পিতা পুত্রকে – ৯

নয়

স্কুল থেকে হেড মাস্টার মশাই বিদায় নিলেন আমি যখন মাত্র দশম শ্রেণিতে উঠেছি। ছাত্ররা তাঁকে বিদায় দিয়েছিল সভা করে, মালা পরিয়ে, শত শত হাত ছুঁয়েছিল তাঁর চরণ। আমাদের অনেকের চোখ থেকে অশ্রু নেমে এসেছিল। আমরা মুছবার চেষ্টা করিনি।

বিদায় নেবার আগে একদিন হেড মাস্টার মশাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর আলাদা ঘর ছিল না। ঘরের এক কোণে জানলার পাশে বসতেন কেরানি বললাম বাবু। তিনি ছাত্রদের মাইনে নিতেন, মাস্টার মশাইদের মাইনে দিতেন, খরচের টাকা যোগাতেন, হিসাবপত্র রাখতেন, কেরানির আর যা যা কতব্য সব করতেন। তাঁর পেছনে দুটো বড় আলমারি কেরানির ‘ঘর’ হেডমাস্টারের অফিস আলাদা করে রেখেছিল।

পিয়ন নটবর আমাকে ক্লাস থেকে ডেকে হেডমাস্টারের কাছে নিয়ে গেল।

দেখতে পেলাম, হেডমাস্টারের পাশে একটা চেয়ারে বসে আছেন উমেশবাবু।

হেডমাস্টার মশাই আমাকে বললেন, “তুমি বার্ষিক পরীক্ষায় সব বিষয়ে প্রথম হয়েছ। ইংরেজি ও বাংলায় খুব ভালো করেছ, ৮০ এর বেশি মার্কস পেয়েছ। কিন্তু অঙ্কে পাস করতে পারনি, মাত্র ২৫ নম্বর পেয়েছ।”

আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলাম।

হেডমাস্টার মশাই বললেন, “আমি তোমার পিতৃদেবকে এ নিয়ে চিঠি লিখেছিলাম। তিনি তার জবাবে লিখেছেন, তোমাকে ক্লাস টেনে বাড়তি এক বছর রেখে দিতে। তুমি তাতে রাজি আছ?”

আমি বললাম, “না, ম্যাট্রিকে অঙ্কে আমি পাস করে যাব।”

তিনি বললেন, “আমারও ধারণা এক বছর তোমাকে আটকে রেখে কোনো ভালো ফল হবে না, যদি তুমি অঙ্কে উৎসাহের সঙ্গে মনোনিবেশ না কর। আমরা মানে, এই স্কুল আশা করছে, তুমি ম্যাট্রিকুলেশনে খুব ভালো ফল করবে, জিলা স্কলারশিপ পাবে। কিন্তু অঙ্কে খুব উঁচু নম্বর না তুলতে পারলে তুমি তা পাবে না। অতএব এ বছরটা অঙ্কে তোমাকে গভীর মনোনিবেশ করতে হবে। আমি উমেশবাবুর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি অনুগ্রহ করে তোমাকে অঙ্ক শেখাতে রাজি হয়েছেন। প্রত্যেক সন্ধ্যায় তুমি ওঁর বাসায় গিয়ে অঙ্ক শিখবে।”

আমি খুব নিচু গলায় বললাম, “প্রাইভেট টিউশনির পয়সা নেই আমাদের। সারা মাস মাত্র কুড়ি টাকায় চালাতে হয়।”

হেডমাস্টার মশাই বললেন, “তোমার পিতৃদেবের সঙ্গে আমার চিঠিপত্র আদান-প্রদান হয়েছে। তিনি প্রতি মাসে উমেশবাবুকে টাকা পাঠাবেন। তুমি কাল থেকেই ওঁর কাছে অঙ্ক শিখতে শুরু করে দাও। সন্ধ্যার একটু আগেই যেয়ো। তোমার পিতৃদেব খুব সুন্দর ইংরেজি লেখেন। বুঝতে পারছি ভাষায় দখলটা তোমার জন্মগত উত্তরাধিকার। তোমার পিতামহ রজনীকান্তের নামও অজানা নেই। শুনেছি ইংরেজিতে খুব ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন। আচ্ছা, তুমি এখন এসো। তোমার ম্যাট্রিক পাসের সময় আমি এই স্কুলে থাকব না। কিন্তু তোমার ফলের উপর নজর রাখব। তুমি নিশ্চয়ই আমাকে, আমাদের সবাইকে, হতাশ করবে না।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *