প্রসন্ন পাষাণ – ২৫

২৫

কামিলরা সোমবার চলে যাবে এই কথাটি আবার চাপা পড়ে গেল। ছোট চাচা কিছুতেই শুনলেন না। কিন্তু কামিল কলেজ থেকে নাম কাটিয়ে দিয়েছে। সে আর পড়বে না। একটা নতুন খবরের কাগজ বেরিয়েছে; তারা লোক চায়। সাব-এডিটরের কাজ কামিলের জুটে গেল। কামিল থাকবে বলে যে বাড়িটা ঠিক করেছে, পথে যেতে-আসতে তা দেখেছি। দু’শ টাকা মাইনে পাবে। মা-পোয়ের জন্য তাই না কি যথেষ্ট।

এরই মধ্যে কামিলের সঙ্গে আমার আপোস হয়ে গেছে। ঠিক কখন কিভাবে হলো বলা কঠিন। এই যে কামিল বারবার এ বাড়ি থেকে উঠে যাবার কথা বলে তা যেমন সত্য হয়েও সত্য নয়, তেমনি কামিলও বুঝতে পারে, তার ওপর আমার রাগ অকৃত্রিম হয়েও তারই মধ্যে কোথায় যেন একটা ফাঁকিও আছে।

—মা-ছেলের জন্য যথেষ্ট বলছ। কিন্তু আর কি কেউ নেই এবং তার জন্য কি চিন্তা করতে হয় না?

—আর কে আছে বলো!

—আসতে তো পারে!

কামিল হেসে ফেলল। সে হাসির মধ্যে কিছুটা প্রশ্রয় ছিল, কিছুটা বিদ্রূপও ছিল।

–যে আসবে সে বুঝি তুমি?

–হতেও তো পারে।

—না পারে না।

—কেন?

—কেন, সে কথা আজ থাক। তবে এক মুহূর্তের ভুলেও তুমি আমার জীবনে আসতে চেয়েছিলে এইটেই আমার জীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে।

—আমাকে বুঝি এক মুহূর্তের বেশি সহ্য করা যায় না?

কামিল আবার হেসে ফেলল।

বললো : না সত্যিই যায় না।

—তাহলে অবশ্য অন্য কথা।

—তুমি যে দেখি সত্যিই রাগ করলে! ঠাট্টাও বোঝ না?

—ঠাট্টাচ্ছলে জীবনে এত সত্য কথা বলা হয় যে কোনটা সত্য আর কোনটা ঠাট্টা জানব কেমন করে?

—সত্যিই কি সে কথা জানা যায় না?

এবার আমি চুপ করলাম।

একেবারে সকালবেলা গাড়িয়াহাট রোড দিয়ে আমরা হাঁটছিলাম। বাম পাশের বাংলো টাইপের বাড়িগুলোর বারান্দায় দু’একজন বৃদ্ধ পায়চারি করছিলেন। দু’একজন ডেক চেয়ারে পা এলিয়ে দিয়ে অতি প্রত্যুষের আকাশ দেখছিলেন, কোলের ওপর সদ্য-আসা খবরের কাগজ। কোনো কোনো বাড়ির বাগানে মালী পানি দিচ্ছিল।। ট্রলিতে করে বেয়ারা চা নিয়ে আসে। কল্পনা করতেও ভালো লাগে, কেটলির নলি দিয়ে ঈষদুষ্ণ বাষ্প পাউডারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে।

এবং ডান দিকে শ্যামল তৃণের বন্যা।

পথে ঠিকমতো লোক চলাচল তখনো শুরু হয় নি। হঠাৎ দেখি এক শ্বেতাঙ্গিনী, তাঁর সঙ্গে একটি কুকুর, গলায় তার বেল্ট বাঁধা। কখনো সে কর্ত্রীর আগে আগে চলে, কখনো পিছিয়ে পড়ে, নাকটি পথের ওপর নাবিয়ে ঘ্রাণ নিতে থাকে। পাশের গাছে কখনো একটি কি দুটি পাখি ডেকে ওঠে। পথের ধারে একটি কল খোলাই পড়ে আছে, পানি গড়িয়ে গড়িয়ে স্রোতের মতো ভেসে যায়। এই প্রাচুর্যটুকু চোখে ভালোই লাগে।

ফর্সা হয় নি তখন ভালো করে। আমরা হাঁটছি একটি বীথিকার মাঝ দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে আমরা বহুদূর চলে এসেছি। লেক আর বেশি দূরে নয়।

আমার দুটি পা ধরে এসেছিল। লেকে পৌঁছে বললাম : বসবে একটু লেকের ধারে? কামিল একটুকাল ইতস্তত করল। বললো : আমার তো আগ্রহ থাকারই কথা; কিন্তু বাড়ির কথা কি একেবারেই ভুলে গেলে?

আমি সেখানেই বসে পড়লাম। তারপর মাথার ওপর ঘোমটা দিলাম টেনে। ঘোমটার ভিতর দিয়েই আমার হাসি ঠিকরে পড়ল। একটি বিখ্যাত নায়িকার অনুকরণে বসলাম : ক্ষতি কি। যদি দুর্নাম রটে, কিছু উপায় হতে পারে।

—উপায় যে কি হয়েছিল সে তো জানই। সুতরাং তোমার ও নজির টিকল না। কিন্তু বসতে হয়, আরো একটু এগিয়ে বসা যাবে। এইখানটা লেকের শুরু বটে, কিন্তু পথ এখানে শেষ হয়েও হয় নি। দেখছ না গাড়িঘোড়ার ভিড়। ওঠ

উঠে পড়লাম। আরো এগুতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে আমার স্যান্ডেল আঙুলের কাছে ছিঁড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো।

কামিল বললো : সব পথ এসে এখানেই শেষ হলো। জিত হলো ছেঁড়া জুতোর। আমি কিছু বললাম না। জুতো জোড়া হাতে তুলে নিয়ে পাশের একটি ঝোপ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে ফেললাম। ঝোপটির সারা গা নড়ে উঠল।

কামিলই আবার বললো : দেখছ তিশনা। ঝোপটি কিভাবে নড়ছে।

আমি তাও কিছু বললাম না।

সকালবেলার শিশির আমার পায়ের পাতা, আমার শাড়ির পাড় সব ভিজিয়ে দিচ্ছিল। শিশিরের স্পর্শ কোমল স্নেহের মতো আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ঘাসের উপরকার ধুলাবালি পায়ের কাছে শাড়ির প্রান্তটিকে নোংরা করে দিচ্ছে। বারবার দৃষ্টি নাবিয়ে আমি তাই দেখতে থাকি। এ যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা।

আবার কামিলই বললো : নগ্ন পায়ে তোমার পদমর্যাদা বুঝি আর থাকে না!

—মর্যাদা নাই থাক; এখন পদ দুটি অক্ষত থাকলেই আমি কৃতজ্ঞ থাকব।

—আমার সঙ্গে পথে নাবার দুর্গতির সঙ্গে পরিচয় হলো তো।

–স্যান্ডেল জোড়া এভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করবে কে ভেবেছিল!

—দারিদ্র্যের পথে এমন ঘাতক কোনো সময়ই বিরল নয়।

—বুঝেছি, তুমি খুব কথা শিখেছ। এবার চুপ করতো।

—অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?

কি হবে অত তর্ক করে? তর্ক করে আর সব প্রশ্নের সদুত্তর মিলিয়েই কি আর মেয়েমানুষের মন পথ চলে। তাই আর কথা-কাটাকাটি করতে আমারও ইচ্ছে হলো না। আমরা হাঁটছি। আমার পাশে কামিল। তার দীর্ঘ ছায়ার কিছুটা আমার কাঁধে, আমার মুখের ওপর এসে পড়ছে—এ যেন কামিলেরই স্পর্শ।

কামিল নাছোড়বান্দা। সে আবার প্রশ্ন করল : ওভাবে একটুখানি হাসলে যে!

—এমনি।

—বলবে না?

—আর একদিন। আজ না।

—তাহলে না-ই। কিন্তু এই সখের শ্রম আর কতক্ষণ? পায়ে যে চোট লাগবে!

—থাক না এই অভ্যাসটাও। জানি না তো কোন পথে হাঁটতে হবে।

—তাহলে সত্য কথাটা শুনবে তিশনা? খালি পায়ে এই পথে হাঁটতে এখন তোমার খারাপ লাগবে না। পায়ে যতই কাঁকর বিঁধুক। কারণ তুমি জানো যখন খুশি পায়ে মখমলের জুতো উঠতে পারে; কিন্তু যেদিন দেখবে এই পথ ছাড়া সামনে আর পথ খোলা নেই, আজকের এই বিলাস সেদিন গলার ফাঁস মনে হবে।

—সোনার জুতো পরে সোনায় মোড়া পথে হাঁটাটাই কি জীবনের পরম কাম্য। একবার দেখবে না পথের শেষে তোমার জন্য কি অপেক্ষা করে আছে?

কামিল হাসল।

—না তিশনা। সোনার জুতো পরতে বলি না। আভরণ হিসেবে তার কদর যতই হোক পদাবরণ হিসেবে তা খুব আরামদায়ক হবে না। তবে পথের শেষে তোমার জন্য সোনার পালং অপেক্ষা করে আছে সে তো দিব্য চক্ষেই দেখতে পাচ্ছি।

—সেই সোনার পালং তো এক প্রসন্ন সমাধিও হতে পারে। এবার কামিল গম্ভীর হয়ে গেল। আর কিছু বললো না।

লেকে এখন বেশ ভিড়। রোদও উঠে পড়েছে। আমার খালি পা দেখে অনেকে মুখ টিপে হাসাহাসিও করছে। যতই এই হাসিটুকু গায়ে না মাখবার চেষ্টা করি অস্বস্তি ততই যায় বেড়ে

কামিল আমার মনের ভাব বুঝতে পারল কি না জানি না। কিন্তু বললো : এবার বাড়ি ফিরলে হয় না?

আমার কিন্তু জেদ চেপে গেল। বললাম : এরই মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়লে?

—আমরা তো আর পদব্রজে ভূ-প্রদক্ষিণে বের হই নি। আর শরীর যখন অজর অমর অক্ষয় নয় ক্লান্তি তখন আসেই। আবার যে দেখি মুখ ভার করলে? এত রাগ কেন?

আমি এবার ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। সামনেই লেকের মসজিদটা দেখা যাচ্ছে। মাথার ওপর বড় বড় গাছ। আমার ওপর, কামিলের মুখের ওপর, ঘাসের ওপর তারই ছায়া নড়ছে।

আবার কামিলই বললো : বড় যে অক্লান্ত তুমি! বসেও তো পড়লে তুমিই আগে!

আমি হেসে ফেললাম। এবারও কোনো কথা বললাম না। হাত দিয়ে ইশারা করে আমার পাশেই ঘাসের আসনটি দেখিয়ে দিলাম। কামিল সেখানেই লম্বা হযে শুয়ে পড়ল। আমি গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছি। কামিলের মুখ অন্যদিকে ফেরানো। আমি তাকে দেখছি, কিন্তু সে আমাকে দেখছে না। তার মুখে একটি চোরা কাঁটা; এটি কামিলের অপ্রতিভ মুহূর্তের অভ্যাস আমি জানি। সে এখন কিছু ভাবছে যা তাকে বিব্রত করছে।

এক সময় সে জিগ্যেস করল, কণ্ঠে অনেক দ্বিধা : আমার উপন্যাস কেমন লাগল বললে না?

এবার আমি কাঁটা নিয়ে খেলা করতে লাগলাম। কিছুই বলতে পারলাম না।

—কই বললে না তো?

—নামটা তো বেশ!

—নামটা বেশ, না নামটাই বেশ? আর ছাপা বাঁধাই?

কামিল কথা কয়টি বলে হেসে ফেলল। কিন্তু তবু উত্তরের জন্য অপেক্ষাও করতে লাগল। আমাকে বলতেই হলো : ভালো লাগে নি। আমার এ দুঃখ যে কি তুমি বুঝবে না! কামিল আবার সজোরে হেসে উঠল। হাসিটি সচেষ্ট বলেই এত সরব। তারপর বললো : এইটে বলতেই এত দ্বিধা করছিলে?

—তোমাকে দুঃখ দিলে যে দুঃখ পাই।

—ঠিকই বলেছ তিশনা। এ বই কিছুই হয় নি। হয়তো কোনোদিনই লেখা আমার দ্বারা হবে না। তবু কেবলি মনে হয়—যাক সে কথা!

—না থাকবে কেন? প্রথম বই ভালো না হলেই বুঝি হাল ছেড়ে দিতে হয়?

—এ বই ভালো হলো কি মন্দ হলো সে কথা নয়। আসল কথা লেখকের ধাতুতে আমি তৈরি কি না। কোনদিনই কিছু লিখতে পারব কি না কে জানে।

—পারবে পারবে। আর যদি ভালো লেখক নাই হও তাতেই-বা কি? ভালো লেখক হওয়াটাই কি সব। কেবল ভালো হওয়াটাও কম কথা নয়।

—আমি আর কোনো বিষয়েই কৃতী নই, হতে পারবও না। অন্য কিছু আমার কাছে অতটা কাম্যও নয়। কেউ সাধনা করে অর্থের, কেউ পরমার্থের। যে-কোনো রকম পরমার্থেই আমি আস্থা হারিয়েছি। এখন আমার কাছে একমাত্র সত্য সাহিত্য। এখানেও যদি অসার্থক হই, তাহলে বাঁচব কি নিয়ে?

—একমাত্র সত্য সাহিত্য? আর কিছু নেই?

কামিল অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল। একটি রেলগাড়ি বুঝি বালিগঞ্জ স্টেশন থেকেই কোথাও রওয়ানা হলো। তার ঝকঝক আওয়াজ দুরে মিলিয়ে গেলে কামিল বললো : না, আরো একটি সত্য আছে আমার জীবনে। সে তুমি। কিন্তু দুই বুঝি আমার নাগালের বাইরে।

—কামিল, জীবনটা অনেক সময়ই শূন্য মনে হয়; কিন্তু আবার ভরেও যায় একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে।

—আমি সাময়িক শূন্যতা আর পূর্ণতার কথা বলছি না। আমার কথা তুমি বুঝবে না; কিন্তু এবার উঠতেই হয়। চলো।

—না।

—না! বাড়ি ফিরবে না?

—উঠব আর একটু পর।

—ছোট চাচা তোমাকে আস্ত রাখবেন না।

—আমিও তো তাই চাই। সবগুলো তরী পুড়িয়ে ফেলতে চাই। ফিরবার আর উপায় যেন না থাকে।

—আত্মহত্যা করবার সখই যদি তোমার হয়ে থাকে, অন্য উপায় আবিষ্কার কর। আমি তোমার গলার ফাঁস হতে পারব না।

—আচ্ছা চলো। কিন্তু আমার একটা অনুরোধ রাখবে?

—বলো।

—মোড়ের দোকান থেকে এক জোড়া স্যান্ডেল কিনতে হবে। তারপর দ্বারিকের দোকানে বসে কিছু খাব।

—উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু এভাবে যে বেপরোয়া হয়ে উঠলে—মতলবখানা কি?

—একেবারেই ভালো নয়।

আমরা পথে নেবে এলাম। কিন্তু বেশি দূর এগুবার আগেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়তে লাগল। মশারির ঝালরের মতো আমাদের দু’জনের মাথার ওপর, চারদিকের ঘরবাড়ি গাছপালার ওপর, বৃষ্টি এলো নেবে। অন্যের দৃষ্টি থেকে আমাদের আড়াল করে দিল।

দ্বারিকের দোকানে খাওয়া আজ আর নসিবে নেই। একটা ফিটন নিয়ে আমরা এবার বাড়ির দিকে ফিরলাম।

ফিটন থেকে নাবতেই দেখি, বারান্দায় ছোট চাচা দাঁড়িয়ে আছেন।

আমাদের দেখতে পেয়ে তিনি সরে গেলেন।

ওপরে উঠতে উঠতে আমি মনে মনে কোমর বাঁধতে লাগলাম।

ছোট চাচা কিন্তু একটা কথাও বললেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *