পিতা পুত্রকে – ১২

বারো

“হে জীবন, স্বাগতম! লক্ষ লক্ষ মানুষের মতো আমিও চলেছি অস্তিত্বের বাস্তব পাহাড়, মরু, উপত্যকা, সমতলের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়ে। আমার আত্মার যাত্রাপালায় এবার আমাকে নিজের হাতে মানুষের উপযুক্ত বিবেক তৈরি করে নিতে হবে। হে বৃদ্ধ পিতা, হে প্রাচীন কারিগর, এখন এবং সর্বদা আমাকে সাহায্য কর।”

এই প্রার্থনা নিয়ে জেমস জয়েস তাঁর প্রথম উপন্যাস রচনা করেছিলেন— “শিল্পীর প্রতিকৃতি জনৈক যুবক”—“এ পোর্ট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়ং ম্যান”।

১৯৩৭ সালের তপ্ত গ্রীষ্মে সদ্য ম্যাট্রিক পাস করা পনেরো বছরের যে তরুণ গণেশপুর গ্রামের পদ্মাতট থেকে ডুগি নৌকায় চাঁদপুর রওয়ানা হয়েছিল গ্রাম জীবনের সুরক্ষিত মন্দগতি জীবন থেকে বিদায় নিয়ে কলকাতার মতো অচেনা অজানা এক মহাদানব শহরের উদ্বেলিত কোলাহলের মধ্যে বেঁচে থাকার পাথেয় সংগ্রহের উদ্দেশ্যে, তার মুখে ঐরকম কোনো বিপুল প্রার্থনা নীরবে উচ্চারিত হতে পারেনি। মা নদীতটে এসে বিদায়কালে আশীর্বাদ জানাতে না পারলেও তাঁর জলভরা চোখ ও হাসিভরা মুখ ছেলেটির বুকে নদীর তরঙ্গের মতোই উচ্ছ্বলিত হচ্ছিল। পদ্মাতটে বিদায় দিতে সমবেত হয়েছিলেন আমার স্বজন ছাড়া জেলে পাড়ার প্রজাদের কয়েকজন। গ্রামের অধ্যয়ন শেষ হলো, সে চলল এবার কলকাতায়, যেখানে দানব ও মানুষের সংঘাতী সহবাস। সেখানকার অজানা যন্ত্রে তৈরি হয় : হাজার হাজার গ্রামছাড়া মধ্যবিত্ত কিশোরের ভবিষ্যৎ। কলকাতা আমার কাছে অনেক কিছুর জটপাকানো অবাস্তব একটা প্রতিমূর্তি মাত্র। তার সামনে মানস চোখে দাঁড়াতে পর্যন্ত আমার হৃদয় ভীতকম্পিত। অথচ তার টানে আমাকে চলতেই হবে নৌকো, স্টিমার, রেল চেপে যতক্ষণ না তার অন্ধকার গহ্বরে ঢুকে পড়েছি আলোর সন্ধানে। যেটুকু আলো, যতটুকু আলো, ছিনিয়ে নেওয়া যায় সময়ের কৃপণ হাত থেকে।

নৌকা ছাড়ল। তখনকার দিনে বাই-বাই করে বিদায় দেবার কায়দা ছিল না। আমি আমার ভাই-বোন, আত্মীয়দের ওপর নজর রেখেও দেখতে পাচ্ছিলাম বাড়ির বাইরের ও ভেতরের পুকুর দুটোকে। জামরুল গাছ, সারি সারি নারকেল ও সুপুরি গাছ, মানুষের পায়ে হাঁটা সরু সরু গ্রাম্য পথ, হাসনাহেনা ভরতি সাদা ফুলের স্তবক, যার সৌরভে ভরে গেছে পুরো বাড়ির বাতাস। আমার পড়বার ভাঙা টেবিলের ওপর দেওয়ালের গা বেয়ে সুর সুর করে এগিয়ে যাওয়া মাকড়সা গাছ ছেয়ে গেছে বকুল ফুলে। দুর্গা মণ্ডপের দক্ষিণে এবং বাড়ির ভেতরের উঠোনের দক্ষিণ কোণে বিছানা পেতে রেখেছে ঝরা শেফালি।

বড় বড় আম-কাঁঠাল-সেগুন গাছের সারি সরে গেল আমার চোখের সামনে পদ্মাতীরে। নদীর বুকে আরও কিছু নৌকা, জেলেরা জাল পেতে বসে আছে জোয়ারের অপেক্ষায়। আকাশ জুড়ে হালকা মেঘের খেলা। নদীর ঢেউ, আকাশ আমাকে নিয়ে যাচ্ছে পুরাতন থেকে নতুনে। কিন্তু আমার মনে কোনো প্রভাত পাখি গাইছে না। শুনতে পাচ্ছি সন্ধেবেলা নীড়ে ফেরা পাখির গান। সারি সারি বক আকাশ সাঁতরে ঘরে ফিরছে। নিশ্চয়ই আমার গণেশপুরের বক এরা, এদের সঙ্গ ধরে আমারও ইচ্ছে করছে ফিরে যাই ঘরে, মা, ভাইবোনদের নিশ্চিত পরিচিত সান্নিধ্যে। একই সঙ্গে মনের তারে ঝঙ্কৃত হচ্ছে মার মুখে পুনঃ পুনরক্ত রবীন্দ্রনাথের কবিতা : “যাব না পশ্চাতে মোরা, মানিব না বন্ধন ক্রন্দন, হেরিব না দিক— গণিব না দিনক্ষণ”— তৎক্ষণাৎ আমি বুঝতে পেরেছি, ভারত পথিক আমি নই। আমার দৃষ্টি ধাবিত অগ্রে ও পশ্চাতে, বন্ধন ক্রন্দন হয়ে আমার গলা চেপে ধরেছে, আমি এগোতে এগোতে যেন পিছে পড়ে যাচ্ছি, আমার পনেরো বছরের জীবন কিছুতেই অতীত হতে রাজি নয়। গণেশপুর, যার মাটিতে আমি জন্মেছি, কিছুতেই হতে চাইছে না ইতিহাস।

আমার যাত্রা নৌকা চেপে চাঁদপুর, বারো ঘণ্টার নদীপথ। চাঁদপুরে স্টিমার বন্দরে জাহাজ চেপে খুলনা। খুলনায় পিতৃদেব দুর্জয় সিংহের সঙ্গে তিন-চার দিন বাস করে ট্রেনে চেপে শিয়ালদহ, অর্থাৎ কলকাতা। জীবনে এই আমার প্রথম একলা যাত্রা নয়। ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেবার জন্য সুরেশ্বর থেকে একাই আমি মাদারীপুর গিয়েছিলাম। তথাপি এবারের একক যাত্রায় আমার নিজেকে ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হলো। ডুগি নৌকায় আরও পাঁচজন যাত্রী সংগ্রহ করেছিল মাঝির। যারা সবাই গ্রামীণ মধ্যবয়সী পুরুষ, তাদের সঙ্গে আমার একটাও বাক্যালাপ হলো না। আমি খোলা আকাশের নিচে মাঝির কাছাকাছি আমার বিছানার ওপর ভর দিয়ে বসে রইলাম। আসার সময় একটা ছোট নতুন মাটির হাঁড়িতে মা খিচুড়ি দিয়ে দিয়েছিল, তাই দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজন হলো। হাঁড়ির মধ্যে একটা বোতলে জল ছিল, তাই খেয়ে পরিতৃপ্ত হলাম। নদীর তটভূমির কাছাকাছি চলছে নৌকো। কয়েকবার দ্বিতীয় মাঝি তীরে নেমে গিয়ে ‘গুণ’ টানল, অর্থাৎ নদীর সঙ্গে বাঁধা কঠিন দড়ি টানতে টানতে এগিয়ে গেল। দার্জিলিং বা সিমলার পথে ছোট পাহাড়ি রেলগাড়িকে যেমন একসঙ্গে সামনে ও পেছন থেকে ইঞ্জিনের জোরে এগোতে হয়। নদী থেকে তীরে চলমান গাছ লতা গুল্ম। আকাশের সঙ্গে সঙ্গে চলমান একের পর এক গ্ৰাম। কয়েকটি গ্রামে নৌকা থামল। মাঝিরা একটু বিশ্রাম করল। আহার সারল। পুরোনো যাত্রীরা তীরে নেমে গাছের আড়ালে প্রস্রাব করল। কাছাকাছি দোকান থেকে চিঁড়ে গুড় কিনে এনে নৌকায় বসে দুপুরের আহার সারল। দু-একজন নতুন যাত্রী উঠল নৌকাতে। এরাও যাবে চাঁদপুর।

চাঁদপুর জিলা শহর। এখানে রেল লাইন আছে। ‘জাহাজে’র বন্দর আছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঁদপুরকে প্রাধান্য দিয়েছে। গণেশপুর গ্রাম যে জিলার অন্তর্গত তার নাম ফরিদপুর। গণেশপুর থেকে অনেক দূর। গণেশপুরের সঙ্গে কাচারি আদালতের সম্পর্ক মাদারীপুর মহকুমা শহরের। সুরেশ্বর গ্রাম থেকে স্টিমারে চেপে আর এক মহকুমা শহর গোয়ালন্দে পৌঁছে, সেখান থেকে দশ বারো ঘণ্টার ট্রেন যাত্রার পর শিয়ালদহ, অর্থাৎ কলকাতা। তার মানে গণেশপুরের সঙ্গে জিলা ফরিদপুরের যোগাযোগ ছিল না বললেই হয়। আমি কোনোদিন দেখিনি গ্রামের কোনো লোক ফরিদপুর যাচ্ছে অথবা ফরিদপুর থেকে এসেছে। এর ব্যতিক্রম ঘটল একবার। গণেশপুরের ছাত্র-যুবকদের ‘বিচারে’ মহকুমা শাসক যে রায় দিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধে আপিল করতে হলো ফরিদপুর জিলা শহরে সেসস আদালতে। ফরিদপুর নামটা গণেশপুরের মানুষদের মনে দাগ কাটল।

গোয়ালন্দে পদ্মার নাম কীর্তিনাশা। রাজবাড়ি গ্রামের রাজাদের প্রাসাদই শুধু নয়, কয়েকটা পাশাপাশি গ্রামকে গিলে নিয়েছে কীর্তিনাশা। স্টিমার থেকে রাজবাড়ির রাজপ্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ আমরা ভয় ও বিস্ময়ের চোখে দেখতাম। বর্ষায় এখানে পদ্মার কূল চোখে পড়ল না। সুবিস্তীর্ণ সমুদ্র সমান নদী। উত্তাল উন্মত্ত তার তরঙ্গ। বর্ষাকালে নদীতে ঝড় উঠলে বড় বড় স্টিমার কখনো কখনো জলের অতলে তলিয়ে যায়।

চাঁদপুরে যে বন্দরে আমাদের নৌকা এসে নোঙর ফেলল তার নাম মেঘনা। মেঘনা নদীর নাম আমরা ভূগোলে পড়েছিলাম। চোখে দেখলাম এই প্রথম। পদ্মা যেমন উচ্ছ্বল উদ্বেলিত, মেঘনা তেমনি শান্ত। পদ্মার জল হলদেটে সাদা। মেঘনার জল ঘন কৃষ্ণবর্ণ। যেন সবসময় আকাশজোড়া মেঘের ছায়া বুকে ধরে চলেছে মেঘনা ধীর গতিতে, স্থির মনে।

মাঝি আমাকে নির্দেশ দিয়ে দিল বন্দরে কোথায় দাঁড়াতে হবে। স্টিমার আসতে এখনও দু ঘণ্টা দেরি, কোথায় কোন গবাক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হবে, এবং ক্ষিদে পেলে কোন্ রেস্তোরাঁয় মাছ—ভাত পাওয়া যাবে।

স্টিমারটা বেশ বড়সড়। যে জাহাজটা করে মাদারীপুর গিয়েছিলাম তার তুলনায় সত্যিকারের জাহাজই মনে হলো আমার। আরও অনেক যাত্রীর সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে কেবিন ঘরগুলোর কাছাকাছি ডেকের ওপর আমি বিছানা পেতে নিলাম। কেবিনের যাত্রীরা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির। প্রথম শ্রেণির কেবিন দোতলায়, লোহার জাল দিয়ে ঘেরা অনেকখানি জায়গা নিয়ে। কেবিন কতগুলো আমি জানতে পারিনি, তবে দেখলাম তাদের বাইরে বেশ বড় একটা লাউঞ্জ তৈরি করেছে, ফুলের, সবুজ গাছের টব দিয়ে সুসজ্জিত। কয়েকটি টেবিলের ওপর সিগারেটের কেস, এক একটিতে ফুলসহ ফুলদানি, পাটের কার্পেট দিয়ে মেঝে আবৃত।

দ্বিতীয় শ্রেণির কেবিনগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট। লাউঞ্জে বেতের চেয়ার টেবিল, মেঝেয় সতরঞ্চি।

জাহাজের বাকি সবটাই ডেকযাত্রী ও কর্মচারীদের জন্যে।

দোতলা থেকে সরু লোহার সিঁড়ি বেয়ে তেতলা অর্থাৎ ছাতে উঠলে সারেঙ সাহেবের ঘর। সারেঙ মানে জাহাজের ক্যাপ্টেন। নৌ—সেনাদের মতো ধবধবে ফর্সা না হলেও সাদা পোশাক তার। মাথায় কালো ফিতে দিয়ে ঘেরা সাদা টুপি। হাতে একটি ছোট্ট বেতের লাঠি—ক্যাপ্টেনের বেটন। সারেঙের ঘরে বড় কম্পাস, দেওয়ালে যাত্রা পথের নকশা, অনেক দেব-দেবতার ছবি, কয়েকটি স্ত্রীলোক ও পুরুষেরও। আমি অনুমান করে নিলাম সিনেমার অভিনেত্রী অভিনেতাদের। যদিও তখনও সিনেমা আমার দেখা হয়নি। কম্পাসের বুকে ঝোলানো রয়েছে মা কালীর ছোট ছবি। সারেঙ এই ছবির মাধ্যমে দেবীর আশীর্বাদ নিয়ে নদী পাড়ি দেয়, ঝড় উঠলে শরণ নেয় দেবীর চরণে।

জাহাজ নোঙর তোলার আগে সারেঙ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে গেল। একটি প্রথম শ্রেণির কেবিনের গায়ে বিছানা পেতে মোটা লোহার বেড়ার ওপর শরীর রেখে আমি নদী দেখছিলাম। সারেঙ এসময় এসে আমার পাশে দাঁড়াল, আমি সসম্ভ্রমে সেলাম দিলাম।

আমার বিছানার ওপর নজর রেখে সারেঙ প্রশ্ন করল, “এটা আপনার?”

প্রশ্ন করল ইংরেজিতে, আমি হকচকিয়ে গেলাম।

জবাব দিলাম, “ইয়েস স্যার।”

সারেঙ আমার নাম জানতে চাইল। আমি বললাম।

এবার সারেঙ বঙ্গভাষা ব্যবহার করতে লাগল, “কোথায় যাবেন?”

“খুলনা।”

“কলেজে পড়তে?”

“আপনি কী করে বুঝলে আমি কলেজে পড়তে যাচ্ছি!” আমার কৌতূহলে সারেঙ হেসে ফেলল।

“প্রতিদিন শত শত যাত্রীদের মুখ দেখি, চেহারা দেখি, এখন আন্দাজ করতে পারি কে কোন শ্রেণির মানুষ। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি স্কুল পাস করেছেন, তাই কলেজে পড়তে যাওয়াটা স্বাভাবিক।”

“আপনার দৃষ্টি খুব গভীর। সব সময় নদীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত দৃষ্টি রেখে জাহাজ চালাতে হয় আপনাকে।”

“নদীর ওপর নজর রাখাই শুধু নয়, যাত্রীদের উপরও নজর রাখতে হয়। ওপরে আসবেন আমার ঘরে, কী করে জাহাজ চালাতে হয় দেখতে পাবেন।”

অতি উৎসাহের সঙ্গে বললাম, “নিশ্চয়ই যাব।”

“কোথা থেকে আসছেন?”

“গণেশপুর থেকে।”

“আপনাদের গ্রামের জমিদার বাড়ির চারজন যাত্রী যাচ্ছেন ফার্স্ট ক্লাসে। ঐ যে বজরা দেখছেন, ওতে করে এঁরা চাঁদপুর এসেছেন।”

“জমিদার বাড়ির কাউকে আমি চিনি না।”

“চেনবার কথাও নয়, ওঁরা নিজেদের খুব মাতব্বর মনে করেন। বলেন, ওঁদের দেহে খাঁটি আরব রক্ত। বাংলা বলেন না, বলেন উর্দু।”

“আমাদের স্কুলের বার্ষিক সভায় সভাপতিত্ব করেন জমিদার বাড়ির একজন। চোখ ট্যারা, দাড়ি বেশি লম্বা নয়, ভীষণ মোটা। তাঁর নাম জানা নেই আমার। বক্তৃতা করেন ইংরেজিতে।”

“এঁরা যাচ্ছেন খুলনা হয়ে কলকাতায়।”

“আমিও তাই।”

“তাহলে খুলনায় আপনি পড়ছেন না। আছে কেউ ওখানে? না-কি জাহাজ বন্দর থেকে সোজাসুজি রেলস্টেশনে চলে যেতে হবে আপনাকে?”

“আমার বাবা খুলনায় বাস করেন। তাঁর কাছে তিন-চার দিন থেকে কলকাতায় যাব।”

“এঁরা কেন যাচ্ছেন জানেন?” সারেঙ প্রশ্ন করল প্রথম শ্রেণির কেবিনের ওপর নজর রেখে।

“কেন?”

“আপনি দেখছি দেশের কোনো খবরই রাখেন না। এটা ১৯৩৭ সাল। নির্বাচন হয়ে গেছে প্রত্যেক প্রদেশে। বঙ্গদেশেও। এঁরা মুসলিম লীগের নেতা। কলকাতায় পার্টিদের মধ্যে আলোচনা হবে মুসলিম লীগের রাজনীতি। প্রধান দল তো কংগ্রেস।”

“আপনি কি মুসলমান?”

“না, আমি হিন্দু। মাখনলাল সরকার আমার নাম। চট্টগ্রামে আমার বাড়ি।”

সারেঙদের অধিকাংশই মুসলমান। জাহাজে যারা কাজ করে, তারাও মুসলমান। চট্টগ্রাম নোয়াখালীর মানুষ। কিছু আসে ওড়িয়া থেকে।”

“আর একজন নেতাও এই জাহাজে যাচ্ছেন। প্রথম শ্রেণিতে। কিন্তু গণেশপুরের জমিদারদের তিনি শত্রু।”

“কী নাম তার?”

“ফজলুল হক। শুনেছেন নামটা?”

“শুনেছি, উনি তো মুসলিম লীগের নন!”

“মোটেই নন। উনি কৃষক প্রজা পার্টির। জবরদস্ত নেতা। চাঁদপুর এসেছিলেন সভা করতে। নোঙর তোলার আগে এঁরা চারজন জাহাজে উঠবেন। এখন বন্দরে আমাদের আপিসের গেস্টরুমে অপেক্ষা করছেন ফজলুল হক। গণেশপুরের জমিদাররা বজরাতেই থাকবেন। নোঙর তোলার আগে আমাদের লোক তাঁদের নিয়ে আসবেন জাহাজে।”

সারেঙ তার পরিদর্শনের কাজে চলে গেল। একজন অনেকজান্তা লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পেরে আমারও খুব ভালো লাগল। আমিও আমার নিজের জাহাজ পরিদর্শনে লেগে গেলাম। দোতলা থেকেই দেখতে পাওয়া যায় জাহাজের পাওয়ার হাউস, একটা বিরাট গহ্বরে প্রচণ্ড চাকাগুলো ঘুরতে থাকে। নদীর জল কেটে ইঞ্জিন জাহাজকে এগিয়ে নেয় গন্তব্যের দিকে। দোতলা ডেকের ভাড়া একটু বেশি। বেশিরভাগ যাত্রীই হয় মধ্যবিত্ত ভদ্র পরিবারের লোক, নয়তো শিক্ষিত গ্রামীণ ব্যবসাদার। প্রত্যেক যাত্রী ও যাত্রীযূথ নিজেদের বিছানা পেতে নিয়েছে, কোণে সরিয়ে রেখেছে আহার্য। অনেকে নদী দেখছে, অনেকে পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তায় ব্যস্ত কেউ কেউ চুপচাপ বসে রয়েছে। বাচ্চা ছেলেমেয়েরা করছে ছুটোছুটি। বাতাস বইছে, নরম স্নেহময় বাতাস, পূর্ববঙ্গের গ্রীষ্মকে যে বাতাস সহনীয় করে রাখে। পেট্রোল, কেরোসিন, মাছ, শাকসবজি, এখানে ওখানে কোণে কোণে জমানো জঞ্জাল, পচা ইঁদুর, একরাশি ছাগল—সবকিছুর মেশানো বিচিত্র গন্ধ বাতাস বহন করছে। জাহাজকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখবার নিয়ম যদি বা থাকে, গরজ নেই কারুরই। মেঝের উপর আরশোলা, ইঁদুর, শুঁয়োপোকা দিব্যি বিচরণ করছে। এরা সব সময়ের যাত্রী। নদীপথ চলাতেই এদের আনন্দ। এই চাঁদপুরের চরাচরে গ্রীষ্মের তীব্রতা মানুষ উপেক্ষা করে। শব্দহীন উদার স্তব্ধতার দিনও এখানে অনুপস্থিত। এখানে তৃণে, বৃক্ষে, কুটিরে, জনপদে, নদীর বুকে এবং নদীতটে জীবনের প্রথম কল্লোল কলরব আমি শুনতে পেলাম।

নিচের ডেকে নেমে এসে দেখলাম গ্রামের কতকিছু সম্পদ চলে যাচ্ছে শহরে—বস্তা বস্তা চাল, সবজি, মসলা, পাটের কাপড়ে জড়ানো ঝুরি ঝুরি মাছ। একপাল ছাগল, শতশত মুরগি, বস্তা বস্তা আম। তখনও নদীপথেই দেশের পণ্যদ্রব্য রপ্তানি হতো গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে গ্রামে। রেল লাইনের প্রসারতা তখনও সংক্ষিপ্ত। মালগাড়ি চলত কচ্ছপগতিতে। কিন্তু গ্রামের মানুষ তার মাটির, জলের ও গৃহশিল্পের উৎপন্ন শহরে চালান না করলে উপবাসী থাকতে বাধ্য। গণেশপুরের তিনটি জেলেকেও দেখতে পেলাম একতলার ডেকে। এরা ইলিশ মাছ চাঁদপুরের পাইকারি খদ্দেরদের কাছে না বেচে খুলনা পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে ভালো দামের আশায়। খুলনায় বাবার কাছে ক’দিন কাটিয়ে কলেজে পড়তে যাচ্ছি কলকাতায়। শুনে তারা গর্বিত, উচ্ছ্বসিত। গ্রামের মানুষের হৃদয় নদীর মতোই উচ্ছল।

তীরে একসময় কিছুটা উত্তেজনা দেখা গেল। জমিদারদের বজরা জাহাজের সঙ্গে লেগেছে। বিশেষ পাটাতন পড়েছে জাহাজ ও বজরার মধ্যে। তার উপর দিয়ে পর পর চারজন পুরুষ চলে এলেন স্টিমারে। জাহাজ কোম্পানির মালিক ও সারেঙ তাঁদের অভ্যর্থনা করে ওপরে প্রথম শ্রেণির কেবিনে নিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দুজন দেহরক্ষী, তাদের হাতে বড় বড় দুটো ব্যাগ, নিশ্চয়ই খাদ্যে-আহার্যে ভরা। তিনটে কুলি ছ’টা কাঠের ট্রাঙ্ক মাথায় বয়ে নিয়ে এল। প্রত্যেকের হাতে এক একটা বড় চামড়ার ব্যাগ।

গণেশপুর জমিদারদের দেহের বর্ণ, আমার চোখে, সাহেবদের মতো ফর্সা, প্রত্যেকের শরীর বিপুল। কটা চোখ, পরনে আচকান ও চুড়িদার পাজামা, মাথায় টুপি।

কয়েক মিনিট পরে আর একজন মুসলমান, কিছু মুসলমান ও কতিপয় হিন্দু দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে জাহাজের দিকে এগিয়ে এলেন। আমি অনুমান করলাম ইনি ফজলুল হক। সাধারণ বাঙালির তুলনায় দীর্ঘ দেহ, মেদবাহুল্যহীন, মুখে দাড়ি-গোঁফ নেই, পরনে পায়জামা ও হাঁটুর নিচে নেমে আসা আচকান। সাধারণ মুসলমানের ব্যবহৃত ইসলামি টুপি। তফাত শুধু তাঁর ফর্সা রং। ফজলুল হকের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের সুযোগ পরে আমার একবার হয়েছিল। এখন দূর ও অনেকটা কাছাকাছি দেখে মনে হলো গ্রামের কোনো বড় চাষি অথবা স্কুলের মুসলমান শিক্ষক।

ফজলুল হক বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী হবেন, অনেকে বলেছিল।

১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হয়েছিল। গণেশপুর গ্রামের সিনিয়র ছাত্র হিসেবে আমরাও অনুভব করেছিলাম। কংগ্রেস প্রথমে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রণীত গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট ঘোষণা করবার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস গান্ধীজির নেতৃত্বে তাকে পুরোপুরি বর্জন করেছিল। এই আইনের ছিল দুটো অংশ। প্রথম অংশে ভারতবর্ষকে একটা ফেডারেশন রাষ্ট্রে পুনঃগঠনের ব্যবস্থা। ফেডারেশনের প্রস্তাব কংগ্রেস ও লীগ দুইই প্রত্যাখ্যান করলে ইংরেজ সরকার প্রাদেশিক ‘গণতন্ত্ৰ’ উদ্বোধনের উদ্যোগ নিলেন। কংগ্রেস প্রথমে অনেক নেতিবাচক হুংকার দেবার পর প্রাদেশিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে রাজি হয়ে গেল।

বঙ্গদেশে কংগ্রেস বরাবরই দলীয় বিভাগে দুর্বল। নির্বাচনের সময় শরৎ বসু সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সুভাষ বসুর অস্ফুট সম্মতি নিয়ে প্রস্তাব করেছিলেন কংগ্রেস ও ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি একত্র হয়ে নির্বাচন লডুক। এই কোয়ালিশন যদি কংগ্রেস কর্তারা মঞ্জুর করতেন তাহলে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পথ অন্যরকম হতো। মুসলিম লীগ ছিল নবাবজাদা বড় জমিদারদের দল। তার নেতা মহম্মদ আলী জিন্নাহ বোম্বাইয়ের ধনী ব্যারিস্টার, যাঁর জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ বিলিতি। ফজলুল হক ছিলেন বঙ্গের চাষিসমাজের প্রকৃত প্রতিনিধি। লীগে তিনি সামিল হতে চাননি। তাঁর নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টি পূর্ববঙ্গে বলিয়ান হয়ে উঠেছিল। ফজলুল হক তৈরি ছিলেন কংগ্রেসের সঙ্গে মিলিত হয়ে নির্বাচন লড়তে এবং জয়লাভের পরে যৌথ সরকার গঠন করতে। ফজলুল হকের দলকে যদি কংগ্রেস মিত্রতার সুতোয় বাঁধতে পারত তাহলে মুসলিম লীগের গণসমর্থন প্রসারিত হতে পারত না।

শরৎ বসুর প্রস্তাব বঙ্গ কংগ্রেসের অন্যান্য উপদলীয় নেতারা একসঙ্গে প্রতিরোধ করেছিলেন। গান্ধী-নেহেরু হাই কমান্ড কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা দলের নির্বাচনি ঐক্যে অনুমতি দেননি। নির্বাচনে কংগ্রেস মাদ্রাজ, বোম্বাই, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ (তখনকার সিপিও বেরার)। বিহার ও ওড়িষ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল।

প্রাদেশিক নির্বাচনে ভোটারদের সংখ্যা অনেক বাড়ানো হয়েছিল। অনেক মহিলারাও ভোটের অধিকার পেয়েছিলেন।

বঙ্গপ্রদেশে ২৪০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৬০টি। মুসলিম লীগও সুবিধে করতে পারেনি।

গণেশপুরেও একটি ভোট কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। আমাদের স্কুলেই দশম শ্রেণির ঘরে।

সবচেয়ে সন্নিকট থানা ভেদেরগঞ্জ। গণেশপুর থেকে পাঁচ মাইল দূরে।

থানা থেকে বড় দারোগা সাহেব নিজে এসেছিলেন শান্তিপূর্ণ ভোট নিশ্চিত করতে। সঙ্গে এনেছিলেন তিনটে বন্দুকধারী পুলিশ।

মহকুমা মাদারীপুরের জুনিয়র ডেপুটি কালেক্টর নিযুক্ত হয়েছিলেন রিটার্নিং অফিসার।

আমরা দশম শ্রেণির ছাত্ররা তখনও ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিইনি। তখনও তিনমাস বাকি।

আমরা দলবেঁধে ভোট দেওয়া দেখতে গিয়েছিলাম।

খুব আবছা ছায়া আমার স্মৃতিপটে এখন ঐ বিশেষ ঘটনার। শুধু মনে আছে, ভোট দিতে আসেনি বেশি লোক। হয়তো ভোটের অধিকারই খুব কম লোকের ছিল। যারা এসেছিল তাদের বেশিরভাগ মুসলমান। তাদের আসতে হয়েছিল জমিদারদের পেয়াদাদের ভয়ে।

একজন স্ত্রীলোককেও ভোট দিতে দেখিনি আমরা।

গণেশপুর গ্রামের বর্ণহিন্দুরা ভোট দেয়নি। তারা এই নির্বাচনটাকে ইংরেজের সঙ্গে কংগ্রেস নেতাদের আপসনীতি বলে ধরে নিয়েছিল। গণেশপুরের যুবকদের সন্ত্রাসবাদের মিথ্যে মামলায় গ্রেফতার, বিচার, সাজা এবং মুক্তির কাহিনি তখনও গ্রামবাসীদের স্মৃতিতে সুস্পষ্ট।

মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে দিল্লিতে এআইসিসি-র দুদিন ব্যাপী গরম অধিবেশনের সময় আমি মাদারীপুরে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিচ্ছি।

মহকুমা শহর, তাছাড়া উপরাজনীতির শহর মাদারীপুর। দিল্লির অধিবেশন নিয়ে বহু মানুষের বিরাট ঔৎসুক্য। দুদিন ধরে যে প্রশ্নটি নিয়ে উষ্ণ উষ্ণতর তর্ক-বিতর্ক হলো তা হচ্ছে : নির্বাচন জিতেও কংগ্রেস বিভিন্ন প্রদেশে সরকার গঠন করবে কিনা।

নেহেরু, সুভাষ ও বাদবাকিদের মত : কংগ্রেস সরকার গঠন করবেন না। করার মানে হবে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপস করা। বল্লভভাই প্যাটেল প্রমুখ নরমপন্থী নেতাদের পাল্টা প্রস্তাব : কংগ্রেস সরকার তৈরি করবে। ইংরেজের সঙ্গে লড়াই করবে সরকারের মধ্যে ও বাইরে থেকে।

মহাত্মা গান্ধী ছিলেন ‘নিরপেক্ষ’। তাঁর আপস প্রস্তাব সবশেষে এআইসিসি-তে বিপুল ভোটাধিক্যে গৃহীত হয়েছিল।

একটা শর্ত কংগ্রেস সরকার আরোপ করেছিল : মন্ত্রিমণ্ডলির কাজ কর্মে গভর্নর হস্তক্ষেপ করবেন না। ব্রিটিশ সরকার ও ভাইসরয় লিনলিথগো শর্তটা মানতে রাজি হননি। কংগ্রেসও মন্ত্রী সভা গঠনে রাজি হয়নি। অবশেষে লর্ড লিনলিথগো একটা অপরিচ্ছন্ন, কূটনৈতিক, বিবৃতিতে কংগ্রেসকে ভরসা দিয়েছিলেন যে গভর্নরগণ “সাধারণত” মন্ত্রিমণ্ডলীর কাজে হস্তক্ষেপ করবেন না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে ক্ষমতার দরজা সামান্য একটু উন্মুক্ত হলো, আর সেই আংশিক উন্মুক্ত দ্বারপথ দিয়ে কংগ্রেসীরা সুর সুর করে সহযোগিতার পথে ঢুকে পড়লেন।

এসব ঘটনা নিয়ে মাদারীপুর, এমনকি গণেশপুরেও তপ্ত আলোচনা হতো। সবটা আমি বুঝতে পারতাম না। স্কুল লাইব্রেরিতে ‘স্টেটসম্যান’ আসত, তার পুরোনো সংখ্যা পড়ে নিতাম।

ফজলুল হক এরই মধ্যে আমার মতো গ্রাম্য তরুণের কাছেও বড় হয়ে উঠেছিলেন কী করে?

বড় হয়েছিলেন এ জন্যে যে তিনি সহজে মুসলিম লীগে যোগ দিতে চাননি। শরৎ বসু কংগ্রেসের হাই কমান্ডের কাছে অনুমতি চেয়েছিলেন ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে জোট বেঁধে কোয়ালিশন মন্ত্রিত্ব তৈরি করতে। তা হতে পারলে ফজলুল হক লীগকে জনসমর্থন জুগিয়ে দিতেন না। অন্তত বঙ্গদেশে লীগের প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকত।

হাই কমান্ড অনুমতি দেননি।

এইখানে বলে রাখি, উত্তরপ্রদেশে যদি কংগ্রেস মুসলিম লীগকে সরকারের শরিক করে নিত, বঙ্গপ্রদেশে যদি কংগ্রেস-কৃষক প্রজা পার্টির কোয়ালিশন মন্ত্রীত্ব হতো, তাহলে দশবছর পর ভারত হতো না বিভক্ত।

ইতিহাসের “যদি”-গুলো সর্বদা রহস্যময়।

যে ফজলুল হকের কথা অনেক শুনেছি, কিছুটা সংবাদপত্রেও পড়েছি, তাঁকে চোখের সামনে সিঁড়ি বেয়ে জাহাজের দোতলায় উঠে যেতে দেখতে পেয়ে বেশ গর্ব বোধ করেছিলাম। তিনি তখনও লীগে যোগদান করেননি। তিন-চার বছর আরও সময় দিয়েছিলেন কংগ্রেসকে। কংগ্রেস অবশ্যই সে সময়ের সুযোগ নেয়নি।

জাহাজ ছাড়তে সূর্য অস্তগামী হয়ে গেল। আকাশে বেশি মেঘ জমেনি। নদী শান্ত। অস্তরাগ ছড়িয়ে পড়েছে আকাশ জুড়ে। মেঘের ওপর মেঘে সাতরঙের অপূর্ব খেলা। সারা আকাশ হালকা আবীরে ছেয়ে গেছে। আমার মনে গুঞ্জিত হলো রবীন্দ্রনাথের ‘দিনান্ত’ কবিতার কয়েকটি লাইন। যে পঙ্ক্তিগুলো এই তিনকুড়ি-দশ বয়সেও আমার মনে ধ্বনিত হয়। জীবনকে যে কোনো মানুষ গভীর প্রেমে আলিঙ্গন করেছে, জীবনকে দিয়েছে দেহ-মন উজাড় করে, জীবন থেকে পেয়েছে আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, সৃষ্টি-বিনাশের ঐক্যতান সংগীত, তার মনে দিনান্তে এ প্রশ্ন আসবে, আসবেই :

যাবার আগে সবই যেন       আমায় ডেকেছিলে কেন
আকাশ পানে নয়ন মেলে     শ্যামল বসুমতী—
কেন নিশার নীরবতা          শুনিয়েছিল তারার কথা—
পরানে ঢেউ তুলেছিল         কেন দিনের জ্যোতি।
তোমার কাছে আমার          এই মিনতি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *