পিতা পুত্রকে – ৮

আট

যতীনবাবু খুন হবার পরেই ঝড় উঠল গণেশপুর গ্রামে। ঝড় তো নয়, প্রভঞ্জন। একপাল বন্দুকধারী পুলিশ পাঁচখানা গ্রাম ছেয়ে ফেলেছে। ষোলো-সতেরো বছর বয়সের ছেলেরা যেসব বাড়িতে, সেখানে পুলিশ ঢুকে খানাতল্লাসি করল। পনেরোটি তরুণ ও যুবককে হাতবেড়ি পরিয়ে ধরে নিয়ে গেল। তার মধ্যে গণেশপুর হাইস্কুলেল দশম শ্রেণির চারটি ছাত্র। গণেশপুরের বাড়ি থেকে আরও দুজন যুবক।

পাবলিক লাইব্রেরি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ব্যায়ামাগার উঠে গেল।

পুলিশ অনেক খুঁজেও অনন্তদাকে পেল না। আমাদের বাড়ি পর্যন্ত খুঁজতে এসেছিল। আমাদের বাড়ি থেকে চারটে ছেলে স্কুলে যেত। আমি ছাড়া বাকি তিনটি ‘পুবের ঘরে’ জ্ঞাতি ভাই। সবচেয়ে বড়টি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেনি। আমি তো মাত্র অষ্ট শ্রেণির বালক।

তাই পুলিশ যখন আবার আমাদের বাড়িতে ঢুকল আমরা সবাই চকিত ও ভীত হলাম।

রণজিৎ জ্যেঠামশাই শনিবার রাত্রে বাড়ি ফিরতেন, সোমবার প্রত্যুষে ভোজেশ্বর চলে যেতেন।

তিনি বাড়িতে নেই। ‘উত্তরের ঘরে’র জ্যেঠামশাই বাইরের পুকুরে ছিপ ফেলে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে মাছের জন্য ব্যর্থ অপেক্ষা করছিলেন। তিনিই দুটো পুলিশকে নিয়ে এলেন বাড়িতে। একজনের হাতে বন্দুক, অন্যজনের হাতে লাঠি।

পুলিশ জানতে চাইল, এ বাড়িতে বিজন সেনগুপ্ত বলে কেউ আছে কিনা।

জ্যেঠামশাই বললেন, “না।”

“বিজন সেনগুপ্ত এ বাড়ির লোক নয়?”

জ্যেঠামশাই বললেন, “হ্যাঁ, এ বাড়ির লোক, কিন্তু তার বাস কলকাতায়, সে গ্রামের বাড়িতে আসে না।”

“বিজন সেনগুপ্ত তো টেররিস্ট!”

জ্যেঠামশাই বললেন, “বিজন আমার খুড়তুতো ভাই। সে কয়েক বছর রাজবন্দী ছিল। এখন ছাড়া পেয়ে কলকাতায় আছে শুনতে পাই। পিতার মৃত্যুর পর সে আর গ্রামে ফিরে আসে নি। তার খবর আমাদের জানা নেই।”

“অমলেন্দু দাসগুপ্ত কি এ বাড়ির কেউ হয়?”

“অমলেন্দু এ বাড়ির জামাই। বিজনের ভগ্নিপতি। মাদারীপুরের লোক।”

“অমলেন্দু দাসগুপ্ত তো ভীষণ টেররিস্ট!”

“সেও রাজবন্দী ছিল। এখনও হয়তো আছে। দেউলিতে। আমরা তার কোনো খবর রাখি না।”

“এটা তো রজনীকান্তের বাড়ি?”

“তিনি আমার স্বর্গত জ্যেঠামশাই।”

“তাঁর পরিবারের কে কে আছে এই বাড়িতে?”

“বড় ছেলে দুর্জয় খুলনাতে স্কুলমাস্টার। ছোট ছেলে সূর্যকান্ত পাঞ্জাবে অধ্যাপক। দুর্জয় সিংহের পরিবার এ বাড়িতে বাস করে। তার স্ত্রী, দুটি ছেলে, একটি মেয়ে।

জ্যেঠামশাই ভুলে গেছেন আমার আর একটি ভাই জন্মেছে বছর খানেক আগে। তার নাম ভানু।

“ছেলের বয়স কত? কোন ক্লাসে পড়ে?”

“ছেলের বয়স তেরো, পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে।”

“তাকে ডেকে দিন।”

আমাকে নিয়ে এসে পুলিশের সামনে দাঁড় করালেন জ্যেঠামশাই।

“তুমি লাইব্রেরিতে যেতে প্রতি সপ্তাহে, তাই না?” লাঠিধারী পুলিশ প্রশ্ন করল আমাকে।

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“বই আনতে।”

“কী বই?”

“বাংলা বই।”

“কয়েকটার নাম করতে পার।”

আমি একসঙ্গে অনেকগুলো উপন্যাসের নাম বলে দিলাম। পুলিশ দুজনই কেমন ভড়কে গেল। এত লেখক ও বইয়ের নাম এর আগে একসঙ্গে তারা কোনোদিনও শোনেনি।

“খুব পড়ুয়া ছেলে তুমি?”

আমি চুপ করে রইলাম।

“ব্যায়াম করতে যেতে?”

“না।”

“ছোরা খেলা, বা লাঠি খেলা?”

“না।”

“কেন?”

“আমার খেলতে ভালো লাগে না।”

“তুমি অনন্তদাকে তো চিনতে?”

“এক দুবার দেখেছি।”

“তোমার সঙ্গে কথা বলতেন না?”

“আমি তো ছোট্ট ছেলে।”

“এ বাড়িতে এসেছে কখনো?”

“না।”

বন্দুকধারী পুলিশ বলে উঠল, “অনন্ত তোমাদের ঘরে লুকিয়ে রয়েছে, আমরা জানতে পেরেছি।”

কথাগুলো শুনে আমি হেসে ফেললাম।

পুলিশ দুজন একেবারেই তৈরি ছিল না আমাকে হাসতে দেখতে।

বললাম, “আসুন না, ঘরে খুঁজে দেখুন, অনন্তদা আমাদের বাড়ি চেনেনই না।”

এবার পুলিশ দুজন হেসে ফেলল। অবাক হবার পালা আমাদের। আমাদের জানা ছিল না পুলিশও হাসে।

বন্দুকধারী পুলিশ বলল, “খুব স্মার্ট ছেলে তুমি। স্কুলের হেডমাস্টার আমাদের বলেছেন, তুমি ইন্টার স্কুল বিতর্কে প্রথম হয়ে সোনার মেডেল পেয়েছ। ইংরেজ সরকারের দারুণ প্রশংসা করেছ।”

আমি বললাম, “মেডেল দেবার কথা ছিল। দেয়নি।”

.

পনেরোটি যুবককে বন্দি করে হাজতে রেখে দিল পুলিশ একমাস। তারপর একে একে পাঁচজনকে ছেড়ে দিল। এদের সবাইকে মহকুমা শহর মাদারীপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ছাড়া-পাওয়া পাঁচজনের মধ্যে একজন সত্যদা, সত্য চক্রবর্তী, আমাদের স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। তার পিতা মাদারীপুরে উকিল। তাকে স্কুলে পড়তে দেওয়া হবে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল মাস্টারমশাইদের মধ্যে। কয়েকজন শিক্ষক একত্র হয়ে বলেছিলেন, রাজনৈতিক অপরাধের সন্দেহে ধৃত ছাত্রকে স্কুলে রাখলে কর্তৃপক্ষ বিরূপ হবেন, জমিদার বাড়ির চৌধুরীরা আপত্তি করতে পারেন। আমরা শুনেছিলাম ছোট চৌধুরী সাহেব আপত্তি তুলেও ছিলেন। কিন্তু নতুন হেড মাস্টার মশাই, যিনি মাত্ৰ বছরখানেক চব্বিশ পরগনার একটি স্কুল থেকে এসেছেন আমাদের স্কুলে, প্রবল আপত্তি জানালেন। নির্দোষ বিবেচিত হয়ে পুলিশ যাকে ছেড়ে দিয়েছে, আদালতের হুকুমে নয়, স্কুল তাকে দোষী করতে পারবে না। তিনি নাকি ছোট চৌধুরী সাহেবকে বলেছিলেন সত্য চক্রবর্তীকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিলে তিনি পদত্যাগ করবেন। আরও বলেছিলেন, দেশপ্রেম, দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম কোনো গর্হিত কাজ নয়, যদিও সন্ত্রাসবাদ নিশ্চয়ই অত্যন্ত গর্হিত।

আমাদের সত্যদা, অতএব স্কুলেই রয়ে গেল। তার মুখে শোনা গেল পুলিশ পনেরোটি ধৃত যুবককে বিস্তর মারধোর করেছে অপরাধ স্বীকারের জন্য। সে নিজেও প্রহৃত হয়েছে, পিঠে তার প্রহারের দাগ রয়েছে। আদালতে কেস তুলবার আগে পুলিশ রাজসাক্ষী পাওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে রয়েছে।

এক বছরের মধ্যে গণেশপুর ‘ছাত্রযুবকদের মামলা’ (সংবাদপত্রের ভাষায়) আদালতে উঠল। আদালত বসল জমিদার চৌধুরী বাড়ির বিশাল অভ্যর্থনা কক্ষে। মাদারীপুরের মহকুমা শাসক বিচারক। তিনি একটা চকচকে-ঝকঝকে মোটর লঞ্চে গণেশপুরের নদীতীরে দু’সপ্তাহের নিবাস নিলেন। জমিদার বাড়ির আতিথ্য গ্রহণ করলেন না, কিন্তু তাঁদের পাঠানো প্রাতঃরাশ থেকে সান্ধ্য ভোজনের আহার্যে তাঁর আপত্তি হলো না।

যতদূর মনে পড়ছে এসডিও মহাশয়ের নাম ছিল সুশীল কুমার চ্যাটার্জী। আইসিএস, খুব অল্প বয়স, পঁয়ত্রিশের বেশি নয়, ছিমছাম সুপুরু, ‘বোট’ থেকে নেমে ঘোড়ায় চেপে কোর্টে আসতেন প্ৰতিদিন সকালে, চারজন বন্দুকধারী ঘোড়সওয়ার রক্ষী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে। ঠিক সাড়ে দশটায় আমাদের স্কুলের মাঠ পেরিয়ে জমিদার বাড়ির সদর দরজায় প্রবেশ করতেন। আমরা ছাত্ররা, আমাদের শিক্ষকরা ক্লাস থেকে বেরিযে লাইন করে দাঁড়িয়ে যেতেন এই অভিনব দৃশ্য দেখার জন্য। একমাত্র হেডমাস্টার মশাই নিজের অফিস ঘরে বসে কাজ করে যেতেন।

গণেশপুরে ‘ছাত্র ও যুবকদের’ বিচার সারা বঙ্গে আলোড়ন তুলেছিল। বন্দীদের পক্ষে দশ-বারোজন উকিল, দুজন অ্যাডভোকেট, এঁরা সবাই হয় মাদারীপুর, নয় জিলা শহর ফরিদপুর, নয় বঙ্গের রাজধানী কলকাতা থেকে এসেছেন। ডিঙ্গামানিক, মধুপুর, চাকদহ এই তিনখানা পাশাপাশি গ্রামের বর্ধিষ্ণু গৃহস্থ বাড়িতে তাঁদের আবাসন তৈরি হয়েছে। এঁরা টাকা পয়সা না নিয়েই বন্দীদের জন্যে লড়ছেন। যাতায়াতের খচরও কলকাতার বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল কংগ্রেস যোগান দিচ্ছেন। দুজন অ্যাডভোকেট, যদিও তাঁদের নাম আমি একদম ভুলে গেছি, ছিলেন আইনজীবী হিসেবে খ্যাতিসম্পন্ন।

সরকারের পক্ষে জিলা ও মহকুমার প্রধান প্রসিকিউটর ও তাঁদের সহকারীবৃন্দ। গুজব শোনা গেল কলকাতা থেকে স্বয়ং অ্যাডভোকেট জেনারেলও একদিনের জন্য আসবেন, কিন্তু এলেন না।

কোর্টে যেতে কোনো বাধা ছিল না। শুধু পঞ্চাশ জনের বেশি দর্শককে ঢুকতে দেওয়া হতো না। আসামিদের পিতা, কাকা, জ্যেঠা ইত্যাদির প্রথম প্রবেশ অধিকার। আমরা ছাত্রেরা প্রতিদিন পাঁচজন যাবার অনুমতি পেয়েছিলাম। কিন্তু দেখা গেল কোর্টে যাবার উৎসাহ বেশি ছাত্রের নেই।

তাই আমি দুদিন কোর্টে বিচার দেখার সুযোগ পেয়ে গেলাম। হেড মাস্টার মশাই এ সুযোগ করে দিলেন। শুধু বললেন, আমাকে এসে বলবে কী হচ্ছে-না হচ্ছে। আমি যা বলতাম, তা থেকে তিনি কতটুকু আদালতের আবহাওয়া ও মতিগতি বুঝতে পারতেন আমার জানবার উপায় ছিল না। আমি নিজেই বুঝতাম খুব সামান্য। পুলিশ অনেক সাক্ষী জোগাড় করেছিল। তাদের মধ্যে ছিল গ্রামের কয়েকজন ভদ্রলোক, আরও অনেক বেশি ‘ছোটলোক’। মাদারীপুর, কলকাতা, বরিশাল থেকে নিয়ে আসা কয়েকজন পুরুষ, দশটি নারী, যাদের বলা হতো বেশ্যা, যে শব্দটার সঙ্গে এই আমার প্রথম পরিচয়। মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বেশ্যা মানে কী, শুনেছিলাম, “ওরা খারাপ মেয়ে মানুষ।”

দুজন রাজসাক্ষীও পুলিশ তৈরি করতে পেরেছিল। তাদের মধ্যে একজন গণেশপুরের যুবক হেরম্ব, ডাক্তার শীলের ছেলে, যার মাত্র দু’বছর বিয়ে হয়েছিল, প্রথম বন্দীদের মধ্যে যে ছিল একজন।

সরকার পক্ষের সাক্ষীরা বলেছিল, আসামিরা অনন্তদার মন্ত্র শিষ্য, তারা রোজ ছোরা, তলোয়ার, লাঠি খেলা শিখত। তাদের ব্রত ইংরেজ ও তাদের বংশবদ ভারতীয় রাজপুরুষদের হত্যা করা, গোয়েন্দাদের খুন করা বা পঙ্গু করে দেওয়া। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে ভয়ে দেখিয়ে অর্থ সংগ্রহ করত। বলত সব টাকা সন্ত্রাসবাদ সংগ্রামের জন্যে। তারা অনুশীলন করত পিস্তল খেলা, পিস্তল চালানো। একথা তারা নিজেরাই সগর্বে ঘোষণা করত। অনন্ত ছিল অনুশীলন দলের নেতা। জঙ্গলে দেখা যেত আসামিদের সে গেরিলা যুদ্ধ শেখাচ্ছে, আসামিরা বলত তারা ধনীদের বাড়িতে হানা দিয়ে টাকা পয়সা ধনদৌলত লুঠ করবে। দুজন ব্যক্তি সাক্ষী দিলেন আসামিদের তিন—চারজন তাদের বাড়িতে ডাকাতি করেছে। সবাইকে পিস্তল দেখিয়ে রুদ্ধ কণ্ঠ করে বড় গলায় ঘোষণা করেছে, এ ধন আমরা নিচ্ছি ইংরেজদের মারবার জন্য, আপনারা পুলিশ ডাকলে আপনাদেরও খুন করা হবে। দু-তিন বছর ধরে আসামিদের ও তাদের অনুগতদের অত্যাচারে গ্রামের বিত্তবান পরিবারগুলোকে সর্বদা আতঙ্কের সঙ্গে বসবাস করতে হয়েছে…

কয়েকটা কোর্ট দৃশ্য এখনও আমার মনে আছে।

হেড মাস্টার মশাইয়ের সাক্ষ্যটা সবচেয়ে বেশি।

তাঁকে সাক্ষীর চেয়ারে বসিয়েছেন জেলার প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর।

“আপনি কবে থেকে গণেশপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক?”

“এক বছর নয় মাস তেরো দিন।”

“এর আগে কোথায় শিক্ষকতা করেছেন?”

“চব্বিশ পরগনার—গ্রামের হাই স্কুলে।”

“হেড মাস্টার ছিলেন?”

“না। অ্যাসিসটেন্ট হেড মাস্টার।”

“গণেশপুর, ডিঙ্গামানিক গ্রাম আপনার ভালো করে জানা আছে?”

“মোটামুটি জানা আছে।”

“আপনি গ্রামের ভদ্রলোকের বাড়ি যান? বন্ধু পরিবার তৈরি হয়েছে আপনার?”

“বিশেষ নয়।”

“গণেশপুর যে সন্ত্রাসবাদীদের একটা কেন্দ্র হয়ে গেছে এ খবর আপনি জানতেন?“

“না।”

“এ বিষয়ে আপনার কোনো সন্দেহ আছে?”

“না, যা আমি জানি না তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারি কী করে!”

“আপনার স্কুলের ছাত্ররা যে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে শিক্ষা পাচ্ছিল সেটা জানতেন?”

“এমন খবর আমি এখনও পাইনি।”

“আসামিদের মধ্যে আপনার স্কুলের দশম শ্রেণির তিনটে ছাত্র রয়েছে, নাম রমেশ বসু, ধনঞ্জয় রায়, আর সুভাষ মল্লিক, এদের আপনি কতটুকু জানেন?”

“স্কুলের উচ্চতম শ্রেণির ছাত্র হিসেবে যতটুকু জানা দরকার ও সম্ভব ততটুকু।”

“আপনি এদের পড়ান?”

“দশম শ্রেণিতে আমি ইংরেজি পড়াই। সব ছাত্রকেই ইংরেজি পড়তে হয়।”

“স্কুলে এদের আচার-ব্যবহারে আপনি উগ্র রাজনৈতিক ব্যবহার নিশ্চয়ই পেয়েছেন?“

“না, তা পাই নি।”

“স্কুলের বাইরে এরা কী করত না করত আপনার জানার কথা নয়?”

“না। কোনো নালিশ আমি পাইনি এদের সম্বন্ধে।”

“আপনাকে যা প্রশ্ন করা হয়েছে ঠিক তারই জবাব দেবেন, বাড়তি কিছু বলা আপনার পক্ষে অনুচিত হবে, বে-আইনিও।”

“আপনার প্রশ্নের জবাব তো দিয়েছি!”

“আমাদের কাছে খবর আছে আপনি নিজেই সন্ত্রাসবাদের সমর্থক। এ বিষয়ে আপনি কিছু বলবেন?”

“খবর সত্যি নয়।”

“আপনি সুভাষ বসুকে প্রশংসা করে প্রবন্ধ লেখেননি?”

“লিখেছি।”

“তার মানে আপনি ইংরেজ সরকারের বিরোধী।”

আসামিপক্ষের উকিল প্রশ্নে আপত্তি জানালেন। এ প্রশ্ন এক্ষেত্রে অবান্তর। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আপত্তি অগ্রাহ্য করে হেড মাস্টার মশাইকে প্রশ্নের জবাব দিতে আদেশ করলেন।

হেড মাস্টার মশাই বললেন, “আমি সুভাষচন্দ্র বসুকে শ্রদ্ধা করি। তাঁর প্রশংসা করি।”

“আপনি কি চান না ইংরেজ সরকার ভারত থেকে বিদায় নিক? হ্যাঁ, কি না, জবাব দিন।”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে নিশ্চয়ই যারা ইংরেজ শাসন খতম করবার জন্য সহিংস পথ নিয়েছে তাদের প্রতি আপনি সহানুভূতিশীল?”

“এ ধরনের সিদ্ধান্ত ভুল। ইংরেজ শাসন দূর করবার অহিংস পথও আছে। আমি তারই সমর্থক।”

“সুভাষচন্দ্র বসু কি অহিংস পথের নেতা?”

“আমি তার মধ্যে সহিংস কিছু দেখতে পাইনি।”

“হেড মাস্টার মশাই, আপনার স্কুলের ছাত্ররা সন্ত্রাসবাদী হয়ে গেছে, আপনি কি তারও খবর জানেন না। এতে কি প্রমাণ হয় না যে প্রধান শিক্ষক হিসেবে আপনি হয় ব্যর্থ নয়তো ছাত্রদের সন্ত্রাসবাদী হতে আপনি সক্রিয় অথবা পরোক্ষ উৎসাহ দিয়ে থাকেন?”

“আমার বিশ্বাস গণেশপুর হাই স্কুলের কোনো ছাত্র সন্ত্রাসবাদী নয়।”

পাবলিক প্রসিকিউটর চেঁচিয়ে উঠলেন, “আপনার বিশ্বাস ভুল। এ মামলায় তা প্রমাণিত হবে। আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই।”

আসামিদের পক্ষ থেকে একজন উকিল হেড মাস্টার মশাইকে প্রতি-জেরা করলেন।

“চব্বিশ পরগনার গ্রামের হাই স্কুলে আপনার বেশ সুনাম ছিল, তাই না?”

“আমার তো তাই ধারণা!”

“তাঁরা আপনার পদত্যাগ গ্রহণ করতে চাননি। তা না?”

“তাঁরা আমাকে রাখতে ইচ্ছুক ছিলেন।”

“আপনি হেড মাস্টার পদের আকর্ষণেই কি শুধু গণেশপুর হাই স্কুলে চাকরি নিলেন?”

“একটা কারণ ছিল তাই। অন্য কারণ ছিল আমি শহর থেকে দূরে প্রকৃত গ্রামের ছাত্রদের শিক্ষক হতে ইচ্ছুক ছিলাম।”

“এ ইচ্ছার কারণ?”

“কিছুটা আদর্শবাদ বলতে পারেন। তাছাড়া শহর, শহরতলীর জীবন আমার ভালো লাগে না।”

“হেড মাস্টার মশাই, আপনার পিতা কি মহাত্মা গান্ধীর শিষ্য ছিলেন?”

“হ্যাঁ, গান্ধীজীর ওয়ার্ধা আশ্রমে তিনি বাস করতেন। ওখানকার স্কুলে পড়াতেন।”

“পিতার প্রভাব আপনার ওপর প্রবল ছিল নাকি?”

“ছিল। এখনও আছে। আমার জীবনে তাঁর চেয়ে শ্রদ্ধেয় আর কেউ নেই।”

“তিনি কি আপনাকে জীবন যাপন বিষয়ে কোনো উপদেশ দিয়েছিলেন ওয়ার্ধায় চলে যাবার আগে? “

“আমার পিতৃদেব আমাকে বলেছিলেন, শিক্ষকতার চেয়ে মহান জীবিকা নেই। যদি পার গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা কোরো।”

উকিল মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছিলেন, “আমার আর কোনো প্ৰশ্ন নেই।”

বিচারের ছ’মাস পরে হেড মাস্টার মশাই স্কুল ছেড়ে চলে গেলেন। অনেকে বলল, তিনি নিজেই স্কুল ছেড়ে চলে গেলেন। আবার এও শোনা গেল জমিদার ছোট চৌধুরী সাহেব তাঁকে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। তাঁর মতে, আমাদের স্কুলের হেড মাস্টার আসলে উগ্র জাতীয়তাবাদী।

একদল স্ত্রীলোক সরকার পক্ষের সাক্ষী ছিল। এরা ঘড়িসার বাজার থেকে নিয়ে আসা বেশ্যা। এরা আদালতকে বলেছিল, আসামিরা নিয়মিত এদের কাছে যেত, মদ খেত, হুল্লোড় করত, অনেক টাকা খরচ করত। সে সব টাকা, আসামিরা বলত, আসত ডাকাতি থেকে।

একটি বেশ্যার সাক্ষী মনে আছে।

ডেপুটি পাবলিক প্রসিকিউটর, “আপনার নাম কী?”

ছোটখাটো মোটাসোটা পান-বিচানো অনেক গহনা-পরা স্ত্রীলোকটি বলেছিল ‘জবা’।

“কোথায় থাকেন?“

“ঘড়িসার বাজারে।”

“কাজ করেন?”

“হ্যাঁ।”

“কী কাজ করেন?”

“বাবুদের সেবা করি।”

“আসামিদের মধ্যে কাকে কাকে আপনি চেনেন?”

“তিনজনকে।”

“কী তাদের নাম?”

“পলাশ, তুফান, হিমালয়?”

“এগুলো কি আসল নাম?”

“ও নামেই আমি এদের চিনি।”

“এই তিনজনেক আপনি আসামিদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন?”

“পাচ্ছি।”

“আদালতকে দেখিয়ে দিন কারা এই পলাশ, তুফান, হিমালয়।” স্ত্রীলোকটি তিনজন আসামিকে দেখিয়ে দিল।

“কী করে এদের চেনেন আপনি?”

“এরা আমার কাছে আসত।”

“কেন?”

“স্ফূর্তি করতে।”

“মদ নিয়ে আসত?”

আসামিপক্ষের উকিল এ প্রশ্নে আপত্তি জানালেন। আদালতকে বললেন, “ইয়োর অনার, পাবলিক প্রসিকিউটর লিডিং কোশ্চেন করছেন।”

বিচারক তাঁর আপত্তি অগ্রাহ্য করে ‘জবা’কে প্রশ্নের উত্তর দিতে আদেশ দিলেন।

জবা বলল, “নিয়েও আসত, বাজার থেকে কেনাও হতো।”

“আর কিছু আনত?”

“অনেক টাকা থাকত এদের কাছে।”

“আর কিছু?”

“অন্তত দুদিন এদের কাছে পিস্তল ছিল।”

“আপনি দেখেছিলেন?”

“হ্যাঁ, পিস্তলটা এরা আমার চোখের সামনে মাটিতে রেখেছিল।”

“কী বলত এরা নিজেদের মধ্যে? যা আপনি নিজে শুনতে পেতেন?”

“বলত, কটা বাড়িতে চুরি-ডাকাতি করে টাকা পেয়েছে।”

“আর কিছু?”

“বলত নাশিলন দলের নেতারা এখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে সম্ভারবাদী দল তৈরি করছে।”

“নাশিলন বলতে কি আপনি অনুশীল বোঝাচ্ছেন? সন্তারবাদী বলতে সন্ত্রাসবাদী!”

আসামি পক্ষের উকিলরা একসঙ্গে আপত্তি করে উঠলেন। একজন বললেন, “ইয়োর অনার, পাবলিক প্রসিকিউটর আসামিকে প্রকাশে তালিম দিচ্ছেন।”

এবার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আপত্তি মেনে নিলেন।

পাবলিক প্রসিকিউটর জেরা করলেন, “এই তিন আসামি প্রায়ই আপনার ঘরে যেত?”

“হ্যাঁ, সপ্তাহে একবার তো বটেই। মাঝে মাঝে দু’বার।”

“মদ্যপান করত?”

“করত।”

“আপনাকেও মদ খেতে হতো?”

“হতো।”

“এরা আপনার সঙ্গে আর কী করত?”

“সবকিছুই করত!”

“তিনজনেই?”

“তিনজনেই।”

“একসঙ্গে, না পর পর?”

“দুটোই।”

“কত টাকা দিত আপনাকে?”

“কখনো পঞ্চাশ, কখনো ত্রিশ।”

“আপনার সাধারণ প্রাপ্যের বেশি?”

“প্রারপো মানে কী?”

“যা আপনি সাধারণত নেন খদ্দেরের কাছ থেকে তার বেশি?”

“হ্যাঁ।”

“আপনার কাছে আসামিরা কখনো কিছু গচ্ছিত রেখেছিল?”

“দু-তিনবার রেখেছিল।”

“কি?”

“কাগজপত্র।”

পাবলিক প্রসিকিউটর কতগুলো ইস্তাহার পুলিশের কাছ থেকে নিয়ে স্ত্রীলোকটির চোখের কাছে রেখে জানতে চাইলেন, “এগুলো?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি জান এগুলো কী? “

“ওরা বলেছিল এগুলো খুব গোপন দরকারি কাগজপত্র।”

“তুমি পড়তে পার?”

পাবলিকব প্রসিকিউটর সহজেই ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে এসেছিলেন সাক্ষীকে প্রশ্ন করতে করতে।

“না।”

“আসামিরা বলেছিল এগুলো গোপন?”

“হ্যাঁ।”

আসামিপক্ষের উকিল আপত্তি করলেন। বিচারক আপত্তি গ্রহণ করলেন না।

“তুমি রাখতে রাজি হয়েছিলে কেন?”

“আমাকে একশো টাকা দিয়েছিল।”

“এগুলো পুলিশের হাতে গেল কী করে?”

“পুলিশ আমার ঘরে এসেছিল, আমিই পুলিশকে দিয়েছিলাম।” আসামিপক্ষের জেরা করেছিলেন কলকাতা থেকে আসা এক নামকরা অ্যাডভোকেট।

“আচ্ছা জবা দেবী, পলাশ মানে কী জানেন?”

“পলাশ মানে পলাশ ফুল।”

“তুফান?”

“তুফান মানে—ঐ যা প্রতি বছর হয়ে থাকে। ঝড়, বৃষ্টি, বাতাস।”

“হিমালয় মানে জানেন?”

“না।”

“কখনো শুনেছেন নামটা?”

“না।”

“প্রথম কার মুখে শুনলেন?”

“পুলিশের মুখে।”

“পলাশ আর তুফান কথা দুটোও তো তাই?”

“হ্যাঁ।”

“কথাগুলো পুলিশই আপনাকে শিখিয়েছিল, তাই না? আপনি বেশ বুদ্ধিমতী, চটপট শিখে নিয়েছিলেন।”

জবা দেবী প্রশংসা শুনে হাসলেন।

“আসামিদের নাম পুলিশই আপনাকে বলে দিয়েছিল, তাই না?”

“না, আসামিরাই বলেছিল।”

“জবা দেবী, আপনার খদ্দেররা নিজেদের নাম বলে?”

“বলে।”

“আর কয়েকটা নাম বলতে পারেন?

“মনে নাই।”

“কিন্তু এ নাম তিনটে তো খুব মনে আছে। এটা কী করে হলো?” জবা দেবীর কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে।

“পুলিশ বারবার বলে শিখিয়ে আপনাকে মুখস্থ করিয়েছে, তাই না?”

জবা দেবীর কপাল থেকে ঘাম ঝরছে।

“দেখুন জবা দেবী, এই আসামিরা যুবক। এদের মা বোন আছেন, বাবা আছেন, এরা কেউ বিয়ে করেনি। আপনার সাক্ষ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে এরা মদ খায়, চুরি-ডাকাতি করে, বেশ্যা বাড়ি যায়, মানে, এরা খুব বদ ছেলে। আপনি এদের সবার দিকে পরিষ্কার করে তাকিয়ে দেখুন। এরা কি বদ ছেলে বলে মনে হয় আপনার?

জবা দেবী আসামিদের মুখের পানে তাকাতে পারছেন না। মাথা নিচু করে আছেন।

“আচ্ছা, জবা দেবী, আপনার ব্যবসায়ে পুলিশদের সর্বদা খুশি রাখতে হয়। তাই না?”

“হ্যাঁ, আমরা সবাইকে খুশি রাখতে চেষ্টা করি।”

“কিন্তু পুলিশদের তো খুব ভয় করেন আপনারা, তাই না-কি? পুলিশ আপনাদের কারণে অকারণে ধরে নিয়ে যায়। এসব এড়ানোর জন্য পুলিশকে মাসে মাসে টাকা দিতে হয় আপনাকে। আমি কি ভুল বলছি?”

জবা দেবী চুপ করে রইলেন।

ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ করলেন, “প্রশ্নের জবাব দাও।”

অ্যাডভোকেট বললেন, “ইয়োর অনার, ইনি বেশ্যা হতে পারেন, তবুও স্ত্রীলোক। এঁর মানসম্মান, লজ্জা, সরম আছে। আমাদের পণ্ডিতেরা বলেছেন, ‘মৌনং সম্মতি লক্ষণম’।”

অ্যাডভোকেট বললেন, “এ মাসে পুলিশ আপনাকে পাকড়ে হাজতে রেখেছিল। রাখে নি?”

“রেখেছিল।”

“আর কাকে? আপনার সঙ্গে যেসব বেশ্যারা এসেছেন তাদেরও তো?”

“আমি জানি না।”

“কিন্তু পুলিশ দাবি করছে, আপনাদের ঘরে ভীষণ বিপদকারী স্বদেশি যুবকরা আসে, স্ফূর্তি করে, গোপন কাগজপত্র রেখে যায়, সে জন্যে অনেক টাকা দেয়। আপনাকে তাই বলেনি?”

“বলেছিল।”

“আপনাকে ভয় দেখান নি, যদি আপনি পুলিশদের শেখানো কথা সাক্ষীতে না বলেন আপনার ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে, আপনাকে জেলে পাঠানো হবে?”

“না।”

“সহসা সারা আদালত কাঁপিয়ে কলকাতার অ্যাডভোকেট ভীষণ চড়া গলায় পৃথিবীর সবটুকু ক্রোধ ও হিংসা টেনে এনে জবা দেবীর একেবারে মুখোমুখি হয়ে গর্জে উঠেছিলেন, “সত্যি কথা বলুন, মিথ্যা বললে পাপ হবে আপনার। এতগুলো যুবকের জীবন নিয়ে মিথ্যে খেলবেন না। আপনি নারী। আপনার নিজেরও একটি ছেলে আছে। সত্যি কথা বলুন। আদালতে সর্বদা সত্যি বলতে হয়। আপনি ধর্মসাক্ষী করে সত্যি ছাড়া আর কিছু বলবেন না কবুল করেছেন। বলুন আমি যা বলেছি তা সত্যি কিনা?”

জবা দেবী এবার একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলেছিলেন, “সত্যি।”

.

আদালতে দারুণ চাঞ্চল্য। সরকারপক্ষের উকিলরা উত্তেজিত, পুলিশরা ক্রুদ্ধ।

অ্যাডভোকেট বললেন, “জবা দেবী আসামিদের দিকে তাকান। “ জবা দেবী চোখের জল মুছে তাকালেন।

“হিমালয় কার নাম বলুন তো?”

“কী নাম?”

“হিমালয়।”

জবাদেবী তখন সব শেখানো নাম ভুলে গেছেন। বললেন, “জানি না।”

অ্যাডভোকেট মশাই আদালতকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “ইয়োর অনার, এসব সাক্ষীকে পুলিশের মাধ্যমে মিথ্যে শেখানো হয়। আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই।”

বিচার একসঙ্গে পনেরো দিন চলছিল। একমাস পরে এসডিও সুশীল চট্টোপাধ্যায় ‘রায়’ ঘোষণা করেছিলেন। চারজন আসামিকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে মুক্তি দিয়েছিলেন। বাকিদের পাঁচ বছর থেকে আট বছর সশ্রম কারাদণ্ড। ‘রায়ে’ যুবক সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্ত্রাসবাদ প্রবেশ করার জন্য প্রচুর ক্ষেদ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রত্যেক স্কুলের কর্তৃপক্ষকে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। এসডিও ভয় দেখিয়েছিলেন, এ সন্ত্রাসবাদের অঙ্কুরগুলো এখনই উৎপাটিত না হলে সরকারকে ভাবতে হবে স্কুলগুলোকে চালু রাখা হবে কি না।

আসামিপক্ষ থেকে আপিল করা হলো সেসন্‌স কোর্টে। বিচারক ছিলেন শৈবাল গুপ্ত। বিখ্যাত মানুষ। আইসিএসদের মধ্যে যাঁরা কিছুটা স্বাধীনমনা, তাঁদের প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগে সরিয়ে দেওয়া হতো। বাঙালিদের মধ্যে যাঁরা বিচারের স্বাধীনতায় সারা দেশের শ্রদ্ধাভাজন হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্নদাশঙ্কর রায় ও শৈবাল গুপ্তের নাম প্রথম পঙ্ক্তিতে। অন্নদাশঙ্কর একই সঙ্গে স্বাধীন বিচারক ও লেখক হিসেবে আমাদের কৈশোরেই নাম করেছিলেন। আমি তার ‘দেশে বিদেশে’ পড়ে বিমুগ্ধ হয়েছিলাম। পরবর্তী জীবনে অন্নদাশঙ্করের সঙ্গে কিছুটা পরিচয় হবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমি।

শৈবাল গুপ্ত পুরো মামলাটাকে ডিসমিস করিয়ে দিয়েছিলেন। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সুশীল চট্টোপাধ্যায়, অনুসন্ধানী পুলিশ, গণেশপুর হাই স্কুলের বোর্ডের চেয়ারম্যান, জমিদার বাড়ির ছোট চৌধুরী : কেউ তাঁর থেকে রেহাই পাননি। এতগুলো যুবকের নীবন বয়সকে এভাবে ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়ার জন্য পুলিশ কর্তৃপক্ষ তাঁর “রায়ে’ ধিকৃত হয়েছিল। শৈবাল গুপ্তের ‘রায়’ সারা বাংলাদেশে তীব্র চাঞ্চল্য এনেছিল। ‘আনন্দবাজার, ‘অমৃতবাজার’ তো বটেই, ইংরেজ শক্তির মুখপাত্র ‘স্টেটসম্যান’ ও ‘টাইমস্ অব ইন্ডিয়া’তেও পুলিশ নিন্দিত হয়েছিল এ ধরনের একটা প্রচ্ছন্ন মিথ্যে কেস তৈরি করার জন্য। শুধু হার্ড লাইন ‘ক্যাপিটাল’ সাপ্তাহিক শৈবাল গুপ্তকে বিচারকের সীমা ‘অতিক্রম করার’ জন্য সমালোচনা করেছিলেন। ‘ক্যাপিটাল’ কট্টর সাম্রাজ্যবাদী সাপ্তাহিক। সম্পাদের নাম টাইসন। পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, পুলিশ ভুল করেছে নিশ্চয়ই। এ কেসটা তৈরি করা ঠিক হয়নি। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের বিষ যে ক্রমে ক্রমে তরুণ-যুবক মানসে ঢুকে গেছে এর প্রমাণ রয়েছে অনেক। অতএব জজ্ গুপ্ত পুলিশ ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটকে অত তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করে বিচারের সীমানা উৎরে রাজনীতির সীমানায় প্রবেশ করে ফেলেছেন।

এ মামলা গণেশপুরকে আরও একবার বঙ্গবাসীর মানসপটে চিহ্নিত করে দিল। প্রথমবার বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে রজনীকান্তের ভূমিকা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *