প্রসন্ন পাষাণ – ৫

পাঁচ

আমার এই কাহিনী অত্যন্ত বিলম্বিত লয়ে বাদ্যি বাজাচ্ছে। প্রথমত স্মৃতির নকশি কাঁথা তৈরি করা সহজ কর্ম নয়; তদুপরি আমার সমস্যা এই যে, গুছিয়ে নিটোল করে একটা কাহিনী উপস্থিত করব সে বিদ্যা বা অনুশীলন কোনোটাই আমার নেই। বিগত জীবনের ঘটনাবলির বৃত্তটির সূত্র খুলতে বসে দেখতে পাই, যতদূর চোখ যায় কেবলই ছোট বড় ঘটনার ছোট বড় তরঙ্গ। কতটা বলতে হবে, এবং কতটা না বললেও চলে—বরং বলাটাই চলে না—সেটাও আমি ঠিকমতো বুঝতে পারি না।

তাছাড়া আরো একটা অসুবিধা আছে। সংসারের বিভিন্ন কাজের অবসরে অত্যন্ত নিভৃতে এবং অতিশয় সঙ্গোপনে আমাকে এই সাহিত্য সাধনা করতে হচ্ছে; অবশ্য সাহিত্য সাধনার মতো একটা কঠিন নাম যদি এই অধ্যবসায়কে দেয়া যায়। একজন বিখ্যাত মহিলা লেখিকার একটি বই পড়েছিলাম : এ রুম অফ ওয়ান্‌স ওউন। বিশ্বের ইতিহাসে মহিলাদের ভূমিকা আরো বিশিষ্ট কেন হয় নি লেখিকা বিস্তৃতভাবে তারই আলোচনা করেছেন। অবশ্য সেই একই জিকির তোলা এই আখ্যায়িকার উদ্দেশ্য নয়! তবু অতিশয় বিনয়ের সঙ্গে কতিপয় অসুবিধার কথা উল্লেখ করব—যদিচ ছেলেবেলা থেকেই আমার নিজের জন্য একটি স্বতন্ত্র কক্ষ নির্দিষ্ট ছিল, একান্ত আপনার এক জগৎ।

আমার এক পরমাত্মীয়কে আমার এই শিল্পকর্মে উৎসাহিত করতে চেষ্টা করেছিলাম। বড় আশা ছিল, তিনি আমার এই দিগ্বিদিকহীন কাহিনীটিকে নির্দিষ্ট বন্দরে পৌঁছে দিতে সহায়তা করবেন। রাত্রিবেলা। বন্ধুর সঙ্গে সন্ধ্যার শো’তে সিনেমা দেখে একটু আগেই তিনি ফিরেছেন। এইমাত্র আহার সেরে মুখে একটি পান পুরে সেদিনের খবরের কাগজটি চোখের সামনে মেলে ধরে তিনি বিছানায় আশ্রয় নিয়েছেন। এমন সময় আমার ভীরু দুটি হাত এই পাণ্ডুলিপির কিয়দংশ তাঁর দিকে এগিয়ে দিল। হস্তস্থিতের তুলনায় হস্তের প্রতি তাঁর যে রকম নিষ্ঠা দেখলাম তাতে আমার রাগ হতে পারত, তবে কিনা হস্তটিও তো আমারই। তাই তাঁর দৃষ্টির এই লক্ষ্যভ্রম আমাকে সেভাবে দংশন করতে পারল না। পাণ্ডুলিপিটা কিছুকাল নাড়াচাড়া করে আমার হাতে ফিরিয়ে দিলেন। বাঃ বেশ হচ্ছে, এই বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন।

দিনেরবেলা লিখতে বসা আরো অসম্ভব; কারণ আমি জানি আমার এই কাজটিকে কেউ সুনজরে দেখবেন না। এমনকি আমার নিজেও এ ব্যাপারে এক অদ্ভুত অপরাধবোধ ছিল। নাটক-উপন্যাসের মতো এমন অনাবশ্যক—এমনকি অবাঞ্ছিত বস্তুর জন্য সংসারের ময়দা পেশা ও ডালে বাঘার দেওয়ার মতো অপরিহার্য কর্তব্যগুলোতে শিথিলতা দেখা দিলে সে ত্রুটি কেউ ক্ষমা করবেন না। সবচাইতে মজার কথা, আমি নিজেও করব না। তাই অন্যসব প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে এই অপ্রয়োজনের দায় সারতে বসি। কিন্তু এইভাবে বসবার সময়টুকু অফুরন্ত নয়। তাই একদিন লিখতে বসবার পর বেশ কিছুদিনের ফাঁকের মধ্যে মনটি হারিয়ে যায়। যে মন নিয়ে আজ লেখা শেষ করে উঠলাম, পরের বার লিখতে বসে সেই মনটিকে আর খুঁজে পাই না। বিগত দিনের লেখনীতে বাঁশরির যে সুর বেজেছিল, পরবর্তী দিনের রচনায় তার রেশটুকু আর লাগে না। ঘটনাগুলোকে যেন কেমন নির্লিপ্ত, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে স্বতন্ত্র মনে হয়, একটি থেকে আর একটি যেন মুখ ফিরিয়ে থাকে, ঘটনাগুলো যেন বিভিন্ন দিক থেকে একে অপরকে ঠেলা দিচ্ছে—সবগুলো মিলে ঐকতানের ঐক্য বাজে না।

সুতরাং আর অধিক অগ্রসর হতে কোনো পাঠক যদি অনিচ্ছুক হন, তাঁকে দোষ দেব না। এ উপন্যাস তাঁর না পড়লেও চলবে; কিন্তু এ কাহিনী না লিখলে আমার চলবে না।

ভাবতে অবাক লাগে, এই আমাদের মেয়ের মন, কি যে চায় আর না চায়। কি যে চায় তা কি ছাই জানে। আমিই-বা কি চেয়েছিলাম? রাঙা টুকটুকে বর? ফুটফুটে ঘর? সচ্ছল সংসার? প্ৰেম?

ঠিকমতো কিছুই বলতে পারব না। মানুষের চাওয়ার কি শেষ আছে। প্রত্যাশার সমগ্র চেহারাটাই কি সে দেখতে পায়। কোনো মানুষের পক্ষেই কি আত্মহারার মতো সুখী হওয়া সম্ভব। কোনো একটা বেদনা, যার রূপ নেই, ঠিকানা নেই সর্বক্ষণই মনের মধ্যে পাখির পায়ের শিকলের মতো বাজতেই থাকে। তাছাড়া চিরটাকাল কি মানুষ একই জিনিস চায়। কাম্যবস্তুরও তো পরিবর্তন-সংশোধন আছে।

একদিনের কথা বেশ মনে পড়ে। তখন আমার বেশ বয়স হয়েছে। কোনো একটি মফস্বল টাউনে তখন থাকি। এখন এর বেশি কিছু বলা কাহিনীর স্বার্থে ঠিক হবে না।

আকাশে মেঘ করে এসেছে। রাতও বেশ গভীর। শীত শীত করছিল, গায়ে চাদরটি ভালো করে জড়িয়ে নিয়েছি। পথিপার্শ্বের দোকানগুলো ঝাঁপি বন্ধ করছে। কাঁচা সড়কে লোক চলাচল বিরল। ঝিঁঝির অবিশ্রান্ত ডাকে নিশীথের অন্ধকার আকম্পিত। ক্বচিৎ অতি দূর থেকে দুই পথিকের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। তাদের খণ্ড আলাপের শব্দ এই পরিবেশে সর্বাঙ্গে জীবনের এক আশ্চর্য উষ্ণতা মেখে দিয়ে যায়। এমন সময় বারান্দায় একটি ইজিচেয়ারে অন্ধকারে শুয়ে থেকে দেখতে পাই, একটি গরুর গাড়ি, একটিমাত্র গরুর গাড়ি, চাকার ক্যাচারম্যাচর শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে। চাকার একটু উপরেই একটি লণ্ঠন বাঁধা; চালকের আপাদমস্তক একটা সাদা কাঁথায় ঢাকা, তার কণ্ঠে একটি বাউল গান। গরু চলছে আপন মনে, চালকও আপন মনে গাইছে। লণ্ঠনটি ঝাঁকানিতে দুলছে, শিখাটি বাতাসে কাঁপছে। দু’পাশের ঝোপঝাড় থেকে ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে।

হঠাৎ আমার সর্বশরীরে এক কাঁপুনি থরথর করতে লাগল। সেই লণ্ঠনের শিখার মতো সুন্দর দৃশ্য আমি যেন আর দেখি নি। অমন মর্মস্পর্শী গানও যেন আর কখনো শুনি নি। গরুর গাড়ির চাকার আওয়াজ তাও কানে মধুর লাগে। এমনকি কাদার বুকে বড় বড় চাকার দাগ দেখেও আবেগে মন ভরে যায়।

মনে হলো গরুর গাড়ির চালকের মতো সুখী উদার নিস্পৃহ নিষ্কাম নির্লোভ ব্যক্তি যেন সারা দুনিয়ায় আর নেই। এবং সেই মুহূর্তে এক অসহ্য সুখে আমার সারা শরীর যেন অবশ হয়ে এলো। মনে হলো, সেই মুহূর্তে বিশ্ববিধাতা যেন আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন।

সেই রাত্রের মতো সুখানুভূতির অভিজ্ঞতা আমার জীবনে কমই হয়েছে। তাই বলছিলাম, মানুষের মন কি যে চায় সে কি নিজেই তা জানে। অন্তত আমার নিজের মন কি যে চায় তার সমগ্র চেহারাটা আমি জানি না।

সংসারের সুখ-দুঃখ বেদনার কারণগুলো সবসময় আমাকে তেমনভাবে স্পর্শ করে না। ফুল ফোটে, পাতা ঝরে, পাখি গান গায়, আত্মীয় বিয়োগের সংবাদ আসে কিন্তু আমার মনে হয় এসব কিছুই আমার সত্তার বাহিরের এক রঙ্গমঞ্চের লীলাখেলা, আমার সঙ্গে সম্পর্কহীন। আমি খাই দাই ঘুরে বেড়াই, আর মাঝে মাঝে অনুভব করি আমার মনটি এক জায়গায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে—তার যেন ঠিকমতো পরিণতি হচ্ছে না। মনটি যেন কি সব স্বপ্ন নিয়ে পুতুল খেলা খেলছে, মনটিও অসম্বত, স্বপ্নগুলোও নিরাকার। তা বলে আমি খামখেয়ালি নই, হৃদয়হীনও নই। আমাকে আত্মকেন্দ্রিক বললেও অবিচার করা হবে। তবু কিছুই আমাকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করতে পারে না। যা চোখের সামনে ঘটছে তা অল্পক্ষণের জন্য হাসিয়ে আর কাঁদিয়ে ফুলঝুরির মতো শেষ হয়ে যাবে। এসবে আমার প্রয়োজন নেই।

আবার ছোট ছোট নিতান্তই তাৎপর্যহীন ঘটনায় আমার মনটা এমন প্রবলভাবে নাড়া খেয়ে উন্মুখ হয়ে ওঠে যে তাও এক আশ্চর্য ব্যাপার।

তরীর পাল দেখে, বাঁশবনের ঝাড় দেখে, গ্রাম্যবধূর মাথার ঘোমটা দেখে, আকাশে একখণ্ড মেঘ দেখে আমি মাঝে মাঝে এমন দিশেহারা হয়ে যাই যে তাও অবিশ্বাস্য মনে হবে।

তোমরা মনে করো না নিজকে অসামান্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য আমি এই কথার সাজি সাজিয়ে এনেছি। আমার মতো সামান্যা দুটি মিলবে না। কিন্তু কেমন করে যেন আমার মনটির ব্যবহার সৃষ্টিছাড়া হয়ে যায়। এবং তখুনি আমাকে নিয়ে হয় বিপদ।

কামিল কতদিন ধরে আমাদের এখানেই আছে, তবু তাকে আমার চোখেই পড়ে নি। সে স্কুল যায়, ফিরে আসে, হাত-পা ধুয়ে নাশতা করে নেয়—তারপর বেরিয়ে পড়ে। আবার পায়ে ধুলাবালি মেখে ফিরে আসে, আর একবার হাত-মুখ ধোয়া, তারপর সেই যে তাদের ঘরে প্রবেশ করে পরদিন সকালের আগে আর তাকে দেখাই যায় না। সে যে দেখতে ভালো তা কোনোদিন মনে হয় নি, তাকে যে দু’চোখে তুলে একবার দেখা চলে তাও কখনো মনে হয় নি। কতদিন তো হলো তারা এসেছে। তার মা-র প্রতি একটা দুর্নিবার আকর্ষণ বরং বারবার আমাকে তাদের ঘরের দোরগোড়া পর্যন্ত টেনে এনেছে; কিন্তু কামিলকে কোনোদিনই আমার চোখে পড়ে নি। অর্থাৎ আমার মনের চোখে।

কোনো কোনো লোক আছে যাদের একটি বিশেষ পটভূমি বা পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে না দেখলে তাদের সত্যকার দেখাই হয় না। তাদের রূপই বল, ব্যক্তিত্বই বল, মানসিক ঐশ্বর্যই বল, তাদের মনের স্বরূপই বল, সেই বিশেষ পটভূমিতে না দেখলে দেখাই হয় না। এই পরিবেশটুকুর অভাবে ব্যক্তির স্বরূপ তার নিজের ও পরের কাছে অনাবিষ্কৃত থেকে যায়।

সেদিন অনেক রাত হয়ে গেছে। বাড়ির সকলেই খাওয়াদাওয়া সেরে শয্যা নিয়েছেন। এমনকি ছোট চাচাও ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমিও বাতি নিভিয়ে খাটে এসে শুয়ে পড়েছি। এমন সময় একটা মিহি মিঠে আওয়াজ এলো কানে। কণ্ঠটি পরিচিত মনে হলো; কিন্তু চেনা মুখ দেখেও যেমন অনেক সময় কিছুতেই মনে পড়ে না, কোথায় দেখেছি, তেমনি আওয়াজটি যে কোথায় শুনেছি তাও ঠাহর করতে পারছিলাম না। কণ্ঠটি দরাজ নয়, কেমন যেন ভীরু সলজ্জ, প্রদীপ শিখার মতো অনিশ্চিত কম্প্র।

আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। অন্ধকারেই পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেবে এলাম। মিঠে আওয়াজটি যেন ত্রস্ত হরিণী, পদশব্দে যার পলায়ন নিশ্চিত।

সিঁড়ির নিচে অন্ধকার কোণটিতে এসে দাঁড়ালাম।

ছোট ফুপুর ঘরের একটি কবাট খোলা। ভিতরে লণ্ঠন জ্বলছে।

তিনি পড়ছেন :

শুলশন মে নহি ও’হ গুলে রানা কাঈ দিন সে
বেচইনিমে হ্যয় বুলবুলে শায়দা কাঈ দিন সে
রানজিদে নজর আতে হঁয় মওলা কাঈ দিন সে
কিয়া কহরে হায় আল্লা হো তালা কাঈ দিন সে

ছোট ফুপু তাঁর কণ্ঠের মর্মস্পর্শী আবেদন দিয়ে রাত্রির অন্ধকারের দুয়ার খুলতে চান— আলোক দেখবার আশায়। তাঁর স্বরে এক বেদনাবিদ্ধ আকুলতা ছিল। নিস্তব্ধ প্রহরের অবকাশে তিনি তাঁর আল্লাহকে তাঁর মওলানাকে স্মরণ করছেন, না কি তাঁর হৃদয়ের অন্তঃস্থিত কোনো ফরিয়াদ আছে যা তিনি খোদাতায়ালার দরবারে পৌঁছে দিতে চান? বড় ইচ্ছে করতে লাগল, তাঁর কোলের কাছে বসে পড়ে আমিও তাঁর ধর্মাচরণের অংশ নিই। কিন্তু দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারলাম না। দরজার আড়ালে তাঁদের দৃষ্টির অন্তরালে দাঁড়িয়েই থাকলাম। কামিল তাঁর কোল ঘেঁষে মাদুরের ওপর শুয়েছিল। তার চোখে-মুখে দিনের অস্থিরতা নেই। চঞ্চলতার ছোট ছোট বুদ্বুদগুলো তার চোখমুখের অভিব্যক্তিকে এখন আর আকীর্ণ করে নেই, সেখানে এখন গভীর দিঘির স্তব্ধতা। লণ্ঠনের আলো সরাসরিভাবে তার চোখের ওপর এসে পড়েছে, সেখানে কিসের যেন তন্ময়তা। কামিলের নিস্তরঙ্গ দেহটিকে ভাস্করের এক মূর্তির মতো মনে হচ্ছিল। তাকে আমি সেই প্রথম দেখলাম।

এমনও হতে পারে আমার নিজের মনটাই তখন এক বিশেষ তারে বাঁধা ছিল। আমি হয়তো আমার হৃদয়ের বর্ণ দিয়েই কক্ষটিকে রাঙিয়ে তুলেছিলাম। তবু সেই কক্ষটির পরিবেশ বড়ই লোভনীয় মনে হলো।

তেমনি নিঃশব্দেই আবার ওপরে উঠে এলাম। দেখলাম ছোট চাচাও অন্ধকারে রেলিং ধরে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই মুহূর্তেই হঠাৎ ফুপুজানের ঘরের দরজাও খুলল। ছোট চাচা একটি কথাও বললেন না, তাঁর ঘরে গিয়ে প্রবেশ করলেন। ফুপুজানও আবার তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ করলেন; কিন্তু বেশ একটু শব্দ তুলে। শব্দটিতে কিসের যেন প্রতিবাদ ছিল।

বিছানায় পড়ে থাকলাম। চোখে ঘুম নেই। এক সময় শুনতে পেলাম, কোথায় ঢংঢংঢং করে বারোটা বাজল।

নির্জন পথ দিয়ে একটি রিকশাও চলে গেল ঠুং ঠুং করে। নিস্তব্ধ প্রহরে এইসব ছোট্ট ছোট্ট শব্দের বুদ্বুদ মানুষের মনকে সঙ্গ দেয়। হঠাৎ সংবিৎ ফিরে আসে যে বেঁচে আছি, জীবলোকের মধ্যে, জীবিত লোকের মধ্যেই আছি।

তোমরা বলবে, সেদিন রাত্রিবেলা এক ভদ্রমহিলা ধর্মচর্চা করছিলেন, এই কর্মের মধ্যে তুমি নতুন কি জিনিস আবিষ্কার করলে যে তাই তোমার জীবনের এক গভীর অভিজ্ঞতা হয়ে থাকল? এমন তো কতই দেখা যায়, কিন্তু ক’জন মনে রাখে, আর ক’দিনই-বা মনে রাখে?

তা ঠিক। কিন্তু একই ঘটনা বিভিন্ন মুহূর্তে বিভিন্ন পরিবেশে মানব হৃদয়ের এক বিশেষ গ্রহণশীল অবস্থায় এক বিশেষ তাৎপর্য লাভ করে। আমার মন হয়তো তখন গ্রহণ করবার জন্যই উন্মুখ হয়ে ছিল, তাই হৃদয়ের তারে সঠিক সুরটি বেজে উঠল।

তাছাড়া ছোট ফুপুর আবৃত্তি শব্দগুলোর মধ্যে যে বক্তব্য ছিল তার মধ্যকার বেদনাবোধ ছাড়াও, তাঁর কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যা তাঁর উচ্চারিত বাণীতে এক শব্দাতীত ব্যঞ্জনাদান করতে সমর্থ হয়েছিল। ছোট ফুপুর মনের মধ্যে কি ছিল জানি না, হয়তো তিনি নিজেও জানতেন না; কিন্তু মনের এমন অনেক আকুতি আছে ভাষায় যার প্রতিরূপ ঠিকমতো আসে না। মনের কথা মুখের ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। কেবল কণ্ঠের ব্যঞ্জনায় চোখের চাউনিতে হাতের একটি আক্ষেপে অথবা হয়তো মুখের একটি রেখায় সেইভাবই বাঙময় হয়ে ওঠে। ছোট ফুপুর আবৃত্তি আমার বুকে এক প্রচণ্ড ধাক্কা মারল এই কারণে যে আমি সেদিন এক ভাষাতীত ভাষা শুনলাম বা শুনলাম বলে কল্পনা করলাম, যা হঠাৎ আমার মনের দিগন্তকে সূর্যালোকের মতোই উদ্‌ভাসিত করে তুলল। শিল্পী তার পটে এমন এক বর্ণের প্রলেপ দিতে চায় যে বর্ণের কোনো অস্তিত্বই নেই, আছে কেবল তার মানসলোকে। তেমনি অনেক ভাব আছে যার কোনো ভাষা নেই। তখন ইঙ্গিত আর সঙ্গীতই একমাত্র আশ্রয়।

সেই রাত্রে সেই সঙ্গীত আমার হৃদয়কে স্পর্শ করে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *