৩৫
কয়েকদিন গত হয়েছে। কামিল এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
আবার শরৎ ফিরে এসেছে। বাতাসে শীতের কামড়। আকাশ এখন যাকে বলে নীল। প্রকৃতির শ্যামল কোমল রূপ মায়ের মতো সমস্ত সত্তাকে স্নেহরসে ভরে দিতে চায়। ঝিরঝির করে গাছের পাতা নড়ে। বাতাস কানে কানে শিস দেয়। শাখার ওপর ফুল বাতাসের স্পর্শ পেয়ে কিভাবে নাচতে থাকে তাই বসে বসে দেখতে থাকি।
আমাদের বাগানের দক্ষিণ দিকে একটি গাছের নিচে বেঞ্চির ওপর বসেছিলাম। সকালবেলা।
কামিল এসে কাছেই দাঁড়ালো। এখুনি বুঝি স্নান করে এলো। পরনে ফর্সা পাঞ্জাবি- পাজামা। তার উন্নত ললাট সকালবেলার দিগন্তের মতো প্রসন্ন। চোখ দুটি শিশির-স্নাত ফুলের মতোই সজীব।
বেঞ্চির এক পাশে সরে বসলাম। কিন্তু তবু কামিল সেইভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। তেমনি দাঁড়িয়ে থেকেই বললো : আমি চলে যাচ্ছি।
আমি তক্ষুণি কোনো প্রশ্ন করলাম না। গাছের একটি লতা আমার হাতের কাছে দুলছিল। হাত দিয়ে তাই ঠেলে দিয়ে অনেকটা অন্যমনস্কের মতো প্রশ্ন করলাম : কোথায়?
—আমি বাড়ি ভাড়া নিয়েছি তুমি জানো। সেখানে।
—এ বাড়িতে আর থাকবে না?
—না তিশনা। এবার আমার যাবার সময় হয়েছে।
কামিলের দিকে চোখ তুলে তাকালাম। কামিলের চিবুকের কাছে এক অনড় প্রতিজ্ঞার কতগুলো রেখা। তাছাড়া আর কিছুই উল্লেখযোগ্য নয়।
বললাম : আমার অপরাধ?
—তোমার অপরাধ?
—তাহলে যে এত বড় শাস্তি দিচ্ছ!
—শাস্তি দিচ্ছি নিজেকে। তা না হলে আরো অনেক বড় শাস্তির ফাঁস পরতে হবে। মানুষের দূরাকাঙ্ক্ষার সীমা নেই। যা প্রাপ্য নয় তাকেও সহজলভ্য মনে হয়।
—যদি বলি অপ্রাপ্য নয়!
—দু’শ টাকার সাব-এডিটরের ঘরে অত দামি জিনিস রাখব কোথায়?
—যদি দামি জিনিসই মনে কর, রাখবার ঠাঁই করে নিও।
—সে সামর্থ্য নেই। অত লোভ করতে গিয়ে নিজের দামটুকুও খোয়াব। অনেক ভেবেছি। সংসার আমার জন্য নয়।
—কেন? পয়সার ঝুমঝুমি বাজাতে পার না বলে?
—তাও বটে। শুধু কথার ঝুনঝুনি বাজালে প্রেম বাঁচে না। অন্য বাধাও আছে।
—শুনতে পাই সেটা কি?
—আমি নিজেকে বুঝি না। শেষ পর্যন্ত মহার্ঘ বস্তুর মূল্য দিতে পারব কি না তাও জোর করে বলতে পারি না। কোনোরকম সংশয়ের মধ্যে আমি তোমাকে টেনে আনতে চাই না। তুমি চাইলেও না।
—আমার কথাও কি কখনো ভেবেছ?
—তাছাড়া আর কিছুই ভাবি নি। তোমার মুখের প্রতিটি রেখা আমার পরিচিত। কখন কি কারণে তোমার মুখের ওপর ছায়া পড়ে তাও আমি জানি। আর তোমার কথা ভাবব না? জীবনে কোনো কোনো সমস্যা আসে, যার ষোলো আনি সমাধান সম্ভব হয় না। তখন একটা রফা করতেই হয়; তোমাকে বঞ্চিত করতে পারব না বলেই নিজেকে রিক্ত করে চলে যাচ্ছি। আশা শুধু এই, সৃষ্টিকর্তা মানুষকে অশেষ করে সৃষ্টি করেছেন। ফুরিয়ে দেন, আবার একদিন ভরেও দেন। এরই ওপর ভরসা করে আজ তোমাকে দুঃখ দিতেও বাধছে না। বিশ্বাস কর, তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তোমাকে চিরকাল সুখী রাখতে পারব সে রকম মশলা দিয়ে আমি তৈরি হই নি। ভেবেছিলাম, সহজভাবে বিদায় নিয়ে চলে যাব, কথায় ভাবাবেগের রঙ চড়তে দেব না; কিন্তু পারলাম কৈ?
—মাঝে মাঝে আসবে না?
—না। হাতে কিছু রাখব না। যা ফেলে গেলাম, কোনোদিন তার দিকে আর ফিরে তাকাব না। তীরে পৌঁছে আমার তরী দেব ডুবিয়ে। ফিরবার পথ যেন খোলা না পাই।
—এই তোমার শেষ কথা?
—এটাই আমার বহুদিনের চিন্তার ফল। এর নড় নেই। কারণ এ লোভের সিদ্ধান্ত নয়। এ সঙ্কল্প ত্যাগের।
–কেবল ত্যাগের মহিমার জন্যই ত্যাগ? মানুষের সুখ-দুঃখ কি এতই তুচ্ছ?
—মানুষের সুখ-দুঃখ তুচ্ছ নয়। এ সংসারে তার চাইতে বৃহৎ বস্তু আর কিছুই নেই। তাই ত্যাগের এই সঙ্কল্প।
—তোমার মা-কেও সঙ্গে নিচ্ছ?
কামিল কোনো জবাবই দিল না।
আমি আবার বললাম : অবিচার হচ্ছে ছোট চাচার ওপরও। তোমাকে ক’টি কথা বলবার আছে।
এই বলে কামিলকে সেই রাতের বৃত্তান্ত ছোট ফুপুর কাছে যা শুনেছি সব বললাম। সমস্ত শুনে কামিল স্থির হয়ে বসে থাকল। গাছ থেকে দু’একটি পাতা ঝরে পড়ে। কামিল পা দিয়ে তাই নাড়তে থাকে।
—মাকে বোলো, আমি তাঁর অযোগ্য সন্তান।
এই বলে কামিল উঠে পড়ল। তার লম্বা শরীর এক পলকে সরলরেখার মতো খাড়া দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখের দৃষ্টিতে, চলনে কোথাও এতটুকু দ্বিধা নেই। সত্যিই সে একবারও ফিরে দেখল না।
একটু পর রাস্তা থেকে রিকশার ঠুনঠুন শব্দ এলো কানে। কামিল চলে গেল।
আমি যেখানে বসে আছি সেখান থেকে বাইরের দরজা পর্যন্ত পথটি আমার চোখের সামনে মূর্ছিতের মতো পড়েই থাকল।
আরো দু’একদিন গেল গড়িয়ে।
একদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই শুনি রান্নাঘর থেকে কনিজ এবং এক পুরুষ মানুষ বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। প্রথমে মনে করলাম জাফরের সঙ্গে কনিজের কোনো কারণে ঝগড়া বেধেছে বুঝি। কিন্তু পুরুষ কণ্ঠটি তো জাফরের নয়।
নিচে নেবে আসতেই দেখি হুকুম আলী দরজার কাছে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই একগাল হেসে সালাম করল। বললো : মামণি, ভালো আছ?
হুকুম আলীর এই সস্নেহ প্রশ্ন শুনে অকস্মাৎ আমার দুটি চোখ পানিতে ভরে গেল। এত সহজে আমার চোখে অশ্রু আসে না। তাই আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম।
কোনোমতে বললাম : হ্যাঁ হুকুম আলী। তুমি ভালো? কখন এলে?
—এইতো কিছু আগে।
—নাশতা করেছ?
করেছি মা। কনিজ বহিন বাবুর্চিখানায় বসিয়ে কত আদর করে নাশতা খাওয়ালো। পরক্ষণেই হুকুম আলী হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গ তুলল : আচ্ছা মা, তোমার তো
অনেক এলেম আছে। তুমিই বল আমার কথা ঠিক কি না?
—কি কথা হুকুম আলী?
—আমি কনিজ বহিনকে বলি। সে কিছুতেই মানতে চায় না। বল তো মা, ঠিক কি না :
শেখ, সৈয়দ, মোগল, পাঠান,
উস্কা নিচে বান্দী গোলাম।
না, মা, ওভাবে হাসলে চলবে না। তোমাকে বলতে হবে!
—হ্যাঁ, হ্যাঁ তোমার কথাই ঠিক। ছোট চাচার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
হুকুম আলী গম্ভীর হয়ে গেল। কিছু বললো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল।
—দেখা কর নি?
—গিয়েছিলাম মা, দেখা করব বলে। সাহেব দেখা করলেন না!
আমি ছোট ফুপুর ঘরে এলাম।
টিনের বাক্সটি গুছিয়ে ফেলেছেন। বিছানা আর বালিশ একটা চাদরে মোড়া। ছোট ফুপুর গায়ে বোরখা। যাবার জন্য একেবারে তৈরি।
তিনি যাবেন শুনেছিলাম, সে যে এত শিগগির—আর আজই—তা ভাবি নি।
—তিশনা, চললাম।
—আর কিছু বলবে না?
—আর তো কিছু বলবার নেই।
—আর কারো সঙ্গে একবার দেখা করবে না?
—না।
—তোমার চোখে এক ফোঁটা পানিও নেই!
—আমার দুঃখ তো একদিনে ফুরিয়ে যাচ্ছে না যে এক মুহূর্তে সমস্ত অশ্রু ঝরিয়ে মুক্তি লাভ করব। তোমাকে কোনোদিনই ভুলব না। আল্লাহ্ তোমার ভালো করুন। এবার আসি।
আমি নিচু হয়ে ছোট ফুপুর পা ধরে সালাম করলাম।
ছোট ফুপু ফিটনে গিয়ে উঠলেন, ফিটনের পর্দা নেবে এলো। হুকুম আলী গিয়ে বসল কোচোয়ানের পাশে।
আমি দরজার ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ফিটন ছেড়ে দিল। আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে যেতে লাগল। আমি তখনো সেখানেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। ফিটন বহুদূর চলে গেলে হঠাৎ একটি সাদা হাত পিছনের ছোট পর্দাটি একবার তুলে ধরল। ছোট ফুপুর মুখটি দেখতে পেলাম না ভালো করে—ঘোমটাটাই চোখে পড়ল।
পর্দা আবার নাবল। ফিটন চোখের আড়ালে হারিয়ে গেল।
এক সপ্তাহ পর আবার টেলিগ্রাম এলো : তোমরা অবিলম্বে কুষ্টিয়া চলে এসো। আমরা এখন কুষ্টিয়া। টেলিগ্রামে আর কিছুই নেই।
আব্বা কি অসুস্থ? এই আমরাটা কারা?
ছোট চাচা আর আমি পরদিন সকালে চিটাগাং মেইলে কুষ্টিয়া রওয়ানা হবার জন্য তৈরি হতে লাগলাম। ছোট চাচা নিজে অসুস্থ। তার ওপর, কুষ্টিয়া পৌঁছে কি দরকার হয় না হয় কিছুই জানা নেই। ছোট চাচা তাই আলীমকেও ছুটি নিয়ে আমাদের সাথে আসতে বললেন।