পিতা পুত্রকে – ২০

কুড়ি

সময়-ঘোড়া তার নিজের বেগে ছুটে চলে, সমাজ বদলায়, মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসে, আমাদের বয়স বাড়ে, মধ্যবয়সীরা বৃদ্ধ হন, তরুণরা হয় মধ্যবয়সী। বালক-বালিকারাও অর্জন করে কৈশোর। ভক্তির সঙ্গে আমার বন্ধুতা এখনও জীবিত, তার বয়স তিন কুড়ি ষাট হবে। ভক্তি কখনো সুস্থ সবল হতে পারেনি, কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যাসিসটেন্ট পদে চাকরি শুরু করে কোনো এক সময়ে ফরেন সার্ভিসে উত্তীর্ণ হয়েছে, বিবাহ করেছে সুন্দরী কন্যাকে, যে তার মামার বাড়িতে বড় হয়েছে। একটি ছেলের সঙ্গে তার যে গভীর প্রেম ছিল মুখ ফুটে কাউকে জানাতে পারেনি। অনেক বছর পরে যখন আমি নিউ দিল্লির ‘যোজনা ভবনে’ প্ল্যানিং কমিশনের ‘যোজনা’ পত্রিকার সম্পাদক এবং ভক্তি অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এসে বিদেশমন্ত্রকে মধ্যশ্রেণির অফিসার, একদিন সে হন্তদন্ত হয়ে আমার ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে বলল, “তোমার সঙ্গে গুরুতর কথা আছে।”

আমি মনোযোগের সঙ্গে তার পানে তাকাতে সে বলল, “কণিকা আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে।”

কণিকা ভক্তির স্ত্রী। ওদের দুটি সুন্দর সন্তান। একটি ছেলে, একটি মেয়ে। আমরা প্রায়ই পরস্পরের বাড়িতে যাতায়াত করে থাকি। কণিকা আমার স্ত্রীকে জানিয়েছে আর একটি ছেলেকে সে ভালোবাসত। সে ভালোবাসা তখনও তাদের দেহ-মনে সজীব।

আমি বললাম, “নতুন কী ঘটল?”

ভক্তি বলল, “সে ভদ্রলোক দিল্লি এসেছেন। তিনি ধনী এবং সুস্থ সবল। কণিকা বলেছে, সে তার সঙ্গে চলে যাবে।”

আমি কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে বললাম, “তুমি কী বলেছ?”

“আমি বলেছি যাওয়া চলবে না, ছেলেমেয়ে দুটোর কী হবে?”

“তাতে কণিকা কী বলেছে?”

“বলেছে তোমার ইচ্ছে হলে ওরা আমার সঙ্গে থাকতে পারে। তুমি যদি ওদের কোথাও রেখে দিতে চাও আমার কিছু করার নেই। আমি তোমার সঙ্গে লড়াই করতে চাই না।”

“তুমি আমাকে কী করতে বল?” প্রশ্নটা আমার নিজের কানে বোকা বোকা শোনাল।

ভক্তি বলল, “তুমি কণিকার সঙ্গে একটু কথা বল, তাতে কাজ হতে পারে।”

আমি বললাম, “আমার খুব সন্দেহ আছে কাজ হবে কিনা, তবু তুমি যখন বলছ আজকে সন্ধ্যার পরে আসব।”

আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ঠিক হলো একা যাওয়াই ঠিক হবে। ভক্তির বাড়িতে গিয়ে জানতে পারলাম এই জটিল নাটকের তৃতীয় অভিনেতাও সেখানে উপস্থিত।

কণিকার সঙ্গে কথা হলো, তার বয়ান স্পষ্ট, মন নির্ভীক ও নিঃসন্দেহ, সংকল্প দৃঢ়। সে কে কী বলবে তার বিন্দুমাত্র পরোয়া করে না।

“আমি চোদ্দ বছর আপনার বন্ধুর ঘর করেছি। সংসার পেয়েছি, সুখ পাইনি। এবার আমি সুখী হতে চাই। এজন্য কোনো মূল্যই আমার কাছে বড় নয়। যেদিকে যাচ্ছি সে পথে যদি ভরাডুবি থাকে তার জন্যও আমি প্রস্তুত।”

ছেলেমেয়ে সংসার স্বামী এসব নিয়ে অনেক কথা আমি বলে গেলাম। কণিকা সব স্থির হয়ে শুনল। অবশেষে সে বলল, “শুধু একটিমাত্র শর্তে আমি আপনার বন্ধুর সঙ্গে থাকতে রাজি আছি। আমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক থাকবে না।”

আমি ভক্তিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি রাজি আছ?”

দৃঢ়কণ্ঠে জবাব এল, “না।”

দু’মাস পরে কণিকা ভক্তির জীবন থেকে বিদায় নিয়ে কলকাতায় চলে গেল। ভক্তিরই উদ্যোগে আদালতে ওদের বিবাহ বিচ্ছিন্ন হলো। ভক্তি কণিকাকে নিয়ে গেল স্টেশনে, রেল টিকিট ও রিজার্ভেশন আগে থেকেই করা ছিল, গাড়ি ছাড়া অবধি বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। গাড়ি চলবার প্রথম পদক্ষেপে, কণিকা বলল, “যদি পার আমাকে ক্ষমা কর, দরকার হলে ছেলেমেয়েদের আমি দেখব। মেয়ের পুরো দায়িত্ব থাকতে আমারই। তুমি নিজেকে দেখো।”

ভক্তি চুপ করে রইল। ট্রেন সরে গেল নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে। ভক্তি তো মানুষ এবং পুরুষ। চণ্ডালিকার বুদ্ধ সন্ন্যাসীর মতো সে বলতে পারল না তার শেষ কথা, “কল্যাণ হোক তব, কল্যাণী।”

তবু বলে রাখি ভক্তি যেভাবে তার প্রেমসিক্ত স্ত্রীকে ভদ্রতা, সম্মান ও আভিজাত্যের সঙ্গে বিদায় দিতে পেরেছিল, তার নজির দেশে আমি দ্বিতীয় দেখিনি, বিদেশেও কম। পরবর্তী সুদীর্ঘ বছরগুলোতে ছেলেমেয়ে দীর্ঘকাল তাদের মায়ের কাছেই থেকেছে, কণিকাই মেয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা ও তারপর বিবাহের ব্যবস্থা করেছে। ঘটেনি শুধু একটি ঘটনা, ভক্তি ও কণিকা আর মুখোমুখি হয়নি। ছেলের বিবাহে আসতে পারেনি কণিকা, মেয়ের বিবাহে উপস্থিত থাকেনি ভক্তি।

বিচ্ছেদের মধ্যেও আভিজাত্য এবং পারস্পরিক অনুচ্চারিত ক্রোধ মিশ্রিত স্নেহ বর্তমান থাকতে পারে। জীবন যেমন মিলনে সুন্দর, তেমনি বিচ্ছেদেও চিত্তস্পর্শী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *