পনেরো
বাবা একটা সাইকেল রিকশা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন। বাক্স বিছানা পায়ের নিচে রেখে প্রথম আমি, পরে বাবা তাতে চেপে বসলেন। বাবা গন্তব্যস্থান আগেই বলে রেখেছিলেন। শীর্ণদেহ মাঝবয়সী রিকশাওয়ালার সব ভারটা তুলতে কষ্ট হলো কিন্তু একবার তোলা হয়ে গেলে সে রিকশা চালিয়ে চলল, আমার মনে হলো না, তার আর কষ্ট হচ্ছে। এবার বাবা প্রথম কথা বললেন, “স্টিমারে কোনো কষ্ট হয়নি তো?”
আমি বললাম, “না, একটুও না।”
“বাড়ি থেকে দুবেলার খাবার দিয়ে দিয়েছিল?”
“হ্যাঁ। লুচি, তরকারি।”
“বাড়ির সব খবর ভালো?”
“ভালো। ভানুর পেটটা খারাপ যাচ্ছিল, সত্য কবিরাজের ওষুধ খেয়ে ভালো আছে।”
কথা শেষ। আমার পিতৃদেব ও আমি এর আগে কখনো পরস্পরের মধ্যে এতগুলো বাক্য বিনিময় করিনি। আমি রীতিমতো অস্বস্তি বোধ করছি। দনিজেকে বিব্রত মনে হচ্ছে। আমার মনে তখনও রাত্রির ভৈরব ঢেউ তুলছে। মাকে কাছে পেলে মন উজাড় করে কথা বলতাম। বাবাকে ও সব বলা যায় না।
তবু নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলে বসলাম, “জাহাজের সারেঙ লোকটা খুব ভালো। অনেক পড়াশোনা করেছে। আমাকে বুঝিয়ে দিল কী করে জাহাজ চালাতে হয়।”
বাবা বললেন, “ওরা চট্টগ্রামের মুসলমান। ভয়ঙ্কর লোক ওরা।”
“এ সারেঙ হিন্দু।”
“কী নাম?”
নামটা তো আমাকে বলেছিল। একটুও মনে নেই আমার। শুধু মনে আছে, “আমার আবার নাম কী! আমি জাহাজের সারেঙ। নাবিক। আমার আর কোনো পরিচয় নেই।”
বাবাকে বললাম, “বলেছিল, মনে করতে পারছি না।”
আবার দুজনে চুপ। পথ দেখছি অনেক দীর্ঘ। একটা চড়াই-এ এসে রিকশাওয়ালা সিট থেকে নেমে দুবাহু দিয়ে জোরে রিকশা টানতে লাগল। লোকটার সারা দেহ ঘামে ভিজে গেছে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে ছেঁড়া গেঞ্জি। মাথায় চুল নেই বললেই হয়। সব ঝরে পড়ে গেছে। আমার মনে হলো, আমাদের দুজনের নেমে যাওয়া উচিত। তাহলে রিকশার ভার কম হবে।
বাবা কি আমার মনে কথা শুনতে পেয়েছিলেন? নিজেই লোকটাকে বললেন, “দাঁড়া, আমরা নেমে যাচ্ছি। তুই রিকশাটা টেনে নিয়ে উত্রাইয়ে নিয়ে আয়। তখন আমরা আবার বসব।”
আমরা দুজনে নেমে পড়লাম।
পায়ে হেঁটে চলতে চলতে বাবার হঠাৎ মনে পড়ল, আমার হয়তো ক্ষিধে পেয়েছে।
প্রশ্ন করলেন, “সকালে কিছু খেয়েছিস? ক্ষিধে পেয়েছে?”
চড়াই উঠবার সময় বাবার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারলাম। বাবা সাংঘাতিক হাঁপানিতে ভোগেন। বুক থেকে শোঁ শোঁ শব্দ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে।
আমি তখন দরকার মতো মিথ্যে বলতে শিখে গেছি। নিজেকে রক্ষা করতে অনেক সময় মিথ্যে বলতে হয়। শত্রুর হাত থেকে শুধু নয়, নিকটতম প্রিয়জনের হাত থেকেও। বাবার কাশি আরম্ভ হলো। এ কাশি আর পরিচিত। দেখলাম একটু পরেই কাশি বন্ধ হয়ে গেল।
নিজেই বললেন, “গরমকালটা ভালোই থাকি, কষ্ট হয় শীতের মাসগুলো।”
আমি বললাম, “আপনি বিপিন সরকার নামে কাউকে চেনেন?”
স্মৃতির জঙ্গলে একটু খোঁজার চেষ্টা করে বাবা বললেন, “না।”
“এখানে মিউনিসিপ্যালিটির কেরানি। আমার পাশেই উনি বিছানা পেতে নিয়েছিলেন। মাসিমা আমাকে সকালে খাইয়ে দিয়েছেন।”
বাবা নীরব হলেন। উৎরাইতে রিকশার চেন পড়ে গেল।
আমি বললাম, “মিউনিসিপ্যালিটির খুব নিন্দে করলেন মাসিমা। কী যেন ‘নাগ’। বললেন, তার কুনজরে পড়ে ভদ্রলোকের উন্নতি হচ্ছে না।”
“কে বলল?”
“ওঁর স্ত্রী। মাসিমা।”
বাবা এবার একটু কঠিন স্বরে বললেন, “রায় বাহাদুর বলদাস নাগ। তাঁর বাড়িতেই আমি থাকি। ছেলেমেয়েদের পড়াই। খেতে থাকতে পাই। তোকেও ওখানেই নিয়ে যাচ্ছি।”
বুঝতে পারলাম অজান্তে নিষিদ্ধ স্থানে প্রবেশ করেছি। চুপ করে গেলাম। নীরব পিতা-পুত্রকে নিয়ে কিছুক্ষণ পর সাইকেল রিকশাওয়ালা একটা বিরাট দালান বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়াল। গেট বন্ধ। গেটের সামনে লাঠিধঘারী প্রহরী। বাবা ও আমি দুজনেই রিকশা থেকে নামলাম। বাবা সাইকেল রিকশাওয়ালাকে তার পাওনা দিয়ে দিলেন। ময়লা গামছা দিয়ে সে তার দেহ, মাথা মুছতে লাগল। বাবা প্রহরীকে বললেন, আমার বাক্স বিছানা ভেতরে নিয়ে যেতে। “আমার ঘরে রেখে দিও।”
রিকশাওয়ালা জল চাইল। বাবা তাকে দাঁড়াতে বললেন। গেটের পরেই বেশ বড় লন, ঘাসগুলো কিন্তু সবুজ নয়। অনেক রকম ফুলের গাছ লনের চার কিনারে। জমির ওপরেও তৈরি করা হয়েছে, এখন যাকে বলি ফ্লাওয়ার-বেড। লনের মাঝখানে ইটের পথ। বাবা একটু পরে রিকশাওয়ালাকে ডেনে লনের ওপর বিছানো দীর্ঘ পাইপের মুখটা তুলে ধরলেন। দুহাত পেতে পেট ভরে লোকটা জল খেল। তারপর সেলাম করে গেটের বাইরে গিয়ে সাইকেল রিকশায় প্যাডেল করতে করতে একটু সময়ের মধ্যে চোখের বাইরে চলে গেল।
গণেশপুরে, তোমার মনে পড়বে, দুখানা সাইকেল ছিল। দুটোই জমিদার বাড়ির। লোকেদের পায়ে হেঁটে দূরত্ব ভাঙতে হতো। অথবা জলপথে নৌকোয়। মানুষ ঘাড়ে, পিঠে, মাথায় বোঝা বইত। গরুর গাড়িও ছিল না। আমি অবশ্য ঢাকা শহরে সাইকেল রিকশা দেখেছি, চড়েছি। এই মুহূর্তে আমার মন শহর সম্বন্ধে বিরূপ হয়ে উঠল। মনে হলো গণেশপুর গ্রাম ঢাকা, খুলনা থেকে অনেক ভালো। মানুষ গ্রামে খাটে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে খাটে। কিন্তু শহরে তারা যেন পশু হয়ে যায়। গণেশপুরে আমাদের বাড়িতে কয়লার বস্তা মাথায় চাপিয়ে মুটে আসত। তারা জল চাইলে আমি বা আমার বোন মধু বলতাম, ছায়ায় একটু বসো। ঘরে গিয়ে মাটির কলস থেকে এক ঘটি জল ও কয়েকখানা বাতাসা এনে দিতাম মুটেকে। বাগান বা লনের পাইপ থেকে পানি পান করতে হতো না তাকে। বাবা পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ছুটিতে বাড়ি আসতে স্টিমার বন্দর থেকে। তিন ক্রোশ পথ। সঙ্গে বিছানা বয়ে আনত এক মুটে। পায়ে হাঁটার মধ্যে একটা মর্যাদা আছে, আত্মসম্মান আছে, এখন মনে হলো আমার। মানুষে টানা রিকশা বা সাইকেল রিকশা চেপে পথ অতিক্রম করার মধ্যে রয়েছে নিষ্ঠুরতা। পশুর কাজ করে পয়সা কামাতে হয় শহরে গরিবদের। স্টিমার বন্দরে অনেক ভিখিরি দেখেছিলাম। গণেশপুরে ভিক্ষা করত না কেউ। বাউলরা একতারা বাজিয়ে গান করতে আসত। আমরা বাড়ির প্রায় সবাই, বুড়োরা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যেতম গান শুনতে। কেউ কেউ পয়সা দিত। ফকির আসত আল্লাহ্ আল্লাহ্ উচ্চারণ করতে করতে। পরনে আলখাল্লা, গলায় নানবারকম পাথর। হার, ছোট্ট শাঁখের একরাশি মালা। লম্বা জট পাকানো চুল কাঁধ ছাড়িয়ে পিঠ পর্যন্ত নেমে এসেছে। দেখলে ভয় পেতাম আমরা ভাইবোনেরা। মা হয় নিজে, না হয় অন্য কাউকে দিয়ে দু’চার মুঠো চাল দিয়ে দিতেন ফকিরদের। আমরা তাদের ভিখিরি মনে করতাম না। মাঝে মধ্যে এক একটা লোক আসত পেটে ক্ষিদে নিয়ে। পুরো আহার দেবার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। কিন্তু খালি হাতে, পেটে ক্ষিধে নিয়ে তাদের আমরা দুর দুর করে তাড়িয়ে দিতাম না। হয় একটু চিঁড়ে, না হয় দু-চারটে মোওয়া, অথবা খানিকটা মুড়ি গুড়ের সঙ্গে দেওয়া হতো ক্ষুধার্ত মানুষকে। এবং এক ঘটি জল। একটা পাগল ছিল গণেশপুরে। মুখে তার কথা ছিল না। বোবা নয়, নির্বাক। মাসে একদিন সে এসে রান্নাঘরের অনতিদূরে লিচুগাছের নিচে চুপচাপ বসে থাকত। আমি অথবা মধু তাকে কলাপাতায় ডাল ও ভাত দিয়ে আসতাম। কখনো তাকে আমরা তাড়িয়ে দিইনি। ভাত-ডাল খেয়ে, জল পান করে, কলাপাতা জঙ্গলে ফেলে দিয়ে চলে যেত পাগল মানুষটা। বিড় বিড় করে কখনো কখনো কী সব বলত। আমরা তার এক বর্ণও বুঝতাম না। তাকে নিয়ে আমাদের কোনো কৌতূহল ছিল না। পাগল লোকটা গণেশপুরের অঙ্গ, সমাজচিত্রের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সংযুক্ত ছিল। শহরের মানুষ, ভিখিরিদের মানুষ মনে করে না। গণেশপুর গ্রামের ভিখারিরা মানুষ ছিল। হতভাগা, ক্ষুধার্ত, গৃহহীন, গরিবের চেয়েও গরিব। তথাপি মানুষ।
এত সব কথা ও স্মৃতি আমার মনকে ভরে রেখেছিল। বাবা যখন একটা ছোট্ট দালান বাড়ির সামনে আমাকে অপেক্ষা করতে বলে নিজে ঘরের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলেন, তখন দেখতে পেলাম একজন লোক ঐ ছোট বাড়িটার ডান দিকে পরিষ্কার দৃশ্যমান একটা বিরাট বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। বাবা ছোট বাড়িটার ভেতরে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে শুনতে পাচ্ছি বাবার কাশির শব্দ।
কিছুক্ষণ পরে যে লোকটি বাড়ির ভিতর চলে গিয়েছিল, সে ফিরে এল। তার ফেরার শব্দের জন্যেই বোধহয় বাবা অপেক্ষা করছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনিও বেরিয়ে এলেন। তাঁর হাত পা ধুলোমাখা, ধুতি হাঁটুর ওপরে, পা খালি। তাঁকে পরিশ্রান্ত মনে হলো।
লোকটা তাকে বলল, “বড়মা একে ভেতরে ডাকছেন।”
বাবা আমাকে বললেন, “রায়বাহাদুরের পত্নী, এ বাড়ির বড়মা, তোকে ডেকে পাঠিয়েছেন। এর সঙ্গে যায়। উনি যা বলেন সেই মতো কাজ করিস।”
আমি ভেতরে ভেতরে রেগে উঠছিলাম, এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকায়।
বাবাকে প্রশ্ন করলাম, “আপনি কী করছিলেন ঘরটার মধ্যে আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে?”
বাবা ব্যস্ত হয়ে বললেন, “ওসব পরে হবে, এখন তুই ওঁর সঙ্গে যা বড়বাড়িতে।”
বাড়িটা বড়ই বটে। প্রবেশ রাস্তাকে ইঁট ও লাল সুড়কিতে মনোহর করে রাখা হয়েছে। প্রবেশ রাস্তার দু’ধারে রং-বেরং টবে নানারকম ফুল ও গাছ। ধবধবে সাদা মার্বেলের আটটা সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হয় বারান্দায়। বারান্দাটা বিরাট লম্বা ও চওড়া, সবটাই শ্বেতপাথরের। ভেতরে ঢুকে প্রকাণ্ড বসার ঘর। এমন সব আসবাব যা আমি বইয়ে পড়েছি, চোখের সামনে দেখে কেমন হতভম্ব হয়ে গেছি। লোকটা আমাকে বলল, “আপনি বসুন এখানে। আমি বড়মাকে খবর দিচ্ছি।”
বিরাট বসবার ঘরের জমি লাল সিমেন্টের। দুপাশে দুটো সোফাসেট কার্পেটের ওপর। অনেকগুলো বাড়তি চেয়ার। দুটো সোফাসেটের মাঝখানে দুই মার্বেলের টেবিল। ঘরে কয়েকখানা পাথর ও পিতলের মূর্তি। দেওয়ালে বড়লাট লর্ড লিনলিথগো, বঙ্গের গভর্নর (নাম ভুলে গেছি) সম্রাট জর্জ দ্য সিকস্থ ও আরও কিছু ইংরেজের। ঘরখানাকে দেখা আমার তখনও অনেকটা অসমাপ্ত, অন্দরের দরজার পর্দা তুলে প্রবেশ করলেন এক মহিলা, আমি তাঁর পানে বিস্ময় নীরব চোখে তাকিয়ে রইলাম।
“তুমি অনেকক্ষণ বসে আছ, বাবা?” মহিলা এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। আমি স্বতঃপ্রবণ হয়ে তাঁকে প্রণাম করলাম।
“মাস্টার মশাইকে আমরা সবাই শ্রদ্ধা করি। তিনি আমার নাতি নাতনিদের পড়ান। তাঁর কাছে শুনেছি তুমি খুব ভালো করে পাস করেছ ম্যাট্রিকুলেশন। এখন কলকাতায় গিয়ে পড়বে। তোমার পথে কষ্ট হয়নি তো?”
আমার বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি।
বললাম, “কোনো কষ্ট হয়নি।”
বড়মা বললেন, “সকাল থেকে নিশ্চয়ই কিছু খাওনি। ভেতরে এসো, তোমার খাবার তৈরি।”
তাঁর পিছনে পিছনে আমি কয়েকটা ঘর পার হয়ে যে ঘরে পৌঁছালাম, সেটা নিশ্চয়ই খাবার ঘর।
প্রকাণ্ড ঘরটা। পর পর আলমারিতে অনেক চিনেমাটির বাসন। ডাইনিং সেট বলে কিছু যে আছে তা আমার জানাই ছিল না। আমি চিনেমাটির কাপ-ডিস, খাবার প্লেট দেখেছি। দেওয়াল জুড়ে একটা আলমারিতে সারি সারি ঝকঝকে স্টেইনলেস স্টিলের বাসন। চকচকে লাল মেঝের ওপর পিঁড়ি পাতা, তার সামনে থালা ভর্তি লুচি, ডাল, তরকারি, বেগুন ভাজা। থালার পাশে এক গ্লাস জল।
বড়মা বললেন, “নাও, খেতে বসো। ক্ষিধেয় তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে।”
আমার পরনে সেই পোশাক যা আমি গণেশপুর ছাড়বার সময় পরেছিলাম। সেই নীল পপলিনের শার্ট, পায়ে রবারের পাম্প শু। স্নান হয়নি, সারা শরীর নোংরা লাগছে। আমি দেখতে পেলাম, এ খাবার ঘরে দেওয়ালের সঙ্গে হাত মুখ ধোবার ব্যবস্থা আছে। সাবান আছে। তোয়ালে এবং মুখ দেখার মতো দেওয়ালে আয়না। আমি সাবান দিয়ে হাত ধুলাম, বেশ কিছু সময় নিয়ে মুখ ধুলাম, তোয়ালে দিয়ে মুখ হাত মুছলাম। আয়নায় নিজের মুখ দেখে হাসি পেল। আয়নার মুখটাও হাসল।
পিঁড়ির ওপর আমি সোজা টান হয়ে বসলাম। লুচি তরকারি মুখে পুরে বুঝতে পারলাম পেট ক্ষিধেয় কাতর। ধীরে আস্তে নিজেকে খাওয়ালাম।
পাশে একখানা আসনে বসে ‘বড়মা’ প্রশ্ন করতে লাগলেন—
“গ্রামের বাড়ির সবাই ভালো আছেন তো?”
আমি খাওয়া বন্ধ করে বললাম, “ভালো।”
“ক’ ভাই, ক’ বোন তোমরা?”
“তিন ভাই, এক বোন।”
“তুমি সকলের বড়ো?”
“হ্যাঁ, আমার পরে বোন মাধুরী, পর পর দু’ভাই।”
“তোমার মা নিশ্চয়ই খুব দক্ষ মহিলা। তোমাদের তো একাই থাকতে হয়?”
এ প্রশ্নের তো কোনো জবাব ছিল না। আমি শুধু ‘বড়মা’র মুখের পানে তাকিয়ে রয়েছি।
“তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না! শুধু আমাকে দেখছ! খেয়ে নাও। লুচি ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
আমি খাওয়াতে মন দিয়েছি, মাথা নিচু করে নয়। সটান সোজা হয়ে বসে।
বড়মা হঠাৎ বলে উঠলেন, “কী দেখছ আমার মধ্যে? অমন করে তাকিয়ে রয়েছ কেন?”
কে যেন চাবুক মারল আমাকে। আমি বুঝতে পারিনি তাঁর মুখ থেকে আমার দৃষ্টি সরতে চায়নি। আমার মনে হয়নি আমি কোনো দোষ করেছি। অনায়াসে প্রশ্নের উত্তরে বললাম, “আপনি কী সুন্দর! ঠিক দুর্গা প্রতিমার মতো মুখ আপনার। তাই দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে আমার।”
বড়মার গৌরবর্ণ মুখ লাল হয়ে গেল। নিজের অজ্ঞাতেই তাঁর আঁচল উঠে এসে ঢেকে দিল চিবুক, দাঁত, নাকও। হঠাৎ তিনি হেসে উঠলেন। আঁচল সরিয়ে নিলেন মুখখানা থেকে।
“সত্যি সুন্দর লাগছে আমাকে তোমার?”
“আমি এত সুন্দর মুখ, এমন সুন্দর মা কোথাও দেখিনি।”
মহিলার চোখে জল এসে গেছে।
“তুমি গ্রামের সহজ সরল ছেলে। তাই এত সহজে কথাগুলো বলতে পারলে।”
আমি বললাম, “প্রতিবছর আমাদের বাড়িতে দুর্গাপূজা হয়। দুর্গামায়ের মূর্তি তৈরির থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত কুমোরদের সঙ্গে লেগে থাকি। আপনাকে তো ভগবান নিজের হাতে তৈরি করেছেন।”
আর এক ঝলক হাসি উছলে পড়ল বড়মার মুখ থেকে।
প্রসঙ্গ বদলে তিনি জানতে চাইলেন কলকাতায় আমি কার সঙ্গে থাকব, কোন কলজে পড়ব।
“থাকব আমার কাকার কাছে। বাবার ছোট ভাই। আমার একই কাকা। কাকামণি বলি তাঁকে। তিনি গণিতের অধ্যাপনা করতেন পাটনায়, নেপালে, পাঞ্জাবে। এখন তাঁর চাকরি নেই। কোন্ কলেজে পড়ব জানি না। কলকাতায় গেলে ঠিক হবে। যে কলেজ আমাকে বৃত্তি দেবে, মাইনে নেবে না, সেখানেই পড়ব আমি।”
বড়মা’র মুখখানা ঈষৎ মলিন হলো।
“তাই কর।” বললেন উনি, “মাস্টারমশাইয়ের পক্ষে গ্রামের সংসারের খরচ মিটিয়ে কলেজে টাকা পাঠানো কঠিন হবে।”
একটু পরে, “তোমার বাবার মতো সজ্জন মানুষ বেশি নেই। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত খেটে যান তোমাদের জন্য। হাঁপানিতে কষ্ট পান, তবু টিউশনি ছাড়েন না। তুমি বড় হয়ে সবার অভাব দূর করবে। তুমি তো শুনেছি তিন দিন থাকবে এখানে। মাস্টারমশাইকে বলে দিয়েছি এ ক’দিন আমার নাতি নাতনিদের পড়াতে হবে না। সন্ধে থেকে রাত অবধি তোমার সঙ্গে কাটাতে পারবেন। আর দু’খানা লুটি দেবো তোমাকে?”
“না, না” বলে উঠলাম আমি। “ভীষণ পেট ভরে গেছে।” তখন দুটি সন্দেশ ও জল খেয়ে আমি খাওয়া শেষ করেছি।
বড়মা উঠলেন। আমিও। এগিয়ে গিয়ে আমি মুখ হাত ধুয়ে নিলাম। রবারের জুতো খাবার ঘরের বাইরের দিকে রেখেছিলাম। সে দিকে পা বাড়াতে গিয়ে শুনতে পেলাম :
“বাইরের মুনসিজীর ঘরে তোমার বাবা বাস করেন। তুমি রাত্রে এই বাড়ির ভেতরে শোবে। তোমার জন্য বিছানা তৈরি রাখবে বলে দিয়েছি আমি রঘুকে। রঘু এখন তোমাকে তোমার বাবার কাছে নিয়ে যাবে।”
আমি জুতো পরে নিয়েছি। বিদায় নেবার আগে বললাম, “ভীষণ পেট ভরে খেয়েছি। বাবার যদি খুব অসুবিধা না হয় আমি তাঁর কাছেই শোব। মেঝেতে শোবার অভ্যেস আছে আমার। যদি বড় বাড়িতে শুতে না আসি অপরাধ নেবেন না।”
‘বড়মা’র মুখখানা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে
“তুমি এমন সুন্দর করে কথা বলতে শিখেছ কার কাছে?”
আমি তাঁর মুখখানার ওপর স্থির দৃষ্টি রেখে বললাম, “আমার মা।” আর একটা বাক্য মুখে এসেও অনুচ্চারিত রয়ে গেল, “গণেশপুরে ফেলে আসা কান্নাভরা আমার মা।”