পিতা পুত্রকে – ১৬

ষোলো

রায় বাহাদুর বলদাস নাগ খুলনার বৃহত্তম জমিদারদের একজন। তাঁর রাজনৈতিক প্রভাবও অনেক। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান। জিলা ম্যাজিস্ট্রেটের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পরামর্শক। জাস্টিস অব পিস। জিলা এডুকেশন বোর্ডের সভাপতি। খুলনা যশোহর জমিদার সমিতির ভাইস-প্রেসিডেন্ট। বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের মনোনীত সদস্য। কলকাতায় গভর্নর সাহেবের বাড়িতে বছরে দু-তিন বার তিনি পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়ে আসেন। গভর্নর যখন জিলা পর্যবেক্ষণে বেরোন, খুলনায় পদার্পণ করলে রায়বাহাদুর বলদাস নাগ, আরও কতিপয় ঢাউস ব্যক্তিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে, তাঁকে রেল স্টেশনে অভ্যর্থনা করেন। তিনি জিলা সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসলে নিমন্ত্রিতদের মধ্যে প্রথম পঙ্ক্তিতে দেখা যায় রায়বাহাদুর বলদাস নাগকে।

এত প্রভাবশালী অর্থবান মানুষ সাধারণত যেমন হয়ে থাকে, রায়বাহাদুর বলদাস নাগও তাই। এর বেশি বাবা আমাকে প্রথম কিছু বললেন না। তিনি দয়া, সহানুভূতি বর্জিত নন, আমার নিষ্ঠুরতা, কঠোর শাসন, প্রয়োজনে ব্যবহার করে থাকেন! তাঁর কথাই আইন ও নিয়ম। কত সব প্রতিষ্ঠান-মঞ্চের তিনিই শিরোমণি। কঠোর হাতে তিনি অবাধ্যদের বাধ্য করেন। প্রতিদ্বন্দ্বীদের পাখা কেটে দেন। আঠারোজন লাঠিয়াল নিয়ে তৈরি তাঁর নিজস্ব রক্ষী বাহিনী। এরা প্রজাদের বশে রাখে। খাজনা আদায় করে। ষড়যন্ত্রকারীদের করে শায়েস্তা, প্রতিদ্বন্দ্বীদের দেয় না পা বাড়াতে। এদের কার্য কর্মের বিধি—নিয়ম নেই। ভয় দেখানো, ভয় শেখানো, এদের প্রধান কাজ। রায়বাহাদুর বলদাস নাগ জানেন, ক্ষমতায় থাকতে হলে ভয়ের পাত্র হওয়া বিশেষ দরকার।

রঘু আমাকে মুনসিজীর ঘরে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। আমি ঘরে ঢুকেই বুঝতে পারলাম আমাকে বাবা অতক্ষণ বাইরে দাঁড় করিয়ে কী কাজ করছিলেন। ঘরটা মাঝারি সাইজের। মুনসি মানে রায়বাহাদুরের হিসাব রক্ষক। তার দখলে ঘরের অর্ধেকটা। সেখানে একটা অনেক পুরোনো টেবিল, সঙ্গে চেয়ার। আর দুজন কেরানির জন্য, মনে হলো। ঘরটা রোজ একবার ঝাড়ু দিলেও ভীষণ ময়লা। দেয়ালে পানের পিক। আরও অনেক কিছুর দাগ। মাকড়সার জাল জুড়ে রয়েছে দেওয়ালগুলো অনেক মাকড়সা ঘুরে বেড়াচ্ছে বা জালবদ্ধ হয়ে ঝুলছে। ছাতের কোণে কোণে জমে রয়েছে বহু বছরের জটপাকানো ঝুল।

ঘরের বাকি অংশ আমার পিতৃদেবের। একটা কাঠের তক্তপোষ। তার ওপর তোষক। চাদর দিয়ে বিছানা পাতা। মশারি টানানোর দড়ি দেওয়ালে পেরেক পুঁতে। মশারিটা এখন উপরে গোটানো। বাবা সারা ঘরটাকে যথাসাধ্য সাফ করে নিয়েছেন। অন্তত মেঝের নোংড়া এখন পরিষ্কার। একটা ট্রাঙ্ক খাটের নিচে। তার পাশে আমার টিনের বাক্সও। আমার বিছানাটা বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে একটা চেয়ারের ওপরে। দেখলাম একটা নতুন মাটির কুজো। জলে ভরা। চকচকে পরিষ্কার কাচের গেলাস।

রোদ গরম ছড়াচ্ছে। বেলা কতটা হয়েছে জানবার উপায় নেই। বাবার ঘড়ি নেই। আমার তো নেইই। ঘরের দেওয়ালে একটা পুরোনো ঘড়ি বহুকাল বন্ধ হয়ে রয়েছে। আমার শরীর স্নান করে, জামাকাপড় বদলে, গা ছেড়ে ঘুমোবার জন্যে অস্থির।

বাবা বললেন, “ভালো করে খেতে দিয়েছিল তো?” আমি বললাম, “খুব ভালো করে।”

“একা একাই খেতে হলো তোকে?”

“না। বড়মা সামনে বসে খাওয়ালেন।”

শুনে বাবা খুব খুশি হলেন মনে হলো। মন থেকে একটা ভার নেমে গেল।

“কথাবার্তা হলো?”

“অনেক। বাড়ির কথা খুঁটিয়ে জেনে নিলেন। কোন্ কলেজে পড়ব জানতে চাইলেন। কলকাতায় কার কাছে থাকব, তাও।”

বাবা একটু ইতস্তত করে বললেন, “এই নাগেরা আসল সদগোপ। খুলনা যশোহরে সদগোপেরা বর্ধিষ্ণু, সুন্দর। এককালে এরা বঙ্গের বারো ভূঁইয়াদের লাঠিয়াল ছিলেন। কেউ কেউ তাদের সর্দার।

আমি বললাম, “বড়মা দেখতে খুব সুন্দর। আমার চোখে দুর্গা প্রতিমার মতো মনে হচ্ছিল।”

বাবা বললেন, “জাতে আমরা ওঁদের থেকে অনেক উঁচু। তুই কি ওঁকে প্রণাম করলি?”

আমি বললাম, “হ্যাঁ, ওকে দেখবার সঙ্গে সঙ্গে প্রণাম করতে ইচ্ছে হলো।”

“রাত্রে বলদাস নাগ মশাই ওঁদের সঙ্গে আমাদের আহারের নিমন্ত্রণ করেছেন। নাগ মশাইকেও প্রণাম করবি?”

“আপনি কী বলেন?”

“আমি ভাবছিলাম, প্রণাম করাই উচিত হবে। ষাট বছর পেরিয়ে গেছে নাগ মশাইয়ের। ক্ষমতাবান লোক। তাছাড়া-”

আমি আর বাবাকে এগোতে দিলাম না। বললাম, “বেশ তো, প্রণাম করব।” একটু পরে নিচু গলায় বললাম, “জাত-পাত আমি মানি না।”

কথাটা হয়তো পিতৃদেবের পছন্দ হলো না। তিনি চুপ করে গেলেন। আমি বলদাস নাগকে প্রণাম করতে রাজি হয়ে তাঁর মনের একটা ভার লাঘব করে দিলাম।

বাবা এবার তাঁর সঙ্গে তিন দিন থাকবার সিদ্ধান্ত জানালেন। আমি আগেই খবরটা বড়মার মুখে শুনেছিলাম। এখন জানলাম বাবা কাকামণিকে লিখে দিয়েছেন। খুলনায় এসে পৌঁছানোর তৃতীয় দিবসে ট্রেনে চেপে আমি কলকাতায় যাচ্ছি। শিয়ালদা স্টেশনে আমাকে যেন কেউ ‘মিট’ করে। শুনলাম তাঁর বাসগৃহের একটু দূরে যে পায়খানা আছে, আমাকে তাই ব্যবহার করতে হবে। কাঁচা পায়খানা, ফ্ল্যাস নেই, রোজ মেথর এসে সাফ করে দেয়। বাবা নদীতে স্নান করেন, আমাকেও তাঁর সঙ্গে যেতে হবে। এখন আমরা স্নানের জন্যে তৈরি হব। আমি পায়খানা যেতে পারি। দুজনে একসঙ্গে নদীতে স্নান করব। বাবা আরও বললেন, আজকের দিনটা তিনি ছুটি নিয়েছেন। অপরাহ্নে আমাকে স্কুলে নিয়ে গিয়ে হেড-মিস্ট্রেসের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবেন। তিনি দেখতে চেয়েছেন আমাকে। ওখান থেকে আমাকে নিয়ে তিনি বাজার যাবেন। আমার কিছু জামাকাপড়, চামড়ার জুতো কিনতে। পরে আমাকে নিয়ে আর এক রায়বাহাদুরের বাড়ি। ইনিও ‘নাগ’। এ বাড়িতে বাবা টিউশনি করেন সকাল বেলা।

এই দ্বিতীয় রায়বাহাদুরের নামটা আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে এঁর সঙ্গে বলদাস নাগ রায়বাহাদুরের আদা-কাঁচকলা সম্পর্ক।

তারপর সামান্য ইতস্তত করে বাবা বললেন, “আর একজন তোকে দেখতে চাইছে। আমার অনেক পুরোনো ছাত্রী। বাংলা পড়ায় যশোহর কলেজে। হিন্দু মেয়ে। বাপ মায়ের আপত্তি অগ্রাহ্য করে এক মুসলমানকে বিবাহ করেছে। আমার সঙ্গে বহুদিন যোগাযোগ নেই। হঠাৎ সেদিন স্কুলে এসে হাজির। কোথা থেকে শুনেছে তুই খুলনা হয়ে কলকাতা যাচ্ছিস। বাংলায় লেটার পেয়েছিস এ খবরও জানে। বলল, তোর সঙ্গে দেখা হলে খুব খুশি হবে।”

আমি বললাম, “বেশ তো, আমি কিছু শিখতে পারব।”

বাবা আমার এ জবাব আশা করেননি। চুপ করে গেলেন। পরে বললেন, “কাছেই থাকে। সোজা রাস্তা এখান থেকে। গান্ধী পার্কের বাঁ দিকে। তোকে একাই যেতে হবে। আমার সন্ধেবেলা টিউশনি আছে।”

আমি বুঝতে পারলাম, যে হিন্দু মেয়ে মুসলমান বিয়ে করেছে বাবা তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে নারাজ।

বললাম, “সময় যদি থাকে আমি একাই যেতে পারব।”

বাপ-বেটায় আমরা নদীতে স্নান করতে গেলাম। বাবা অঙ্গার ও পোড়া তামাক পাতার গুঁড়ো একত্র করে দাঁত মাজার পাউডার তৈরি করে রেখেছেন। তারই একটু নিয়ে দাঁত মাজলেন। ধুতি ও সার্ট আমি সঙ্গে নিয়ে নিলাম। এবং আন্ডারওয়ার। কাপড় কাচার সাবানও। বাবা নিলেন ধুতি, একটা ধোওয়া ফতুয়া, সাবান। মাইলখানেক হেঁটে ভৈরব তীরে স্নানের ঘাট। পথে আমাদের মধ্যে অনুচ্চারিত অনেক কথা হলো। আমি বাবাকে নিঃশব্দে প্রশ্ন করলাম, এই বিশ্রী নোংরা ছোট্ট ঘরে আপনি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বাস করেন কী করে? এখন গ্রীষ্মেও তো হাঁপানি আপনাকে পুরোপুরি ছেড়ে দিচ্ছে না! সকাল সন্ধ্যায় টিউশনি করেন, ছয় ঘণ্টা স্কুলে ছাত্রী পড়ান। তার ওপর রবিবার ও অন্যান্য ছুটির দিনে স্কুলে পরীক্ষার খাতা বাঁধা থেকে হেড মিস্ট্রেসের চিঠিপত্র লিখে দেওয়া : এমন একটানা পরিশ্রম করে আপনি আমাদের মানুষ করছেন। মুখে শুনেছি, এখন চোখে দেখছি। কিন্তু না পারছি বিশ্বাস করতে, না পরিস্থিতি পুরোপুরি বুঝতে আপনার জীবনে কি কোনো আনন্দ নেই? এখন তো ‘টকি’ সিনেমা এসেছে, দেখছেন কি একটাও? নাটক দেখতে যান টাউন হলে? আপনি তো জেল খেটেছেন বিপদজনক যুবকদের মতো, ইংরেজদের কৃপায়? এখন কোনো রাজনীতি আছে আপনার? মার চিঠিগুলো কি আপনি যত্ন করে রেখে দেন? স্কুলে তো অনেক মহিলা শিক্ষক, কারুর সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে আপনার? পুরুষ বন্ধু আছে ক’জন? তাঁদের সঙ্গে আড্ডা দেবার সুযোগ পান? নাগেদের বাড়িতে আপনাকে ভালো করে খেতে দেয়?

বাবা আমাকে নীরবে কী সব প্রশ্ন করেছিলেন আমি আন্দাজ করবারও চেষ্টা করিনি। প্রথম সন্তান, কলেজ যাবার মুখে পুত্রকে দেখে তিনি সন্তুষ্ট, না আশাহত? মনে পড়ল, আমি ভালো পাস করেছি এ জন্য অভিনন্দন দেওয়া তো দূরের কথা, ঘটনার উল্লেখ পর্যন্ত করেন নি বাবা। অথচ খুলনা শহরে সম্ভবত এমন একজনও নেই যার কাছে খবরটা অজানা। নিশ্চয়ই এঁরা গেজেট খুলে খবর সংগ্রহ করেনি। গেজেটে রোল নাম্বারের সঙ্গে নাম উল্লেখ থাকে কিনা তাও আমার জানা নেই। তবে হ্যাঁ, আনন্দবাজারে আমার নাম বেরিয়ে ছিল বটে।

ভৈরবে স্নান করে খুব ভালো লাগল। বাবা সাঁতরে কিছুটা দূরে চলে গেলেন তট থেকে। আমার গণেশপুরের পুকুরে স্নানের অভ্যেস, পদ্মায় স্নানের কথাই ওঠেনি কোনোদিন। আমি তটের কাছাকাছি ডুব দিলাম, সাঁতার কাটলাম। স্নানের শেষে বাবা বিড়বিড় করে মন্ত্র উচ্চারণ ও আমার অজ্ঞাত কোনো দেব বা দেবীকে প্রণাম করলেন। নিশ্চয়ই মা কালীকে, আমরা সবাই জানতাম তিনি কালীভক্ত।

রায়বাহাদুর নাগ মশাইয়ের বাড়ি ফিরবার পথেও বাক্য বিনিময় হলো না।

বাপ ছেলের গল্প করা তখনকার শাস্ত্রে ছিল নিষিদ্ধ। ফিরে এসে কাপড় পরে দুজনে বসে আছি। বেশ গরম, আমাদের দেহ ঘামে ভিজে গেছে। গণেশপুরে বাড়ির দক্ষিণে হাওয়া বইত সর্বদা, এখানে তা নেই। মুনসিজীর ঘরের দেওয়ালে জানলা মাত্র দুটি, তাও আকারে ছোট।

সেই রঘু এসে জানতে চাইল আমরা ভেতরে গিয়ে খাব কিনা।

আমি বাবাকে বললাম, “আমার পেট ভরা। দুপুরে খাওয়ার মতো জায়গা নেই।” বাবা রঘুকে বললেন, তিনি একাই খাবেন। নিজের ঘরেই খাবেন।

আমার এতক্ষণে খেয়াল হলো মুনসিজী বলে তো কাউকে দেখতে পেলাম না। ঘরের অন্য অংশটা একেবারে খালি!

জিজ্ঞেস করতে বাবা বললেন, “রায়বাহাদুর পত্নীর আদেশে তিন দিন মুনসি ও তার দুই সহায়ক অন্যত্র কাজ করছে। আমি আসছি তাই পুরো ঘরটাই আমাকে ও বাবাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

বাবার জন্য আহার এল। থালায় ভাত, তরকারি, মাছ, ডাল। মেঝেতে কুশান পেতে বসলেন বাবা। গণ্ডুস করলেন, পরে আহার। ঘুমে আমার চোখটা ভারী হয়ে এল। নিজের অজান্তেই বাবার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসতে এক মিনিটও লাগল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *