এগারো
সেদিন বিকেলবেলা সবে স্নান সেরে খোলা চুলে জানালার কাছে বসে আমি একটা বই পড়ছিলাম। কামরার দরজা ছিল খোলা। লোক চলাচলের শব্দ আসছিল কানে; কিন্তু আমার মন ছিল বইয়ের পাতায়,—এমিল ব্রন্টের ওয়াদারিং হাইটস—অন্য কোনো দিকে লক্ষ্য ছিল না।
—জানো কেমন লাগছে। তোমার লম্বা গ্রীবাটি রজনীগন্ধার বৃন্ত, আর তার ওপরের মুখটি? হরিণীহীনা হিমধামা। বিদ্যাপতি পড়েছ? তুমি ইন্দুমুখী। তোমার মুখটি চন্দ্রমা।
সেদিন আমার মনটি অত্যন্ত প্রসন্ন ছিল, একেবারেই অকারণে। এমনকি আলীমের সঙ্গেও পরিহাসের সুযোগটি নষ্ট করলাম না। তাছাড়া এ কথা তো মানবে, ভদ্রতা বলেও একটা জিনিস আছে?
—তুমি যে দেখছি কাব্যরসে কক্ষটিকে ধৌত করে দিলে। কিন্তু রজনীগন্ধার বৃত্তে চন্দ্রোদয়ের কল্পনাটি তোমার, না তোমার সেই বাংলার লেকচারার-কবির?
—লেকচারার-কবির কথা শুনেছ দেখছি। কিন্তু তুমি যে আমাকে অবাক করলে। এত সুন্দর বাংলা বলো তুমি! চর্চা করো চর্চা করো। আখেরে সাহিত্যে নাম করবে।
—কিন্তু আপাতত আমার দুর্নাম রটবে, যদি দয়া করে তুমি অবিলম্বে নিজেকে দুর্লভ করে না তোলো।
—তোমার কথা শুনে আনন্দ হচ্ছে। দুর্নামের ভয়ে তুমি আমাকে সরিয়ে দিচ্ছ; অন্য কোনো অপ্রীতিকর কারণে নয়।
—অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ তুলে আজকের সুন্দর অপরাতটি মাটি করতে চাই নে। আমার একটা অনুরোধ রাখবে?
—একটা! লক্ষ কোটি অনুরোধ করো। অনুরোধের বস্তা কাঁধে চাপিয়ে কুঁজো হয়ে যাব তবু চুঁ শব্দটি করব না—ভারবাহী জন্তুর মতো সারা জীবন তারই বোঝা টেনে সবাইকে বলে বেড়াব : এমন সুখ কি আর কিছুতে আছে!
লক্ষ কোটির প্রয়োজন নেই। একটি অনুরোধ রাখলেই তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। দয়া করে এভাবে আর তুমি আমার ঘরে এসো না।
—হা অদৃষ্ট। ভেবেছিলাম, আমার সমস্ত সত্তার মধ্যে তোমার অনুরোধের স্টিম পুরে নিয়ে জীবনটাকে তারই অশ্বশক্তিতে চালু রাখব। কিন্তু কে ভেবেছিল, মাত্র একটি অনুরোধই জীবনটাকে তার রেলগাড়ির লাইন থেকে এভাবে ডিরেল করে দেবে! কিন্তু তথাস্তু। তাই হবে। আমি চললাম।
আলীম এক নম্বরের ফক্কড় বটে; কিন্তু সে তার কথা রাখল। তৎক্ষণাৎ চলে গেল।
দেখলাম সে আর কামিল একটু পরেই চিলেকোঠার সেই ঘরটিতে উঠে গেল। আর কি বসে থাকতে পারি? বইটিকে মুড়ে রাখলাম। সিঁড়ির সেই কোণটিতে প্রহরীর মতো বসে পড়লাম।
জানি না তোমরা এইখানে একটা কৈফিয়ত তলব করে বসবে কি না। পরস্পরের গা টেপাটেপি করে তোমরা হয়তো বলাবলি করছ, এই যে আলীমের সঙ্গে এক্ষুণি কথা-কাটাকাটি হলো, ওটা কেমন হলো। যে আলীমের ওপর এত রাগ তারই সঙ্গে পরিহাস। অবশ্য কথাগুলোর মধ্যে যথেষ্ট চোখ রাঙানি ছিল কিন্তু তারই পাশে বর্ণের একটি সূক্ষ্ম রেখাই কি ছিল না! হয়তো ছিল। কিন্তু তোমরা কি মনে করো, আমি হচ্ছি সামঞ্জস্যতার একটি রিল—সারাটা জীবন চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মাইলের পর মাইল মসৃণ পরম্পরার সুতা কেটে যাব! একনিষ্ঠতার চর্কা কাটাই কি আমার কাজ। হঠাৎ বলে কি জীবনে কিছুই নেই! তাছাড়া এর মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাবটাই তোমরা দেখলে কোথায়? আলীম আমার কেউ না, তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্কই নেই, মনের এই সঙ্কল্পটুকু অটুট রাখলেই তো হলো! কিন্তু তার মানে এই নয় যে তার বিরুদ্ধে আমার মনটিকে এক অসুস্থ বিকারের বাষ্পে ভরে রাখতে হবে। তার মুণ্ডপাত করা ছাড়া কি আমার অন্য কোনো কাজ নেই। বরং আমার তো এই মনে হয় তাকে সহজভাবে গ্রহণ করলেই অন্য কোনোভাবে গ্রহণ করবার প্রশ্নই উঠবে না। কৈফিয়ত যদি দিতেই হয় তো এই কৈফিয়তই দেব।
কিন্তু আমি কি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবানবন্দি দিচ্ছি যে উকিলের শতপ্রকার কূট প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য থাকব। আমি শোনাতে বসেছি আত্মকাহিনী তোমাদেরকে এই আশ্বাস দিতে পারি, মোটের ওপর সত্য কথাই বলব। আমার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলে বিশ্বাস করো—আর যদি অবিশ্বাস্যই মনে হয়, তার আর আমি কি করতে পারি বল? আমি সত্যই বলতে পারি কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য করবার দায়িত্ব নিলে অনেক সময়েই মিথ্যা বলতে হয়।
যাই হোক, যা বলছিলাম!
সেদিনও শুনতে পেলাম, আলীম বলছে :
—আমি তো দোজখে যাবই, কোনো ব্যাটাই ঠেকাতে পারবে না। পরকালটা-তো একেবারেই ঝরঝরে হয়ে গেছে, শতভাবে রিফু করলেও কিছু করা যাবে না। আর আল্লাহ্ যদি আমাকে দোজখে পাঠায়, আর পাঠাবেই জানা কথা, তাহলেও আল্লাহকে দোষ দিতে পারব না। গোনাটা কি জীবনে কিছু কম করেছি। তাই বলছি, পরকালটা তো গেছেই, তাহলে ইহকালের সুখটা পণ্ড করি কেন। নে নে তুইও নে। পিলে পিলে মেরে রাজা।
আমার তো চক্ষুস্থির!
আলীম এতটা বাড়াবাড়ি করবে কল্পনাই করতে পারি নি। পিলে পিলে! এমন কথা শুনলে কার না পিলে চমকে যায়! তাও কি না আমাদের বাড়িতেই। ছেলেটার তো সাহসও কম না। একবার মনে করলাম ফুপুজানকে ডেকে আনি। কিন্তু আসামি তো একজন নয়, সুতরাং বিচারে উভয়কেই দণ্ড ভোগ করতে হবে। বাড়িতে ছোট চাচাও নেই। ছোট ফুপুকে ডাকব? কিন্তু তাঁর সঙ্গে এখনো অতটা সহজ হতে পারি নি।
আরো একটি কারণে শেষ পর্যন্ত চুপ করে বসেই থাকলাম। দেখাই যাক না এরা কি বলে কি করে!
—মাঝে মাঝে জানিস কামিল, আমার ইচ্ছে হয় মরে যাই। কিন্তু ভয় শুধু দোজখের। নরকবাস যতদিন ঠেকিয়ে রাখা যায়, ততটাই লাভ। তবু এক একবার ভাবি, দূর ছাই কি হবে। মরবার পর আল্লাহর সামনে গিয়ে যখন দাঁড়াবো, হুট করে হাঁটু গেড়ে তাঁর দুটি পা চেপে ধরব। বলব, মার, যত খুশি মার। আল্লাহ্ কি আর তা পারবেন। তাঁর হচ্ছে যাকে বলে দয়ার শরীর। তুই জানিস, আমার মাথার ওপর আল্লাহ্ থাকলে আমি অন্য মানুষ হতাম।
—আল্লাহ্ তো সবারই মাথার ওপর আছেন!
—হ্যাঁ সবারই। কিন্তু আল্লাহ্ যদি একটু বিশেষভাবে আমার হতেন।
–হতে তো পারেনই; কিন্তু এবাদত দরকার।
—ঠিক বলেছিস কামিল, বড় জিনিস পেতে হলে বড় রকম এবাদত করতে হয়। চল এবার যাই!
সিঁড়ির কাছ থেকে সরে আমি আমার কামরার দরজার কাছে দাঁড়ালাম। এর শেষ পর্যন্ত আমাকে দেখতে হবে।
আলীম আর কামিল নেবে এলো। দু’জনেই আমাকে দেখে সিঁড়ির ওপরই দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি এগিয়ে এসে বললাম : তোমার হাতে ও কিসের বোতল? অসভ্যের মতো পিলে পিলে করছিলে!
—লুকিয়ে অন্যের আলাপ শোনাই-বা কোন দেশী ভদ্রতা! আর বোতল? তোমার সাক্ষাতে নিষিদ্ধ বোতল নিয়ে ঘুরে বেড়াব এমনকি আমারও অতটা সাহস নেই। এটা হলো ভিমটো, তুমিও খেয়ে দেখতে পার। আমরা এই একটু রগড় করছিলাম আর কি! রগড় কাকে বলে জানো? জানো না?
—তুমি চুলোয় যেতে চাও মহা আনন্দে যেতে পার, কেউ মানা করবে না। কিন্তু বাড়িতে অন্য লোকও আছে।
—তিশনা, আমিও জানি, মানা কেউ করবে না। তাইতো দোজখে যেতে আপত্তিও নেই। কি জানো, ভালো হতে চেষ্টা আমিও করেছি। কিন্তু হলে কি হবে, আমি যতই ভালোর দিকে এগিয়ে যাই, ভালোও ততই আমার কাছ থেকে ছুটে পালায়। এই দেখ না তুমিই, কেমন ছিটকে বেরিয়ে যাও।
—দিন দিন তোমার আস্পর্ধা বেড়েই যাচ্ছে। তোমাকে এই বলে দিচ্ছি, খবরদার তুমি আমার সঙ্গে ওভাবে কথা বলবে না।
রাগে আমার সারা শরীর কাঁপছিল।
আলীম আর একটি কথাও বললো না। মুখটা নিচু করে চলে গেল। যাবার আগে বোতলটি আমার পায়ের কাছে রেখে গেল। কামিলও যথারীতি চলল সেই পথে ভ্রমণ করতে। সত্য কথাটি বলতে কি, আলীমের চাইতেও আমার রাগ হচ্ছিল কামিলের ওপর। আচ্ছাই এক মেরুদণ্ডহীন মুতফারাক্কা ছেলে!
বোতলটি হাতে তুলে নিয়ে একবার দেখলাম। না, সত্যিই ভিমটো!