এক
পুত্র, তোমার যখন পঁচিশ বছর বয়স, তখন তুমি আমাকে, শুধু তোমার নয়, বিশ্বব্যাপী তোমাদের পুরো প্রজন্মের আত্মকাহিনি শুনিয়েছ। শুধু আমাকে নয়, আমার মতো পঞ্চাশ বছরের পৃথিবীজোড়া পিতা-প্রজন্মের সবাইকে, জানানোর জন্য পঁচিশ বছরের ছোট প্রজন্মের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছ।
আজ আমি, সত্তর-উত্তর বয়সে, আমার, তথা বিশ্বব্যাপী পিতৃ—প্রজন্মের কাহিনি লিপিবদ্ধ করছি তোমার ও তোমাদের সবার জন্য।
একদিন পুত্র পিতাকে করেছিল আহ্বান। সারা দুনিয়ার পুত্রদের জীবন-বাণী শোনবার জন্য। আজ পিতা আহ্বান করছে পুত্রকে, সারা পুত্র প্রজন্মকে। সত্তর-উত্তর পুরুষের কাহিনি শোনবার জন্য। সময়ের শেষহীন নদীর এপার ও ওপার পরস্পরকে নিজের কথা বলছে, তুলে ধরছে একই ধারাবাহিক ইতিহাসের দুই পারস্পরিক চালচিত্র। পুত্ৰ পিতাকে ও পিতা পুত্রকে এই দুই সেতুর নিচে প্রবাহিত হয়ে গেছে চুয়াত্তর বছরের ভারতবর্ষের ইতিহাস। এই ইতিহাসের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে প্রায় সারা দুনিয়া।
আমি যখন জন্মেছিলাম তখন ভারত; ছিল ইংরাজের কলোনি। তার শ্রেষ্ঠ ও সর্বোজ্জবল উপনিবেশ। “জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন”।
তুমি যখন জন্মালে তখন এই প্রাচীন দেশটাও নবজন্ম পেল রাজনৈতিক স্বাধীনতায়। এই দুই জীবনের পরিধির মধ্যে বিশ্ব—সাম্রাজ্যবাদের, আরও সঠিক করে বলতে গেলে বিশ্ব সাম্রাজ্যের, অপসরণ শুরু হলো।
এক প্রথিতযশা ইংরেজ ঐতিহাসিক বিংশ শতাব্দীর নাম দিয়েছেন “ছোট শতাব্দী”, দ্য শর্ট সেঞ্চুরি। ছোট, কেননা এই শতাব্দী একটার পরে একটা বিশাল ঘটনা, মানুষের উজ্জ্বলতম জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির আবিষ্কার, দুনিয়ার বৃহত্তর অংশে মানব সমাজের অভূতপূর্ব অগ্রগতি, সঙ্গে সঙ্গে দুই বিশ্বযুদ্ধ, দুই বিরাট সমাজ বিপ্লব এবং অবিশ্বাস্য সাংঘাতিক সংঘাতের জন্যে অভিনব, অভিনবতর, অভিনবতম মারণাস্ত্রের আবিষ্কার ও ব্যবহার, মানুষ যে কত নিষ্ঠুর নৃশংস রক্ত—পিপাসু হতে পারে তার ভয়াবহ বীভৎস প্রমাণের পরে প্রমাণ—সময়কে দীর্ঘ অবকাশে ধীরে চলবার সুযোগ দেয়নি।
তোমার প্রজন্মের কাহিনিতে ঘোষিত হয়েছিল নতুন যুব শক্তির বিদ্রোহ প্রাচীন অথচ সুপ্রতিষ্ঠিত সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে। তুমি জন্মেছিলে বাঙালি মধ্যবিত্ত পিতামাতার প্রথম সন্তান হয়ে মধ্যভারতের এক রাজধানী শহরে। শিশু বয়সেই তোমার ও তোমার বোনের জীবন মধ্যভারত থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় উত্তীর্ণ হবার আগেই তোমার যুবক জীবনে এসে গেল নিউ ইয়র্ক। তুমি মিশে গেলে সারা পৃথিবীর পদযাত্রার সঙ্গে। তোমার জীবনের বিদ্রোহ প্রতিবাদী হিপি-কালচারের পরে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে মার্কিন মুলুক জুড়ে, আন্দোলন, অবরোধ, প্রতিবাদের মাধ্যমে স্নাতকোত্তর।
প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ জীবন-বোধনকে ধারাল করে। মানুষের অনুভূতিগুলোকে করে চঞ্চল ও অন্বেষণী। প্রতিবাদ-বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ বুকে রেখে মানুষ নিজের হাতে তৈরি অবরোধ এড়িয়ে, অথবা অতিক্রম করে ঢুকে পড়ে জীবনের অন্দরমহলে। প্রতিবাদ ও বিদ্ৰোহ জীবন নামক পাঁচ-মহলের বাইরের প্রাঙ্গণে তার দৃপ্ত পদধ্বনি সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হয়।
কেবল বিপ্লবই পারে পাঁচ-মহলকে ভাঙতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় বিপ্লবের ভাঙন পাঁচ-মহলকে নিশ্চিহ্ন করে না। সময়-মাটির মধ্যে সুদীর্ঘ শিকড়ে আবদ্ধ মানুষের সমাজ। এ সমাজ কিছুতেই নিশ্চিহ্ন হবার নয়। অতএব ইতিহাসে আমরা কেবল দেখতে পাই পুরাতন-নতুনে আবহমান সংগ্রাম। যে সংগ্রামে পুরো জয় না নতুনের, না পুরাতনের। মিতালি ও বৈরীতার মধ্যে ঘটে এক দ্বন্দ্বমূলক বন্ধুত্ব।
আমি জন্মেছিলাম ইংরেজের ভারত সাম্রাজ্যের অন্যতম প্ৰদেশ বঙ্গদেশের অনেক গভীরে এক গ্রামে। এমন একটি ক্ষুদ্রতম তালুকদার পরিবারে যেখানে ভদ্রলোকের আত্মগরিমা তার সামান্য সম্পদকে স্পর্ধার সঙ্গে উপেক্ষা করে আত্মপ্রতিষ্ঠার চেষ্টায় কিছুটা জয়ী, অনেকখানি পরাভূত। দারিদ্র্য নামক হৃদয়হীন দস্যুর বিশাল কবলের অন্ধকারে কেটেছিল আমার পিতার জীবন, আমার বাল্যকাল ও যৌবনের বেশির ভাগ। পরে, ঘটনাচক্রে, আমি একদিন হয়ে গেলাম যাকে বলা যায় বিশ্বগ্রামীণ, গ্লোবাল ভিলেজার। শব্দটার প্রচলিত অর্থে নয়। পৃথিবীকে এখনও একক বিরাট গ্রামে পরিণত হতে বহু সময়, বোধহয় আর এক শতাব্দী, অপেক্ষা করতে হবে। আমার মধ্যে পনেরো বছর বয়স পর্যন্ত একটি গ্রাম্য যুবক একদিন বিশ্বনাগরিক হবার স্পর্ধা হজম করে যা হতে পারল তা হলো গ্রাম, শহর ও পৃথিবীর আর এক বহু সংবর্ণের পিণ্ড। তার গায়ে অনেক কাঁটা।
‘পুত্র পিতাকে’ ও ‘পিতা পুত্রকে’ বাপ ও ছেলের সম্পর্ক নিয়ে দুই সমান্তরাল গল্প নয়।
তুমি যা লিখেছ ও আমি যা লিখছি তা হলো এই সংক্ষিপ্ত শতাব্দীর সময় সমুদ্র দ্বারা তৈরি এক মহানদী থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা একটি ছোট নদীর দুই শাখা।
এবার শুরু হোক পিতৃ কাহিনি। পিতা বলুক পুত্রকে….
এখন যার নাম বাংলাদেশ, বহুদিন যার নাম ছিল পূর্ববঙ্গ, এবং তার মানুষদের বলা হতো ‘বাঙ্গাল’, সেই নদীবহুল ছায়াঘন বৃক্ষ-বন—সবুজ দেশের জনৈক গ্রাম গণেশপুর, তার ডাকসাইটে এক পুরুষের নাম রজনীকান্ত, তাঁর পুত্র দুর্জয় সিংহ, তস্য পত্নী ননীবালা, ননীবালার গর্ভে এক ভাদ্রশেষের রবিবারের মধ্যাহ্নে, ঘড়ির কাঁটা যখন ঠিক বারোটা ছুঁয়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য নিশ্চল, নিঃশ্বব্দ, তখন আমার জন্ম হলো, আমি এলাম। তারপর বাইবেল উক্ত তিনকুড়ি দশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল, কী ভীষণ ও চমকপ্রদ পরিবর্তনের বন্যায় পৃথিবী বার বার ঘূর্ণি খেল, কত কিছু কী নিদারুণভাবে বদলে গেল, কত কিছু কী কঠিনভাবে রয়ে গেল অপরিবর্তনীয়। ইতিহাস নামক দানব মানুষ ও পৃথিবী নিয়ে খেলে গেল এক শেষহীন বিচ্ছেদ-মিলন, ভাঙন-গঠন নিয়ে তৈরি অপার বিস্ময় খেলা। আমরা এককালের শিশু, বাল্য, কৈশোর, যৌবন, মধ্যবয়স অতিক্রান্ত হয়ে বার্ধক্যের ধূসর ভূমিতে উপনীত হলাম। তোমরা, আমাদের পুত্ররা, মধ্যবয়সে ভুঁড়ি, সবে—পাকা দাড়ি অর্জন করে জীবনের তথাকথিত সার্থকতা-ব্যর্থতার মিঠে-তেতো আস্বাদ জিভে নিয়ে চলেছ জীবনযাত্রার বহুমুখী পথে তোমাদের সন্তানরা নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন চোখে নিয়ে নতুন শরীর, নতুন মন নিয়ে জীবনের প্রথম আস্বাদ পেতে শুরু করেছে। এভাবে এগিয়ে চলেছে কালের মৃত্যুহীন স্রোতস্বিনী, “সীমা তো কোথাও নাই,—সীমা সে তো ভ্রম।”
পিতার কাহিনি পুত্রকে শোনাতে গিয়ে প্রথমে এবং পরিশেষে যে মহাসত্য, বুঝি প্রথম ও শেষ সত্য, অনুভব করছি, উপলব্ধির ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত থেকে, তার নাম ‘আমি’। আমি আছি বলেই সবকিছু আছে, আমার কাছে অর্থবহ হয়ে আছে, হয়ে আছে বার্তাবহ। উপনিষদেও ঐ একই বাণী ধ্বনিত হয়েছে— ‘অমোনাযাস্যমা হি তে সর্বমদং স হি জ্যৈষ্ঠঃ-’ আপনি ‘অম’ নামধারী, কারণ নিখিল জগৎ (প্রাণরূপী) আপনার মধ্যে বিদ্যমান। আপনি (অর্থাৎ আমি) জ্যেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ, দীপ্তমান ও অধিপতি…”
পুত্র, আমি কি তোমায় বোঝাতে পারছি কী অনুভূতি বেরিয়ে আসছে? পিতামহ, পিতা, পুত্র, আবার পুত্র, পিতা, পিতামহ : এই চলেছে জীবনের স্রোতস্বিনী— এখানে পিতা মানে মাতাও, পুত্র কন্যাও, পিতামহ অবশ্যি মাতামহীও। আমাদের শাস্ত্রে ঈশ্বরের অর্ধনারীমূর্তি কল্পিত হয়েছে, স্ত্রী-পুরুষের সমান ভূমিকা ও অধিকারের। এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি হতে পারে না, যদিও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সেই বৈদিক কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নারীদের দাবিয়ে রেখে এসেছে পুরুষ, যেমন ভারতবর্ষে তেমনি দুনিয়ার সর্বত্র, একমাত্র কতিপয় নারী শাসিত সমাজ ছাড়া।
পুত্রের কাছে পিতার জবানবন্দী করতে গিয়ে আমার বারবার মনে হচ্ছে আমরা, তুমি পুত্র, আমি পিতা, কত কাছে, কত দূরে। দূরত্ব ও নিকটত্ব কোনটা এই দুইয়ের অনিবার্য দ্বন্দ্বে জয়ী হয় তা নির্ভর করে পিতা পুত্রের দ্বৈত আদান প্রদানে। ‘প্রকৃতির পরিশোধে’ রবীন্দ্রনাথ পিতা ও সন্তানের যুগপৎ নৈকট্য ও দূরত্ব আকুলতার সঙ্গে ব্যক্ত করেছিলেন :
বালিকা : পিতা, পিতা, কোথা তুমি পিতা!
সন্ন্যাসী : (চমকিয়া) কে রে তুই!
চিনি নে চিনি নে তোরে, কোথা হতে এলি!
বালিকা : আমি! পিতা, চাও পিতা, দেখো পিতা
আমি!
সন্ন্যাসী : চিনি নে চিনি নে তোরে, ফিরে যা, ফিরে
যা!
আমি কারো কেহ নই, আমি যে স্বাধীন।…
[একটু পরেই ]
সন্ন্যাসী : আয় বাছা, বুকে আয়, ঢাল অশ্রুধারা!
ভেঙে যাক এ পাষাণ তোর অশ্রুস্রোতে।
আয়, তোরে ফেলে আমি যাব না বালিকা,
তোরে নিয়ে যাব আমি নতুন জগতে।
হে পুত্ৰ, তোকে আমি বুকে জড়িয়ে হাতে হাত, প্রাণে প্রাণ রেখে, নতুন জগতে নিয়ে যাবার স্বপ্ন পোষণ করেছি বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। নিয়ে যেতে পারিনি।
আমরা, এ শতাব্দীর পিতারা, গড়তে পারিনি নতুন জগৎ। আমাদের ব্যর্থতা এ সমগ্র শতাব্দীর সংঘাতসংকুল ইতিহাসের পাতায় পাতায় লিখিত রয়েছে।