পিতা পুত্রকে – ১৪

চৌদ্দ

ঊষার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম কেটে গেল। অর্থাৎ আমার যখন ঘুম ভাঙল, মনে হলো সবেমাত্র ঊষা এসেছে রাত্রির শেষে।

আমার হাতে তো ঘড়ি নেই, সময় বোঝা সম্ভব নয়। পাশে সরকার মেশো চিৎ হয়ে গভীর নিদ্রিত। মুখে তেমন একটা লোভী লোভী হাসি নিয়ে ভদ্রলোক স্বপ্ন দেখছেন। মাসিমার ঘুম ভেঙে গেছে, তবুও শুয়ে রয়েছেন বিছানায়। একমনে, কিছুই না দেখে, নিবিষ্ট দুচোখ খুলে। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম বেশিরভাগ যাত্রীই চাদরে গা ঢেকে ঘুমুচ্ছে। কয়েকজন উঠে বসেছে, একটি মেয়ে, স্কুলের উঁচু শ্রেণির মেয়ে মনে হচ্ছে। রেলিং চেপে ধরে নদীর ঢেউ দেখছে।

ভৈরব, দেখতে পেলাম, একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেছে। সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলছে। চলতে চলতে শ্রান্ত হয়ে পড়েছে।

সারেঙ কি এখনও জেগে জেগে কম্পাস ঘুরাচ্ছে? ম্যাপের ওপর নজর রেখে কম্পাসের চাকা ঘুরিয়ে দিচ্ছে?

উঠে, নিচে নেমে এসে, দেখলাম আর এক চেহারা জাহাজের। সকলে মালপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে, খালাসিরা ব্যস্ত সমস্ত, কেউ এক কোণ থেকে অন্য কোণে দৌড়চ্ছে। বালতি বালতি জল তুলে ধোওয়া হচ্ছে জাহাজের মেঝে।

একটি লোক, প্রকাণ্ড ভুঁড়ি, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, সারা মুখ দাড়িতে ঢাকা, কপালে সিঁদুরের টিপ, হাতে অনেকগুলো আংটি, বাহু থেকে শক্ত মণিবদ্ধ, তাকে বেষ্টন করে রয়েছে সোনার চেনে বড় একটা ঘড়ি।

আমি এগিয়ে গিয়ে লোকটার মুখোমুখি হয়ে স্তব্ধ বাক্যহীন হয়ে পড়লাম। মানুষটা অন্ধ। দুটো চোখই তুলে ফেলা হয়েছে। রয়েছে শুকনো চামড়ায় ঢাকা দুটো গর্ত। দাঁড়িয়ে কয়েকটা চাকরকে চওড়া গলায় হুকুম করছে পাটের চটে বাঁধা বরফ দেওয়া বড় বড় মাছের ঝাকা গুছিয়ে রাখতে, জাহাজের খোলা দরজার পাশে, যেখানে কাঠের তক্তা দিয়ে রাস্তা বসানো হবে তীরের মাটি পর্যন্ত, যাত্রীদের অবতরণের জন্য।

আমার স্তব্ধ ভীত ভাব কেটে গেলে আর একটু কাছাকাছি পৌঁছেছি, মানুষটার অনেক কাছাকাছি।

হঠাৎ আমাকে দারুণ চমকে দিয়ে সে বলে উঠল, “কে ওখানে? কী চান? মাছ কিনবেন? “

আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “না।”

“তবে? তবে কী চান আপনি?” প্রশ্ন তো নয়, হুংকার।

“কিছু না। কটা বেজেছে তাই খুঁজছি। আপনার হাতে ঘড়ি দেখে–।”

লোকটা ঘড়ির ওপর হাত বোলাল। বলল, “সাতটা বেজে তেইশ।”

শুনেই বুক কেঁপে উঠল। প্রশ্ন করলাম, “খুলনায় তো আটটায় পৌছাবার কথা। তাই না!”

লোকটি বলল, “পৌছে যাবে। আধ ঘণ্টার বেশি দেরি হবে না। “ শুনেই আমি এক দৌড়ে ওপরে চলে গেলাম আমার বিছানার কাছে। মাসিমা তখনও ঐ একইভাবে শূন্য দৃষ্টিতে কিছুই না দেখে তাকিয়ে আছেন ড্যাবডেবে দু’চোখে। এখন তার বিপুল দেহ বসে রয়েছে বিছানার ওপর। সরকার মশাই তখনও স্বপ্ন দেখে হেসে চলেছেন।

আমি খুব বাস্তবতার সঙ্গে বললাম, “মাসিমা, সাড়ে সাতটা বেজেছে। এখুনি খুলনা এসে যাবে। ওনাকে তুলুন। বিছানা বেঁধে নামবার জন্য তৈরি হোন।”

বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার তোষক, চাদর, বালিশ সব একত্র করে সতরঞ্চির ওপর রেখে বিছানা রোল করে পাটের দড়িতে বেঁধে ফেললাম। আমার টিনের বাক্সটা নিলাম। বন্ধ তালা ঠিকই রয়েছে। মা একজোড়া নতুন রবারের পাম্প শু কিনে দিয়েছিলেন। সে দুটো পায়ে পরে নিয়ে কাছাকাছি মুখ ধুতে গেলাম। দাঁত মাজার জন্য নিমের দাঁতন পকেটেই ছিল। তাড়াতাড়ি চিবিয়ে চিবিয়ে নরম করে মিনিটখানেক দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে নিলাম। সঙ্গে গামছা ছিল না, বিছানায় বাঁধা হয়ে রয়েছে। মুখ মুছতে হলো না, নদী তার বাতাস দিয়ে মুছে দিল আমার ভেজা মুখ। শুকিয়ে দিল ভেজা চুল।

বাঁধা বিছানা ও টিনের বাক্সটাকে নিচে নিয়ে যাবার জন্য শোবার জায়গায় ফিরে এসে দেখি সরকার মেশোমশাই উঠে গেছেন। স্ত্রীর সাহায্যে বাঁধছেন বিছানা। ওঁদের সঙ্গে দুটো বাক্স, একটা চামড়ার সুটকেস, তিনটে বড় বড় টুকরি। এসব নিচে নিয়ে আসবেন কী করে জানতে চাইলে সরকার মশাই বললেন, কেন? কুলি এসে যাবে। দেখো জাহাজ বন্দরে দাঁড়ালেই ঝাঁকে ঝাঁকে কুলি এসে যাবে।

কুলিকে কত পয়সা দিতে হয় আমার জানা নেই। আমি শুধু জানি টিনের বাক্সে পাঁচটা টাকা আর আমার শার্টের পকেটে এক টাকা তেইশ পয়সা রয়েছে। আমি নিজেই গণেশপুরে আধমন চালের বস্তা মাথায় করে কুড়ি মিনিট হেঁটে বাজার থেকে বাড়ি এসেছি দু’পয়সা বাঁচাবার জন্য। একবার বর্ষায় ভরা পদ্মার উজান স্রোতে অসংখ্য ইলিশ মাছ ধরা পড়লে মাঝিরা চার পয়সায় প্রকাণ্ড বড় বড় ইলিশ বিক্রী করছিল। আমি একটা কিনে, তীর থেকে মাঝিকে চারপয়সা দিতে গেলে একটা পয়সা হাত পিছলে পড়ে গেছিল নদীর জলে। বাকি ছিল মাত্র তিন পয়সা। জেলে মাঝি আমার ক্ষতি দেখে দয়া করে তিন পয়সাতেই সেই এখনকার প্রায় দেড়কিলো ইলিশ মাছটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। মাছের মাথার ভেতর দড়ি ঢুকিয়ে দড়িটা আমার আঙ্গুলে শক্ত করে ধরে দিয়েছিল যাতে মাছটা না জলে পড়ে যায়। বর্ষার অস্থির পদ্মা হেসে অস্থির হয়ে দেখেছিল সে দৃশ্য। বাড়ি এসে মার কাছে একটা পয়সা নদীর জলে ফেলে দেবার জন্য কেঁদে ফেলেছিলাম। আমি গণেশপুরের ভদ্র গরিব ঘরের নওজোয়ান সন্তান। এক পয়সাও আমার কাছে অনেক দামি।

অতএব টিনের বাক্সটাকে মাথায় তুলে নিয়ে বিছানার দড়ি ধরে টেনে নিয়ে আমি চললাম নিচের ডেকে। জাহাজ খুলনা বন্দরে নোঙর ফেলবার অপেক্ষায়। যাবার আগে সরকার মেশোমশাই ও মাসিমাকে দু’হাত জোড় করে নমস্কার জানালাম। আমাকে দুটো বোঝা তুলে নিতে দেখে সরকার মেশোমশাই অবাক হলেন, বাধা দিলেন না, কিছু বললেনও না। মাসিমার মুখখানা থেকে সেই ঝলমলে হাসির আলো চলে গিয়েছিল। তিনি শুধু ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে কয়েক সেকেন্ড।

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে কষ্ট হলো না। নিচের ডেকে তখন যাত্রীরা ভিড় করে রয়েছে খোলা দরজাটার সামনে। এদের পেছনে দাঁড়ালে পিতা ঠাকুরকে আমি দেখতে পাব না। তিনিও দেখতে পাবেন না তার আত্মজ অগ্রজ পুত্রকে। আমি তাই একপাশে সরে রেলিঙের পাশে দাঁড়ালাম। টিনের বাক্স ও বিছানাকে রাখলাম পায়ের কাছে, পা দিয়ে স্পর্শ করে।

মন্থর গতিতে জাহাজ এবার হেলে দুলে এগোচ্ছে। নদীর দুধারের বৃক্ষরাজি, লতাগুল্ম, কুটির, দালান নজরে আসছে। ঝাঁকে ঝাঁকে বক পাখি উড়ছে জাহাজের সঙ্গে সঙ্গে। মাছের মধ্যে লোভী পাখিরা নদীর কাছাকাছি উড়ছে, পাখার ঝাপটে ছিটাচ্ছে নদীর জল। নদীর জল ঘোলাটে, ঢেউগুলো নিস্তেজ। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, তাই অত দেরিতে ঘুম ভাঙলেও মনে হয়েছিল নদীর সঙ্গে ঊষার সাক্ষাতের সময় ঘুম ভেঙে গেছে আমার। জাহাজ ভোঁ ভোঁ আওয়াজে তার আগমন ঘোষণা করছে। আমি হঠাৎ যেন এক অজানা অদ্ভুত উত্তেজনা ধমনীতে বুকের স্পন্দনে অনুভব করছি। এটা কি জল থেকে তীরে নামবার উত্তেজনা? মাটির আসন্ন স্পর্শের উদ্বেলতা? না কি যে পিতাকে আমি খুব কম চিনি, জানি আরও কম, অথচ যাঁর সঙ্গে আমার আত্মার ও রক্তের গভীর চিরস্থায়ী বন্ধন, তাঁর সঙ্গে এই প্রথম মুখোমুখি হবার আশা ও আশঙ্কার যৌথ চাপে কাঁপছে আমার বুক। হাতের তালু মনে হচ্ছে ঠান্ডা, পা অবশ।

খুলনা বন্দর এবার চোখের সামনে। অনেক লোক ভিড় করেছে তীরে। আত্মীয়স্বজনদের আদর করে পাড়ে নিয়ে যেতে। অথবা মাছ পণ্য তরিতরকারি কিনে দিতে। জাহাজ নোঙর ফেলেছে। পড়েছে কাঠের রাস্তা। আমি তীরস্থ মানুষগুলোর সামনে পঙ্ক্তিতে বাবাকে দেখতে পাচ্ছি। তাঁর উৎসুক, আকুল, ভীত দৃষ্টি জাহাজের দরজার ওপর ও কাছাকাছি দাঁড়ানো যাত্রীদের, ত্বরিৎবেগে তন্ন তন্ন তালাস করে হঠাৎ পতিত হয়েছে আমার ওপর। একমুহূর্তে কেটে গেছে উদ্বেগ, আকুলতা, ভয়। গভীর নিশ্চিত নিশ্বাসের সঙ্গে আমার বাবার মুখখানা এমন শান্ত, স্নেহার্ত। তিনি ভিড় ঠেলে আমার দিকে এগোচ্ছেন। সঙ্গে নিয়ে আসছেন একটা ছোকরা ‘কুলি’ আমারও রুদ্ধশ্বাস এবার মুক্তি পেয়ে গেছে। ভয়ার্ত মুহূর্তগুলো এক নিমেষে পলাতক। ভয় নেই আমার দেহ মনের কোথাও। বাবা এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছেন। আমি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছি। বাবা ঐ ছেলেটাকে বলছেন, “বাক্সটা মাথায় তুলে নে।” তুলে নেবার সঙ্গে সঙ্গে বাবা আমার বিছানাটা ঐ বাক্সের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছেন। বলছেন, “চল্, এগেিয় চল্, রিকশা দাঁড়িয়ে আছে।” ছেলেটাকে সামনে রেখে বাবা এগিয়ে যাচ্ছেন জাহাজ ছেড়ে খুলনার মাটিতে। তার ঠিক পেছনে আমি। বারবার বাবা তাকিয়ে দেখছেন আমি ঠিক পেছনে আছি কিনা।

আমাদের পিতা-পুত্রে একটা কথাও বিনিময় হয়নি। শুধু এক স্নেহার্দ্র নীরবতা দুজনকে দৃঢ় বন্ধনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ শুনতে পেলাম, “গুডবাই, মাই ইয়ং ফ্রেন্ড।”

তাকিয়ে দেখলাম সেই সারেঙ সাহেব। পরনে জাহাজের কাপ্তানের পোশাক, মাথায় কাপ্তানি টুপি।

আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সারেঙ সাহেব, আমিও বাড়িয়ে দিয়েছি। আমি গুডবাই বা থ্যাংকইউ বলতে পারিনি। মুখেও শব্দ আসেনি। আসলেও বাবার এত কাছে, মুখ দিয়ে বেরুত না ও কথাগুলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *