পিতা পুত্রকে – ১০

দশ

উমেশবাবু আমার অঙ্ক-আতঙ্ক দূর করে দিয়েছিলেন। এই প্রথম অঙ্কে আমার আকর্ষণ জন্মেছিল। বিশেষত গণিত ও অ্যালজেব্রায়, জিওমেট্রির সঙ্গে কিছুতেই আমার সদ্ভাব হলো না। প্রব্লেমটা উমেশবাবু শুধু সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দিতেন না, আমার মনে হতো প্রত্যেকটা একটা চ্যালেঞ্জ, তার পরাজয় আমার হাতে হতেই হবে। তিন মাসের মধ্যে অঙ্কে চতুর হয়ে উঠলাম। দশম ক্লাসের প্রথম দ্বৈমাসিক পরীক্ষায় চুয়াত্তর নম্বর পেয়ে সবাইকে বিস্মিত চকিত করে দিলাম। হেডমাস্টার মশাই তখন স্কুল থেকে চলে গেছেন। তাঁর ঠিকানা আমার কাছে ছিল, তাঁকে লিখে জানালাম আমি তাঁর আদেশ পালন করেছি। চিঠির জবাব না পেয়ে ক্ষুণ্ন হয়েছিলাম বৈকি। আমার চৌদ্দ বছরের পাকা মন অবশ্য বুঝতে পেরেছিল ভদ্রলোক নতুন চাকরিতে মনোনিবেশ করতে গিয়ে পেছনে ফেলে আসা একটি ছাত্রের চিঠির জবাব দিতে না পারলে আমার দুঃখ পাওয়া উচিত নয়। পিতৃদেবকে আমি অঙ্কে উন্নতির কথা জানাইনি। মাকেও বলে দিয়েছিলাম না লিখতে। যদি সত্যিই অঙ্কের সঙ্গে লড়াইয়ে জয়লাভ করতে পারি ম্যাট্রিক পরীক্ষায়, তখন তিনি জানতে পারবেন।

উমেশবাবুর স্থানটা রয়ে গেছে আমার জীবনে অন্য কারণে, অঙ্কের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। উমেশবাবু ছিলেন বৈষ্ণব সাহিত্যে ও ধর্মে দীক্ষিত পণ্ডিত। বৈষ্ণব পদাবলী ছিল নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে বিজড়িত। মিনিট চল্লিশ অঙ্ক শেখানোর পর তিনি চলে যেতেন তাঁর স্বক্ষেত্রে। আমার চৌদ্দ বছরের মন তাঁর সঙ্গে চলে যেত এক অনাস্বাদিত অভূতপূর্ব জগতে, যেখানে কৃষ্ণ আর রাধার প্রেম ছাড়া আর কিছু নেই। উমেশবাবু আমাকে বুঝিয়েছিলেন রাধাকৃষ্ণের প্রেম পবিত্র, বৈষ্ণব কবিগণ যতই বিরহ মিলনকে দেহ বিলাসের মাধুর্যে রসালমুকুলমধু করে থাকুন না কেন। তাঁরা আসলে ছিলেন দেহাতীত, ইন্দ্রিয়াতীত প্রেমের সাধক। তাঁদের কাব্যের চিরন্তন ব্যঞ্জনা, ধ্বনি ও ভাষা, যা যুগ যুগ পরেও বহু মানুষের মন উথাল-পাতাল করছে, ছিল দেহ থেকে দেহাতীয় প্রেমের ভাষা, প্রকৃতিকে প্রেমে আপুত, প্লাবিত করে সৃষ্টি করেছিলেন তাঁরা প্রকৃতি-অতীত জীবন-সংগীত। রাধা কৃষ্ণ তাঁদের আশুদূতী, রাধার সখীগণ। তাঁদের মান-অভিমান, বিরহের তপ্ত দাহন তাঁদের অভিসার, মিলনের তপ্ত পরিপূর্ণতা, এ সব অভিব্যক্তির সঙ্গে, উমেশবাবু বলতেন, বিভিন্ন সংগীতের তালে, রমনের মাধুর্যে মিশে যেত যমুনার জল ও তটভূমি, আকাশ, বনরাজি, পথ, জনপদ। এক কথার সম্পূর্ণ প্রকৃতি-পৃথিবী-পুরুষ নারীর অপূর্ব মিলন গাঁথা বৈষ্ণব কবিতা।

উমেশবাবু চণ্ডীদাসের একটি কবিতা প্রায়ই সুর দিয়ে আবৃত্তি করতেন, যেখানে কৃষ্ণ রাধার দেহের স্তরে স্তরে শুধু ফুলশোভা দেখতে পাচ্ছিল। বলতেন, পৃথিবীর আর কোনো সাহিত্যে সম্ভবত প্রকৃতি ও প্রেমিকাকে এমন রস সৌন্দর্যে শোভিত করেনি। গানটি আজও আমার কানে বাজে :

তমলে কুসুম চিকুর গণে।
নীল কুরুবক তোর নয়নে ॥
সুপট নামা তিলফুলে
দেখি তোর গন্তযুগ মহুলে ॥
অধর সুরঙ্গ বন্ধেলী ফুলে।
কণ্ন যুগ তোর ও বলহুলে ॥
মুকুলিত খুন্দ তোর দশনে।
খস্তুরী কুসুম তোর মোনে ॥
ভুজযুগ হেম যুথিকা মালে।
অশোকবক বরযুগলে।

উমেশবাবু কবিতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাধাকৃষ্ণ রোমাঞ্চে অধীর হয়ে উঠতেন। বিহারে, বঙ্গে এত যে ফুল আছে তাই বা চণ্ডীদাস জানলেন কী করে? রাধার কেশ কলাপে তমাল ফুল, নয়নে নীল কুরুবক, তীক্ষ্ণ পুষ্ট নাসায় তিলফুল, দুই গালে মহুয়া, সুরক অধরে বান্তলী পুষ্প, দুই কানে বকফুল। রাধার গণ্ডকৌমুদি মুকুলিত কুন্দ, বসনে আন্তরী পুষ্প, বাহুযুগল অলঙ্কৃত। করযুগলে অশোকগুচ্ছ। রাধার স্তন মুকুলিত থলকমল, আতরী ফুলের মতো রোমরাজি, গভীর নাভিতে নাগকেশর জঙ্ঘায় স্বর্ণকতকী। রাধার চরণকমল স্থলপদ্ম, আঙ্গুলিগুলো চাঁপা কলি, সারা তনু শিরীষ কুসুম। শরীরের কান্তি কনকচম্পক ফুলের পঙ্ক্তির মতো, নবমল্লিকা ফুটে রয়েছে ঈষৎ মধুর হাস্যে, তার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। রাধা, আমি তোমার কুসুমিত দেহ দেখছি। চণ্ডীদাস বাসলী বরে গগান গাইলেন।

উমেশবাবুর বিপুল দেহ, প্রকাণ্ড উদর, বিশাল বদন, ঘনগম্ভীর কণ্ঠে বৈষ্ণব পদাবলী আবৃত্তি ও গান করে যেত। আমার চৌদ্দ বছরের নবীন শরীরে নানা বর্ণের রেখাঙ্ক বদলে যেত, আমি ভেসে যেতাম কোনো এক শেষহীন প্রেমের প্লাবনে। চৈতন্যদেবের যুগ আরম্ভ হবার আগেই চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গুণরাজ বৈষ্ণব পদাবলীর জোয়ার ডেকে আনেন। তারপর চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ও তাঁর পরের প্রায় দুইশত কবি এই প্লাবনকে যুগের পর যুগ অব্যাহত রেখেছেন। এ বার্তা উমেশবাবু আমাকে প্রথমে দিয়েছিলেন। কীর্তন আমার প্রধান সংগীত ছিল, আমি নিমাই সন্ন্যাস পালা গাইতাম। তাই এত সহজে ভেসে যেতে পেরেছিলাম উমেশবাবুর সহজীয়া সংগীতের প্লাবিত ধারার সঙ্গে। মেঘচিহ্ন আষাঢ় শ্রাবণে বাঁশির শোকে আমার চোখেও জল নেমে আসত। আমিও অহর্নিশি—

যোগ যে আই,
মন পবন গগনে রহাই,
আমার চোখের সামনেও ‘যমুনার কূলে,
ব্রজের নন্দন, হরিল আমার মন,
ত্রিভঙ্গ দাঁড়ানো তরুমূলে।

রাধার লজ্জা আমাকেও শিহরিত করে তুলত— “কুচ নখ লাগত সখি জন দেখ। বইস নুকানত গিরি সখিরেন।” জ্ঞানদাসের দুটি লাইন উমেশবাবু বিশেষ আবেগের সঙ্গে গাইতেন : “যত যত পিরিতি করয়ো পিয়া মোরে, আখেরেতে লেখা আছে হিয়রে মাঝারে।” বলতেন, বৈষ্ণব ধর্মের এই হলো মর্মকথা, তুমি যতটুকু প্রেম দিচ্ছ আমাকে, সবটুকু আমার অন্তরে চিহ্নিত, স্বাক্ষরিত হয়ে রয়েছে। প্ৰেম বিস্মৃতির নয়, স্মৃতির, সুন্দরের। যদি কারুর মনে চিহ্ন রাখতে চাও তাকে ভালোবাস, ভালোবাসার স্বাক্ষর কোনোদিনও মুছে যায় না।

উমেশবাবু থাকতেন ডিঙ্গামানিক গ্রামের এক বাড়ির অংশ ভাড়া করে। আমাদের বাড়ি থেকে চার মাইল পথ। গ্রাম ছাড়িয়ে এক প্রকাণ্ড জনশূন্য মাঠ, তার মাঝখানে এক বিরাট বৃদ্ধ বটগাছ। লোকে বলত বটবৃক্ষে ভূতেরা বাস করে। রাত্রিতে চলাচল করে নির্জন অন্ধকার মাঠে। আমি বেশ বেলা থাকতেই উমেশবাবুর কাছে হাজির হতাম, কিন্তু বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ানোর সময় আকাশ জুড়ে অন্ধকার। আঁধার নেমে এসেছে গাছে, বনে, মাঠে, খালে। আঁধারের বুকে দূরে দূরে এক একটি গৃহে জ্বলছে কেরোসিনের লণ্ঠন, অথবা ‘কুপি’। মাঠের কাছাকাছি হতেই ভয়ে শরীরে রোম দাঁড়িয়ে উঠত। বৈষ্ণব কবিদের রাধাকৃষ্ণ প্রেমকথা মন থেকে একেবারে পলাতক। আমি বড় বড় পা ফেলে, ঊর্ধ্বতম গলায় যা কিছু গানের লাইন মনে পড়ত তাই গাইতাম, সবটাই কৃষ্ণ বা হরির গান, যা শুনলে ভূতেরা পালিয়ে যায়। নিমাই সন্ন্যাস, নৌকাবিলাস, মাথুর, যে কোনো পালাকীর্তনের যা মনে আসত তাই চেঁচিয়ে গাইতাম— “উঠ উঠ গোরাচাঁদ নিশি পোহাইল, নদীয়ার সব লোক জাগিয়া উঠিল”— অথবা “কেমন করে এমন ছেলে মা হয়ে বিদায় দিয়েছে,” অথবা “সুর ধনী তীরে নব ভাণ্ডারী তলে, বসিয়াছে গোরাচাঁদ নিজগণ মেলে”… মাঠ পেরিয়ে গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়লে আমার কণ্ঠ নীরব হতো, তখনও বুকের কাঁপন কানে আসত, ভয় চলত সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার মতো, একেবারে বাড়ি পৌঁছে মা’র কাছে দাঁড়ানো পর্যন্ত। মাকে কিন্তু একদিনও বলিনি মাঠ পেরোতে ভীষণ ভয়ের কথা। বরং গ্রামের লোকেদের মুখে শুনেছি সন্ধেবেলা দুর্জয় সিংহের ছেলেটা সুন্দর কীর্তন গেয়ে রোজ ডিঙ্গামানিক থেকে গণেশপুরে ফেরে, মাস্টার মশাইয়ের কাছে পড়া শেষ করে।

আমি বৈষ্ণব ধর্মে আকৃষ্ট হইনি, সারাজীবন ধর্ম থেকে দূরে থেকেছি, কোনো গুরু নেই আমার, ধর্মীয় দীক্ষা নিই নি আমি, মন্দিরে পূজা দিতে আমি যাইনে। কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলী আমার পরিণত কিশোর মনে গভীর স্বাক্ষর খোদাই করে দিয়েছিল। করেছিল আমাকে রোমান্টিক ও নারীপ্রবণ। ভানুসিংহের পদাবলীর বৈষ্ণবতা আমার কানে ও মনে ধরা পড়েছিল সেই সময়েই। আমি বুঝতে পেরেছিলাম বৈষ্ণব ধর্ম না হজম করতে পারলে বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করা সম্ভব নয়। পরিণত জীবনে আমি বেদ-উপনিষদ-গীতা থেকে হিন্দু দর্শনের উদার আত্মপ্রশ্ন কুড়িয়ে নিতে পেরেছিলাম, আমার সীমিত ক্ষমতার মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসাকে যতটুকু সম্ভব ধারালো করার জন্যে। যে সাধারণ অর্থে হিন্দুধর্ম কথাটি ব্যবহার হয় তা কখনো আমাকে আকর্ষণ করেনি। দুর্জয় সিংহ কালীপূজক ছিলেন। আমার মনের গভীরে ‘দুর্গা’ আদ্য অক্ষরের আসন দখল করে রেখেছে, দিনের প্রথমে ও শেষে স্বতঃউচ্চারিত ঐ নাম আমার অজ্ঞাতে একটা শক্তি ও আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। দুঃখ থেকে আনন্দ, বিপদ থেকে সান্ত্বনা, বিয়োগের উত্তীর্ণ মিলন, হারানোর মধ্যে প্রাপ্তি, সর্বোপরি মানুষ সম্বন্ধে অমর আশাবাদ, বলিষ্ঠ ভবিষ্যৎ দৃষ্টি। এর সঙ্গে কৈশোরের বৈষ্ণব পদাবলীর কোনো যোগাযোগ নিশ্চয়ই নেই। উমেশবাবু আমাকে যে মৌল ও মূল শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন, নিজে না জেনে, না অনুমান করে, তা হলো : ভালোবাসা।

আমি তাঁর কাছে সেই কৈশোরে শিখেছিলাম, ভালোবাসা ও প্রেমের চেয়ে সুন্দর জীবনে নেই কিছুই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *