পিতা পুত্রকে – ১৯

উনিশ

বিদ্যাসাগর কলেজের জীবন ঘটনাবহুল হতে পারেনি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা এখানকার ছাত্র, অধ্যাপকেরাও শুনতাম কম মাইনে পান। প্রিন্সিপ্যাল, যাঁর নাম স্মরণে নেই, আমাদের ইতিহাস পড়াতেন, তাঁর পড়ানোয় যতটা নাটকীয়তা ছিল ততটা সারবত্তা ছিল না। তিনি সোজা বলে দিতেন, “এল.এম. মুখার্জীর বই মুখস্থ করে নাও” এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিজের প্রণীত একটি প্রশ্ন ও উত্তরভিত্তিক ইতিহাসের বই নাটকীয় কণ্ঠে সুপারিশ করতেন।

ক্লাসে দশটি স্টার পাওয়া ছেলে, তারা প্রায় সবাই পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র। তাদের তিনজনের সঙ্গে ছিল আমার বন্ধুত্ব। স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তথাকথিত খারাপ ছেলেদের সঙ্গে আমার ভাব হতো বেশি ও থাকত দীর্ঘকাল। কোথায় কোন্ সুদূরে একটি খেলার মাঠ ছিল, ছাত্রেরা সেখানে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলত। ক্রীড়াবিমুখ আমি সে মাঠের মুখদর্শন করিনি। বাংলা সিনেমার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ এখনও সুখকর। ‘চিত্রা’ প্রেক্ষাগৃহে আমার প্রথম দেখা ছবি প্রমথেশ বড়ুয়ার ‘মুক্তি’। সে এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি।

বিদ্যাসাগর কলেজে বন্ধুর অভাব ছিল প্রখর। আমি প্রথম বুঝতে পারলাম গ্রাম ও শহরের বন্ধুত্বতার প্রভেদ। গণেশপুর স্কুলের ও গ্রামের বন্ধুদের আমি সরাসরি ঘরের মধ্যে নিয়ে আসতাম। আমার বিছানার খাটে অথবা হাতভাঙা চেয়ার ও নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসে আমাদের আড্ডা হতো। মা অনেক সময় সরষের তেলমাখা মুড়ি দিয়ে যেতেন। কদাপি কখন তার সঙ্গে মেশানো থাকত নারকেলের টুকরো। কলকাতায় দেখলাম বন্ধুতার দৌড় কলেজ প্রাঙ্গণে, রাস্তায়, রেস্টুরেন্টে এবং বড়জোর বন্ধুর বাড়ির দরজা পর্যন্ত। কলকাতায় যাকে ‘রক’ বলে তার উপর বসে আড্ডায় সমাপ্তি। এমন একজনও বন্ধু হয়নি বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ার সময় যার বাড়ির দরজা খুলে অন্তত বসবার ঘরে প্রবেশের আন্তরিকতা পেয়েছি। পরে মনে হতো অনেক মধ্যবিত্ত বাঙালির বাড়িতে বসবার ঘর বলে কিছু হয়তো ছিল না। কোনো মধ্যবিত্ত বাড়ির দরজায় পর্দা দেখতে পাইনি।

একটি বন্ধুর বাড়িতে শুধু প্রবেশ নয়, অন্তরঙ্গ আত্মীয়তার সুযোগ এসেছিল এক বিপর্যয়ের আনুকূল্যে। ভক্তি দাশগুপ্ত (আসল নাম নয়) স্টার পাওয়া অতিশয় কৃশ দুর্বল ও নিঃশব্দ ছাত্র। ইন্টারমিডিয়েটের দ্বিতীয় বছরে কলেজের অধ্যাপকরা পনেরোটি ছাত্রকে আলাদা করে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা বেশি টিউটোরিয়ালের ব্যবস্থা করেছিলেন। এদের মধ্যে আমারও স্থান হয়ে গিয়েছিল এবং ভক্তি দাশগুপ্তেরও।

হঠাৎ দেখা গেল ভক্তি চারদিন কলেজে অনুপস্থিত। কলেজের অদূরে সিমলা স্ট্রিটে তার বাড়ির দরজা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার গল্প করতে করতে আমরা দুজনে গেছি তারপর আমাকে বিদায় নিতে হয়েছে। আমি যেহেতু থাকতাম আমার কাকার সঙ্গে শুধু একখানা ঘরে এবং ২৯ নম্বর বীডন স্ট্রিটে রক পর্যন্ত ছিল না, কোনো বন্ধু কোনোদিন আমাকে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি পৌছে দেয়নি। ভক্তির চারদিনের অনুপস্থিতি আমাকে দুশ্চিন্তিত করল। আমি তার বাড়ির দরজায় হাজির হলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে তাকে ডাকতে ডাকতে কিছুক্ষণ পরে একখানা শীর্ণহাত দোতলার জানলা দিয়ে বেরিয়ে এল। তার পেছনে একটি শীর্ণ কণ্ঠ—”ভক্তি অসুস্থ, তুমি কে?” আমার নাম শুনতে পেয়ে বললেন, “সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এসো। দোতলায় উঠে ডানদিকে চার নম্বর ঘর আমাদের।”

সিমলা স্ট্রিটের ঐ বাড়িটার কথা আমি এখনও ভুলিনি। বেশ বড় দোতলা বাড়ি। মেরামতের অভাবে দেওয়াল বুড়ো মানুষের দাঁতের মতো নড়বড়ে। যে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হলো তাতে ঝাড়ু পড়ার চিহ্ন নেই। যদি বা এককালে কাঠের একটি রেলিং ছিল, এখন শুধু তার জীর্ণ ভগ্নাবশেষ। সমস্ত বাড়িটার একখানা, বড়জোর দুখানা, ঘর নিয়ে এক একটি পরিবারের বাস। এক তলায় কলকাতার সেই অতি পরিচিত শ্যাওলা পিছল উঠোন, বড় একটা চৌবাচ্চা, দুপাশে দুটো নলের সঙ্গে লোহার পাইপ যোগ করে চৌবাচ্চায় জল সঞ্চয়ের ব্যবস্থা। ঐ উঠোনে নলে চৌবাচ্চায় সারা বাড়ির সম্ভবত শতাধিক মানুষের স্নান, বাসন মাজা, কাপড় কাচা, কাপড় ধোওয়া। এ নিয়ে ঝগড়া কলহের বিরাম নেই। মহিলাদের কূপিত উচ্চকণ্ঠ বাড়িটার একমাত্র সংগীত।

আমি দোতলায় উঠেই ডানপাশ মোড় নিতে দেখতে পেলাম একখানা ঘরে চার-পাঁচটা শিশু ও বালক বালিকা দুষ্টুমি করার জন্য মায়ের হাতে প্রহৃত হচ্ছে এবং তাদের সমবেত কণ্ঠের কান্না মিলিত হচ্ছে উঠোনে তিনজন মহিলার জল নিয়ে কলহের সঙ্গে। দুটো ঘর এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলাম একখানা ঘরের দেওয়ালের উপরে একটা অনেক পুরোনো কাঠের ফলকে প্রায় উঠে যাওয়া অক্ষরে লিখিত সন্তোষ দাশগুপ্ত। বন্ধ দরজায় আস্তে কড়া নাড়তে এক মহিলা কপাট খুলে সামনে দাঁড়ালেন। ছোটখাটো বিশীর্ণ ধূসর চেহারা। অথচ পরিষ্কার বোঝা যায় এককালে সুন্দরী ছিলেন। আমার বুঝতে এক মুহূর্ত লাগল ইনি ভক্তির মা। পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে তিনি বললেন, “ঘরে এসো।” ঘরে ঢুকে দেখলাম দুটি রোগশয্যা। একটির উপরে কাতরাচ্ছেন এক বৃদ্ধ, মাথায় সাদা বাবরি চুল, দাড়ি গোঁফে জঙ্গলীকৃত মুখ, বেদনায় বিকৃত দুটো চোখ টকটকে লাল।

ঘরের অন্য পাশে বিছানায় শুয়ে আছে ভক্তি। আমি তার পাশে মুখোমুখি দাঁড়াতে সে কাহিল হাসল। তার মা বললেন, “আজ চারদিন ধরে জ্বর। কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবশ।” আমি জানতে চাইলাম কী চিকিৎসা হচ্ছে। বললেন, “এ বাড়িতেই কবরেজ আছে, তার গুলি খাচ্ছে।”

আমার নজরে পড়ল ঘরের এক চতুর্থ মানুষের ওপর। আমাদের চেয়ে বয়সে কিছু বড় একটি মেয়ে, বড় বড় মাঠের মতো ফাঁকা দুটি চোখে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে নিজের মধ্যে অথবা নিষ্ঠুর জীবনে। ভক্তির মা বললেন, “এ আমার মেয়ে অতসী।”

অতসী দিদিরই কথা আমি ভক্তির মুখে শুনেছি। আমি ভক্তির পাশে বসে বললাম, “আমি এক রাজবন্দী হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের এক দালানের সহবাসী। শুনেছি তিনি ভালো চিকিৎসা করেন। তাকে নিয়ে আসব তোমাকে দেখবার জন্য?”

ভক্তি ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, “ফি দিতে পারব না। “

রাজবন্দী ডাক্তারের নাম মনে নেই, শুধু মনে আছে সামনে হাজির হতে দেখতে পেলাম তাঁর টেবিলের সামনে বসে আছে গীতা মিত্ৰ। আমার বুক কাঁপল। নিশ্চল নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ডাক্তারবাবুর প্রথম প্রশ্ন কানে ঢুকল না। গীতা মিত্র বোধহয় আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন, নিজের চেয়ার একটু সরিয়ে নিয়ে পাশের চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “বসুন না।”

এবার ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আমার কথা হলো। তাকে ভক্তির রোগের বৃত্তান্ত বলার পরে তিনি বললেন, “মনে হচ্ছে জন্ডিস, দেখতে হবে।”

আমি বললাম, “আপনাকে রিকশা করে নিয়ে যেতে আমি এখনই তৈরি।”

ডাক্তারবাবু বললেন, “আমার ফি দু-টাকা এবং রিকশার ফেরত ভাড়াও দিতে হবে।”

তখন কলেজের দ্বিতীয় বছরে আমি মাসে সাত টাকা বৃত্তি পাই। নিজেকে বেশ ধনী ধনী মনে হয়। বললাম, “এক্ষুনি যাবেন?”

তিনি বললেন, “গীতাকে ওষুধটা দিয়ে নিই।”

আমি এবার অনেক সাহস সঞ্চয় করে প্রতিবেশিনী গীতা মিত্ৰকে প্রশ্ন করলাম, “কার অসুখ?”

গীতা বলল, “মা’র, বোধহয় ম্যালেরিয়া।”

ডাক্তারবাবুর চিকিৎসায় ভক্তি দশ দিনে সুস্থ হয়ে উঠল।

আমাদের টিউটোরিয়ালে আসবার মতো শক্তি সঞ্চয় করবার পর একদিন বলল, “আমার বাবা খুব অসুস্থ। কিন্তু কিছুতেই ওষুধ খাবেন না।”

জানতে চাইলাম অসুখটা কী। ভক্তি বলল, “আমরা কিছুই জানি না। কাউকে কিছুই বলেন না। শুধু কাতরান আর মেজাজ করেন। এর মধ্যে পড়াশোনা কি সম্ভব?”

ভক্তির অসুখের সময় আমি রোজই ওকে দেখতে যেতাম। ওর মা ও দিদির সঙ্গে আমার কিছুটা ঘনিষ্ঠতাও হয়েছিল। ভক্তির কাছে ওর বাবার রোগের গুরুত্ব জানতে পেরে আমি একদিন বুকে খুব সাহস বেঁধে, তাঁর পাশে বসে বললাম, “যে ডাক্তার ভক্তিকে ভালো করে দিয়েছেন, তাঁকে নিয়ে আসব আপনাকে দেখতে?”

দু-চার মিনিট তাঁর মুখে কোনো কথা নেই। বড় বড় কটকটে চোখ দিয়ে আমাকে দেখছেন। ভয়ে আমার হৃৎপিণ্ড কাঁপছে। তবুও আমি সাহস করে বললাম, “চিকিৎসা না করালে ভালো হবেন কী করে?”

ভাঙা কর্কশ স্বরে জবাব এল, “ভালো হবার দরকার নেই।”

আমি সহজে ছাড়লাম নাম, বললাম, “আপনি এত কষ্ট পেলে ভক্তি পড়বে কী করে? পরীক্ষার তো মাত্র ছ’মাস দেরি।”

কিছুক্ষণ নীরব থেকে তিনি বললেন, সেই কর্কশ ভাঙা স্বরে, “নিয়ে আসতে পার। আমাকে শুধু দেখতে হবে। কোনো প্রশ্নের জবাব আমি দেব না।”

ডাক্তারবাবুর কাছে হাজির হলাম। ভক্তির বাবা একসময়ে ময়মনসিংহ অথবা কোথায় যেন স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। একটা বাংলা-ইংরেজি অভিধান রচনা প্রায় শেষ করে এনেছিলেন। কোনো প্রকাশক উৎসাহ দেখায়নি। আর একখানা ইংরেজি বাংলা অভিধানও এগিয়েছিল। এই দুখানা পাণ্ডুলিপি তাঁর রোগশয্যার সঙ্গী, বালিশের ডান দিকে রাখা। তাঁর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে কলকাতার বাইরে কোনো এক আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে কী একটা কারিগরি বিদ্যা শিখছে। ভক্তির মা তাঁর দ্বিতীয় পত্নী। প্রথম পত্নী কী ভাবে কত বছর আগে মারা যান ভক্তি আমাকে বলেনি। কিন্তু তার কথাবার্তায় মনে হতো সে মৃত্যুর সঙ্গে কোনো একটা আভিঘাতিক জড়িত আছে। ভদ্রলোকের বয়স আমার জানা নেই। চেহারা দেখে বয়স অনুমান করার শক্তিও তখন আমার হয়নি। রাজবন্দী ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তরে ভক্তির পিতা সম্বন্ধে এর বেশি বলা আমার সম্ভব হলো না।

ডাক্তারবাবু বললেন, “একবার দেখতে নিয়ে চল। প্রশ্ন করতে হবে না। আমি দেখেই বুঝতে পারব কী অসুখ।”

ঠিক হলো তার দুদিন পরেই আমি ডাক্তারবাবুকে নিয়ে যাব ভক্তির সিমলা স্ট্রিটের বাড়িতে।

যেতে হলো না। পরের দিন সকালে একটি লোক একখানা চিরকুট নিয়ে আমার কাছে হাজির। ভক্তির হাতের লেখা, “বাবা আজ সকালে মারা গেছেন, তুমি পারলে এসো।”

গিয়ে দেখলাম শবদেহ নিয়ে লোকেরা চলে গেছে শ্মশানে। গেছে ভক্তিও। কেননা বড় ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তাকেই মুখাগ্নি করতে হবে। বাড়িতে রয়েছেন একমাত্র অতসীদি। নির্বাক, চোখে জল নেই, বিশেষ শোকে আক্রান্ত মনে হচ্ছে না।

তিন-চার জন প্রতিবেশী আমাকে বলল, “মড়া নিয়ে ঘাটে গেছে, দুটো-তিনটে নাগাদ ফিরবে। তার আগে সমস্ত বাসি খাবার ফেলে দিয়ে বাসন-পত্র মেজে ঘরখানা ধুয়ে মুছে সাফ করতে হবে। সিঁড়ি দিয়ে নিয়ে গেছে মড়া, সিঁড়িও ধুয়ে দিতে হবে।”

আমি অতসীদির মুখের দিকে তাকালাম। তিনি তেমন নির্বাক নিশ্চল। এসব কাজের কোনোটাই করবার মতো আগ্রহের সম্পূর্ণ অভাব।

তখন আমাকে কাজে লেগে পড়তে হলো। ঘরেরই এক কোণে হতো রান্না। ভাত-তরকারি ইত্যাদি যা অবশিষ্ট ছিল সেগুলোকে নিয়ে পড়শিদের নির্দেশে রাস্তায় জঞ্জালের স্তূপের মধ্যে ফেলতে হলো। বাসন-কোসন বিশেষ ছিল না, যা ছিল কলতলায় এনে নারকেলের ছোবড়া ও ছাই দিয়ে ধুয়ে রাখতে হলো। তারপর বালতি বালতি জল দিয়ে পুরো ঘর, ঘর থেকে সিঁড়ি এবং সিঁড়ি থেকে রাস্তা পর্যন্ত ধুতে হলো। ঘর মুছবার জন্য ময়লা কাপড় সংগ্রহ করতে অতসীদিকে প্রশ্ন করতে হলো না। সব ধুয়ে মুছে সাফ করে আমি শুধু তাকে বললাম, “এবার আমি যাচ্ছি। ভক্তিকে বলবেন কাল কলেজে দেখা হবে। যদি না হয়, পরশু আসব।”

এতক্ষণে অতসীদি প্রথম কথা বললেন, “দাদা আজ বিকেলেই আসছে।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *