ষোলো
আমাদের বাড়ির পিছন দিকে একটা ছোটখাটো কলাবাগান ছিল। কলাবাগান পেরিয়ে সামান্য একটু খোলা জায়গা। একদিকে কলাগাছ আর একদিকে ইটের পাঁচিল এই জায়গাটিকে জনমানবের চক্ষু থেকে আড়াল করে রেখেছিল। আমাদের বাড়ির দৃষ্টি বৃক্ষশ্রেণীতে এবং বহির্জগতের দৃষ্টি পাঁচিলে বাধা পেয়ে ফিরে যেত। মাঝখানকার এই ছোট্ট ভূখণ্ডটি একটি অনাবিষ্কৃত দ্বীপের মতো পড়ে ছিল। এই দ্বীপের আবিষ্কারক, একমাত্র নাগরিক এবং দণ্ডমুণ্ডের কর্তৃত্ব আমিই। কোনো সাম্রাজ্যবাদী যে কোনোদিন আমার এই রাজ্যটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে তেমন আশঙ্কা ছিল না। কোনো পথ ভোলা পর্যটকও এ পথে আসে না, যদিও এলে তার সাদর অভ্যর্থনা সুনিশ্চিত। গাছের ডালে বসে কাকপক্ষী অবশ্য তাদের দৃষ্টি মেলে ধরত; কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে কোনোপ্রকার মুগ্ধভাব থাকত এ কথাও বলা যায় না। কাকপক্ষী আর যেসব আচরণের দ্বারা এই ক্ষুদ্র এলাকার যোগ্য ব্যবহার সম্পর্কে তাদের অভিমতটি প্রকাশ করত তা নিয়ে লীগ অব নেশনস্-এ হয়তো ফরিয়াদ তোলা সম্ভব; কিন্তু উপন্যাসের পৃষ্ঠায় জাঁক করে সে কথা বলবার মতো নয়।
লোকচক্ষুর অন্তরালে অনাদরে পড়ে থাকা এই বিশ গজ পরিমাণ জমিটুকু আমার বড়ই প্রিয় ছিল। পৃথিবী বিপুলা বলেই নিজস্ব একটুখানি নির্জন কোণের মূল্য যে কত সে আমি তখনই বুঝেছি। এই জায়গাটির প্রতিটি ঘাস, গোষ্পদ এমনকি পোকামাকড়ও আমার পরিচিত ছিল এ কথা বললে খুব বেশি অত্যুক্তি করা হয় না। এখানে পাঁচিলে দিনেরবেলার কোন সময়টিতে ছায়া কোথায় ওঠে, সন্ধ্যাবেলা কোন কোণটিতে সূর্য তার মাথা গুঁজে অদৃশ্য হয়ে যায়, সকাল দুপুর বিকেলে কখন কিভাবে হাওয়া দেয় সব আমার জানা। ঘাসের আর পাতার রঙ দেখে আমি জানতে পারি হেমন্ত শীত বসন্তের আগমন বার্তা।
একটা মাদুর আর বালিশ নিয়ে আমি প্রায়ই এখানটায় চলে আসতাম। হাতে থাকত একটা বই। কোলের কাছে আমরুদ বা কালোজাম, নুন তেল মরিচ বাটা। কতদিন এমন হয়েছে যে বইয়ের একটি পাতাও খুলি নি, পাশে থেকেছে পড়ে। মাদুরের ওপর, কোলের ওপর, মাথার খোঁপায় একটি কি দুটি আমের বোল ঝরে পড়ত, একটি কি দুটি ঝরা পাতা, মরা ফুল। পায়ে বিধত বেল ফুলের কাঁটা। একটি বটগাছ, দুটি আমগাছ, তার পাশেই একটি নিম গাছ—এবং আরো দু’একটি গাছ যার নাম আমি জানি না—আমার এই অঞ্চলে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকত। তাদের শাখা নড়ত, পাতার মর্মর ঝিরঝির আওয়াজ শোনা যেত। বড় বড় গাছগুলো ডাল নাড়িয়ে হাওয়া দিত। মনে মনে আমার সঙ্গে তাদের কতরকম কথাই-না হতো। দেখতাম ঋতুতে ঋতুতে তাদের বিভিন্ন সাজ। দুপুরে মাদুরের ওপর চুল এলিয়ে দিয়ে শুয়ে থাকতাম, আকাশে উড়ছে চিল, মেঘ ভাসছে, আকাশের রঙ বদলাচ্ছে—হঠাৎ দমকা হাওয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ত চোখমুখের ওপর দুরন্ত শিশুর মতো, গাছের পাতা দিতে থাকত শিস। মাঝে মাঝে চোখ পড়ত ডালে বসে থাকা কাকের ওপর, সেও যেন উদাস অন্যমনস্ক।
পৃথিবীর যতসব জিনিস বিখ্যাত তার সবগুলোরই একটি নাম আছে, আর আমার এই স্বর্গটুকুই কি অপরিচয়ের গ্লানি নিয়ে পড়ে থাকবে? সুতরাং নাম আমাকেও একটা দিতে হলো। যে নামটি শেষ পর্যন্ত কায়েম হলো তা হচ্ছে “তিশনগর।’ বলা বাহুল্য, এই নাম উদ্ভাবনের জন্য আমার কল্পনাশক্তির ওপর বিশেষ করে জবরদস্তি করতে হয় নি। জুলুম যদি কিছু করা হয়ে থাকে তো সে আমার পাঠকদের ওপর। একবার তপোবন নামটিও মনে এসেছিল কিন্তু টিকল না। তারপর কিছুদিন তিশনাকুঞ্জ কানের মধ্যে গুঞ্জরিত হয়ে কলের গানের রেকর্ডের মতো থেমে গেল। শেষ পর্যন্ত তিশনগর নামেই জায়গাটি আমার আত্মীয়-স্বজনের মহলে মহলে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠল।
তিশনগর নামের বিরুদ্ধে যত রকম যুক্তিই থাক, স্বপক্ষে বলবার এই আছে যে নগরটি তিশনারই হাতের যত্নে পালিত। এখানে কতরকম ফুলের গাছই-না নিজের হাতে লাগিয়েছি। আমার হাতে লাগানো কাগজি লেবুর গাছ থেকে যখন গন্ধ উঠত, বাসরঘরের বরবধূ বুক ভরে নিত তার আঘ্রাণ। আমার মনে হতো যেন আমার হৃদয়টিকেই এই মাটিতে রোপণ করছি। কতদিন যে ছেলেমানুষের মতো মুঠি মুঠি মাটি হাতে তুলে মুখে মেখেছি সে কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। কখনো মাটি হাতে তুলে নিয়ে দেখেছ? দেখ। সে এক আশ্চর্য স্পর্শ।
সেদিন দুপুরবেলা আমি বটগাছটির পায়ের কাছে শীতলপাটি বিছিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছি। চুপ করে কেবল বসেই ছিলাম, কিছুই করছিলাম না। মাথায় ঘোমটা ছিল না, চুলগুলোও ছিল খোলা। সামনের গাছটির পাতা নড়ছিল বসে বসে তাই দেখছিলাম। পাতা নড়ে, ছেলেবেলায় কেতাবে তা পড়েছিলাম, এবং পাতা যে নড়বার জন্যই একভাবে তাও ছিল জানা। কিন্তু পাতা যে এভাবে নড়ে এবং তা বসে বসে দেখবারও যোগ্য আজই তা প্রথম উপলব্ধি করলাম।
একটু আগেই চুলে তেল মেখেছি, পাশে খোলা শিশি পড়ে আছে, ছিপিটা লাগিয়ে দেবার কথা পর্যন্ত মনে হয় নি, মুখটি খোলাই পড়ে আছে।
এমন সময় মরা পাতার মড়মড় আওয়াজ এলো কানে। একটু পর এলো সেই শুকনো পথ দিয়ে কামিল।
বিস্ময়ের একটা ঢেউ আমার চোখ ছুঁয়ে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই আমি আমার পা দুটি গুছিয়ে নিয়ে চিবুকটি হাঁটুর ওপর নাবিয়ে তেমনি বসে থাকলাম। পা দুটিকে দু’হাত দিয়ে ঘিরে বেঁধে রাখলাম।
কামিল একটু ইতস্তত করল।
—আসতে পারি?
আমার মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরুল না। শুধু দুই চোখের কুঁড়ির ভিতর দিয়ে আমার সম্পূর্ণ দৃষ্টির পুষ্পটি কামিলের ওপর ঝরে পড়ল।
কামিল আর কি দেখল সেখানে জানি না; কিন্তু তার প্রশ্নের নিঃসংশয় উত্তরটি নিশ্চয়ই পেয়েছিল।
আমার ভয় করছিল বলতে পারব না—তবে এক ভীরু লজ্জা সমস্ত সত্তাকে জড়িয়ে ধরেছিল।
কামিল একটুখানি হাসল। আর কোনো আমন্ত্রণের অপেক্ষা না করেই মাদুরের এক পাশে বসে পড়ল।
বললো সে : তিশনগরের পথ শুনেছি খুব দুর্গম। তাই আসতে সাহস হচ্ছিল না। কোথায় গেল আমার লজ্জা আর সঙ্কোচ। ফস করে বলে ফেললাম : দুর্গমকে এতই ভয়! কামিল সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না।
কিন্তু জবাবের জন্য আমি অপেক্ষা করে আছি বুঝতে পেরে বললো : দুর্গমকে ভয় নয়। ভয় দুর্লভকে।
এবার আমাকে চুপ করতে হলো। কিছু বলতে পারলাম না। আবহাওয়া কেমন যেন ভারি হয়ে এলো। একটা দারুণ অস্বস্তি মনটিকে কেবলই পীড়িত করতে লাগল।
তাই কিছুকাল চুপ থেকে লঘু পরিহাসের ভঙ্গিতে বললাম : তুমি যে দেখছি পদ্মপত্রে শিশির বিন্দুর মতো মাদুরের এক পাশে টলমল করছ। সরে ঠিকমতো বসলেই হয়।
কামিল একটু সরে এলো। কিন্তু বসল না। মাদুরের ওপর মাথা আর ঘাসের ওপর পা রেখেই সেখানেই শুয়ে পড়ল। তার মাথা আর কপালে আমগাছের পাতার ছায়া নড়ছিল। আমিও একটু দূরে সেইভাবেই বসে থাকলাম। ঝিরঝির হাওয়া কি যেন বলে বলে যায়।
কামিল সেইভাবেই শুয়ে আছে।
দাঁত দিয়ে একটা চোরাকাটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললো : তোমাকে একটা কথা বলতে ভারি মন চাইছে। ধৃষ্টতা মনে হলে থামিয়ে দিও। বটগাছের ছায়ায় তুমি একা বসে আছ— দেখামাত্রই জানি না কেন তোমাকে বড় আপন মনে হলো।
এই বলে কামিল উঠে বসল। আমার আর তার মাঝখানে শুধু একটা দ্বিধার ব্যবধান।
কামিলের কথার কোনো জবাব দেব, কি তাকে বাধাই দেব, সে শক্তিই ছিল না। সমস্ত শরীর মন এবং সেই অবশ সত্তাকে মাঝে মাঝে বেদনার মতো বিদীর্ণ করে এক তীব্র অসহ আনন্দানুভূতি মনের মধ্যে লুটিয়ে পড়তে লাগল। কামিলের এক একটি কথা যেন এক এক ঢোক মদ।
কামিলের চোখ কিন্তু আকাশের মতোই অমল উদার—কোথাও এতটুকু বিকার নেই। সেই মুহূর্তে সেই আকাশের গায়ে ডানা মেলে দিতে মনের কোনো বাধাই ছিল না।
আমি বললাম : শিশির বিন্দু হঠাৎ এই চলৎশক্তি পেল কোথায়?
কামিল কিছু বললো না। সে আবার সেইভাবে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ল। সেইভাবেই তার কপালের ওপর পাতার ছায়া নড়তে লাগল। কি যেন চিন্তা করছে সে।
—কিন্তু জানো তিশনা। এ কথা বলতে আমি এখানে আসি নি। এ কথা কোনো দিন বলব মনেও ভাবি নি। তবু তোমাকে যখন দেখলাম সবার আগে এই কথাটিই এলো মনে। তখন বলে ফেলাটাই সবচাইতে সহজ আর স্বাভাবিক মনে হলো। বলবার জন্য যে সাহস দরকার, শুনে তুমিই-বা কি বলবে, এসব কোনো চিন্তাই একবারও মনে আসে নি। কিন্তু এখন যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে না বলতে পারি না।
—এখন আর দুশ্চিন্তা করে কি লাভ। যা হবার তাতো হয়েই গেছে।
—ঠিক বলছ?
এবার আমি সে কথার কোনো জবাব দিলাম না। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে প্রশ্ন করলাম : কি বলতে এসেছিলে, সেই আসল কথাটিই যে বলা হলো না।
কামিল হেসে ফেলল। বললো : এখন তো মনে হচ্ছে আসল কথাটি বলা হয়ে গেছে। তবে এ কথাও শুনে রাখ, আমি আই.এ পাস করেছি। ফার্স্ট ডিভিশনে।
—সত্যি! -সত্যি।
—ছোট ফুপু ছোট চাচা এঁদের বলেছ?
—না। এখনও বলি নি।
—কেন?
—আগে হলে বানিয়ে অন্য জবাব দিতাম। কিন্তু এখন সত্যই বলব। সবার আগে খবরটা তোমাকে দিতে ইচ্ছে করল। কোনোই কারণ ছিল না; তবু মনে হলো শুনে তুমি খুশি হবে।
—মনের কথা মাঝে মাঝে শুনতে পার। ঠকবে না। একটু সরে যাও। মুখে রোদ পড়ছে খেয়াল নেই?
কামিলের পায়ের কাছে পাতি হাঁস-মুরগি ছুটোছুটি করছে। মুখটিকে রোদ থেকে বাঁচিয়ে কামিল সরে এলো একপাশে; এখন এক ফালি রোদ তার পায়ের পাতার ওপর মোজার মতো জড়িয়ে আছে।
—ওভাবে আপন মনে হাসছ কেন?
–কেন শুনবে তিশনা? মনে পড়ে সেদিনের কথা! কি ছেলেমানুষই ছিলাম। আলীমের চিঠি এনে তোমার ঘরে রেখে গেলাম। ভেবেছিলাম, এ লজ্জা ঢাকার ঠাঁই নেই। তোমাকে বুঝি আর কোনোদিনই মুখ দেখাতে পারব না; কিন্তু কেমন দিব্যি মুখটি দৃষ্টিগোচর এখন!
সেই মুহূর্তেই পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ আবার এসে পড়ল কামিলের মুখের ওপর। কামিল তার আগের কথারই খেই ধরে আবার বললো : কি ছেলেমানুষই ছিলাম। বাঃ, কাগজি লেবুর কি সুন্দর গন্ধ আসছে।
—ওসব কথা এখন থাক। ছোট ফুপুকে সুখবরটা দিয়ে এসো।
কামিল এবার উঠে পড়ল।
—আচ্ছা। তাই যাই।
কিন্তু তবু সে দাঁড়িয়েই থাকল। বিকেলের ছায়া গাছের তলায় লম্বা লম্বা মাদুর বিছিয়ে দিতে শুরু করেছে। কামিল দাঁড়িয়ে আছে, তার শরীরের অর্ধেকটা রোদে হাসছে, বাকি অর্ধেকটা ছায়ায় ম্লান।
কামিল বললো : শুনতে পাই তোমার এই তিশনগরে সকলের আসা মানা। তোমার না কি অনুমতি লাগে।
আমি এক পা এগিয়ে এলাম—এক মুহূর্ত দ্বিধায় পড়লাম। তারপর বলেই ফেললাম : এই নাও তিশনগরের চাবি।
বলে একটি হাত কামিলের দিকে এগিয়ে দিলাম। কামিল সেই শূন্য হাতটি ধরে ফেলল—সেখানে সামান্য একটু চাপ পড়ল।
—আম্মাকে কোন সুখবরটা দেব?
আমি কিছু বলতে পারলাম না। হঠাৎ যে কাজটি করে বসলাম তার লজ্জায় আর মাথাই তুলতে পারছিলাম না।
কামিল এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। তারপর হেসে চলে গেল।
তোমরা অবাক হচ্ছো? হবেই তো। অবাক আমিই কি কিছু কম হয়েছিলাম।