পিতা পুত্রকে – ২৬

ছাব্বিশ

আমাদের পরিবারে ইতোমধ্যে অনেক পরিবর্তন এসে গিয়েছিল। কাকামণির পাঞ্জাব যাওয়ার ছ’মাসের মধ্যেই কাকিমা ও খুড়তুতো ভাই বোনেরা তাঁর কাছে চলে গেল। ২৯ নম্বর বীডন স্ট্রিটের পরিবারগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। পিসিমা গোয়াবাগানে আলাদা ঘর ভাড়া নিলেন। তিনখানা ঘরের ফ্ল্যাট। রেণুদি, অনুদি দুজনেই কলেজে পড়ছে, বেথুনে দুজনেরই সম্মান। দাদামণি যুদ্ধের বাজারে ব্যবসা করে অর্থবান হতে চলেছে; পিসেমশাই বেহালায় কবিরাজি করেন। সারা সপ্তাহ ওখানে কাটিয়ে শনিবার রবিবার বাড়ি আসেন। আমি টমোড়ি হোস্টেলে থাকার সময় মা’র একটা পত্রে জানলাম আমার এক নতুন বোন জন্মেছে। নাম রাখা হয়েছে বেণু। খবরটা জেনে কেন জানি খুশি হতে পারলাম না। এক বোন ও দুই ভাই আমার হাতে ছোটবেলায় তৈরি হয়েছে। আমি তাদের স্নান করিয়েছি, খাইয়েছি, জামাকাপড় পরিয়ে দিয়েছি। বোনকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি, ভাইদের প্রথম পাঠ শিখিয়েছি। এ-বাড়িতে এবার একটি বোন জন্মাল, যার সঙ্গে আমার বয়সের প্রচুর ব্যবধান, আদান-প্রদানের বিরাট দূরত্ব। এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কখনো গভীর হতে পারবে না। আমার প্রভাব পড়বে না এর জীবনে।

হোস্টেলে আমার আর্থিক অবস্থা ভালো। খেতে পরতে খরচা লাগত না। পনেরো টাকা সরকারি বৃত্তি এবং কাকামণির দ্বারা প্রেরিত দশ টাকা। সরকারি বৃত্তি আসতে মাসের পর মাস দেরি হয়ে যেত, তখন, অনেক সময় অধ্যাপক গ্রে অগ্রিম টাকা ধার দিতেন। কিছু টাকা আমি প্রতি মাসেই গণেশপুরে পাঠাতে পারতাম।

১৯৪১-এ ইচ্ছে হলো গ্রামে যাবার। সব আত্মীয়স্বজনদের জন্য শাড়ি, ফ্রক, প্যান্ট, শার্ট, ধুতি, পাঞ্জাবী কিনে ফেললাম। সংকল্প করলাম পুজোর পর সব প্রজাদের খাওয়া হবে, খরচ বহন করব আমি। বালকদের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হবে আমার খরচে। সেজন্যে বেশ কিছু প্রাইজ কিনে নিলাম।

শিয়ালদা থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত রেলগাড়ি, তারপর স্টিমার চেপে সুরেশ্বর। সেখান থেকে নৌকা চেপে গণেশপুর। বাজারের সামনে নৌকা ভিড়বার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম জ্যেঠামশাই দুই ভাই—বোনকে নিয়ে আমার অপেক্ষায়। রাস্তায় যেতে যেতে দীর্ঘ বছরগুলোর বড় বড় ঘটনা শোনা গেল। কোন্ বাড়ির কার মৃত্যু হয়েছে, কার হয়েছে বিবাহ, ক’বার বসেছে যাত্রাগান ও সংকীর্তন, দোলের সময় শিব সেজে যারা নাচতে আসত তাদের কথা এবং আমাদের প্রজা—বাড়িগুলোর মধ্যে এক বাড়িতে একটি স্ত্রীলোকের উপর ভূতের আক্রমণ।

বাড়ি পৌছে দেখি মা প্রায় তেমনিই আছেন। প্রণাম করতে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন বিছানায়। দেখতে পেলাম হাত পা ছুঁড়ে শুয়ে আছে ও খেলছে একটি শিশু, আমার তিন মাসের বোন বেণু। জ্যেঠামশাইকে মনে হলো অনেকটা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তাঁর স্ত্রী বড়মা নীরব ও লাজুক। অন্য শরিকদের মধ্যেও কোনো পরিবর্তন নজরে পড়ল না। জ্যেঠামশাই আমার কেনা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গর্বের সঙ্গে সারা গ্রাম ঘুরে এলেন।

পুজো আসবার ঠিক মুখে গ্রাম সব প্রবাসীদের প্রত্যাগমনে সরগরম হয়ে উঠল। প্রতিমা তৈরি প্রায় শেষ, খড়ি পড়ে গেছে, এখন লাগানো হবে রং। ছোট দু’ভাই কানু ও ভানু প্রায় সারা দিন ও উত্তীর্ণ-সন্ধে কুমোরদের সঙ্গে দুর্গামণ্ডপে।

পুজোর দু’দিন আগে বাবাও এসে হাজির হলেন। সেই মুটের মাথায় চাপানো বিছানা, কিন্তু তাঁকে নিয়ে আমার আর কৈশোরের কৌতূহল নেই। বাবাকেও দেখে মনে হলো, বয়স বেড়ে গেছে। স্থির হয়ে গিয়েছিল গণেশপুরের পাট তুলে মা ও ভাইবোনেরা খুলনা চলে যাবে। প্রধান প্রয়োজন বোন মধুর শিক্ষা। প্রাথমিক পাস করে দু’বছর বসে আছে। এবার তাকে হাইস্কুলে ভর্তি করতে হবে। মা’র বিবাহিত জীবনের প্রথম শখ শহরবাসী হওয়ার। সে শখ এখন পূর্ণ হতে চলেছে। বাবা পুরোপুরি নিরানন্দ। তিনি চাকরি করতেন খুলনায়, কিন্তু সারা বছর তাঁর মনপ্রাণ পড়ে থাকত গণেশপুরের পৈতৃক বাড়িতে। সেখানকার ঘরবাড়ি ত্যাগ করে চলে যাবার সিদ্ধান্ত তাঁকে খুব পীড়িত করেছিল, কিন্তু দুঃখের সমব্যথী ছিল না কেউ। ছোট ভাই কানু বড় বড় তক্তাপোষ, হাতলহীন চেয়ার ও নড়বড়ে পড়ার টেবিল সবকিছু কী করে খুলনায় নিয়ে যাওয়া যায়, প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করছে প্রতিদিন। গ্রাম থেকে একটি পরিবার শহরে চলে যাচ্ছে, আর কোনোদিন ফিরবে না, তা প্রায় নিশ্চিত। এতে গ্রামের সবারই দুঃখ, কিছু যেন একটা হারিয়ে যাচ্ছে— কোথায় তৈরি হচ্ছে মস্ত একটা ফাঁক, যা পূর্ণ হবার সম্ভাবনা নেই। সবার চেয়ে উদাস দুর্বল ও পরিষ্কারভাবে আতঙ্কিত আমাদের বহু বছরের প্রধান অভিভাবক জ্যেঠামশাই, বাবার খুড়তুতো বড় ভাই। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক। নিঃসন্তান, তাঁর জীবনে আমরাই তাঁর সন্তানসন্ততি। এবার আমরা চলে যাচ্ছি, তাঁর তো যাবার কোনো স্থান নেই, থাকলেও তাঁকে কিছুতেই গ্রাম থেকে সরানো যেত না।

পুজোর সময় গ্রামে প্রত্যাগত মুখ্য ব্যক্তিদের সামাজিক আদান—প্রদান ঘটে থাকে। এবার দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভালো ফল দেখিযে গ্রামের সম্মানিত গুরুজনদের কাছে আমার দাম বেড়েছে। পিতৃদেব মুখে কখনো একটি প্রশংসার বাক্য উচ্চারণ করেননি। তাঁর হাতের স্নেহ স্পর্শ লাগেনি আমার শরীরে, অথচ ফল্গুধারার মতো স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও আত্মীয় স্বজনের প্রতি নির্ভেজাল মমতা ও দায়িত্ববোধ তাঁর দেহের শিরায় শিরায় প্রবাহিত রয়েছে। একদিন শুনতে পেলাম পিতৃদেব গ্রামের অন্য এক নমস্যকে বলছেন, “শ্ৰীমন্ত কাকা (শ্ৰীমন্ত দাশগুপ্ত, গণেশপুরের একমাত্র জেলা প্রশাসক) বলছিলেন, প্রেসিডেন্সি কলেজে না পড়ে স্কটিশে পড়ানো আমার পক্ষে ঠিক হয়নি। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্ররাই বেশির ভাগ আইসিএস—বিসিএস পরীক্ষায় পাস করে থাকে।”

আমার সেই বিএ পড়ার সময় তখনও জীবনে কী হব না হব, কী কাজ জুটবে না জুটবে, তা নিয়ে কোনো পরিষ্কার চিন্তাভাবনার তাগিদ আসেনি। যখন এসেছিল এবং ভাগ্যের সুযোগে ও গ্রে সাহেবের সহায়তায় ‘স্টেটসম্যানে’ চাকরি পেলাম, তখন আর একবার বাবার মুখে তাঁর ‘শ্রীমন্ত কাকা’র অভিমত জানবার সুযোগ হয়েছিল। অভিমতটা ছিল, “স্টেটসম্যানে কাজ করা আর বিসিএস হওয়া সমান।” আমার কিন্তু কখনো আইসিএস, বিসিএস হবার ইচ্ছে ছিল না, চেষ্টা করলেও হতো না, ব্যর্থ হতাম। শুধু বুঝতে পেরেছিলাম আমার পিতৃদেবের কাছে এই ধরনের রাজপদ কত মূল্যবান। তাঁর ব্রিটিশ শ্রদ্ধার আর এক নিদর্শন!

পুজো উপলক্ষে যাত্রা, নাটক, সংকীর্তন সব হলো, গ্রামের অভিনেতারাও ডি.এল. রায়ের ‘চন্দ্রগুপ্ত’ অভিনয় করলেন। আমার নিমন্ত্রণে তখন কুমিল্লার জেলাশাসক শ্রীমন্ত দাশগুপ্ত ছেলেদের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সভাপতিত্ব করলেন। একটি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় আমার পিতামহ রজনীকান্তের দেশপ্রেমের প্রশংসা করে আমাকে কিছুটা বাহবা দিলেন। বিজয়ার পরের দিন প্রজাদের খাওয়ানো হলো। আমার মনে আছে পঞ্চাশের উপরে নারী-পুরুষ, কিশোর-শিশুদের খাওয়াতে জ্যেঠামশাইয়ের হাতে আমাকে তুলে দিতে হলো পনেরো টাকা।

গ্রামে আমার এই শেষ উপস্থিতির প্রধান ঘটনার সঙ্গে শারদ উৎসবের কোনো সম্পর্ক ছিল না। প্রাইমারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক দীনেশ কাকা (দ্বিতীয় শিক্ষক আমার জ্যেঠামশাই) একদিন আমাকে এসে পাকড়াও করলেন। তাঁর চোখেমুখে রক্তবর্ণ উত্তেজনা। বললেন, “একটা ভীষণ কেলেঙ্কারী চলছে, তোমাকে তার মীমাংসা করতে হবে।”

“কেলেঙ্কারী! কী কেলেঙ্কারী? মীমাংসা করার ক্ষমতা আমার কোথায়?”

“তোমাদেরই এক প্রজাবাড়িতে।”

“কোন্ প্রজা?”

তোমার মনে থাকবে, আমাদের বাড়ির বাইরের পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে এক স্বর্ণকার পরিবারের শিশু-বিধবা কমলার কথা। সেই কমলা যে সাত বছরে বিধবা হয়েছিল, সে এখন ষোলো সতেরো বছরের যুবতি। বিজয়ার পরের নিমন্ত্রণের দিনে বাবামা’র সঙ্গে সেও খেতে এসেছিল। তখন দেখতে পেয়েছিলাম তার সৌন্দর্য গভীর কোমলতা ও নম্রতায় বিস্ময়করভাবে গর্জিত। আমার বোন মধুর সঙ্গে তখনও তার গলাগলি বন্ধুতা, যদিও সে বয়সে দু-তিন বছরের বড়। তার চোখে আমার চোখ পড়তে, খণ্ডিত মুহূর্তের হঠাৎ চোখাচোখি, আমার শরীরে শিহরণ জেগেছিল, কমলার মুখখানা শারদীয় অপরাহ্নে মেঘের ওপর প্রসারিত সূর্যের আভায় লজ্জারুণ। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, “তুমি ভালো আছো তো?”

আমার বোন পাশেই ছিল। সে বলেছিল, “কমলা প্রাইমারি স্কুলে বৃত্তি পেয়েছে। এখন কোথায় কী পড়বে তাই নিয়ে ওর বাবার ভীষণ দুশ্চিন্তা।”

দীনেশ কাকাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কমলার কী হয়েছে?”

“ছোট মামার সঙ্গে অবৈধ প্রেম করছে।”

“আপনি জানলেন কী করে?”

“আমি সব সময় নজর রাখছি। ওরা চিঠিপত্র লেখালেখি করছে। কয়েকটা চিঠি আমি ধরতে পেরেছি। এই নাও, পড়ে দেখো।”

একগুচ্ছ চটকানো প্রায়-ছেঁড়া রুলটানা খাতার পৃষ্ঠা দীনেশ কাকা আমার হাতে গুঁজে দিলেন। দেখলাম এক একটি চিঠির অনেকগুলো টুকরো তিনি সযত্নে আঠা দিয়ে পাতায় সংযুক্ত করেছেন। একটা চিঠির ওপর নজর রেখে বোঝা গেল— আসল প্রেমের চিঠি, গ্রামের মাটি জল জঙ্গল পশু পাখিদের মতো জীবন্ত ও নির্মোক।

দীনেশ কাকা বললেন, “আমি কমলার বাবাকে বারবার সাবধান করেছি। এই গোপাল ছেলেটা একেবারে বদ। পেশায় মিস্ত্রি, গায়ে গতরে পালোয়ান, দেখলে তুমি বলবে সুপুরুষ, কিন্তু কোনো নীতিবোধ নেই। নিজের ভাগ্নির সঙ্গে প্রেম করছে, তাকে সর্বনাশের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। তোমার জ্যেঠামশাইকে বলেছি। ওকে পেঁদায় এমন কেউ নেই গ্রামে। পুলিশের হাতে তুলে দিতে হয়।”

আমি বললাম, “দীনেশ কাকা, এ ব্যাপারে আমার কী করার আছে? আমি তো এক সপ্তাহ পরে কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। ওর বাবার উচিত কমলার আবার বিয়ে দেওয়া।”

“বিয়ে দেওয়া! বিধবা মেয়েকে আবার বিয়ে দেওয়া! তোমরা কলকাতায় পড়াশোনা করে এই শিক্ষা পাচ্ছ?”

“যদি বিয়ে না দেয়, কমলা অবৈধ প্রেম তো করবেই। ওরা তো ছোটজাত, ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থদের পরিবারের অল্প বয়সী বিধবারা কি উপবাসী থাকে?”

দীনেশ কাকা একসঙ্গে বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হলেন। “তাহলে তুমি কিছু করবে না?”

“আমার কিছু করার নেই, দীনেশ কাকা। আপনারা যাঁরা গ্রামে আছেন এটা আপনাদেরই কাজ। শুধু বলব, কমলার কথাটাও ভেবে দেখবেন।”

তিন-চার দিন পরে কমলার বাবাই আমাদের বাড়িতে এসে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইল। অতীক কর্মকার। ব্যবসায়ে স্বর্ণকার। তার অবস্থা ভালো।

আমি তাকে ঘরে নিয়ে এসে তক্তপোষের উপরে বসালাম। দু—চারটে বাক্য বিনিময়ের পরে প্রশ্ন করলাম, “অতীক কাকা, আমার কাছে আপনার বিশেষ কোনো কাজ আছে?”

“একটি বিষয়ে তোমার পরামর্শ চাই।”

“আমার পরামর্শ!”

“তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে কী সব করেছ, সবার কাছে তোমার নাম শুনি। আমার সামনে এক বড় বিপদ। কমলাকে নিয়ে।”

“কমলাকে নিয়ে কিসের বিপদ আপনার? ও তো প্রাথমিক পরীক্ষা পাস করে সরকারি বৃত্তি পেয়েছে।”

“সেটাই তো বিপদ। বৃত্তি ভোগ করতে হলে ওকে পড়াতে হয়। বড় হয়েছে। নানা রকমের পুরুষ লেগেছে ওর পেছনে। ওই যে দীনেশ শিক্ষক মশাই, তিনি সবচেয়ে বেশি। সকালে ঘুম উঠে দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে আমাদের বাড়িতে হাজির হয়। সবসময় কমলাকে কাছে ডাকে, নানারকম লোভ দেখায়। কী যে করি ওকে নিয়ে ভেবে পাই না। কোনো উপায় বাতলাতে পারবে?”

আমরা সবাই জানতাম দীনেশ কাকা অকৃতদার। বয়স তখন বোধহয় চল্লিশ পেরিয়ে গেছে।

আমি বললাম, “ওকে নার্সিং স্কুলে ভর্তি করে দিন। মাদারীপুরে স্কুল আছে, কলকাতাতে তো আছেই। পড়ার খরচা লাগবে না। হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হবে। আমি কলকাতায় গিয়ে আপনাকে খোঁজ খবর করে কাগজপত্র পাঠাব। আপনারা তপসিলি জাতের লোক। অনেক সরকারি সুবিধা রয়েছে আপনাদের জন্যে যা আপনারা জানেন না। কমলা পুরোপুরি নার্স হতে পারবে। ওর জীবন একেবারে বদলে যাবে।”

অনেক সময়ের দীর্ঘ ব্যবধান এক মুহূর্তে অতিক্রম করে যায় মানুষের মন। মনসা মথুরাং। অলডুস হাক্সলি তাঁর ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’-এ স্যাভেজ নামে একটি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। এক জায়গায় স্যাভেজ বলেছে— আমি দশ দিনে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর পেরোতে পারি! উপন্যাসে আর একটি চরিত্র আছে, অ্যারিয়ল। সে বলে উঠল, ‘আমি পারি এক মুহূর্তে, আমার মনের গতিতে।’

মনের গতিকে এক মুহূর্তের জন্য অনেক সময় পেরিয়ে যেতে দাও। ষাট দশকে আমার প্রথম লন্ডন যাবার সুযোগ হয়েছিল। একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁয় এক ইংরেজ বন্ধুর সঙ্গে খেতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম কাছাকাছি টেবিলে বসে আছে এক দম্পতি, মহিলা আমাকে বারবার দেখছে। মুখখানা চেনা চেনা মনে হলো, কিন্তু এগিয়ে গিয়ে পরিচয় জানবার মতো সাহস হলো না।

মেয়েটি নিজেই এগিয়ে এল। বলল, “আমায় চিনতে পারছেন না? আমি কমলা।”

“তুমি কমলা! কী আশ্চর্য! আর উনি, তোমার স্বামী?”

“হ্যাঁ।”

কমলা তার স্বামীকে ডেকে আনল। সে ডাক্তার, লন্ডনের কাছাকাছি ক্যান্টারবেরি শহরে এক হাসপাতালে কাজ করে। কমলা সেখানে নার্স। কে বলে জীবন মানুষকে পুরস্কার দেয় না? কাকে দেয় কাকে দেয় না তার কোনো বাঁধা-ধরা নিয়ম নেই। অনেক সময় যে পায়, সে হাত ভরে, বুক ভরে পায়।

আমার গ্রামে গণেশপুরের চামার বাড়ির শিশু-বিধবা কমলা ইংল্যান্ডের এক হাসপাতালের নার্স! শুধু পুনর্বিবাহিতই নয়, তার স্বামী ডাক্তার। জীবনের বিস্ময়গুলো আমাদের বারবার ধাক্কা মারে, চমকিত করে, বুঝিয়ে দেয় জীবন কী ভীষণ সুন্দর রহস্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *