প্রসন্ন পাষাণ – ১৯

১৯

টিফিনের ঘণ্টা পড়ল। এতক্ষণ গোটা কলেজটাই শান্ত ছিল, যে যার ক্লাসে বসে পড়া করছে। মাঝে মাঝে কেবল চিলের ডাক মনটিকে অন্যমনস্ক করে দেয়। ক্লাসের দরজা থাকে খোলা। হঠাৎ ঝিরঝিরে বাতাস এসে অলক স্পর্শ করে আঁচল কাঁপিয়ে সুরের একটা তরঙ্গের মতো আবার হারিয়ে যায়। মিস মজুমদার সমানে পড়িয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর একটি কথাও আমার কানে প্রবেশ করে না। মাঝে মাঝে আমার চোখ গিয়ে পড়ে তাঁর দুটি ওষ্ঠের ওপর। দম দেয়া পুতুলর মতো তাঁর ঠোঁট দুটি উঠছে আর নাবছে— তাঁর মুখের সুড়ঙ্গের দরজা একবার খুলছে একবার বন্ধ হচ্ছে। আর পুতুলের মতোই তাঁর মুখের ভাবেরও কোনো পরিবর্তন নেই। তাঁর গলার ভিতর দিয়ে কতগুলো নিষ্প্রাণ শব্দ অনর্গল প্রস্রবণের মতো নেবে আসছে; শব্দগুলোর ভিন্ন কোনো অর্থ নেই তাঁর কাছে, কারণ তাঁর মুখের রেখার কোনোই পরিবর্তন চোখে পড়ে না। বছরের পর বছর সেই একই বক্তৃতা সেই একই কণ্ঠে শোনা গেছে। মিস মজুমদারের কাছে আজ আর তার কোনো তাৎপর্যই নেই।

বেঞ্চির ওপর স্থির হয়ে বসে রাজ্যের যতসব অদ্ভুত হযবরল চিন্তা নিয়ে খেলা করছিলাম। মাঝে মাঝে একটি চিন্তায় মনটা আমোদিত হয়ে উঠছিল। মনে কর, হঠাৎ যদি একটি মাছি মিস মজুমদারের মুখের মধ্যে ঢুকে পড়ে?

টিফিনের ঘণ্টা পড়ল। মিস মজুমদারের মুখের ঝাঁপিও সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল। তিনি যেন এই ঘণ্টার জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। বইটা বন্ধ করে কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে তিনি দরজা দিয়ে বেরিয়ে চলে গেলেন। এই এতক্ষণ ধরে এতগুলো মেয়েদের উদ্দেশে তিনি এত কথা বলে গেলেন; কিন্তু এক নিমেষেই আমরা সবাই তাঁর কাছে মিথ্যা হয়ে গেলাম। কলের পুতুলের মতোই খোলা দরজা দিয়ে তিনি বেরিয়ে চলে গেলেন।

আমরাও বেরিয়ে পড়লাম।

আজকাল আমার দুটি চোখ শরতের মেঘের মতো ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। ঠিকমতো যে কিছুই দেখি তা নয়। চোখের পরিধির মধ্যে যেসব দৃশ্যাবলির মিছিল চলতে থাকে তারই ওপর দিয়ে চোখ দুটিও ভেসে বেড়ায়। হঠাৎ আবার কখনো কোনো একটি দৃশ্যের ওপর আমার দৃষ্টি এসে কাটা ঘুড়ির সুতোর মতো আটকে যায়।

মেয়েগুলোকে লাগে বেশ। কলেজের মেয়ে। আমাদের এই বয়সটাতেই কুহক আছে। চোখ মুখ নাক কানের নকশা কেমন সে প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই বয়সটাই দেখতে ভালো। আর আমাদের মনটা ফড়িংয়ের পাখনার মতো কাঁপতে কাঁপতে উড়তে থাকে, ডানা ঝটপট করে, নীড় খোঁজে। ক্লাসে পড়া চলে। পড়ায় কখন মন বসে, কখনো বসে না। বইয়ের পাতায়, ছেঁড়া একটুখানি কাগজে বাণী বিনিময় চলতে থাকে; চোখে চোখে অর্থময় দৃষ্টি। একটুখানি শব্দের মতো ক্লাসে কণ্ঠের খানিকটা নিক্বণ শোনা যায়। কাঁধ থেকে আঁচল খসে পড়ে, প্রতিবেশী মুচকে একবার হেসে নেয়। শাড়ির পাড় আর চোলির কিনার আলোচনার প্রধান অংশ জুড়ে থাকে। সখিত্ব, বন্ধুত্ব, কত মান-অভিমান চোখের কানায় কতবার উছলে ওঠে। কত যে আজীবন হৃদয় বন্ধন আর আমরণ স্মরণের প্রতিশ্রুতি, যে বলে সেও বিশ্বাস করে না, যে শোনে সেও জানে মিথ্যা। তবু এ খেলার কামাই নেই। এ খেলার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা কপটতাও নেই। টিনের একটি ছোট পাত্রে লুচি আর আলুর দম, কখনো-বা সিঙাড়া আর সন্দেশ, একটুখানি পায়েস, হয়তো ভাত আর মাছের ঝোল, কোনো দুর্লভ দিনে একটি কি দুটি কাটলেট;— তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি আর কানাকানি পড়ে যায়। কে কার চিঠির জবাব দেয় নি, জন্মদিনে উপস্থিত থাকে নি, উপহার হারিয়ে ফেলেছে এই নিয়েও কত নয়ন সিক্ত আর আলাপ তিক্ত হয়ে গেছে। ক্রিকেট খেলার মাঠে ঐ যে ছেলেটি তোমাকে চীনে বাদাম কিনে এনে দিল— সে কে? আহা, আর ঐ ছেলেটি, গলায় স্কার্ফ, গায়ে সবুজ রঙের ব্লেজার আর ফ্যানেলের প্যান্ট, চোখে নীল চশমা— চিনতে পারছ না বুঝি! তা পারবে কেন, ঐ যে ছেলেটি মুশতাক আলীর অটোগ্রাফ এনেছিল— তার বেলা?

তারপর একদিন বিয়ের ঘণ্টা পড়ে। যে লোকটি চীনে বাদাম এনে দিল আর যার গায়ে সবুজ রঙের ব্লেজার তারা হয়তো দূর দিগন্তে হারিয়ে গেল। যাঁরা নিকট অঙ্গনে প্রবেশ করলেন বাদামে হয়তো তাঁর রুচি নেই এবং ব্লেজারে হয়তো তাঁকে কোনোদিনই দেখা যায় নি। তবু মেয়েদের জীবনে এই বিয়ের ঘণ্টা মিস মজুমদারের জীবনে ক্লাসের ঘণ্টার মতোই আগেকার সবকিছুকেই এক মুহূর্তে মিথ্যা করে দেয়।

আগামী সোমবার চিত্রাঙ্গদা মঞ্চস্থ হবে। আমি রিডিং রুমে একটা কোণে বসে পার্ট মুখস্থ করছিলাম। চন্দ্রিমা এসে দাঁড়ালো পাশে। বই থেকে মুখ না তুলেও বুঝতে পারছিলাম সে এসেছে। সে যেখানেই যায়, তার আগে আগে একটি মিষ্টি গন্ধ তার আগমন বার্তা ঘোষণা করে দেয়। গন্ধটি পাঁচ নং শ্যানেলের। বড় লোকের মেয়ে। পোশাকে আর পরিচ্ছদে কোথাও ঔদ্ধত্য নেই; কিন্তু এ কথা মানতে হবে এক একক বৈশিষ্ট্য আছে। সে যে যত্ন করে সাজ করেছে হঠাৎ এ কথা মনেই হয় না। যত্ন করে দেখলেই কেবল চক্ষুষ্মানের দৃষ্টিগোচর হবে।

পাতলা ছিপছিপে গড়ন। কিন্তু যাকে কৃশ বলে মোটেই তা নয়। তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত এমন এক সচলতা ছিল যার সম্মোহন একাধারে মুগ্ধ আর ভীত করত। তার চোখের দৃষ্টি শাণিত আর শরীরটাও তরবারির মতো ক্ষিপ্র। তার চোখ, এমনকি শরীরের প্রতিটি রেখা, প্রতিটি ভঙ্গির ভিতর দিয়ে এমন একপ্রকার বেপরোয়া ভাব বিকীর্ণ হতো, সাধারণভাবে যাকে ঔদ্ধত্য বললে ঠিক বলা হবে না। চন্দ্রিমার রূপের চাইতেও বেশি আকর্ষণ করত তার ব্যক্তিত্বের এই দিকটা। একটু উগ্র হলেও সে অভদ্র ছিল না।

–আমার সাথে কথা বলবে না ঠিক করেছ!

আমি এবার বই থেকে মুখ তুললাম। বললাম : তুমি দেখছি!

–এই প্রথম দেখলে বুঝি! আমি এসেছি টের পাও নি? তোমাকে সত্যবাদী বলেই জানি!

–সত্যবাদী কি না জানি না। কিন্তু তোমাকে এইমাত্র দেখলাম, এ কথা মিথ্যা নয়। আমি বই পড়ছিলাম।

চন্দ্রিমা হেসে ফেলল।

–তোমারই জিত হলো। তবে আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি জানতে নিশ্চয়ই।

— তুমি যে আমারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছ তা ঠিক জানতাম না।

–এবারও তুমিই জিতলে।

আমি সে কথার কোনো জবাব দিলাম না।

–তোমাকে নায়িকা করার বিরোধিতা করেছিলাম বলে তোমার মনে কোনো রাগ নেই বিশ্বাস করতে বল?

–বিরোধিতার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেই কি তোমার বিশ্বাস হবে?

–হবে না, পোড়ারমুখী হবে না। তোকে সেই কথাই বলতে এসেছি।

এই বলে চন্দ্রিমা আমার পাশে বসে দু’হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল।

–তোমার বিরোধিতা বরং সইবে; কিন্তু এই নাগপাশের বন্ধন আর সহ্য হচ্ছে না। দম বন্ধ হয়ে এলো।

–কেন! আর কি কেউ এভাবে জড়িয়ে ধরে নি?

— আহা! সেই ভাগ্যই কি করে এসেছি!

এবার দু’জনেই হেসে ফেললাম।

মিস মজুমদার এই দিক দিয়েই কোথায় যাচ্ছিলেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন।

–এটা রিডিংরুম। গল্প-গুজব করতে হয় তো কমনরুমে যাও।

এই বলে তিনি দ্রুত চলে গেলেন।

চন্দ্রিমা এতটুকু কেয়ার করল না। পিছনে ভালো করে হেলান দিয়ে টেবিলের ওপর পা তুলে দিল।

–আচ্ছা তিশনা। মিস মজুমদারকে ‘হরমোন’ ইনজেকশন দিলে কি কোনো উপকার হবে! উইল শি এভার বি এ ওম্যান?

–তোমার প্রস্তাবটা তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেব কি?

–দিতে পার।

–স্বনামে না বেনামে?

–যেমন ইচ্ছে।

টেবিলের ওপর চন্দ্রিমার পা দুটি নৃত্য করছিল। বিপরীত দিকে বসে পরীক্ষার পড়া করছিল গীতশ্রী। চন্দ্রিমার পায়ের আঙুলগুলো প্রায় তার নাকের কাছে পোকার মতো কিলবিল করছিল।

গীতশ্রী বলে উঠল : ওহে রূপবতী! তোমার চরণপদ্যে শত কোটি নমস্কার; কিন্তু এভাবে তোমার চরণাশ্রয়ে আর কতক্ষণ থাকব?

–আমার পদপ্রান্তে তুই স্বর্গ দেখতে পাচ্ছিস না?

–আমার নাম গীতশ্রী না হয়ে শ্রীগীত হলে নিশ্চয়ই পেতাম। কিন্তু যাই বলিস, রূপের এত দেমাক ভালো নয়। তুই যে এক্ষুণি মিস মজুমদারের রূপ সম্পর্কে কটাক্ষ করলি, ওটা ভালো শোনায় নি। আমার কিন্তু ওটা গরিবকে দেখে বড় লোকের তাচ্ছিল্যের মতোই মনে হলো। এটা যে ভুঁইফোড়ের লক্ষণ নয়, তাও বলতে পারি না।

চন্দ্রিমা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। টেবিলের ওপর থেকে পা দুটি সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ঝুঁকে পড়ে গীতশ্রীর কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো : নোক্ষ্মী মেয়ে!

পরক্ষণেই আমার হাত ধরে টানতে টানতে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। আমার সম্মতির অপেক্ষা করল না; গীতশ্রীর মুখের ভাবান্তর একবার ফিরেও দেখল না।

কলেজ ছাড়িয়ে পথে নেবে এলাম।

–তুই যে দেখি আমাকে কুলত্যাগী করে আনলি। যাচ্ছি কোন জাহান্নামে?

–তা কি ছাই আমিই জানি। মন শুধু বললো : হেথা নয়, অন্য কোনোখানে!

–কিন্তু ক্লাস আছে যে।

–চুলোয় যাক।

–নাটকের রিহার্সাল?

–ভাঙা কুলোয় ফেলে দে।

–আর সত্য হয়ে থাক, তোর মতো একটা বুলডোজারের তলায় পড়ে গুঁড়ো হয়ে যাওয়া?

–হ্যাঁ তাই। আই রোখো রোখো…

চন্দ্রিমা হাত তুলে তারস্বরে চিৎকার করে একটা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড় করালো। পথভরা

লোকজন বিস্মিত, কৌতূহলী, মুগ্ধ, কলুষিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে— চন্দ্রিমা ভ্রূক্ষেপ পর্যন্ত করল না। বাতাসের মতো অবাধ সে, সূর্যের মতো অবারিত।

গাড়িতে উঠে বললাম : তোর লজ্জা করে না!

–লজ্জা! কিসের লজ্জা?

–এতগুলো লোক চোখ দিয়ে গিলছিল।

চন্দ্রিমা পিছনে পিঠ দিয়ে সামনের আসনে পা দুটি তুলে দিল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তার সুন্দর ফর্সা গলার ভাঁজগুলোতে ঘামের অতি শীর্ণ রেখা মুক্তোর মালার মতো চিকচিক করছিল। গাল দুটি হাঁটবার পর লাল হয়ে আছে। আমি মেয়েমানুষ, তবু মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম।

এতক্ষণে আমার কথার জবাব দেবার তার সময় হলো।

–কি বলছিলি? লোলুপ চোখ দেখে লজ্জা পাবার কথা? মনে কর, তুই সারা গায়ের কাপড় ছেড়ে নাইতে বসেছিস, এমন সময় সেখানেই একটা কুকুর এসে দাঁড়ালো— তুই লজ্জা পাবি?

–কুকুর? না, লজ্জা আর কি!

–তবে?

আমি আর কিছু বললাম না।

দুই পাশে দোকানের সারি, কাপড়ের, গহনার, খেলনার, বইয়ের, খাবারের এমনি কত কি। ভিখিরি, ফেরিঅলা, মুটে, মোটরগাড়ি, বস্তি আর ম্যানসন একটা মিছিলের মতো পথের এক পাশ দিয়ে চলে যায়। পাঁচ বছরের একটি ছেলে ফুটপাতে বসে জুতো ব্রাশ করছে, পঞ্চাশ বছরের এক ভদ্রলোক সেই জুতো সাফ করাচ্ছেন। অস্থিচর্মসার দুটি বৃদ্ধ ঠেলাগাড়ি টানছে; তাদের পিঠের ওপর খররৌদ্রের কিরণ কশাঘাত করতে থাকে। রিকশা চালায় বৃদ্ধ; নবদম্পতি বারবার বলতে থাকেন : জোরসে, আওরভি জোরসে। বৃদ্ধ আরো একটু দ্রুত এগোতে চেষ্টা করে।

চন্দ্রিমার দুটি চোখ দুই বিচিত্র পথপ্রবাহের ওপর। তার মুখেও এক বিচিত্র হাসি খেলা করতে থাকে। সে হাসিতে যে শ্লেষ ছিল তাও চাবুক মারতে চায়।

হঠাৎ চন্দ্রিমা চেঁচিয়ে উঠল : কোচোয়ান, জোরসে, আওরভি জোরসে।

চন্দ্রিমার মুখে সেই হাসি। কোচোয়ানও ঘোড়ার পিঠে সপাং করে তার চাবুক নাবিয়ে দিল।

আমি জিগ্যেস করলাম : হাসলি যে!

–এমনি।

বলেই চন্দ্রিমা গম্ভীর হয়ে গেল। কেমন করে যেন আমারও মনে হলো, সে হাসির অর্থ আমি বুঝি। কিন্তু আমিও আর কথা বললাম না।

অনেকক্ষণ পর চন্দ্রিমাই বললো : গীতশ্রীর ধর্মকাহিনী তো শুনলি। তোর কোনো বক্তব্য নেই?

আমি চুপ করে থাকলাম।

— কিছু যে বলছিস না!

— কিছু মনে করিস না। ও কিন্তু বলেছে ঠিকই

–ঠিক বলে কি আমি কি সে কথাই বলছি। ঠিক বলা কি এতই কঠিন! কিন্তু কি জানিস, ঐ যারা সবসময় ঠিক বলে তাদের কখনো বিশ্বাস করিস নে। তোকে তাহলে বলি শোন। আমার এক মাস্টার ছিলেন; মহাশয় ব্যক্তি। আমি যখন এতটুকু তখন থেকেই তিনি আমাকে পড়াতেন। কম করে হলেও বয়স আমার চাইতে বিশ বছরের ওপর। আমার বর্ণ পরিচয় তাঁরই কাছে। আস্তে আস্তে বড় হলাম। মাস্টার মশাইও ধর্মকাহিনীর বেড়া তুলে আমার গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত করতে লাগলেন। সীতা সাবিত্রীর কত যে কাহিনী শুনেছি তাঁর কাছে। বুড়ো মাস্টার আমাদের বাড়িতেই থাকেন। এই মাস ছয়েক আগে আমি আমার কামরায় কাপড় ছাড়ছি। গলি দিয়ে সবসময় লোক চলাচল করে। তাই জানালাটা বন্ধই ছিল। কিন্তু সেই জানালাটাই এক জায়গায় ফাটা ছিল; সেখানে চোখ রাখলে ঘরের ভিতর সবটাই দেখা যায়। হঠাৎ দেখি, সেই বুড়ো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটি ঘরের ভিতর।

–ও মা!

দেখে আমার সর্বশরীর জ্বলে গেল। আমি কি করলাম জানিস? গায়ে একটি সুতোর কণা পর্যন্ত রাখলাম না। সব ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।

আমি ফিটনে বসেই লজ্জায় মুখ ঢাকলাম। একটু পর প্রশ্ন করলাম : তোর লজ্জা করল না?

–লজ্জা? রাগে আমার সর্বাঙ্গ জ্বলছিল। আর লজ্জা? লজ্জা করব কাকে! একটু আগেই কুকুরের গল্প বললাম না!

–তারপর?

—তারপর? বুড়ো বুঝেছিল আমি তাকে দেখেছি। সেই যে চলে গেল আর আসে নি!

-–সত্যি, এই পুরুষ মানুষগুলোকে এতটুকু বিশ্বাস নেই।

এবার চন্দ্রিমা হেসে ফেলল।

—না রে। এত বড় অবিচার করিস না। মেয়েমানুষও কম খল হয় না। আর অন্য পুরুষও আমি দেখেছি।

—সে কথাই বল!

—একদিনে সব শুনতে হয় না। আর একদিন বলব।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে এসে আমরা গাড়ি ছেড়ে দিলাম। চওড়া পিচের রাস্তা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। দুপুরবেলা। লোকজন বিরল। অদূরে বৃটিশ রাজপ্রতিনিধির প্রস্তর মূর্তি। কাকপক্ষী যে কাজের জন্য সেই মূর্তির উঁচু মাথাটি ব্যবহার করে তা খুব গৌরবের নয়। দু’তিনটি দশ বারো বছরের ছেলে ডালমুট এবং পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে মাখা মুড়ি ফেরি করছে। আনা আষ্টেকের গরম মুড়ি কিনে আমরা ভিকটোরিয়া মেমোরিয়ালের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। কেল্লার ময়দানে আজ নিশ্চয়ই কোনো বড় খেলা আছে। এখন থেকেই দর্শকের লাইন লেগে গেছে। গঙ্গা থেকে জাহাজের ভোঁ শব্দ ভেসে এলো।

ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে চন্দ্রিমাই আবার বলতে শুরু করল :

—বুড়োর কথাই মনে কর। কতদিন ধরে সে হয়তো এই কুৎসিত চিন্তার মধ্যেই ডুবে ছিল। তার চোখ দুটি সেদিন কুকুরের জিবের মতোই লকলক করছিল। তার চিন্তা-দৃষ্টি সবকিছুই অপরিচ্ছন্ন; শিষ্ট কেবল মুখের কথাটি। অথচ মজার কথা কি জানিস। সে তো আর শারীরিক ব্যভিচার করতে পারে নি; কেবল চিন্তাটাই তার মাথার মধ্যে তাড়ির মতো গাঁজিয়ে উঠেছে। সুতরাং সমাজ তাকে সচ্চরিত্র বলবে। অথচ যে এক মুহূর্তের ভুলেও রক্ত-মাংসকে সংযত রাখতে পারে নি, সমাজ তাকে কোনোদিনই মাপ করবে না।

—তুই এসব কথা কেন বলছিস?

—কিন্তু বড় পাপী কে? শরীর না মন?

–এসব তত্ত্বকথা এখন থাক। তোর ব্লাউজের বোতামটি যে খুলেছিল তো খোলাই আছে। একটু হুঁশ করে বোতামটা লাগাও। ধিঙ্গি মেয়ে!

চন্দ্রিমা এবার হেসে ফেলল। বললো : A sweet disorder in the dress kindles in clothes a wantonness… একটা সত্য কথা বলবি? কেমন?

–দূর পোড়ারমুখী! লজ্জা শরম নেই।

—কি করে আর থাকবে বল! আজকালকার পুরুষরা আর লজ্জাকে ভূষণ মনে করে না। তারা আমাদের নিরাবরণই দেখতে চায়।

আমরা পাশাপাশি ঘাসের ওপর শুয়েছিলাম। জায়গাটি জনবিরল এবং আমাদের জন্য ভালো। যে দু’একজন লোক আনাগোনা করছিল তারা বেশ ভদ্র। একটু দূরত্ব রক্ষা করেই চলছিল।

চন্দ্রিমার চোখে-মুখে আবার গুঁড়িগুঁড়ি হাসি ছড়িয়ে পড়ল। সে বললো : কোনো পুরুষ যদি আমাদের এই আলাপ শোনে কি ভাববে বলতো!

—ভালো কিছু ভাববে না নিশ্চয়ই।

—সত্যি আমরা পরস্পরের সঙ্গে যেসব কথা বলি তা যদি তাদের কানে যায় তাহলে আমাদের সম্পর্কে সবরকম ‘ইলিউশনই’ লোপ পাবে। এই আমি, চোনড্রিমা চ্যাটার্জি, বিদুষী, যার সফিসটিকেশন বিখ্যাত, যার সবকিছুই এক দুর্নিবার রহস্যে আবৃত, যাকে স্পর্শ করা যায় না, যাকে বোঝা যায় না, যে ধরা দেয় না, তার মুখেই কি না এমন কথা! কোনো পুরুষই কি কল্পনা করতে পারবে তুই আর আমি কোনোদিন পরস্পরের অঙ্গের রূপ নিয়ে আলোচনা করেছি বা করতে পারি। জানলে ‘ইটারনাল ফেমিনিন’ নামটা ঘুচত।

—কিন্তু এক পলাতক মুহূর্তের লঘু পরিচয়টাই কি সত্যকার পরিচয় আমাদের? এই আলোচনা কি আর আমরাই আর কখনো করবো? আমাদের জীবনে এই আলোচনা কতটুকু আর স্থান জুড়ে থাকবে।

—সে কথা হয়তো ঠিক। তবু আমাদের ষাট বা সত্তর বছরের জীবনের একটি মুহূর্তও এই চিন্তা আমাদের আলোচনায় স্থান পেয়েছিল জানলে বহু পুরুষেরই ভাবের ফানুসটি চুপসে যাবে।

—তা হয়তো যাবে।

—তাহলে?

তাহলে এবার উঠুন চোনড্রিমাা ডেবী।

—তারপর?

–যে যার বাড়ি।

—এ আলোচনা আর কোনোদিন নয়?

–কোনোদিন নয়। হলে লোকসানের সম্ভাবনা।

—তবে তাই হোক।

চন্দ্রিমা উঠে দাঁড়িয়ে আড়িমুড়ি ভাঙল। বিদ্যুতের তরঙ্গের মতো তার সৌন্দর্য। আমি একটু হাসলাম।

—হাসলি যে তুই।

—বারে হাসতেও পারব না!

—ওসব চালাকি শুনছি না। বলতে হবে কেন হাসলি।

—চন্দ্রিমা, তুই সত্যিই খুব সুন্দরী।

—হ্যাঁ। আর আপনি ভারি বান্দরী। এবার চলুন।

—তুই আছিস বেশ। সবসময় রক্ত-মাংসে টগবগ করে ফুটছিস।

—যা বলেছিস ভাই। কোন সময় কে সেদ্ধ ভাতের মতো টপ করে গিলে ফেলে ভয় কেবল তাই।

–সে ভয় যে একেবারেই নেই তা নয়।

—তুই ঠিক বলেছিস। যাকে বলে ইমপালসিভ আমি তাই। মাঝে মাঝে এমন অবিমৃশ্যকারিতা করে বসি—তারপর ফুরসতমতো পস্তাই।

আমরা হাঁটছিলাম। কিছুটা সময় নীরবেই কাটল। মাঠে এখন লোকের মেলা। খেলা আছে। সকলেই ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে মাঠের দিকে, অন্য কোনো দিকে দৃষ্টি পর্যন্ত নেই। সামনে একটা বড় ঢেলা পড়েছিল। পা দিয়ে সেটাকে সরিয়ে দিয়ে চন্দ্রিমাকে বললাম : এতদিন কলেজে পড়ছি। সামান্য দেখাশোনা ছাড়া তোর সঙ্গে পরিচয়টাও ভালো করে হয় নি। আজ দেখ, এক বেলায় কতদূর এগিয়ে গেলাম।

—ঠিক বলেছিস। কিন্তু জীবনে এমনটা ঘটে। মনে কর উঁচু পাহাড়ের একেবারে কানায় বহুদিন থেকে একটি পাথর আটকে আছে। একদিন কেউ এসে সামান্য একটুখানি ধাক্কা দিয়ে দিল। তারপর পাথরটি কেমন বেগে নিচে নেবে আসে?

–তোর কথাই যদি ঠিক হয়, তাহলে আমাদের অস্থিচর্মের জন্য দুর্ভাবনার কারণ আছে।

—বন্ধুত্বের ঢল নাবলে সুভাবনার সঙ্গে কিছুটা দুর্ভাবনাও থাকে বৈকি!

—তোকে দেখে আমার কি মনে হয় জানিস চন্দ্রিমা! জীবনে তুই অনেক দুঃখ পাবি।

—এই তোর বন্ধুত্ব! এত বড় অভিসম্পাত।

—অভিসম্পাত নয় তুইও ভালো করে জানিস। -তবে কি একেই বলে আশীর্বাদ!

—তাও নয়। একটা কথা মনে হলো, বললাম। বাস্!

—বাস্! আমার দুঃখ পাওয়াটা এতই সহজ ব্যাপার!

আর আমি কিছু বললাম না।

তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। গঙ্গার ধারে বিশুদ্ধ বায়ু সেবনেচ্ছু নর-নারীর ভিড়। পথের দুই দিক দিয়েই অবিরাম মোটরগাড়ির আনাগোনা; যেন যুগপৎ জোয়ার ও ভাটায় পথস্রোতকে স্ফীত করে তুলছে। আকাশে একটি দুটি তারা, দু’এক খণ্ডি মেঘ। পথঘাট দোকানপাটে বৈদ্যুতিক আলো জোনাকির মতো জ্বলে উঠতে আরম্ভ করেছে। বড় বড় বিজ্ঞাপনের বিজলি বাতিগুলো একবার জ্বলছে একবার নিভছে। মনে হয় ফুলঝুরির মতো ঝরে ঝরে পড়ছে।

একটা দমকা হাওয়া আমাদের ওপর এসে আছাড় খেল। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে চন্দ্রিমা আবার বললো : তুই যে কত ঠিক বলেছিস নিজেও জানিস না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *