প্রসন্ন পাষাণ – ১৮

১৮

পরদিন সকালে সূর্য উঠল নীল আকাশে। বাতাস বেশ ঠাণ্ডা; একটু শীত শীত করছিল। আজ প্রভাতের স্মিত হাসিটুকু দেখে বিশ্বাসই হতে চায় না রাত্রে প্রকৃতির কি দুৰ্যোগটাই-না গেছে।

ছোট চাচা তাঁর খাটে শুয়েছিলেন। সামনের জানালাটি খোলা; তারই ভিতর দিয়ে তাঁর দুটি চোখের দৃষ্টি পাখির মতো নীল আকাশের গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনিও আজ বড় শান্ত অথবা শ্রান্ত। তাঁর স্থির শরীর আর পাণ্ডুর মুখ দেখে মনে হয় এক রুগ্ণ রোগশয্যায় পড়ে আছেন, হয়তো আরোগ্য লাভই করছেন।

গরম দুধের পেয়ালায় ফুঁ দিতে দিতে আমি তাঁর ঘরে প্রবেশ করলাম। পেয়ালাটা পাশের টি-পয়ের ওপর রেখে আমি খাটে তাঁর পায়ের কাছে বসে পড়লাম। ছোট চাচা তেমনি পড়ে থাকলেন। আমিও কোনো কথা না বলে তাঁর পায়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। এক সময় চুরি করে আমার চোখ গিয়ে পড়ল সেই তাকটার ওপর। আজ সেখানে বোতল, গেলাস, পানি কিছুই নেই।

—ভাবছি তোকে ভাইজানের কাছে রেখে আসব। তোর দেখাশোনা করতে পারি কৈ! আমি এবারো চুপ থাকলাম। তেমনি নীরবে তাঁর পায়ের ওপর হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম।

আবার ছোট চাচাই কথা বললেন।

—ময়না কি করছে রে!

বলেই তিনি পাশ ফিরলেন, বোধ করি আমার দৃষ্টি এড়াবার জন্য।

—ঠিক জানি না। সকাল থেকে তাঁকে দেখি নি।

—বাড়ি নেই না কি?

—আছেন। কিন্তু তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ।

আবার বহুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলি না। এবং আবার ছোট চাচাই প্রথমে কথা পাড়লেন।

—ময়নাকে তুই খুব ভালোবাসিস। তাই না!

—তিনি এমন মানুষ। ভালো না বেসে উপায় আছে।

ছোট চাচার পা দুটি সামান্য নড়ছিল। এবার স্থির হয়ে গেল।

—তিশনা, আমি ভাবছি মাস ছয়েকের জন্য বাইরে যাব।

—যাও।

—পারবি তুই একা থাকতে?

—তুমিও থাকবে না, ছোট ফুপুও থাকবে না। আমি একা কার সঙ্গে থাকব!

তোর ছোট ফুপু থাকবে না কেন?

ছোট চাচা এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার মুখের প্রতিটি রেখা পড়বার চেষ্টা করতে লাগলেন। আমি চোখ নাবিয়ে নিলাম।

আবার সেই প্রশ্ন।

—তোর ছোট ফুপু থাকবে না এ কথা তোর মনে হলো কেন?

আমি জবাব দেব কি, ফস করে মুখ দিয়ে যে কথাটি বেরিয়ে গেল, ছোট চাচার কাছে কাল রাত্রের ঘটনার পর তার অর্থ কি হতে পারে তা কি আর আমি বুঝি না। আমি তাই কোনো জবাবই দিতে পারলাম না। মাথা নিচু করে তেমনি তাঁর পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম; কিন্তু আমার আঙুলে আর যেন জোর নেই।

ছোট চাচাও আর প্রশ্ন করলেন না। চোখ দুটি মুদে পড়ে থাকলেন। এক সময় ছোট চাচার শরীর কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। নিজের মনেই তিনি আউড়ে গেলেন : O God! that men should put an enemy in their mouths to steal away their brains…

আমি কাছেই বসে আছি সে হুঁশটুকু পর্যন্ত তাঁর যেন নেই। আমি আর বসে থাকতে পারছিলাম না। ছোট চাচার এখন একা থাকা দরকার উঠে পড়লাম।

—আর শোন! থিয়েটার করতে চাইলে তুই করতে পারিস। আমি আ-র আপত্তি করব না। সেই দিনেরই আরো কয়েকটি বিক্ষিপ্ত পরস্পর সম্পর্কহীন ঘটনা মনে পড়ে।

আমার মনটা ছিল অশান্ত। সেদিন সকালবেলাই কামিল সিরাজগঞ্জ থেকে ফিরেছে। আবার সকালবেলাই কোথায় বেরিয়ে গিয়েছিল। এইমাত্র ফিরল। দুপুর গড়িয়ে গেছে। দিনটা ছিল রবিবার মনে আছে। ধোপা বসে আছে। অসময়ে এসেছে বলে প্রথমে রাগ করলাম। কিন্তু সেও কিছুতেই শুনবে না, ময়লা কাপড়ের জোগান নিয়ে তবে যাবে। আমি একরাশ ময়লা কাপড়ের মাঝখানে বসে আছি। এমন সময় ঘরে ঢুকল কামিল। আমাকে ব্যস্ত দেখে আমার খাটের একপাশে চুপ করে বসে পড়ল।

হাতের কাজ শেষ হলে আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

—জানো তিশনা, আমার একটা উপন্যাস বের হচ্ছে।

—সর্বনাশ! তোমার ঝুলিতে আস্ত একখানা উপন্যাস লুকিয়ে ছিল কোনোদিন ভাবতেও পারি নি। কোনোদিন শুনব, তুমি গোপনে বারুদের কারখানা চালাচ্ছে।

—ঠাট্টা! যেদিন ছাপার অক্ষরে দেখবে সেদিন তো আর অবিশ্বাস করতে পারবে না।

অবাক হবারই কথা! এর মধ্যে কামিল আস্ত একটা উপন্যাস লিখে ফেলল কখন!

—তিশনা, ভেবেছিলাম তুমি কত খুশি হবে।

—খুব হয়েছি। তা তোমার উপন্যাসের বিষয়বস্তুটা কি?

এইবার কামিল যেন একটু বিব্রত হয়ে পড়ল।

—সত্যি কথা বলতে কি, বিষয়বস্তু গোড়ার দিকে একরকম ছিল। কিন্তু পাবলিশার বললো, কাটতি হবে না। সে কিছু অদলবদলের পরামর্শ দিল। আমারও প্রথম উপন্যাস কি না, একটু-আধটু কমপ্রোমাইজ করতেই হয়।

—তাহলে বলতে পার, উপন্যাসটা আধা তোমার আধা পাবলিশারের লেখা!

–লেখা সমস্তটাই আমার। তবে পাবলিশারের আইডিয়া কিছু কিছু আছে বটে।

—অমন বই নাইবা লিখলে!

—তুমি বল কি। জানো, বাইশশ’ কপি বই ছাপা হবে। পাবলিশার বলে এই এক এক কপি বই গড়ে পাঁচজন পড়ে। কত বড় একটা সাকসেস ভেবে দেখেছ!

—একটা বই পাঁচজন পড়ে। আবার পাঁচজন মিলেও একটা বই পুরা পড়তে পারে না। এমন বইও তো আছে।

—বললে তুমি এমন কথা।

—একটু ঠাট্টাও করতে পারব না!

আমি অসন্তুষ্টই হয়েছিলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে চলে এলাম। কামিলকে বলে এলাম। ময়লা কাপড় ঘেঁটেছি। হাত দুটি ধুতে হবে।

সেইদিন সন্ধ্যার কথা। আমি ছোট ফুপুর ঘরে নেবে এলাম। বিকেলবেলা কিছুই করবার ছিল না। অনেকক্ষণ ধরে যত্ন করে প্রসাধন করলাম। চুলে তেল মেখে দু’দিক দিয়ে বেণি ঝুলিয়ে দিলাম। সাধারণত আমি খোঁপা বাঁধি—কাঁধের দু’দিক দিয়ে বেণি নাবিয়ে দিলে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হয়। কিন্তু সেদিন কি মনে হলো, টেনে চুল বেঁধে বেণি ঝুলিয়ে দিলাম। এ কথাটি হয়তো না বললেও চলত। কিন্তু মানুষের জীবনে এমন অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা জমতে থাকে, মনের কোনো এক সূক্ষ্ম অপরিস্ফুট জটিল গ্রন্থির সঙ্গে যার একটা অদৃশ্য অথচ নিগূঢ় যোগ থাকে। এই বেণি করার মধ্যে সেদিনকার মনের অবস্থার হয়তো কোনো ব্যাখ্যা ছিল। ব্যাখ্যাটা যে কি সে কি আমিই জানি।

যাই হোক, আমি যখন নিচে নেবে এলাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। ছোট ফুপু রান্না করবার জন্য ঘেরা অপরিসর জায়গাটিতে অন্ধকারে চুপ করে বসে আছেন। সামনে চুলোর ওপর একটি ছোট হাঁড়িতে ভাতের চাল চড়ানো হয়েছে। পানি টগবগ করে ফুটছে। হাঁড়ির ঢাকনি উষ্ণ বাষ্পে একবার উঠছে একবার পড়ছে। সেদ্ধ চালের গন্ধ নাকে ভেসে আসে। এই পরিবেশটুকুতে এমন এক অন্তরঙ্গতা ছিল যা বারবার মনটিকে ছুঁতে থাকে।

ছোট ফুপুর পাশের পিঁড়িতে আমি বসে পড়লাম। ছোট ফুপুর মুখে তবু কথা নেই। আমার মুখ দিয়েও কথা সরতে চায় না। মুখরতা এই পরিবেশের অন্তরঙ্গতাটুকুকে বুঝি পণ্ড করে দেবে। ডেকচি আর ঢাকনির ফাঁক দিয়ে গরম তাপ বেরিয়ে আসছে—বাষ্পধূম্রের সেই রেখাগুলোর ওপর আমাদের দু’জনের চোখ। টগবগ করে ভাত ফুটছে। কানে কেবল তারই শব্দ।

আমি অকারণেই একটা কাঠি দিয়ে কয়লার আগুন উস্কে দিলাম। হাতের চুড়ি একটুখানি শব্দ হলো।

শুধু তখনি যেন কথা বলার পরিবেশটা তৈরি হলো।

—তোমার শরীর কি ভালো নেই, ছোট ফুপু?

—না মা।

—কি হয়েছে বলবে না?

—এমন কিছু না। এমনি বিশেষ ভালো নেই।

—একটা সত্যি কথা বলবে?

ছোট ফুপু সন্ত্ৰস্ত চোখ দুটির ক্লান্ত দৃষ্টি আমার ওপর মেলে দিলেন।

আমি প্রসঙ্গ বদলে ফেললাম।

বললাম : না বলছিলাম কি, রোজ এই রান্নাবান্না করতে নিশ্চয়ই তোমার কষ্ট হয়?

ছোট ফুপু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

—কষ্ট? না কষ্ট কিসের।

আমি আবার কাঠি দিয়ে আগুন উস্কে দিলাম। কয়লাগুলো আগুনের ছোট ছোট পিণ্ডের মতো রক্ত চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দু’জনের দিকে। খাঁচায় পোরা বাঘের চোখের মতো। পারলে এখুনি ছিঁড়ে খাবে। হাঁটুর ওপর চিবুক রেখে ছোট ফুপু বসে আছেন। হাতের একটি আঙুল দিয়ে ছাইয়ের ওপর হিজিবিজি কি সব আঁকছেন। আগুনের দগদগে আভা তাঁর চোখে-মুখে সূর্যাস্তের বর্ণ লেপে দিচ্ছিল। মানুষ এত সুন্দরও হতে পারে!

আমি অন্যমনস্কভাবে প্রশ্ন করলাম : ছোট চাচা মদ ধরেছেন। কেন বলতে পার?

তারপর মিনিটখানেক নীরবতা। কিন্তু যুগ-যুগান্তর বুঝি এর চাইতে দ্রুত কাটে। পায়ের কাছে ছড়িয়ে থাকা ছাইয়ের ওপর ছোট ফুপুর আঙুল নড়ছিল। হঠাৎ স্থির হয়ে গেল।

ছোট ফুপুর মাথা হাঁটু দুটির মাঝখানে আরো নিচে নেবে এলো। তাঁর স্থির আঙুলটি ছাইয়ের ওপর পড়ে আছে একটা মরা গিরগিটির মতো। কিন্তু সূর্যাস্তের আভা তখনো তাঁর চোখে-মুখে রঙ বুলিয়ে দিতে লাগল।

আমি উপরে উঠে আসব, দেখি সিঁড়ির কোণে কে যেন ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে। আমি এক পাশে সরে এলাম।

—কে?

—আমি আলীম।

—আলীম! এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে!

—তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।

—ঘরে গিয়ে বসলেই তো পারতে। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে আছ?

আলীম সে প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। উপরেও উঠে এলো না। সেই অন্ধকার কোণে তেমনি দাঁড়িয়ে থেকে বললো : সেদিন রাতে তোমার নাটক করা নিয়ে আমার কটুকথা তুমি শুনেছ। আজ একটা কথা বলে যাই। মনের জ্বালায় আমি যাই বলি না কেন, তুমি কোনো অন্যায় করতে পার না আমি জানি।

এই কথা কটি বলে আলীম এক মুহূর্তে চুপ করল।

আমি অন্ধকারে তেমনি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আলীমও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে কিছু চিন্তা করছিল।

কিন্তু আর একটি কথাও না বলে সে হঠাৎ চলে গেল।

সিঁড়ির এক কোণে আমি স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

—আঁধারে দাঁড়িয়ে করছিস কি! উপরে আয়।

ছোট চাচা আমার হাত ধরে উপরে নিয়ে এলেন। তাঁর মুখ ভয়ানক গম্ভীর।

—তিশনা, আমার সুটকেসটা প্যাক করে দেতো।

–সে কি! তুমি সত্যিই চললে না কি?

ছোট চাচা পালংয়ের ওপর পা ঝুলিয়ে বসলেন। অনেকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

—একটা খারাপ খবর আছে মা। তোর ফুপুজান পাবনায় হার্ট ফেল করে মারা গেছেন। টেলিগ্রাম এসেছে। আমাকে এক্ষুণি নর্থ বেঙ্গল একপ্রেসে রওয়ানা হতে হবে।

আমি একটি কথাও বলতে পারি না। জাফর সাইকেলে পাম্প দিচ্ছিল। তারই হুশ হুশ হুশ শব্দ আসতে লাগল কানে।

এবং এইখানেই আমার দুই অঙ্কের এই জীবননাট্যের প্রথম অঙ্কের ওপর যবনিকা নেবে এলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *