ছয়
এই উপন্যাসের গোড়ার দিকে আলীম যে স্থানটুকু অধিকার করে আছে, তা বিস্তৃত না হলেও, বিশিষ্ট; সুতরাং অকস্মাৎ দৃশ্যপট থেকে আলীমের অপসারণ পাঠককে বিস্মিত করতে পারে। বলা বাহুল্য, এর মধ্যে বেশ কয়েকবার আলীমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে; কিন্তু অন্যান্য পাত্রপাত্রীর কথার মধ্যে তার এনট্রান্স ও এগজিটের কোনো নাটকীয় ভূমিকা ছিল না বলেই আলীমের প্রসঙ্গ তুলে রসভঙ্গ করতে চাই নি; কিন্তু এবার আবার আলীমের কথায় ফিরে আসতে হয়।
বোধ করি বয়সের সান্নিধ্যের জন্যই আলীম ও কালিমের মধ্যে অলক্ষ্যে যে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠছিল তা আমার লক্ষ্যগোচর হলো বন্ধুত্ব যখন বেশ পরিণত। বস্তুত আলীম আর কামিলের মতো স্বতন্ত্র-স্বভাব দুটি তরুণ সহজে চোখে পড়বে না। কামিল স্বল্পভাষী, সুকণ্ঠ, লজ্জায় ব্রিত, এবং অন্তর্মুখী; আলীম একেবারে উল্টা। সে বাকপটু, সপ্রতিভ, চৌকস এবং বহির্মুখী; অন্তত তাদের বন্ধুত্বের সূচনায় তারা তাই ছিল। তাই এই দুই বিপরীত শক্তির মিলনে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম—এবং কিছুটা শঙ্কিত।
কামিলকে আমি ভালোবেসেছিলাম? মিথ্যা কথা। আমার কিশোরী হৃদয় যে প্রেমবিমুখ ছিল তা নয়। কিন্তু কামিলকে ভালোবাসব কি, তার সঙ্গে মুখের একটি কথা পর্যন্ত হয় নি। চোখেও দেখেছি ক্বচিৎ কোনো ক্ষণে—এবং দৃষ্টি বিনিময়ের পরও চোখে রঙ ধরে নি, হৃদয় থেকেছে অক্ষত।
তবু নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্বের পাথারে হৃদয়-বন্ধনের ছোট্ট একটা সেতুর জন্য আমার মনটা ছিল তৃষিত। বাল্যকালেই মাতৃহারা হই, আবাল্য পিতার সংস্পর্শ থেকে ছিন্ন, এবং নিত্যসঙ্গী ফুপুজান নিগ্রহেরই প্রতীক। এক ছিলেন চাচা। প্রথমত, অসমবয়সী চাচার সঙ্গ-তে আমার মনের সঙ্গ-তৃষ্ণা মিটতে চায় না। তার ওপর, তাঁর দর্শনলাভ খুব সুলভ ছিল না। প্রতিবেশী বা সহপাঠীদের মধ্যেও সখি অন্বেষণের চেষ্টা করি নি; কারণ বন্ধুত্বের লগি হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াব, আমার অভিরুচি তেমন নয়। বন্ধুত্বের কর্ষণে আমার পটুত্ব বা প্রতিভা কোনোটাই ছিল না; কিন্তু ছিল সঙ্গীত প্রয়োজন। হাতের কাছেই সুবিধামতো একজন বন্ধুলাভের সুযোগ ঘটায় আমি হয়তো কামিলকে নিয়ে কিছুটা কল্পনাশ্রয়ী হয়ে উঠেছিলাম। তাই কামিল ও আলীমের এই নৈকট্যে আমিও নিঃশঙ্ক ছিলাম না।
ছাতের চিলেকোঠা থেকে সেদিন সকালবেলা একটা দমকা হাসি হুড়মুড় করে সিঁড়ি বেয়ে এলো নিচে নেবে। এ হাসি কামিলের। আমি অবাক হয়ে গেলাম। কামিলকে কোনোদিন এভাবে হাসতে শুনি নি। বস্তুত তাকে হাসতেই দেখি নি। তাই তার হাসির এই উচ্চস্বরে আমি চমকিত হলাম। হঠাৎ কিসের এই পুলকাতিশয্য?
সিঁড়ির কাছেই একটি জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়লাম। হাতে ছিল উল আর কাঁটা। তাই উদ্দেশ্য যে আমার দুই বন্ধুর আলাপ শুনবার জন্য কান পেতে থাকা সেটা বুঝবার উপায় ছিল না। নাকে এলো সিগারেটের গন্ধ; আশা করলাম, ধূম্ররসিকটি আলীম, দ্বিতীয়জন নয়। কথা হচ্ছিল, স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম।
—মেয়েদের মন পাওয়া? সে বাঁ হাতের খেলা। থাকতে হবে একটু ফিটফাট; মুখে সামান্য স্নো-পাউডার কিন্তু যেন বোঝা না যায়। আর রুমালের কোণে একটুখানি পারফিউম, তাও ভুললে চলবে না। আসল কথা, চেহারাটিকে ঘষে-মেজে ঝকঝকে করে তুলতে হবে। বাস্, আর দেখতে হবে না—একেবার কেল্লা ফতেহ। তবে মনে রাখিস, চেহারাটাই সম্বল।
আলীম পীর আর কামিল মুরিদ।
সে না হয় হলো, কিন্তু নারীর হৃদয়দুর্গের ব্যূহ ভেদ করবার এই চক্রান্ত কেন!
—মনে রাখবি, শুরুতেই বেশি মাখামাখি করবি না। নিজের দামটি রাখবি চড়া। মেয়েরা হচ্ছে শক্তের ভক্ত। দেখবি পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়বে।
আমি কান খাড়া করে বসে থাকলাম।
–হ্যাঁ ভালো কথা। সিগারেট খাবি, সিগারেট। বেশ একটা ভারিক্কি চাল আসবে—যাকে বলে ব্যক্তিত্ব। তাও কাজে লাগবে।
আলীম বুঝি তার বুদ্ধির গোড়ায় ধুম দিচ্ছিল, কারণ কিছুক্ষণ আর কোনো কথা শুনতে পাই না। আমি মনশ্চক্ষে দেখতে পাই, আলীম শুয়ে আছে মেঝের ওপর, চোখ দুটি তার ছাতের কড়িকাঠে, মুখে সিগারেট, ললাটে গভীর চিন্তার রেখা। অর্থাৎ, যাকে বলে ব্যক্তিত্ব, তাই।
–মেয়েরা হচ্ছে দুঃখসুখের ফানুস। শুনেছিস তো এ কথা। বল দেখি কে বলেছে? আচ্ছা আচ্ছা থাক। সবসময় এই ফানুসটিকে পাম্প দিয়ে ফুলিয়ে রাখবি। কেবল সুখ দিয়ে নয়, দুঃখের পাম্পও দিতে হবে।
সিঁড়িতে বসে আমি ঘামতে লাগলাম।
—শেকসপীয়ার কি বলেছে জানিস—শেকসপীয়ার? না কি লোকটার নামও শুনিস নি!
—নাম শুনেছি। ল্যামস্ টেলস পড়েছি।
এই প্রথম কামিলের গলা শুনলাম।
—শেকসপীয়ার বলেছে, নর হচ্ছে ‘স্টমাক’ আর নারী ‘ফুড’। পেট ভরে গেলে, উগলে ফেলে দিবি। হ্যাঁ উগলে ফেলে দিবি।
—আলীম ভাই, শেকসপীয়ার পড়েছ?
—না। ঠিক পড়ি নি তবে ওকে পড়াই বলে। আমাদের ইংরেজির লেকচারার প্রায়ই শেকসপীয়ারের গল্প করেন। ভালো কথা, মেয়েদের যদি ‘ইমপ্রেস’ করতে চাও, তাহলে দেশবিদেশের কবি-সাহিত্যিকদের চোখাচোখা বুলিগুলো মুখস্থ করতে হবে; এবং জায়গা বুঝে সেগুলোর সদ্ব্যবহার করা চাই। তাছাড়া নিজের কথাও, নাম করা লোকের বলে চালিয়ে দিতে পারিস। মেয়েরা বিয়ে করে বণিককে কিন্তু ভালোবাসে কবিকে।
–তোমাদের লেকচারার মেয়েদের সম্পর্কেও আলোচনা করেন?
—করেন না আবার! শুনেছি তিনি একটি মেয়েকে ভালোবাসতেন। মেয়েটি অন্য একটি লোককে ভালোবাসত। সে তাকেই বিয়ে করল। মাস্টার সাহেব খুব গোসা। তিনি বলে বেড়ান, মেয়েটি তাঁকে জিল্ট করেছে। তখন থেকে মেয়েদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর যতসব হতাশপ্রেমিক যত বিরূপ মন্তব্য করেছেন, সব তাঁর মুখে মুখে ফিরে বেড়ায়।
–কবে যে আমিও কলেজে পড়ব। আলীম ভাই, একটা পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছ না? সিগারেট ফেললে কোথায়?
—পুড়ছে তিশনার মন, আর এই সতরঞ্জির কিনার। হ্যারে তিশনা সারাদিন করে কি?
—করবে আবার কি। ক’দিন থেকে দেখছি সোয়েটার বুনছে। ওতো সারাদিন শুয়েই থাকে!
–মেয়েটা কিন্তু দেখতে ভালো।
কামিল কোনো মন্তব্য করে না।
—কার জন্য সোয়েটার বুনছে জানিস কিছু? তোর জন্য?
—দূর!
—মেয়েটা কিন্তু বড্ড রোগা।
—হবে না। কিছুই খায় না যে।
—কেন? স্ফীতাতঙ্কিত তরুণী না কি! -কি তঙ্কিত?
–স্ফীতাতঙ্কিত
—সে আবার কি?
–জলাতঙ্কের মতো এক ব্যাধি যাকে মেয়েরা ব্যাধের চাইতেও বেশি ভয় করে।
—আলীম ভাই, কড়া বলেছ! এত শিখলে কোথায়?
—আমাদের বাংলার টিচার একজন কবি। সে কথা যাক। এবার উঠি। অনেক বেলা হলো। আমিও সিঁড়ির কাছ থেকে সরে এলাম।
সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নাবছে পদশব্দ। তেতলা থেকে দোতলায়, একতলায়, তারপর পদশব্দ মিলিয়ে গেল।
আলীম সম্পর্কে একটা কথা অন্তত স্বীকার করতেই হবে। বাংলাটা সে জানত ভালো এবং ফুটবল খেলত মন্দ না। অবশ্য তার কোটেশনগুলো সবসময় নির্ভুল হতো না।
তোমরা নিশ্চয়ই ভেবে নিয়েছ, আলীম-কামিলের সংলাপে তিশনা যখন একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল তখন তার মনে যে আন্দোলন উপস্থিত হলো তা বড় মাপের। আন্দোলন যে একেবারেই উপস্থিত হয় নি তা বলব না; কিন্তু তোমরা যতটা কল্পনা করছ অতটা নয়। কারণ আগেই বলেছি, তরুণদের সান্ধ্য আড্ডার আলাপে দখিন সমীরণের মতো প্রবাহিত হবার অভিজ্ঞতা আমার বহুদিনের। বস্তুত এইটিকে আমার একটা ডিভাইন রাইট বলেই মনে করতে শিখেছি।
কিন্তু আজকের এই ঘটনা আমাকে অন্য কারণে বিচলিত করেছিল। শহুরে আলীমের প্রতি গ্রাম থেকে নবাগত কামিলের এই আনুগত্য স্বাভাবিক বলে জানলেও কামিলের ভবিষ্যতের জন্য বাঞ্ছনীয় কিনা সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ ছিল।
হাতে উল-কাঁটা আর মগজে এই দুশ্চিন্তা নিয়ে আমার কামরায় চলে এলাম।
মনে করেছিলাম, আলীম চলে গেছে। কিন্তু জানালা দিয়ে দেখলাম তখনো যায় নি। জাফর গেছে বাজারে। বাড়িতে অন্য পুরুষ কেউ ছিল না তখন। কামিলের হাতে মুরগি, আলীম ছুরিতে শান দিচ্ছে। ফুপুজানও কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন।
আলীম মুরগিটিকে হালাল করবার জন্য এগিয়ে এলো। মুরগির গলার ওপর শাণিত ছুরিটা এলো নেবে।
ফুপুজান চিৎকার করে উঠলেন : তওবা। অসতাখ ফারাল্লাহ।
কামিলও একদিকে ছিটকে এলো।
আলীম মুরগি জবেহ করতে গিয়ে গলাটিকে ধড় থেকে একেবারে আলাদা করে দিয়েছে; ছিন্নমুণ্ডটি আলীমের হাতে, ধড় কামিলের হাতে।
কামিল থরথর করে কাঁপছিল। এ সময় চমকে উঠে স ধড়টিকে মাটিতে ফেলে দিল।
ফুপুজান আর্তস্বরে বলে উঠলেন : খোদা মাপ করো।
আলীম কেবল হাহ হাহ করে হাসতে লাগল। তার হাতের ছুরি থেকে তখনো ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঘামের মতো গড়িয়ে পড়ছে।
কোথা থেকে ঘটনাস্থলে ছোট চাচা উপস্থিত।
ঠাস করে আলীমের গালে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে তিনি দোতলায় উঠে এলেন। নিমেষের মধ্যে এত কিছু ঘটে গেল।
আমি তখনো জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। একি সত্য, না দুঃস্বপ্ন! মুরগি জবেহ করতে গিয়ে আনাড়ির হাতে দুর্ঘটনা খুবই সম্ভব; কিন্তু সেই হাহ হাহ হাসি।
সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
এই হাসি বহুদিন আমার কানে বাজতে থেকেছে।