সাত
এই সব গুরুগম্ভীর অশনি-সংকেত ঘটনাই শুধু গণেশপুরের চালচিত্র তৈরি করেনি আমার তেরো বছর বয়সে। আমাদের গ্রামীণ জীবনের ছোটখাটো কৌতুক, কোমলতা ও ব্যথা বেদনার ক্ষুদে নাটক ঘটে যেত প্রায়ই। মানুষ মারা যেত, তার আপনজনদের কান্নার রোল ভেসে ভেসে বেড়াত বাতাসে। নতুন শিশুর জন্ম হতো, মৃত্যুর শূন্যতা পূর্ণ করবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। বিয়ে হতো সারা বছর ধরে, শুধু তিনটি মাস বাদ দিয়ে : চৈত্র, ভাদ্র ও পৌষ। বর্ষায় গ্রাম প্লাবিত হয়ে যেত। পদ্মা হঠাৎ যৌবনে উচ্ছল, তার প্রসারিত বহু তরঙ্গবাহুতে আতঙ্কময় আলিঙ্গনের আহ্বান। প্রচুর ইলিশমাছ ধরা পড়ত জেলেদের জালে। এক একটা বড় মাছ বিক্রি হতো তিন-চার পয়সায়। দু-একবার বিনে পয়সায় প্রজা জেলেরা মাছ দিয়ে যেত আমাদের। কালবৈশাখী ও আশ্বিনের ঝড়ে অনেক বৃক্ষ উৎপাটিত হতো, অনেক ঘরের চালের টিন উড়ে গিয়ে অন্য বাড়ির জমিতে পড়ত। কলেরায়, বসন্তে মরত মানুষ দলে দলে, দশে-বিশে। ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, আমাশয় ছিল বহু মানুষের নিত্য সঙ্গী। স্কুল পাস করা ডাক্তার মহেন্দ্র শীল ও কবিরাজ গগন রায়ের ডিস্পেনসারিতে রোগী জমত। ছেলেমেয়েরা খেলা করত রাস্তায়, মাঠে, বাগানে, নদীতীরে। বাড়িতে বাড়িতে পালাকীর্তন হতো। নিমাই সন্ন্যাস, নৌকাবিলাস, এ দুটোই আমার বিশেষ করে মনে আছে। আমার গলা ভালো ছিল, আমি নিজেই বাড়ির সমবয়সী ছেলেমেয়েদের নিয়ে নিমাই সন্ন্যাস পালা গাইতাম। তাতে আমাদের বাড়ির বিভিন্ন শরিকদের বাইরে, আর কাউকে ডাকা হতো না। মা আমাকে একটা গৈরিক কাপড়ের পাঞ্জাবী তৈরি করে দিয়েছিলেন গ্রামের দরজির হাতে। যে পুরোহিত মাসে চার টাকা ও প্রতিদিনের নৈবেদ্য প্রণামি পেয়ে প্রতিদিন দশ মিনিট নারায়ণ পূজা করতে আসতেন, তিনি আমাকে তার একখানা পুরান ও কিছুটা ছেঁড়া নামাবলী দান করেছিলেন। গৈরিক পাঞ্জাবী আর নামাবলীতে দেহ আবৃত করে আমি নিমাই সন্ন্যাস গাইতাম। তবলা তো ছিল না, জ্যেঠা মশাইয়ের ঘরে ছিল একটা অনেক পুরোনো খোল, সেটাকে সারিয়ে নিজের হাতে নিজেই বাজাতাম। করতাল বাজাত আমার সমবয়সী স্বরাজ, যে পরিণত বয়সে ইন্সপেক্টর অব স্কুলস পদ থেকে অবসর নিয়ে এখন কোথায় আছে, কেমন আছে, কে জানে? নিমাই যখন সন্ন্যাস নেবার জন্য গৃহত্যাগ করছেন, নিদ্রিত বিষ্ণুপ্রিয়াকে বলছেন, “মায়ের কাছে থেকো, মা বলিয়া ডেকো, তাঁকে মা বলিবার কেউ নেই গো”, তখন দুচোখ থেকে জল নেমে এসে আমার গাল ভিজিয়ে দিত, শ্রোতাদের মধ্যে অনেকের ফাঁপা কান্না শুনতে পেতাম। বাড়ির বাইরে আমার নিমাই সন্ন্যাস দল কখনো কীর্তন করেনি।
এক গ্রীষ্মের ছুটিতে বাবা বাড়িতে এসেছেন। তাঁর দ্বিপ্রহর কাটাবার দুটো অভ্যাস ছিল। কখনো কখনো মধ্যাহ্ন আহারের পরে একখানা পার্টি ও একটা বালিশ নিয়ে দুর্গামণ্ডপের বাইরে চলে যেতেন, জামরুল গাছের নিচে পাটি পেতে বালিশে মাথা রেখে তাঁর দিবানিদ্রা হতো। জামরুল গাছে তখন অনেক ফল, মৌমাছি ভনভন করতে পাকা জামরুলের চারপাশে, কিছু জামরুল ছড়িয়ে থাকত গাছের নিচে, পথের উপর। মৌমাছিদের পরোয়া করতেন না বাবা। খুব কাছাকাছি ছিল কালীপূজার ঘর। তিনি কালী-সাধক ছিলেন, আমার মনে হতো কালীপূজার ঘরের নিকটই তাঁকে বেশি আকর্ষণ করত জামরুল গাছের ছায়ার চেয়ে।
আবার অনেক সময় তিনি ‘দক্ষিণের ঘরে’ পিতামহ রজনীকান্তের খাটে দিবানিদ্রা দিতেন। আমাকে মাটির ওপর মাদুর বা পাটি পেতে তাঁর দেওয়া টাস্ক করতে হতো। অঙ্ক এবং ইংরেজি এই দুটোই করিয়ে নিতেন আমাকে দিয়ে, অঙ্কে আমি আগাগোড়া ফাঁকি দিতাম। কিন্তু খুলনা থেকে নিয়ে আসা ভারী এক একটা ইংরেজি বই পড়ে প্রত্যেকটা আলাদা শব্দকে খাতায় লিখে আশুতোষ চৌধুরীর ইংরেজি—বাংলা অভিধান ঘেঁটে তাদের অর্থ লিখতে হতো। বানান লিখতে হতো। এ পরিশ্রমটা আমার একদমই মনঃপুত হতো না। তাই ইংরেজি শব্দের স্টক আমার বেশ বেড়ে গেলেও বাগানে আমি দুৰ্বল হয়ে রইলাম অনেক বছর। বাবা একবার গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে গেলেই আমি গুটি গুটি পালিয়ে গিয়ে মা’র (এবং আমাদের) বিছানায় দক্ষিণের জানলার পাশে বসে বাংলা উপন্যাস পড়তাম। এ সময়ে আমি বসুমতী সাহিত্য মন্দির থেকে প্রকাশিত চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসগুলোর বাংলা অনুবাদ পড়ে নিয়েছি, সেক্সপীয়রের দু-চারখানা নাটকের বঙ্গানুবাদও আমার পঠিত। ডেভিড কপারফিল্ড ছিল আমার প্রিয়তম ইংরেজি উপন্যাস। বাংলায় পড়া। ডেভিড ও আগনেসের প্রেম কাহিনি অহরহ একটি ক্ষুদ্র দীপ শিখার মতো আমার অন্তরে জ্বলত। উড়িয়া হিপ ছিল আমার কাছে সবচেয়ে ঘৃণ্য। মিস্টার মিকাবার সবচেয়ে মজার মানুষ। উপন্যাসের শেষ দিকে ডেভিড ও আগনেসের মধ্যে মর্মভেদী কথাবার্তার মধ্যে ডেভিডের ব্যাকুল বাক্য—“আগনেস, আমি তোমাকে ভালোবেসে দূরে চলে গিয়েছিলাম। তোমাকে ভালোবেসে দূরে থেকেছি। তোমাকে ভালোবেসে ঘরে ফিরে এসেছি”– পড়বার সময় আমি অশ্রু ধারণ করতে পারতাম না। বারবার পড়ে, বারবার কাঁদতে ভালো লাগত আমার। এই কথাবার্তার শেষ বাক্যটি উচ্চারিত হয়েছিল আগনেসের মুখে যা তার সারা যৌবন বছরগুলোতে গোপন থেকেছে। যে কথা সে কাউকে কোনোদিনও বলতে পারেনি, বলতে চায়নি।
আগনেস বলছে ডেভিডকে, “আমি ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেয়েছি তোমার কথা থেকে। আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে, কিন্তু একটা কথা তোমাকে শুনতে হবে।”
ডেভিড : “কী কথা, প্রিয়তমে?”
আগনেস তার কোমল হাত দুখানা ডেভিডের কাঁধের উপর রাখল। গভীর গাম্ভীর্যের সঙ্গে চোখ রাখল তার চোখে।
“তুমি কি এখনও জানো না সে কথাটা?”
“আমার আন্দাজ করতে ভয় হচ্ছে, তোমার মুখে শুনতে দাও।”
“আমি তোমাকে সারা জীবন ধরে ভালোবেসে এসেছি।” আমার এখনও ভাবতে অবাক লাগে ১৮৬৭-৭০ সালে লেখা চার্লস ডিকেন্সের এক অক্ষয় উপন্যাস ১৯৩৫ সালে বঙ্গভূমির সুদূর এক গ্রামে অন্য ভাষায় পাঠিত হয়েও একটি তেরো বছরের ছেলের বুকে তুফান তুলত। চোখের জলে গাল ভাসিয়ে দিত। পুত্র, তোমাদের কলেজ জীবনে চার্লস ডিকেন্স পাঠ্য লেখক। আমার বিশ্বাস সৃজনশীল, কলেজের পাঠ্যপুস্তক হয়ে গেলে, গবেষণার ক্ষেত্র হলে, তার সাধারণ আবেদন নিস্তেজ হতে থাকে। ক’জন এখন আর ডিকেন্স পড়ে, বলো? ক’জন পড়ে শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কেবলমাত্র রসাস্বাদন ও জীবনের বিরাটতর মহানতর অনুভূতি অভিজ্ঞানের সন্ধানে?
বাবা একদিন বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দিলেন অমর কাকা সন্ধ্যেবেলা আসবেন তাঁর সদ্যপ্রাপ্ত গ্রামোফোন এবং রেকর্ড নিয়ে আমাদের সবাইকে তাক করে দিতে। আমি তো বলেই রেখেছি, উপন্যাস, গান বাবার খাদ্য ছিল না, তার মধ্যে ধর্মীয় অথবা উদ্যোত্মক চেতনা জাগরণের উপাদান না থাকলে। কিন্তু তাঁর অমরকাকা নিজে থেকেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁকে সাগ্রহে গ্রহণ করতে হয়েছিল।
সন্ধ্যের আগেই শেষ অপরাহ্নে অমরদাদু তাঁর ভৃত্যের মাথায় রেকর্ডের বাক্স চাপিয়ে উপস্থিত হলেন আমাদের বাড়িতে। রজনীকান্তের তক্তপোষকে আমি গানের আসরে পরিণত করে রেখেছিলাম একখানা সতরঞ্চি পেতে। অমরদাদুকে বাবা তার উপর বসালেন। আমরা দশ-পনেরো জন বসলাম মাটির ওপর। দু-চার জন রইল দাঁড়িয়ে।
দক্ষিণের জানলা দিয়ে হালকা হাওয়ার সঙ্গে মিষ্টি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। বর্ষা শেষ হয়ে এসেছে, অনেক সবুজ পাতার গন্ধ ও মিশে গেছে ফুলের গন্ধের সঙ্গে। ভিজে মাটির গন্ধ পেয়ে, আমাদের সবাইকে সমবেত হতে দেখে ঘরের আস্তরে তক্ষকগুলো ইতস্তত ছুটে বেড়াচ্ছে, গলা থেকে বিশ্রি আওয়াজ ছেড়ে। বাড়ির আশ্রিত কুকুর কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে থেমে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘরের বাইরে ঘুমোচ্ছে। প্রকাণ্ড চোঙওয়ালা এইচ.এম.ভি. গ্রামোফোন। হিজ মাস্টার ভয়েসে গণেশপুর গ্রামে তার প্রথম পদার্পণ। অমরদাদুর ছেলে কলকাতায় চাকরি করেন। তিনি কিনে এনেছেন বাবা-মা, ভাই-বোন কাকা-কাকি, পিসি-পিসো গ্রামবাসীদের মনোরঞ্জনের জন্য।
ভৃত্য গ্রামোফোনটা তক্তপোষের উপর রাখল। কাঠের বাক্সে সেটা রক্ষিত ছিল, বাক্স খুলে তাকে বার করা হলো। চোঙাটা হলো লাগানো। অমরদাদু সযতনে একটা পরিষ্কার রুমাল দিয়ে মুছলেন। তারপর রেকর্ড বাছাই হলো, তাও রুমালে মোছা হলো। হ্যান্ডেল দিতে পাম্প করলেন গ্রামোফোনকে অমরদাদু। তারপর রেকর্ড বসালেন, গ্রামোফোনের সুঁচ রেকর্ড স্পর্শ করল। আমরা প্রথম ‘কলের গান’ শুনতে পেলাম। কৃষ্ণচন্দ্র দে, রেণুকা রায়, পঙ্কজ মল্লিক এই তিন গায়কের নামই মনে আছে। একটা গান ছিল, অমরদাদুর ভাষায়, “পোয়েট লরিয়েট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের” রচিত : “কত অজানারে জানাইলে তুমি কত ধরে দিলে ঠাঁই। দূর কে করিলে নিকট বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।”