পিতা পুত্রকে – ২২

বাইশ

হঠাৎ জীবনটা বদলে গেল। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠল, কোথায় পড়ব? প্রেসিডেন্সি না স্কটিশ, সরকারি বৃত্তিভোগীদের বেতন দিতে হয় না। কিন্তু শীঘ্রই আমার বাসস্থানের প্রয়োজন হবে। কাকিমারা চলে যাবেন পাঞ্জাবে। থাকতে হবে হোস্টেলে। বাবা দ্বিতীয় পত্রে পুনরায় আদেশ দিলেন সাহেবদের কাছে পড়তে। আগেই বলেছি ইংরেজ ভক্তিতে বাবার সমতুল আর খুব বেশি লোক দেখতে পেতাম না, অথচ জীবনের এমনই পরিহাস, এই নির্বিচার ইংরেজ ভক্ত মানুষটিকে যৌবনে জেলে যেতে হয়েছিল একমাত্র তাঁর পিতা রজনীকান্তের রাজনীতির কার্যকলাপের পুরস্কার হিসেবে।

খবর নিয়ে জানতে পারলাম প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ে সাধারণ ধনী পরিবারের ছাত্র। তখনও ছাত্রীদের ভর্তি হবার ব্যবস্থা ছিল না। হোস্টেলে বিনা পয়সায় থাকবার সুযোগ মিলবে না। ধনী ঘরের ছাত্র আমার কাছে অপরিচিত বিভীষিকা। সমস্ত কলকাতা শহরটাও এক প্রকাণ্ড বিভীষিকা, তার কাছে আমি ক্ষুদ্র, নগণ্য, নিশ্চিহ্ন। কোনো বড় দোকানে ঢোকার মতো সাহস আমার নেই। আমি সবেমাত্র স্যান্ডেল পরতে শুরু করেছি। আমার দেহে-মুখে গ্রামীণতা সুস্পষ্ট। বিদ্যাসাগর কলেজে এক বন্ধুর বন্ধু ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। তার সঙ্গে পরিচয় হলো। কোথাও কিছুই মিলল না। সে ভক্তি দাসগুপ্ত নয়। সে সুবল মিত্র নয়, যে পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল। সে অন্য শ্রেণির অন্য জাতের মানুষ। ইংরেজি মাধ্যমিক স্কুল থেকে পাস করেছে। মনে হলো সাহেবদের মতো ইংরেজি বলে। মনের ভেতর গুঞ্জরিত হলো, “আমার এ পথ তোমার পথের থেকে গেছে বেঁকে।”

অতএব স্কটিশে গিয়ে হাজির হলাম। বীডন স্ট্রিটের বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটা পথ—হেঁদুয়াপুকুর পার্কের পাশে হলদে রঙের একটা বাড়িতে স্কটিশ চার্চ কলেজ। হেঁদুয়ার অন্য প্রান্তে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটের উপর মেয়েদের জন্য বেথুন কলেজ। অ্যাডমিশন প্রার্থী হয়ে এক সাহেব অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে হলো। তিনি আমার সঙ্গে করমর্দন করে বললেন, “আমার নাম প্রফেসর গ্রে। তুমি স্কটিশে ভর্তি হতে চাও? তোমার দরখাস্ত ও মার্কসিট দেখাও।”

কাগজ পত্র দেখে বললেন, “আমরা নিশ্চয়ই তোমাকে ভর্তি করে নেব। ইংলিশ অনার্সও পাবে। আমি ইংরেজির অধ্যাপক।”

আমি বললাম, “আমার হোস্টেল চাই। টাকা দিয়ে হোস্টেলে থাকবার মতো অবস্থা নয়। বাবা স্কুল শিক্ষক, আমার আরও তিনটি ভাই-বোন আছে।”

গ্রে সাহেব বললেন, “তোমার হোস্টেলে থাকতে টাকা লাগবে না। অফিসে গিয়ে কাগজপত্র সই করে নাও।”

দু’দিন পরে অফিস থেকে একখানা চিঠি নিয়ে এক পেয়াদা ২৯ নম্বর বীডন স্ট্রিটে হাজির। স্কটিশ কলেজে আমার ডাক পড়েছে।

প্রথমবারেও প্রিন্সিপ্যালের ঘরে গিয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল অধ্যাপক গ্রেই প্রিন্সিপ্যাল। এবার তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে “গুড মর্নিং স্যার” বলে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

তিনি বললেন, “বস।”

মিনিট তিনেক পরে আমার দরখাস্তের পাতাগুলো উল্টে পাল্টে দেখে বললেন, “ফ্রি হোস্টেল দেওয়া সম্ভব হবে না।”

আমি বললাম, “কাল আমি অধ্যাপক গ্রে-র সঙ্গে দেখা করেছি, তিনি তো বলেছিলেন সম্ভব হবে।”

আমার কাছে এই প্রথমবার নয়, তার পরেও বহু বছর, সব সাদা মুখ এক রকম দেখাত। প্রথম দৃষ্টিতে সাহেবদের মধ্যে ব্যক্তিক প্ৰভেদ হঠাৎ বুঝতে পারতাম না। অধ্যাপক গ্রে হেসে উঠলেন, বললেন, “আমিই প্রফেসর গ্রে, তুমি আমার কাছে এসেছিলে। তোমাকে বলেছিলাম ফ্রি হোস্টেল দেওয়া সম্ভব হবে, কিন্তু কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে।”

আমি বললাম, “তাহলে আমার স্কটিশে পড়া সম্ভব হবে না। বিদ্যাসাগর কলেজে আমি শুধু ফ্রি হোস্টেল নয়, পনেরো টাকা স্কলারশিপও পেতে পারি।”

“তবে এখানে এসেছ কেন?”

“আমার পিতৃদেব লিখেছেন, ইংরেজ অধ্যাপকদের কাছে পড়লে ভালো শিক্ষা পাওয়া যায়, ইংরেজিতে দখল বাড়ে।”

অধ্যাপক গ্রে আবার হেসে উঠলেন, “আই হোপ ইয়োর ফাদার ইজ রাইট। তিনি কি সাহেবদের কাছে পড়েছিলেন?”

“না। কিন্তু আমার ঠাকুরদা ইংরেজিতে খুব ভালো বক্তা ছিলেন, যদিও তিনি স্কুল পাস করেননি।”

অধ্যাপক গ্রে বললেন, “ঠিক আছে, তোমাকে নিজের দায়িত্বে হোস্টেল ফ্রি করে দিচ্ছি। তুমি টমোড়ি হোস্টেলে থাকবে, আমি ওখানে সুপারিনটেন্ডেন্ট। কলেজে আপত্তি করলে তোমার হোস্টেল ফি আমি দিয়ে দেব।”

অধ্যাপক মার্কাস গ্রে আমার জীবনের প্রস্তুতির জন্য প্রথম শক্ত সেতু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *