ে পড়ল। পায়ের দুটি পাতা ওষ্ঠ দিয়ে স্পর্শ করে আরো একবার বললো : মা তুমি! তুমি মা?

আর কিছু বলতে পারল না। এবার দম ফুরিয়ে যাওয়া পুতুলের মতো স্থির হয়ে গেল।

ছোট ফুপু একটি কথাও বলতে পারেন নি—এখনো পারলেন না। কিন্তু এবার তিনিও কামিলের পাশেই বসে পড়লেন। কামিলের মাথা পরম স্নেহে কোলের ওপর টেনে নিয়ে সেইভাবেই বসে থাকলেন।

কামিল আচ্ছন্নের মতো পড়ে থাকল। এইভাবে বহুক্ষণ চলে গেল।

—মা তুমি যাও।

এই বলে কামিল উঠে বসল।

ছোট ফুপু হাত বাড়িয়ে আবার তাকে কাছে টেনে আনতে চেষ্টা করলেন, কামিল হাত সরিয়ে দিল। শুধু বললো : তুমি যাও।

ছোট ফুপুর দুটি কোমল চোখের ভিতর দিয়ে এক কাতর মিনতি কামিলের হৃদয় স্পর্শ করতে চায়; কিন্তু কামিল একবার সেদিকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিল।

বললো : না মা তুমি যাও। ওঃ ওঃ আমি জানতাম। মা আমি জানতাম। my prophetic soul!

সিঁড়ির ওপর ছোট চাচার দীর্ঘ ছায়া পড়ল, তিনিও সিঁড়ির রেলিং ধরে আস্তে আস্তে নিচে নাবছেন।

একবার মনে করলাম, ছুটে গিয়ে ছোট চাচাকে বাধা দি। কিন্তু এক পা-ও নড়তে পারলাম না। লোক যেভাবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে, দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমিও সেইভাবে এক শোচনীয় দুর্ঘটনা অসহায়ের মতো প্রত্যক্ষ করবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ছোট চাচাকে দেখে ছোট ফুপু মাথায় ঘোমটা টেনে দিলেন।

কামিল ততক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মা-র মাথায় ঘোমটা দেখে কামিল একটুখানি হাসল— বড় নিষ্ঠুর মর্মান্তিক সে হাসি।

ছোট চাচা এসে কামিলের সামনে দাঁড়ালেন। কয়েক মুহূর্ত কারো মুখে একটি কথা নেই। দুই প্রতিপক্ষ যেন পরস্পরকে বুঝে নিচ্ছে।

ছোট চাচা কামিলের কাঁধে একটি হাত রাখলেন।

কামিল সে হাত সরিয়ে দিয়ে বললো : তারপর? আমি অপেক্ষা করে আছি।

—কামিল, তুমি তোমার মা-র ওপর নিদারুণ অবিচার করছ।

এই ক’টি কথা বলতেই ছোট চাচার কষ্ট হলো। এই সিঁড়ি দিয়ে নেবে আসা, এমন একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া, তারপর এই ক’টি কথা বলবার প্রয়াসে ছোট চাচার সমস্ত শক্তি নিঃশেষিত হয়ে গেছে।

কামিলের ভ্রূ দুটি ধনুকের মতো বেঁকে গেল, ওষ্ঠেও অত্যন্ত বাঁকা হাসি। ছোট চাচা তা লক্ষ করলেন কিন্তু তেমন ভ্রূক্ষেপ করলেন মনে হলো না।

ছোট চাচা বললেন : কামিল, আমি আর তোমার মা ঠিক করেছি—

–যে আমরা বিয়ে করব?

কামিলই বক্তব্য সম্পূর্ণ করে দিল। কামিলের সেই কথা ছোট ফুপুর দুটি মুখে কালি মাখিয়ে দিল।

ছোট চাচাও ধীরে ধীরে তাঁর মাথা নেড়ে সায় দিলেন। তারপর বাদানুবাদের জন্য দাঁড়িয়ে না থেকে তিনি আবার সিঁড়ির দিকে ফিরে এলেন।

—হা হা হা হা!

কামিলের সেই অট্টহাসিতে গোটা বাড়িটাই কেঁপে উঠল। ছোট চাচা সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু মুখ ফিরালেন না। তেমনি দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করতে থাকলেন—কিসের অপেক্ষা কে জানে!

—হাহ হাহ হাহ হাহ! Therefore, my some time uncle, now my father, please hold your sometime sister, now your queen, for she is in a swoon. হাহ হাহ হাহ! একদা ছিলে ভগ্নি হলে রানী। আর আমি? ভগ্নি পুত্রাধিক; তবু পুত্ৰ নহি নহি। তিশনা, ওপরে দাঁড়িয়ে করছ কি? এবার যবনিকা নাবিয়ে দাও।

কামিল মাতালের মতো টলতে টলতে পথের দিকের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কেউ কি ওকে আজ ধরে রাখতে পারবে? কেউ কি এখন তার কাছে গিয়ে একটি কথাও বলতে সাহস করবে? এই অবস্থায় বাইরে যাচ্ছে—তার কপালে কি আছে কে জানে। কিন্তু নসিবে যাই থাক তাই হবে। অন্তত আমার এত সাহস নেই এখন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াব। ছোট চাচাও আর অপেক্ষা করলেন না। ওপরে উঠে আসতে লাগলেন—এই ওঠা যেন শেষ হতে চায় না। আমিও যে কখন যন্ত্রচালিতের মতো নাবতে শুরু করেছি জানি না। সিঁড়ির মাঝের ধাপে আমি আর ছোট চাচা পাশাপাশি দাঁড়ালাম। ছোট চাচা একবার মাত্র চোখ তুলে আমাকে দেখলেন। তারপর পাশ কাটিয়ে উঠে চলে গেলেন।

—কামিল, বাপ আমার, যাস নে!

কামিলের কি মাথা খারাপ হয়ে গেল? দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়ে আবার নাটকের পাত্রের মতো বলতে শুরু করল : Yes, sometime my nother, and now a distant aunty — কি বলছ?

—তুই এইখানে দাঁড়িয়ে আমার দুই গালে যত খুশি চড় মারতে থাক; কিন্তু যাস নে, চলে যাস নে!

কামিল তেমনিভাবে জবাব দিল : ঠিক বলেছ মা। আমি যাব না। আমি আমার পার্ট ভুলে যাচ্ছিলাম। I shall in all my best obey you, madam.

এবং আশ্চর্য। কামিল ফিরে দাঁড়ালো। উদ্‌ভ্রান্তের মতো পা বাড়ালো। কিন্তু পারল না। সেইখানেই পড়ে গেল।

তখুনি আমাদের বাগানে একটি মোরগ ডেকে উঠল। বুঝি সকাল হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *