আঠারো
প্রথমেই যে প্রশ্ন উঠল তা হলো কোন কলেজে কত সুবিধেতে ভর্তি হওয়া যায়। তিনটে লেটার পাওয়া ছাত্রের সংখ্যা কলকাতায় এসে দেখলাম অগুনতি। যদিও গণেশপুরে ছিল একটি। খুড়তুতো পিসিমা, যাকে ডাকতাম মুরলা পিসি, বললেন, বিদ্যাসাগর কলেজে গভর্নিং বডির এক সভ্যর সঙ্গে তাঁর পরিচয় আছে। সেখানে বিনামূল্যে পঠন এবং ক্ষুদ্র একটি বৃত্তি পাওয়া সম্ভব।
কলেজ নিয়ে কোনো অভিভাবকদের মধ্যে কোনো মতভেদ দেখা গেল না। অতএব মুরলা পিসির সঙ্গে আমি একদিন শঙ্কর ঘোষ স্ট্রিটে এক মহাশয়ের গৃহে পৌঁছে গেলাম করুণাপ্রার্থী হিসেবে। তাঁর নাম মনে নেই, মনে আছে তাঁর বাড়িটা খুব বড়, বৈঠকখানা সোফাসেট চেয়ার টুল ইত্যাদি ছাড়াও একটা বড় ফরাসে সজ্জিত, অর্থাৎ এক বা একাধিক সতরঞ্চির উপর একটা বিশাল সাদা ধবধবে চাদর বিছানো। কয়েকটা ছোট ছোট কোলবালিশ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত।
মহাশয় ছিলেন অ্যাডভোকেট, ঘরে বেশ কয়েকজন লোকের উপস্থিতি। খুব আড়ষ্ট হয়ে মুরলা পিসির সঙ্গে ঘরে ঢুকে চাদরের একপাশে বসলাম। কিছুক্ষণ পরে অ্যাডভোকেট মহাশয় মুরলা পিসিকে প্রশ্ন করলেন, “আপনার কী প্রয়োজন?”
মুরলা পিসি আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “এটি আমার ভাইপো”— বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমি এগিয়ে গিয়ে মহাশয়ের চরণ স্পর্শ করে নিলাম।
“তিনটে লেটার পেয়ে পাস করেছে, আমার দাদা দরিদ্র স্কুল শিক্ষক, একে বিনা বেতনে পড়ার এবং বৃত্তির ব্যবস্থা করে দিতে হবে।”
অ্যাডভোকেট মহাশয় আমার নাম, ধাম, স্কুল ইত্যাদি নিয়ে অনেক প্রশ্ন করলেন। বললেন, “দরখাস্ত এনেছ? সঙ্গে মার্কশিট আছে?”
দরখাস্ত ও মার্কশিটের ওপর চোখ বুলিয়ে প্রভাবশীল কণ্ঠে বললেন, “ফ্রি-শিপ তো হয়ে যাবে। বৃত্তি প্রথম বছর পাওয়া অসম্ভব। স্টার পাওয়া ছেলে অন্তত পনেরোটি।”
তারপর আমাকে হতাশ দেখে প্রশ্ন করলেন, “থাকা খাওয়ার জায়গা আছে?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, আমার কাকা এখানে আছেন।”
সঙ্গে সঙ্গে মুরলা পিসিমাও বললেন, “তার পাঁচটি সন্তান ও তিনি বর্তমানে বেকার।”
আমার কাকা যিনি অঙ্কশাস্ত্রে প্রথম এমএ-তে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, কখনো দীর্ঘকালীন কোথাও কাজ করতে পারেননি। বঙ্গদেশে তাঁর ভাত ছিল না। সবচেয়ে দীর্ঘকাল কাজ করেছিলেন বর্তমান পাকিস্তানে বাহাওয়ালপুর রাজ্য কলেজে, কিছুদিন নেপালে কোনো না কোনো রাণার পুত্র বা পুত্রদের ছিলেন প্রাইভেট টিউটর, কিছুদিন কাজ করেছিলেন ভাগলপুর কলেজে, অনেক পরিণত বয়সে রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব চাকরির ব্যবধানে তাঁকে বছরের পর বছর বেকার থাকতে হতো, দুর্দান্ত অহমিকার জন্য কারও কাছে কিছু চাইতে পারতেন না। কাকিমা যে কী করে সংসার চালাতেন তা নিয়ে আমার কোনো কৌতূহল ছিল না। দেখতে পেতাম আমরা সবাই তিনবেলা খেতে পাচ্ছি। আমাদের কারুর কোনো অভাব নেই। কাকামণি অ্যাকচুয়ালি পরীক্ষা দেবার জন্য অনবরত অঙ্ক কষতেন। মাঝে মাঝে তাঁকে খুব গম্ভীর চিন্তান্বিত দেখাত। প্রতি সন্ধ্যায় আমাদের সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে ভজন পূজন করতেন। অনেকগুলো ভজন আমার তরুণ মন ও ক্ষুধার্ত হৃদয়কে বেশ কিছুটা শান্তি ও পূর্তি এনে দিত।
বীড স্ট্রিট থেকে শঙ্কর ঘোষ স্ট্রিটের কলেজ বড়জোর দেড়মাইল হবে। ট্রামে চড়তে ভয় ও অর্থের অভাব, আমি হেঁটে কলেজে যেতাম ও বাড়ি ফিরতাম। বাবার একটা শার্ট গায়ে ঢিলাঢালা দেখাত, পায়ে চটি। খুলনা বাজারে আমি চামড়ার জুতো কিনতে রাজি হইনি, কিনেছিলাম একজোড়া স্যান্ডেল। মনে হতো গণেশপুর স্কুলে যাচ্ছি। একমাসের মধ্যে জানানো হলো বেতন আমার মার্জনা করা হয়েছে; কিন্তু বৃত্তি পেতে প্রথম বছর খুব ভালো ফল দেখাতে হবে।
ক্লাসে দেখতে পেলাম অন্তত দশটি ছেলে ম্যাট্রিকে স্টার পেয়েছে, বিশেষ করে সংস্কৃত ক্লাসে তাদের উচ্চারণ ও ব্যুৎপত্তি আমাকে বিস্মিত ও স্তম্ভিত করত। এক সংস্কৃত অধ্যাপকের কথা মনে আছে, নাম অক্ষয় বাবু। তিনি সংস্কৃত ভাষায় ক্লাসে বক্তৃতা করতেন। আর একজন অধ্যাপক, যাঁর নাম মনে নেই, তিনি কালিদাসের রঘুবংশ পড়ানোর আগেই ছাত্রদের বলে দিয়েছিলেন যে তাঁর নিজের টীকাকৃত সংস্করণ ‘বাজারে সর্বোত্তম’। কোনো অধ্যাপক আমার মনে গভীর রেখাপাত করতে পারেননি, গ্রামের সেই উমেশবাবু ছাড়া। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হতে পারে না।
আমার ঝোঁক ছিল ইংরেজি, ইতিহাস ও সিভিক্সের উপর, সিভিক্সের সঙ্গে আমাদের একটু ইকনমিক্সও পড়তে হতো। এখনকার ছেলেমেয়েরা দ্বাদশ শ্রেণিতে পঠনপাঠনের যে বিরাট ভার বহন করে, কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য তাদের যে পরিমাণ পরিশ্রম ও অর্থব্যয় করতে হয়, আমাদের সময় ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে তার একাংশ ভারও বইতে হতো না।
তবু আমার মনে আছে একজন ইংরেজি অধ্যাপক এক নিশ্বাসে দু—তিন মিনিট একটানা স্রোতের মতো ইংরেজি বলে, হঠাৎ থেমে, সমস্ত চমৎকৃত ছাত্রদের চোখমুখে বিকশিত প্রশংসা ও বিস্ময় সানন্দে উপভোগ করে নিতেন
মনে আছে এক সংস্কৃত অধ্যাপক পকেটে ছটি ফাউন্টেন পেন রাখতেন ও রোলকল করার আগে প্রত্যেকটি এক একবার পরখ করে শেষ পর্যন্ত একটিকে বেছে নিতেন। সারা কলেজের ছাত্ররা ভিড় করত এক অধ্যাপকের বক্তৃতা শোনবার জন্য, বিখ্যাত জে.এল. ব্যানার্জি। তাঁর ক্লাসে দাঁড়াবার স্থান পাওয়া যেত না।
বিদ্যাসাগর কলেজে প্রচুর ছাত্র, কিন্তু কো-এডুকেশন নেই। শঙ্কর ঘোষ স্ট্রিট দিয়ে মেয়েদের কলেজের বাস বেরিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রেরা হইচই করত, সিটি মারত এবং দু-চারটে অশ্লীল কথাও বলে ফেলত। মেয়েদের মধ্যে দু-চারজনকে আমি হেসে ফেলতে দেখতাম। বলা বাহুল্য বিদ্যাসাগর কলেজে ছাত্রকালে আমার কোনো ছাত্রীর সঙ্গে আলাপ হয়নি। এ নিয়ে খুব একটা আক্ষেপও ছিল না। কেননা ২৯ নম্বর বীডন স্ট্রিটের ছাদে সকাল ও মাঝে মাঝে গোধূলি পর্যন্ত পড়ার সময় ৩০ নম্বর বাড়ির একটি মেয়ের দর্শন প্রায়ই পেতাম। অত সুন্দরী যুবতি মুখ তার আগে আমার চোখে পড়েনি।
মেয়েটির নাম ছিল গীতা মিত্র। তার ভাই একদা বিখ্যাত সাঁতারু দিলীপ মিত্র, দীর্ঘাঙ্গ, সুপুরুষ মজবুত দেহ। গীতা মিত্রের সঙ্গে আমি সম্ভবত দশ-বারোটি বাক্য বিনিময় করেছিলাম, উপলক্ষ ছিল তার বাবা বা মায়ের অসুস্থতা। মনে আছে, গীতা মিত্র সপ্রতিভ ও মধুরকণ্ঠী। কলকাতায় এক রাজবন্দী হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার ওদের বাড়ির একতলায় ডিসপেনসারি খুলে বসলেন। সেখানেও মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যেত। কিন্তু বাক্য বিনিময় হতো না। দিলীপ মিত্রের সঙ্গে আমার একটিও বাক্য বিনিময় হয়নি, কিন্তু তিনি যখনই আমার নজরে পড়তেন, তার দীর্ঘ সবল দেহ আমি প্রশংসার চোখে দেখে নিতাম।